দিন যায় কথা থাকে

পর্ব ১১

হামিদ কায়সার

প্রকাশিত : নভেম্বর ১২, ২০১৮

তারা কেউ গান শুনিয়েছেন। কেউ লিখেছেন হিরন্ময় কবিতা। কেউ আবার গল্প-উপন্যাসের মালা গেঁথে সাজিয়েছেন বাংলা সাহিত্যের ঢালি। কেউ বা নিরলস জ্ঞানচর্চায় যোগ করেছেন বুদ্ধিবৃত্তির নতুন মাত্রা। তাদের সেই দিন আজ আর নেই, কেউ হারিয়ে গেছেন মহাকালে, কেউ বা এক পা বাড়িয়ে রেখেছেন সেই পথে। তবে তাদের কথা আছে; তাদের কর্মে আর সৃজনশীলতায় তো বটেই, আমার কাছেও— কাগজের ভাঁজে ভাঁজে, শব্দগুচ্ছের আড়ালে, বিভিন্ন সময়ে গৃহীত সাক্ষাৎকারে। হয়তো সেই কথাগুলো আবারো জেগে ওঠতে পারে আপনার মননস্পর্শ পেলে। চলুন পাঠ নেয়া যাক।

আজ বলা যায়, শরৎচন্দ্রের ‘রামের সুমতি’ পড়েই সাহিত্যের প্রতি, উপন্যাসের প্রতি এবং সংস্কৃতির প্রতি আমার ভেতরে আগ্রহ তৈরি হয়েছিল: সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

পড়ন্ত বেলা। নির্জন, নিস্তব্ধ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবন। তবু যেন বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে অযুত নিযুত শব্দ। দেয়ালের অণুতে অণুতে মহাজীবনের কল্লোল; প্রতিদিনই এখানে পঠিত হয় বই। কতো অজস্র বই— সাহিত্য, ইতিহাস, সমাজতন্ত্র, দর্শন, অর্থনীতি, বিজ্ঞান আরো কতো বিষয়ে। কলাভবনের ভাঙা মেলায় ইংরেজি বিভাগে নিজের কক্ষে বসেছিলেন খ্যাতনামা প্রাবন্ধিক ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। বললেন, ‘এই বেলাটা পড়াশোনার জন্য খুব সুবিধার, খুবই শান্ত।’ তারপরই জিজ্ঞেস করলেন, ‘বলুন কি জানতে চান?’  বললাম, ‘আপনার প্রথম বই পড়ার কাহিনী জানতে চাই, সেই সময়ের বই পড়ার প্রেক্ষাপট কেমন ছিল?’
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: সেটা বেশ নাটকীয় ঘটনা। ক্লাস সেভেনে পড়ার সময় ফুটবল খেলতে গিয়ে আমার একবার পা ভেঙে গিয়েছিল। পায়ে এমনভাবে চোট লেগেছিল যে, প্লাস্টার করে ছ-সপ্তাহ বিছানায় শুয়ে থাকতে হলো। পুরোপুরি ঠিক হতে আরো দু-সপ্তাহ লাগলো। তখন প্রায় দু-মাস আমি বিছানায় শয্যাশায়ী ছিলাম। তো, এই সময় কাটানোর জন্য আব্বা আমাকে বই এনে দিতেন। তখন আমরা থাকতাম রাজশাহীতে, আমি রাজশাহীর লোকনাথ হাইস্কুলে পড়তাম। রাজশাহীতে তখন ‘আজাদ’ পত্রিকা আসে, মোহাম্মদী পত্রিকা আসে— এইসব আমি বেশ পড়ছিলাম। সেই সময়ে ‘মুসলিম ইন্সটিটিউট’ ছিল রাজশাহীতে। আমার আব্বা আবার ওটার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তিনি ওখান থেকে নিয়মিত অনেক বই এনে দিতেন। তার আনা প্রথম বইটা ছিল শরৎচন্দ্রের ‘রামের সুমতি’। এই বইটা আমি এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেলেছিলাম। শরৎচন্দ্রের ছোটখাটো অনেক লেখা এর আগেও পড়েছি, কিন্তু সম্পূর্ণ একটি উপন্যাস পড়লাম এই প্রথম। এবং এ বইটি আমাকে ভীষণভাবে অভিভূত করলো। ওই সময়ে ছেলে-মেয়েদের কাছে শরৎচন্দ্র ছিল প্রধান পাঠ্য। ‘রামের সুমতি’ দিয়ে আমারও শুরু। তারপরে পড়লাম ‘বিন্দুর ছেলে’। এরপর শরৎচন্দ্র পাঠ অব্যাহত রইলো— আমি বিভিন্ন বয়সেই শরৎচন্দ্র পড়েছি। আজ বলা যায়, শরৎচন্দ্রের ‘রামের সুমতি’ পড়েই সাহিত্যের প্রতি, উপন্যাসের প্রতি এবং সংস্কৃতির প্রতি আমার ভেতরে আগ্রহ তৈরি হয়েছিল।

হামিদ কায়সার: শরৎচন্দ্রের বাইরে আর কোনো পাঠ অভিজ্ঞতা?
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: হ্যাঁ, আর আমরা তখন পড়তাম দস্যু মোহন। মুসলিম ইন্সটিটিউট থেকে ওই সময়ই আব্বা এনে দিয়েছিলেন দস্যু মোহন সিরিজের বইগুলো। তখন দস্যু মোহন ধারাবাহিকভাবে বের হচ্ছে। আমার মনে আছে, শয্যাশায়ী অবস্থায় অনেকগুলো দস্যু মোহনের বই পড়েছি। আমাদের কালের তরুণদের কাছে এ সিরিজটিও ভীষণ জনপ্রিয় ছিল। আর একটা জিনিস আমার খুব প্রিয় ছিল, দেব সাহিত্য কুটির থেকে প্রতি বছরই পুজো-বার্ষিকী বের হতো। সে সব বার্ষিকী খুবই চমৎকার হতো। শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিকেরা লিখতেন। সেখানে নাটক থাকতো, উপন্যাস থাকতো, ছোটদের জন্যও লেখা থাকতো— আর থাকতো মজার মজার সব ছবি, খুবই সুন্দর ছবি। আমরা ছোটবেলায় এই সব বাঁধানো পুজো-বার্ষিকী গোগ্রাসে গিলেছি— সারাবছরই এসব বার্ষিকী আদান প্রদান হতো আমাদের বন্ধুদের মধ্যে। দেব সাহিত্য কুটির-এর ডিটেকটিভ বইগুলোও আমাদের প্রিয় ছিল। তখন ‘প্রহেলিকা সিরিজ’ এবং ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা সিরিজ’ এই দুটি সিরিজের ডিটেকটিভ বইগুলো বের হচ্ছিল। লিখতেন যশস্বী লেখকেরা। প্রেমেন্দ্র মিত্র লিখেছেন, বুদ্ধদেব বসু, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত লিখেছেন। প্রেমেন্দ্র মিত্র বেশ কয়েকটি লিখেছেন। এইগুলো আমরা বেশ আগ্রহের সঙ্গে পড়তাম। আমাদের ছেলেবেলার সংস্কৃতিতে বিনোদনের একমাত্র উপায় ছিল বইপড়া। খেলাধুলা হয়তো একটু একটু করতাম, পা ভাঙার পর খেলাধুলাও বাদ দিয়েছিলাম— বইপড়া ছাড়া অন্য কোনো বিনোদন ছিল না। রাজশাহীতে তখন দুটো সিনেমা হল ছিল, বড়রাই যেতেন, আমাদেরকে কখনও কখনও নিয়ে যাওয়া হতো। রাজশাহীতে নাটকও হতো কম। তখন টেলিভিশন ছিল না, রেডিও তেমন জনপ্রিয় হয়ে উঠেনি। কাজেই প্রধান বিনোদন ছিল বইপড়া। এরপর, কলকাতায় যাওয়ার ফলে বইপড়ার সুযোগ আরো বেড়ে গেল।

হামিদ কায়সার: হঠাৎ কলকাতায়?
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: আব্বা করতেন সরকারি চাকরি। রাজশাহী থেকে বদলি হয়েছিলেন হেড অফিস কলকাতায়। সেই সূত্রেই ক্লাস এইটে পড়ার সময় আমাকে পরিবারের সঙ্গে কলকাতায় যেতে হলো।

হামিদ কায়সার: একেবারে খোদ লেখকদের তীর্থস্থানে।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: হ্যাঁ, কলকাতায় এসে ‘প্রহেলিকা’ এবং ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ সিরিজের বই পাওয়া আরো সহজ হলো। কলেজ স্ট্রিটে গিয়েও আমরা ওই সব বই কিনতাম। ‘আজাদ’-এর সঙ্গে ‘দৈনিক ইত্তেহাদ’ও বেরোতে লাগল সে সময়। ‘ইত্তেহাদ’ বের হওয়ায় আমাদের পরিম-লটা বাড়লো। এ সময়ে ‘আজাদ’-এর মুকুলের মাহফিলে লিখে হাত পাকাতে লাগলাম, এই ধাঁধার উত্তর, চিঠিপত্র লেখা, ইত্যাদি— প্রাণবন্ত কলকাতার সঙ্গে মিশে যেতে সময় লাগল না। ওখানকার হিন্দু ছেলেদের সঙ্গেও বইয়ের আদান প্রদান হতো। বাবা ভেবেছিলেন, হেড অফিস কলকাতাতেই চাকরির বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেবেন— আমি মেট্রিক পাশ করে প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হওয়ার স্বপ্ন দেখছিলাম— কিন্তু হঠাৎ পার্টিশন সবকিছু বদলে দিল। ’৪৭-এ কলকাতায় এক-বছর থাকতে না থাকতেই আমরা দেশবিভাগের কারণে চলে এলাম ঢাকাতে।

হামিদ কায়সার: সে-সময় ঢাকায় এসে বইপড়ার কি পরিবেশ পেলেন, প্রেক্ষাপটই বা কেমন ছিল?
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: সত্যি কথা বলতে কি, ঢাকায় এসে প্রথমে আমরা মুষড়ে পড়েছিলাম। এই জন্য, কলকাতার জীবনটা ছিল পুরো নাগরিক জীবন— ঢাকায় এসে দেখি বাসায় বিদ্যুৎ নেই, পানি সরবরাহ নেই— কলকাতায় ট্রামে চড়ে আমরা কোথায় কোথায় চলে যেতাম— আর এখানে হেঁটে হেঁটে যেতে হয়— দৈনিক পত্রিকাও ছিল না— আজাদ এখানে এসেছে কতদিন পরে, এখানে বাবার প্রিয় পত্রিকা স্টেটসম্যান পাওয়া যায় না, পরে আসলো অনেক দেরিতে— ফলে, আমরা একটু মুষড়ে পড়েছিলাম, কারণ হঠাৎ করে একটি উন্নত-ব্যবস্থা থেকে, সাংস্কৃতিক পরিম-ল থেকে, শিক্ষিত হিন্দু ছেলেদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু এই ক্ষতির অনেকটাই পুষে গেল আমার সেন্ট গ্রেগরি স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর। ব্রাদার লরেঞ্জো বলে একজন আমেরিকান শিক্ষক ছিলেন, তিনি আমাদের ইংরেজি পড়াতেন। লাইব্রেরি দেখাশোনার দায়িত্ব ছিল তার উপর। লরেঞ্জো প্রতি সপ্তাহে একেক দিন একেক ক্লাসের ছেলেদেরকে ক্লাস শেষে বই দিতেন। আমাকে তিনি যে বইটি প্রথম দিয়েছিলেন তা হলো বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের ‘আদর্শ হিন্দু হোটেল’। লরেঞ্জো বইটা আমার হাতে দিয়ে বললেন, ‘পড়ো, এটা তোমার খুব ভালো লাগবে।’ বিভূতিভূষণের লেখা এর আগেও পড়েছি। ‘পথের পাঁচালি’র অপুর সাথে আমার পরিচয় আছে। ‘আদর্শ হিন্দু হোটেল’ পড়ে বিভূতিভূষণের প্রতি আগ্রহ এবং আকর্ষণ আরো বেড়ে গেল। এখানে শিবরাম চক্রবর্তীরও বেশ কয়েকটি বই পেয়ে গেলাম। শিবরামও খুব ভালো লাগতো। এখনও শিবরাম আমার প্রিয় লেখক। শিবরাম চক্রবর্তীর কৌতুক, বলার ঢং সেই বয়সে বেশ উপভোগ করেছি। ঢাকায় আসার ক্ষতিটা আরেকবার পুষলো, আমাদের ক্লাসে শৈলেশচন্দ্র চক্রবর্তী নামে একজন শিক্ষক ছিলেন, তিনি বাংলা পড়াতেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি বাংলায় এম.এ করেছিলেন। সেই সুবাদে তিনি বুদ্ধদেব বসুকে কাছ থেকে দেখেছেন। তিনি শুধু বুদ্ধদেব বসুর গল্প করতেন, বুদ্ধদেব বসুর ব্যক্তিগত প্রবন্ধগুলো তিনি আমাদেরকে পড়ে শোনাতেন এবং পড়তে বলতেন। লাইব্রেরি থেকে বুদ্ধদেবের ব্যক্তিগত প্রবন্ধের বই নিয়ে পড়তে লাগলাম। ঢাকা, পুরানা পল্টন ইত্যাদি বিষয়ে বুদ্ধদেব-এর লেখা খুব ভালো লাগল। একদিকে শিবরাম চক্রবর্তী অন্যদিকে বুদ্ধদেব বসু আমাকে সাংঘাতিকভাবে মন্ত্রমুগ্ধ এবং প্রভাবিত করে রাখল। পরবর্তীকালে আমার লেখায়ও এরা প্রভাব ফেলেছে।

হামিদ কায়সার: এ-সময়ে আপনার পড়াশোনাটা তাহলে লাইব্রেরি কেন্দ্রিকই ছিল? বাইরে আর কোথাও বই পাওয়া যেত না?
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: সদরঘাটে বেশ কয়েকটি বইয়ের দোকান ছিল। ‘আশুতোষ লাইব্রেরি’ ছিল, আর ‘বৃন্দাবন থরস এন্ড কোম্পানি।’ আশুতোষ-এ ‘শিশু সাথী’ পাওয়া যেত— আসতো কলকাতা থেকে। ‘শিশু সাথী’ আমরা নিয়মিত পড়তাম এবং খেয়াল রাখতাম কবে বের হলো। বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে লুফে নিতাম। কলকাতা থেকে আরো পত্রিকা আসতো। ছোটখাটো একটি পত্রিকা ছিল ‘সচিত্র ভারতী’— এটা ছিল কৌতুকের সাপ্তাহিক পত্রিকা। এখানে শিবরাম চক্রবর্তী ‘পথে ঘাটে’ নামে নিয়মিত একটি চমকপ্রদ লেখা লিখতেন। এটা আমরা খুব মনোযোগ দিয়ে পড়তাম। পরে যখন ‘দেশ’ পত্রিকা শুরু হলো, সেটাও গভীর আগ্রহের সঙ্গে পড়েছি। ‘দেশ’-এ শিবরাম লিখতেন ‘ট্রামে বাসে’। আরেকটি পত্রিকা সেই কিশোর-বয়সে আমাদের মধ্যে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছিল ‘অচলপত্র’ নামে। এ পত্রিকা তখন খুব জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। এরপর, বইপড়ায় আমার জীবনে আসে এক স্মরণীয় অধ্যায়।

হামিদ কায়সার: কি রকম!
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: তারপরেই, আমি যখন মেট্রিক পরীক্ষা দেই, তখন আমরা আজিমপুর কলোনীতে চলে গেলাম। এর আগে আমরা থাকতাম বেগম বাজারে। মেট্রিক পরীক্ষা দেয়ার পর কলেজে ভর্তি হওয়ার আগ পর্যন্ত যে লম্বা ছুটিটা পেলাম, তার সমস্ত ক্ষণটাই কাটিয়ে দিয়েছি বই পড়ে, প্রচুর বই পড়েছি এ লম্বা ছুটিতে।

হামিদ কায়সার: এই বইয়ের খনিটা কোথায় মিললো, কিভাবে?
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: হ্যাঁ, সেটাই বলছি। আজিমপুর কলোনীর পাশে পলাশী ব্যারাক বলে একটি ব্যারাক ছিল, ওখানে আমার একজন মামা থাকতেন। তো পলাশী ব্যারাকে সরকারি কর্মচারীরা নিজেদের উদ্যোগে ‘পলাশী নজরুল লাইব্রেরি’ বলে একটি লাইব্রেরি করেছিল। আমার ওই ছোট মামা ওই লাইব্রেরির সদস্য ছিলেন। তার কার্ড দিয়ে বই আনতাম— ওখানকার দায়িত্বপ্রাপ্ত লাইব্রেরিয়ানও জানতেন কার কার্ডে বই নিচ্ছি— তারপরও তিনি আমাকে বিশেষ সহযোগিতা করতেন। যে-বইটি চাইতাম সেটাই দিতেন। একে একে আমি প্রচুর বই পড়লাম। নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের ছোটদের জন্য লেখা বইগুলো পড়লাম, ছোটদের জন্য লেখাই আমার পড়তে বেশি ভালো লাগে। এখনও সমানভাবে পড়ি। প্রেমেন্দ্র মিত্রের, লীলা মজুমদারের বইগুলো পড়ে ফেললাম। তারাশংকরের ‘ধাত্রীদেবতা’ পড়লাম, তার যতগুলো উপন্যাস পাওয়া গেল সব পড়লাম। বনফুলের ছোট ছোট গল্পগুলো আগেই পড়া ছিল, আমাদের পাঠ্যেও তার গল্প ছিল। বনফুলের লেখা যেসব বেরোতে লাগলো তাও পড়ছিলাম। এ-সময়ে ঢাকায় ‘শনিবারের চিঠি’ও আসতো। আর শরৎচন্দ্রের লেখাতো পড়ছিই। এই সময়েই পড়েছি রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পগুলো। এরপর কলেজে ভর্তি হলাম— সেন্ট গ্রেগরিজ কলেজে, স্কুলেরই কলেজ। তো, এখানে অজিত কুমার গুহ যিনি জগন্নাথ কলেজের শিক্ষক, তিনি এখানেও পড়াতেন। অজিত কুমার গুহ আমাকে সাহিত্য পাঠের নতুন স্বাদ দিলেন। এখানে বলে রাখছি, আমার বাবা কিন্তু আমাকে লেখালেখিতে উৎসাহিত করতেন না, কিন্তু পড়তে উৎসাহ যোগাতেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সময় এই সাহিত্য নিয়ে বাবার সঙ্গে আমার একটি দ্বন্দ্ব তৈরি হলো।

হামিদ কায়সার: দ্বন্দ্বের কারণ?
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: আমি বাংলা সাহিত্য পড়ব, উনি তাতে রাজি নন। বাবার কথা আমাকে সিএসপি অফিসার হতে হবে, তাই অর্থনীতি পড়ো। অংক কোনোদিনই ভালো লাগেনি। তাই আমি বাবার কথায় রাজি হলাম না, আমিও বাংলা ছাড়া পড়ব না। শেষে সন্ধি হলো, দুজনেই ছাড় দিলাম একটু করে, সাহিত্য যদি পড়তেই হয় ইংরেজি সাহিত্য পড়ো। বাবার হিসেব, ইংরেজিতে দক্ষতা থাকলে সিএসপি অফিসার হওয়াটা সহজ হবে। ’৫২-র ভাষা আন্দোলনের উত্তাল সময়ে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম ইংরেজি সাহিত্যে। পরে যখন সৌভাগ্যক্রমে এমএ-তে ফার্স্ট ক্লাস পেয়ে গেলাম— ভালো ছাত্র হিসেবে কলেজের চাকরি পেতে অসুবিধা হলো না। এম.এ-র রেজাল্টের আগেই চাকরি পেয়েছিলাম মুন্সীগঞ্জের হরগঙ্গা কলেজ-এ। এম.এ-র রেজাল্টের পর জগন্নাথ কলেজে। পরে সেখান থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে— আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা ছেড়ে সিভিল সার্ভিসে যোগ দেওয়ায় এ পদ খালি হয়েছিল। বাবা আর বাঁধা দিলেন না, সিভিল সার্ভিসে যাওয়ারও তাগিদ দিলেন না। এরপর বইয়ের সঙ্গেই জীবনটা বাঁধা হয়ে গেল। সেই থেকে পড়ছি আর লিখছি— এতেই আমার আনন্দ।

হামিদ কায়সার: বিশ্ববিদ্যালয়-জীবনের আপনার পাঠ অভিজ্ঞতা জানতে চাচ্ছি।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: তখন সকাল বেলা ক্লাস করে দুপুরে খাওয়ার পর বিকেলে লাইব্রেরিতে ঢুকতাম। রাত ন’টা পর্যন্ত খোলা থাকত লাইব্রেরি। লাইব্রেরি বন্ধ হলে তারপর বাসায় ফিরতাম। এই ছয়-ঘণ্টা এখানেই ঘোরাফেরা করতাম। আর যত রেফারেন্স বই আছে আমাদের পাঠ্যবইয়ের— সব ঘেঁটে নোট করতাম, মাঝে মাঝে মধুর কেন্টিনে গিয়ে চা খেয়ে আসতাম। তখন সাহিত্য পাঠটা আনুষ্ঠানিকভাবে ছিল। ওই যে অজিতবাবুর একটা প্রভাব। এইখানে এসেও শিক্ষকদের প্রভাব পড়লো, বিশেষ করে জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতার। আমি সাহিত্য-সমালোচনার প্রচুর সুযোগ পেলাম এ-সময়ে। আর এ-সময়ে প্রচুর সমালোচনা সাহিত্য পড়েছি, কোলরিজের উপর ইবসেনের উপর শেক্সপীয়রের নাটকের উপর যত যত সমালোচনা ছিল পড়ে ফেলেছি।

হামিদ কায়সার: মূল লেখাগুলো?
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: সেটাতো পড়ছিই। সেটাতো আনুষ্ঠানিক পড়া। কিন্তু সমালোচনা সাহিত্য পড়ছি মনের আনন্দে। এখানে বেশ মজা পাচ্ছিলাম। যেমন সুইনবার্নের কবিতার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের কি মিল আছে— সুইনবার্নের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে রবীন্দ্রনাথ ‘উর্বশী’ লিখেছিলেন— এসব নিয়ে আলোচনা পড়ছি, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, টিএস এলিয়ট সম্পর্কে পড়তে পারছি। সেটা এক রোমাঞ্চকর সময় ছিল।

হামিদ কায়সার: আনুষ্ঠানিক পড়ার সঙ্গে মনের আনন্দেরও বুঝি সংযোগ ঘটেছিল?
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: আমি আনুষ্ঠানিকভাবেই তখন সাহিত্য পড়ছি। এর একটা ভালো দিকও আছে মন্দ দিকও আছে। ভালো দিকটা হল, এর বাইরে আমি আর যেতে পারি নাই। সব-সময়ে এই পড়ার মধ্যেই— সাহিত্যের মধ্যেই— পেশাগত এবং অপেশাগত সবটাই এর সঙ্গে জড়িত। তো, এই জড়িত থাকাটার ভালোমন্দ দুই দিকই আছে, এক দিক হলো জীবনটা একপেশে হয়ে গেছে। এর বাইরেও যে একটি জগৎ আছে, তা আমি দেখতে পারি নাই। তবে লাইব্রেরির সেই জগৎটায় আমি একেবারে ডুবে গিয়েছিলাম, পরে যখন শিক্ষকতায় ঢুকলাম, তখন আরেক সুযোগ এলো, লাইব্রেরির যত পুরনো পত্রিকা ছিল সব পড়ে ফেলি। হরগঙ্গা কলেজে কয়েকমাস থাকাকালে সেখানকার লাইব্রেরিতে যেসব পুরনো পত্রিকা ছিল ‘শনিবারের চিঠি’, ‘বিচিত্রা’ তারপরে ‘বসুমতী’ সব পড়েছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে ‘পরিচয়’-এর পুরো সেটস যত পুরনো পত্রিকা পেয়েছি, সব পড়েছি।

হামিদ কায়সার: কিভাবে?
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: সাহিত্য পাঠের যে আনন্দ, পড়ার যে আনন্দ অজিত বাবু সেটা আমার কাছে উন্মোচন করে দিলেন। যেমন, ‘মেঘনাদবধ  কাব্যে’র একটি অংশ আমাদের পাঠ্য ছিল— তিনি সেটা এত সুন্দর করে পড়ালেন যে, অমিত্রাক্ষর ছন্দ কিভাবে পড়তে হয়, তাতে আনন্দ কেমন আছে, কেমন রস পাওয়া যায়, সেটা ওর কাছ থেকেই পেলাম। উনি যখন ‘সোনার তরী’ কবিতাটি পড়ালেন— তার এত সুন্দর ব্যাখ্যা দিলেন— রবীন্দ্রনাথ আমাদের কাছে অতি স্পষ্ট হয়ে উঠলো— সাহিত্য পাঠের যে একটি পদ্ধতি আছে, আনন্দ আছে এটা আমি অজিত বাবুর কাছ থেকেই শিখেছি। তারই আগ্রহে কলেজের লাইব্রেরিতে ‘রবীন্দ্র রচনাবলী’ এলো। রবীন্দ্রনাথকে ভালোভাবে পড়ার সুযোগ পেলাম। এ-সময়ের আরেকটি প্রসঙ্গ এখানে উল্লেখ করতে হয়। তখন বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়ও আসা-যাওয়া ছিল। সে সুবাদেই নাজমুল করিমের বাসা থেকে নিয়ে সলিমুল্লাহ হলের বার্ষিকী পড়েছি, বিশ্ববিদ্যালয়ের বার্ষিকী পড়েছি। এই বার্ষিকীতেই সরদার ফজলুল করিমের একটা লেখা ছিল। আমার আজো স্পষ্ট মনে আছে, সরদার ফজলুল করিমের লেখাটি ছিল সাহিত্যের সমস্যা নিয়ে। সাহিত্যের সমস্যা সম্পর্কে একটা নতুন কথা ছিল সেখানে। একটা মাকর্সবাদী ব্যাখ্যা ছিল সেখানে। এই ধরনের ব্যাখ্যা আমরা আগে কখনো পাইনি। আর নাজমুল করিমের একটা প্রবন্ধ ছিল ‘ভুগোল ভগবান’ নামে। সেটা ছিল খুব চাঞ্চল্যকর লেখা।

হামিদ কায়সার: পড়াশোনার পাশাপাশি তো আপনার সাহিত্য মানসটিও বিকশিত হচ্ছিল?
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: হ্যাঁ, আমার উপর শিবরাম, প্রেমেন্দ্র মিত্র এদের প্রভাব পড়েছিল। এবং লেখালেখির উৎসাহও বোধ করতাম। টুকটাক লিখতামও। আজিমপুরে যখন বাসা-বদল করে এলাম, তখন ‘আজাদ’ অফিসটাকে কাছে পেয়ে যাই। আর এই আজিমপুর থেকে ‘সৈনিক’ নামে একটি বামপন্থী পত্রিকা বেরুচ্ছে। এর কিছুদিন পরে, ফয়েজ আহমেদ ‘হুল্লোড়’ নামে একটি মাসিক পত্রিকা বের করলেন। আর ‘সংবাদ’ বেরুল, ওখানে ছোটদের পাতা থাকলো ‘খেলাঘর’। আজাদের ‘মুকুলের মাহফিল’, সংবাদ-এর ‘খেলাঘর’, ফয়েজ আহমেদের ‘হুল্লোড়’ এবং ‘সৈনিক’-এ লেখা আরম্ভ করলাম।

হামিদ কায়সার: কি লেখা ছিল সেগুলো? ছড়া, কবিতা?
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: না না, ছড়া কবিতা কখনোই আমি লিখিনি। সেগুলো ছিল প্রবন্ধ, ছোট ছোট গল্প, বাচ্চাদের উপযোগী। এরপর ফয়েজ আহমেদ যে বাসায় থাকতেন সেখানে আমার বন্ধু নাজমুল করিমও থাকতেন। সে বাসায় প্রায়ই যাওয়া হতো। নাজমুল করিমের সাথে থাকতেন আরেকজন আমিনুল হক চৌধুরী। উনার কাছে নানা-ধরনের বই থাকত। তো, মেট্রিকের পর সেটা, ওখানেই পেয়ে গেলাম ‘ওয়ার্ল্ড’স বেস্ট শর্ট স্টোরিজ’ বলে একটি বই। এখানে মোপাসার দু-টি গল্প ছিল। দুটো গল্পই এত ভালো লাগল যে, নিজে বারবার পড়ে সে দুটো অনুবাদও করে ফেললাম। আজাদ থেকে বেরোয় ‘মোহাম্মদী’ এবং মোহাম্মদী যেহেতু বাড়ির কাছে, একদিন সাহস করে ১টি গল্প নিয়ে গেলাম সেখানে, কিন্তু ভেতরে যাওয়ার সাহস হলো না। দারোয়ানের হাতে দিয়ে চলে আসলাম। মোহাম্মদী’তে যে সব লেখা ছাপা হতো পূর্বেই তার বিজ্ঞাপন ছাপা হতো আজাদ পত্রিকায়। আজাদ তখন মুসলিম লীগকেন্দ্রিক হয়ে যাচ্ছিল বলে আমাদের বাসায় রাখা হতো না। তাই আজাদ-এ সেই ‘মোহাম্মদী’র লেখকদের তালিকা দেখার জন্য সকালবেলা ঘুম থেকে উঠেই ছুটে গেলাম আজাদ অফিসের সামনে। অবশেষে খুব আশ্চর্য হয়ে দেখলাম মোপাসার সেই গল্পটির নাম রয়েছে, অনুবাদক হিসেবে আমার নামটিও আছে। ভারি আনন্দ লাগছিল, তখনকার সে আনন্দ আজ আর বোঝানো যাবে না। কিছুদিন পর দ্বিতীয় অনুবাদটিও পাঠালাম। সেটাও ছাপা হলো। বাচ্চাদের আসরের বাইরে, আমার প্রথম লেখক হিসেবে আত্মপ্রকাশ। এরপর, সংবাদ-এর খেলাঘরে গল্প পাঠালাম ডাকযোগে। তখন খেলাঘরের পাতা দেখতেন হাবিবুর রহমান (ভাইয়া)। সেখানেও লেখা ছাপা হতে থাকলো। সে সময় কিন্তু দেয়াল পত্রিকার খুব প্রচলন ছিল। হাতে লেখা পত্রিকায় অনেক লিখেছি। ঐ হাতে লেখা পত্রিকার কাজেই হাবিবুর রহমানের কাছে একদিন গিয়েছিলাম। তিনি আমার নাম শুনেই বললেন, ‘ও, তোমার লেখা তো আমার পাতায় ছাপা হয়েছে। তোমার সম্মানী নিয়ে যেয়ো।’ সেটা ১৯৫০-৫১ সালের ঘটনা। অ্যাকাউন্ট সেকশন থেকে লেখার জন্য দশ টাকা পেলাম— তখন আমার কাছে খুব চাঞ্চল্যকর মনে হয়েছিল। লিখেও যে টাকা পাওয়া যায় জানতাম না। আমার একটি অসুবিধার দিক ছিল, আমি ঢাকা কলেজে পড়ি নাই। তখন যারা লেখালেখি করছেন সবাই ছিল ঢাকা কলেজের ছাত্র— ফলে আমি একটু বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলাম। তবে হাতে লেখা পত্রিকাই ছিল আমার সব ইচ্ছে পূরণের হাতিয়ার। ‘ঝামেলা’ নামে একটি দেয়াল পত্রিকা নিয়মিত বের করতাম। বছরে একবার বের করতাম ‘রাঙা প্রভাত’। এ হাতে লেখা পত্রিকায় ২য় সংখ্যার সম্পাদনার দায়িত্ব ছিল আমার। এ সংখ্যায় হাসান হাফিজুর রহমানের সহযোগিতায় মুনীর চৌধুরীর অপ্রকাশিত লেখা ‘ন্যাংটার দেশে’ প্রথম প্রকাশ করতে পেরেছিলাম। পরে এ গল্প তার বইতে এবং রচনাবলীতে স্থান পেয়েছিল।

হামিদ কায়সার: সমালোচনা সাহিত্য পাঠের প্রতিই আপনার ঝোঁকটা বেশি লক্ষণীয়।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: এটা ঠিক, সমালোচনা সাহিত্যে আমি বেশ আনন্দের রসদ খুঁজে পাই, কারণ এটাতে যুগপৎ একটি দার্শনিক চিন্তার অবকাশ থাকে। সমালোচনা সাহিত্যের ধারাটি সত্যিই বিচিত্র। ইংল্যান্ডে আমার এ-ব্যাপারে একটি দারুণ অভিজ্ঞতা সঞ্চয় হয়েছে। আমার অনেক শিক্ষকদের মধ্যে দুজন ছিলেন উইলসন নাইট এবং আর্নল্ড কেটন। নাইট পড়াতেন শেক্সপীয়র এবং কেটন পড়াতেন নভেল। নাইট ছিলেন রক্ষণশীল আর কেটন ছিলেন মার্কসবাদী। একই বিষয়ে তাদের পরস্পরবিরোধী যুক্তির ধারাযুক্ত সমালোচনাগুলো খুব উপভোগ করতাম। আরেকজন শিক্ষক ছিলেন চালর্স উইলিয়াম। কবিতার সমালোচনায় তিনি নতুনধারা সংযোগ করেছিলেন— প্র্যাকটিক্যাল ক্রিটিসিজম। তার কীটসের ‘নাইটিংগেল’ কবিতার পাঠ আমাকে মুগ্ধ করেছিল।

হামিদ কায়সার: ভিনভাষী কবি-সাহিত্যিকদের মধ্যে কাদের লেখা আপনার মনে দাগ কেটেছে?
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: শেক্সপীয়র পড়েছি পেশাদারি কারণেই— শেক্সপীয়র অনেক বড় লেখক— তার নাটকগুলো আমার বহুবার পড়া। আমি প্রতিবারই পাঠকালে তার লেখাগুলো উপভোগ করি। শেক্সপীয়রের বাইরে টলস্টয় আমার প্রিয় লেখক। বিশেষ করে ‘আনা কারেনিনা’, পড়ানোর জন্যই আমাকে একবার করে প্রতিবছর পড়তে হয়। টলস্টয় জীবনকে ট্র্যাজেডি হিসেবে কখনো দেখেননি অথচ শেক্সপীয়র ট্র্যাজিককেন্দ্রিক। টলস্টয় দেখিয়েছেন জীবন চলছে— তার লেখা এপিকধর্মী। মহাকাব্যিকতা ধরা পড়েছে। এবং এই মহাকাব্যিকতাই আমাকে বেশি আকর্ষণ করে। রবীন্দ্রনাথের ‘গোরা’ সেজন্য ভালো লাগে। হোমারের ‘ইলিয়ড’, ‘ওডেসি’-ও আমার প্রিয়। সম্প্রতি পড়লাম রামায়ণ এবং মহাভারত। সাহিত্যের মহাকাব্যিক গুণটা আবারো অনুধাবন করলাম। ছোটগল্পও আমাকে আকর্ষণ করে।

হামিদ কায়সার: আমাদের দেশের কবি-সাহিত্যিকদের মধ্যে কাদের লেখা পড়েন এবং ভালো লাগে?
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ পড়েছি। তার ‘লাল সালু’-ই শ্রেষ্ঠ উপন্যাস। অন্য দুটোতে শক্তির পরিচয় থাকলেও একমাত্র ‘লাল সালু’তে রয়েছে মহাকাব্যিক উপাদান। শওকত ওসমানের ‘বনী আদম’ দৈনিক আজাদ-এর ’৪৭-এর ঈদসংখ্যায় পড়েছিলাম। ভালো লেগেছে। তার কয়েকটি ছোটগল্পও খুব ভালো। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের লেখাও আমার খুব ভালো লাগে। তার ছোটগল্প, উপন্যাস দুটো— সবই আমাদের সাহিত্যকে সম্পদশালী করেছে। তিনি খুব খেটে লিখতেন— ‘খোয়াবনামা’য় যে পরিচয়টা গভীরভাবে পাওয়া যায়। শামসুদ্দিন আবুল কালামের জন্য দুঃখ হয়। আবুল কালাম শামসুদ্দিন নামে ‘পূর্বাশা’, ‘পরিচয়’-এ তিনি বেশ কয়েকটি ভালো গল্প লিখেছিলেন। পরে সাংবাদিক আবুল কালাম শামসুদ্দিনের সঙ্গে নাম এক হওয়ার বিভ্রাটের জন্যে নামটা ঘুরিয়ে নিয়েছিলেন। ‘আগামী’ নামে একটি পত্রিকায় ‘কোন দাম নেই’ নামে আমার একটি গল্প ছাপা হয়েছিল। শামসুদ্দিন আবুল কালাম তখন আজিমপুরে থাকতেন। তাকে গল্পটা পড়িয়েছিলাম, কিভাবে গল্প লিখতে হয়, সে-বিষয়ে আমাকে পরামর্শ দিয়েছিলেন। তিনি দেশ ছেড়ে চলে গেলেন— এটা আমাদের সাহিত্যের জন্য এক বিরাট ক্ষতি। কারণ আমার স্ত্রী নাজমা জেসমিন চৌধুরীর কাছে তিনি পত্র লিখতেন নিয়মিত, মুক্তধারার জন্য গল্প উপন্যাসের পাণ্ডুলিপিও পাঠাতেন। সে-সব লেখা পড়ে মনে হয়েছে, রোম থেকে তিনি যে জীবনের কথা লিখেছেন, তা অনেক পাল্টে গেছে, যা তিনি অত দূর থেকে ঠিক মতো ধরতে পারেন নি। বাংলা একাডেমী তার সাহিত্যকর্মগুলো সংগ্রহ করে রচনাবলী প্রকাশ করতে পারে। হাসান আজিজুল হকের গল্প বরাবরই আমার ভালো লাগে। শওকত আলী, মঞ্জু সরকার-এর লেখাও বেশ উপভোগ করি। আলাউদ্দিন আল আজাদ প্রথম দিকে ‘জেগে আছি’ বইটি দিয়ে বেশ চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছিলেন, পরবর্তীকালে তিনি নিজেকে আর বিকশিত করতে পারেননি। হাসান হাফিজুর রহমানের কথা মাঝে মাঝেই খুব মনে পড়ে। হাসান ভাইয়ের অনেক গুণ। ভালো সম্পাদক তো ছিলেনই, ভালো লেখা সহজেই শনাক্ত করতে পারতেন। পত্রিকার গেটআপ, মেকআপ সম্পর্কেও তার ধারণা ছিল উচ্চ এবং উন্নত রুচির।

হামিদ কায়সার: তরুণদের লেখা পড়েন তো?
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: হ্যাঁ, পড়ি, নিয়মিতই পড়ি। তবে এ বিষয়ে বিশদ আলোচনা করতে চাই না।

হামিদ কায়সার: সম্প্রতি কি বই পড়লেন?
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ’ নিয়ে একটি লেখা লিখতে চাচ্ছি। সাহিত্যের, সংস্কৃতির পেছনের যে একটি পটভূমি সে বিষয়েও তো অনুসন্ধান প্রয়োজন।  তো, এ বিষয় ঘেষা দুটো বই পড়লাম। একটি সুবোধচন্দ্র সেনগুপ্তের ‘তে হি নো দিসাঃ যে দিন গেছে। সুবোধ সেনগুপ্ত সাহিত্যের অধ্যাপক ছিলেন। অনেকগুলো পুরনো জীবনের ছবি পেলাম তার লেখায়। আশুতোষকে যেভাবে জানতাম এ বইয়ে অন্যরূপে পেয়েছি। তিনি ছিলেন পূর্ববঙ্গের লোকÑ চট্টগ্রাম, রাজশাহীতেও অধ্যাপনা করেছেন— তখনকার জীবন, সাম্প্রদায়িকতাকে একজন শিক্ষক হিসেবে যেভাবে দেখেছেন সেভাবেই তুলে ধরেছেন। হিন্দু-মুসলিমদের সম্পর্কের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতা প্রবেশ করলো, এটা যে মধ্যবিত্তের ব্যাপার— এসব ধরা পড়েছে তার লেখায়। দ্বিতীয় বইটি, দেশবিভাগ যে আমাদের উপমহাদেশের সর্বনাশ করেছে, এই ভাঙ্গনের জন্য কে দায়ী? এই ভাঙ্গন কিভাবে রোধ করা যেত— লেখক এসব প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘কেবিনেট মিশন প্ল্যান গৃহীত হলে দেশ বিভাগ হতো না। দেশ বিভাগের জন্য জিন্নাহর সঙ্গে তিনি নেহেরুকেও দায়ী করেছেন। গান্ধীজী দেশ বিভাগের বিরুদ্ধে থাকলেও পরিস্থিতির কারণে মেনে নিয়েছিলেন। এসব তথ্য ও তত্ত্ব সন্নিবেশের কারণে বইটি খুব মূল্যবান।

হামিদ কায়সার: রবীন্দ্রনাথের পর বাংলা ভাষায় আর কোন লেখক নোবেল পুরস্কার পাওয়ার যোগ্য ছিল বা রয়েছে বলে আপনার ধারণা?
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায় তার ‘পথের পাঁচালী’ উপন্যাসের জন্য নোবেল পুরস্কার পেতে পারতেন। তবে, অসুবিধার দিকটি ছিল, এর অনুবাদ করা। এ বই অনুবাদ করার মতো কেউ ছিল না। দারিদ্রের মধ্যেও যে মানবিকতার কঠিন পরীক্ষা, মহাকাব্যিকতা এবং দারিদ্রের সঙ্গে সংগ্রামরত একটা শ্রেণিকে নিখুঁতভাবে তুলে ধরা হয়েছে এ উপন্যাসে। অনুবাদের জন্যে বিশ্বসাহিত্যে এটি ঠাঁই পায়নি— আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকার সাহিত্য ঠাঁই পেয়েছে সু-অনুদিত হওয়ার কারণেই। আমাদের রবীন্দ্রনাথের এই সুযোগটা ছিল। সবশেষে আমি একটি কথা বলতে চাই, পাঠের অভিজ্ঞতা থেকেই বলছি। বাংলা-সাহিত্যের একটি দুর্বল দিক হলো, আমাদের সাহিত্যের দার্শনিক গভীরতা নেই, রবীন্দ্রনাথ, বিভূতিভূষণ, শরৎচন্দ্রের মধ্যে যা ছিল। আমাদের বাংলাদেশের কবিতায়-সাহিত্যে দার্শনিক গভীরতার অভাব খুবই প্রকট।

৯ অক্টোবর ১৯৯৭, সংবাদ সাময়িকী, দৈনিক সংবাদ