দিন যায় কথা থাকে

পর্ব ১৪

হামিদ কায়সার

প্রকাশিত : ডিসেম্বর ০৩, ২০১৮

তারা কেউ গান শুনিয়েছেন। কেউ লিখেছেন হিরন্ময় কবিতা। কেউ আবার গল্প-উপন্যাসের মালা গেঁথে সাজিয়েছেন বাংলা সাহিত্যের ঢালি। কেউ বা নিরলস জ্ঞানচর্চায় যোগ করেছেন বুদ্ধিবৃত্তির নতুন মাত্রা। তাদের সেই দিন আজ আর নেই, কেউ হারিয়ে গেছেন মহাকালে, কেউ বা এক পা বাড়িয়ে রেখেছেন সেই পথে। তবে তাদের কথা আছে; তাদের কর্মে আর সৃজনশীলতায় তো বটেই, আমার কাছেও— কাগজের ভাঁজে ভাঁজে, শব্দগুচ্ছের আড়ালে, বিভিন্ন সময়ে গৃহীত সাক্ষাৎকারে। হয়তো সেই কথাগুলো আবারো জেগে ওঠতে পারে আপনার মননস্পর্শ পেলে। চলুন পাঠ নেয়া যাক

 

পড়লাম পল জনসনের ‘ইনটেলেকচুয়ালস’। অষ্টাদশ শতাব্দীর ১০-১২ জন ইনটেলেকচুয়ালের জীবন ও চিন্তাভাবনার পরিচিতি। লেখক চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলেছেন, এই যেসব ইনটেলেকচুয়াল উপদেশ দেয় তাদের জীবনটা খুঁটিয়ে দেখা দরকার। তারা নিজেরা সেসব উপদেশ পালন করে চলেন কীনা— আনিসুজ্জামান

চারদিকের দেয়ালজুড়ে শোভা পাচ্ছে পেইন্টিং, অসংখ্য পেইন্টিং, নানা মাধ্যমের। কামরুল হাসান থেকে শুরু করে দেশের যশস্বী শিল্পীদের শিল্পকর্ম তো রয়েছেই, বিদেশি কয়েকটি রিপ্রডাকশনও একইসঙ্গে শোভা পাচ্ছে। এসব শিল্পকলায় ছড়িয়ে রয়েছে জীবনের কত আকর—কত রূপ, রং, রস। তাই দেয়ালগুলোকে মনে হচ্ছিল, বইয়ের এক একটি জীবন্ত পৃষ্ঠা। ড্রইংরুমের সোফায় প্রাণবন্ত ভঙ্গিতে বসেছিলেন ড. আনিসুজ্জামান। বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির সঙ্গে যার নাম এবং সত্তা জড়িয়ে আছে ওতপ্রোতভাবে। সাহিত্যের সেই মহীরুহ মানুষটির কাছে জানতে চাইলাম, আপনার প্রথম পঠিত বই কোনটি? এবং তা কোন বয়সে পড়েছিলেন?

আনিসুজ্জামান: ঠিক মনে পড়ে না। তবে এটুকু মনে পড়ে, বাড়িতে বর্ণ পরিচয় শেখার জন্যে পড়েছিলাম যোগেন্দ্রনাথ সরকারের ‘হাসিখুশী’। এটা এতই ভাল বই— এই বইয়ের মূল্য পরে আরো বুঝেছি, তবে তখনও খুব মুগ্ধ হতাম। এটা আনন্দের জন্যে পড়া আরম্ভ করিনি, শেখার জন্যে পড়া আরম্ভ করেছিলাম; কিন্তু পড়ে খুব আনন্দ পেয়েছিলাম। পরে, বইটা এতবার পড়েছি যে, পুরো বইই মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল। আমার বাল্যকাল কেটেছে কলকাতায়, পার্ক সার্কাসে। আমি স্কুলে ভর্তি হয়েছিলাম ছ-বছর বয়সে ক্লাস থ্রিতে। তখন বোধহয় পাঠ্যবইয়ের বাইরে খুব একটা বই পড়িনি। কিন্তু ফাইভ-সিক্সে উঠতে উঠতে পত্রিকা এবং বই পড়া শুরু করি। মনে আছে ‘শিশুসাথী’ পড়তাম। আর, কিছু কিছু পত্রিকা বাড়িতেই পাই— ‘জমজম’ বলে একটি ছিল, ‘ফুলবাগিচা’ বলে একটি ছিল— আবদুল ওয়াহাব সিদ্দিকী সম্পাদক ছিলেন, তিনি উপহার দিয়ে যেতেন এ দু-টি পত্রিকা। পরে ‘সওগাত’ ও ‘মোহাম্মদী’ পড়েছি অনিয়মিতভাবে। আমাদের পাড়ায় একটি লাইব্রেরি ছিল। আমার ঠিক ওপরের যে বোন, সে ঐ লাইব্রেরি সদস্য ছিল। সে নিজে গিয়ে বই আনতে সংকোচ করতো বলে আমাকে পাঠাত। আমি ওর জন্য বই আনতাম, আবার সেসব বইও আমি পড়তাম। এভাবে পড়েছি নীহাররঞ্জন গুপ্তের ‘কালো ভ্রমর’— কিরিটী রায়ের রহস্য উদঘাটন। খুব মনোযোগ দিয়ে পড়েছি, একাধিকবার পড়েছি।
 
হামিদ কায়সার: তখনকার পড়ার অনুভূতি?
আনিসুজ্জামান: চমকপ্রদ মনে হয়েছিল। তারপরে, দেব সাহিত্য কুটির থেকে বের হতো ‘প্রহেলিকা সিরিজ’, ডিটেকটিভ বই। প্রেমেন্দ্র মিত্র, বুদ্ধদেব বসু, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত এঁরা লিখতেন— আবুল কালাম শামসুদ্দিন, যিনি পরে শামসুদ্দীন আবুল কালাম হলেন, ওঁরও একটি বই ছিল ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ সিরিজ। ধরে নেওয়া হতো যে প্রহেলিকা সিরিজ একটু কমবয়সীরা পড়বে— ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ পড়বে আরেকটু বেশি বয়সীরা। এসব পড়েছি খুব। আর আমার ঐ বোনের শখ ছিল ‘মোহন সিরিজ’ পড়ার। মোহন সিরিজ তো আর শেষ হলো না, ক্রমাগত বাড়ল। আমার বোন তার পড়া বইয়ের তালিকা তৈরি করে ফেলেছিল, আর আমি তা মিলিয়ে মিলিয়ে লাইব্রেরি থেকে বাড়িতে বই নিয়ে আসতাম। আমিই মনে হয় গোটা পঞ্চাশেক ‘মোহন’ পড়েছিলাম। দেব সাহিত্য কুটির আরো একটা অ্যাডাল্ট সিরিজ করেছিলো— এগুলি আবার সব বিলেতের পটভূমিকায়। কি সিরিজ সেটা এখন আর মনে পড়ছে না। সেসবও ডিটেকটিভ বই, আরেকটু বড়দের জন্যে। আর দেব সাহিত্য কুটির থেকে শারদীয় সংখ্যা বেরোত। খুব ভালো, খুবই ভালো। তার মধ্যে একটি ছিল ‘রাঙা প্রভাত’— আমার মনে হয় এই ‘রাঙা প্রভাতে’ই প্রথম স্বদেশী বিপ্লবীদের কথা— বাঘা যতীনদের কথা লেখা হয়েছিল— এঁদের সম্পর্কে লেখা মনে স্থায়ী দাগ কেটে গিয়েছিল। দেশের জন্যে মানুষ এইভাবে প্রাণ দিচ্ছে, এটাও খুব উল্লেখযোগ্য মনে হয়েছিল। তারপরে, যাকে বলে সৎসাহিত্য, ক্লাশের বাইরে কিছু পড়েছি। আমাদের বাড়িতে বেশ কিছু বই আসতো নানা কারণে। একটা হচ্ছে, প্রকাশকদের সঙ্গে আমার আব্বার জানাশোনার সূত্রে; আমার বড় বোন কবিতা লিখতেন, কাজেই, কিছু কবিতা-উপন্যাস পড়ার শখ তারও ছিল। রবীন্দ্রনাথের কবিতার বই আমার বোনের কেনা বই থেকেই প্রথম পড়েছি।

হামিদ কায়সার: রবীন্দ্রনাথের কোন বইটি?
আনিসুজ্জামান: আমার যতদূর মনে পড়ে, পাঠ্যবইয়ের বাইরে রবীন্দ্রনাথের কবিতার বই ‘বলাকা’ প্রথম পড়ি আর পড়ি ‘কথা ও কাহিনী’। কিন্তু ‘বলাকা’ অনেক অ্যাডভান্সড ছিল আমার বোঝার জন্যে। কাজেই ঐভাবে উপভোগ করিনি। পরে নজরুলের কবিতা পড়েছি। আর যাঁদের কবিতা প্রধানত পরিচয়সূত্রে পড়া হয়, তাদের মধ্যে ছিলেন গোলাম মোস্তফা, জসীমউদ্দীন, বেনজীর আহমদ, আহসান হাবীব, ফররুখ আহমদ। তারপরে, ছোটদের জন্যে যারা লিখতেন, তাদের বই নিয়মিত পড়তাম। দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদারের ‘ঠাকুমার ঝুলি’ ও ‘ঠাকুরদাদার ঝুলি’ প্রিয় ছিল। আমরা আবার খোদ বাড়িতেই বই উপহার পেতাম নানা উপলক্ষে— বোন দিচ্ছেন, দুলাভাই দিচ্ছেন, আত্মীয়-স্বজন দিচ্ছেন; বই দেওয়ার একটা রেওয়াজ ছিল। আমার এক বন্ধুর মামা ক্যারাম খেলার প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা করতেন প্রতিবছর— তারও পুরস্কার ছিল বই। কাজেই সুনির্মল বসু, সুকুমার রায়, শিবরাম চক্রবর্তী— এঁদের বই প্রচুর পড়েছি। বাড়ি থেকে শুধু বলা ছিল, নভেল পড়বে না। আমারও ধারণা ছিল যে, নভেল পড়া উচিত না। আর, নভেল কী, তখন ভালো বুঝতামও না। আমার মনে হয় যে, আমি ক্লাস নাইনে ওঠার পর প্রথম নভেল পড়ি।

হামিদ কায়সার: গোয়েন্দা কাহিনীগুলো যে পড়েছেন, সে সব পড়তে বাড়িতে বাধা ছিল না?
আনিসুজ্জামান: সেগুলো পড়তে বাধা ছিল না। কারণ, সেগুলো তো ছোটদের জন্যেই লেখা বই— সে সব বইই তো উপহার পেতাম বাড়ি থেকে। এমনকি শরৎচন্দ্রের ‘রামের সুমতি’ও পড়া যেত। ‘রামের সুমতি’র সঙ্গে আরো দু-টি গল্প- ‘বিন্দুর ছেলে’ ও ‘পথনির্দেশ’ নিয়ে সংকলনটি ছিল। এগুলো আমরা পড়তে পারতাম, বাধা ছিল না। কিন্তু ‘দেবদাস’ বা ‘পন্ডিত মশাই’— এসব বোনরা পড়ছে, কিন্তু আমাকে বলা হতো ‘না এটা তোমার পড়ার জন্যে না’। নাইনে ওঠার আগে আমার পড়া হয়নি। ও! এ সময়ের একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হচ্ছে— আমাদের একজন বন্ধু ছিল হাসান শফি নামে— একই স্কুলে আমাদের এক ক্লাস নিচে পড়ত— অবজারভার-এর সম্পাদক আবদুস সালামের জ্যেষ্ঠ পুত্র। স্কুলেই এক দুর্ঘটনায় সে মারা যায়।

হামিদ কায়সার: কিভাবে?
আনিসুজ্জামান: এক ব্যালকনি থেকে লাফ দিয়ে আরেক ব্যালকনিতে যাবার সময়ে নিচে পড়ে গিয়েছিল। ওর নামে আমরা একটি লাইব্রেরি করেছিলাম।

হামিদ কায়সার: কোথায়?
আনিসুজ্জামান: ঐ পার্ক সার্কাসের বড় মাঠের একটি ঘরে— ‘হাসান শফি মেমোরিয়াল লাইব্রেরী’ নাম দিয়ে। ঐ লাইব্রেরি করতে গিয়ে পাড়ার সব বাড়িতে আমরা যেতাম বই চাইতে। তখন নানা রকমের বই বিভিন্ন বাড়ি থেকে পেতাম লাইব্রেরির জন্যে। ওসব বইও পড়তাম।

হামিদ কায়সার: কাদের লেখা ছিল এ বইগুলো?
আনিসুজ্জামান: এখন বলতে পারব না সব লেখকের নাম। জানা-অজানা অনেক লেখকের বই ছিল। বেশ কিছু জীবনী ছিল, ইতিহাসাশ্রিত কাহিনী ছিল। তারপরে তো ঢাকায় এলাম ’৪৮ সালের শেষ দিকে। ’৪৯-এ নাইনে উঠলাম। পাঠ্য বইয়ের মধ্যে নাইন-টেনে পড়তাম ‘সাহিত্য পরিচিতি’ বলে বাংলা গদ্য ও পদ্য। প্রত্যেক লেখকের পরিচিতি তাতে ছিল, সাহিত্যের ইতিহাসও থাকত। ‘গল্পবীথি’ বলে আমাদের র‌্যাপিড রিডার ছিল— তাতে রবীন্দ্রনাথের গল্প ছিল, তারাশংকরের গল্প ছিল, শওকত ওসমানের ‘আব্বাস’ বলে একটি অবিস্মরণীয় গল্প ছিল। যে ক’টা গল্প পাঠ্য— তার বাইরের সব গল্পও পড়ে ফেলেছিলাম। বার বার পড়েছি। পাঠ্যবইও যে এত আনন্দদায়ক হতে পারে! সেই তুলনায়, একেবারে কয়েক বছরের মধ্যে দেখলাম যে, বইয়ের মান খুব নেমে গেল। পাকিস্তানি ভাবাপন্ন হতে হবে— এই একটি ধারা এলো খুব পেছনমুখী। আমরা যারা, ‘৫১, ‘৫২ সালে ম্যাট্রিক পাস করেছি— তারা এই ‘সাহিত্য পরিচিতি’ পড়েছি। বাংলা ভাষার ইতিহাস সম্পর্কে, ধারা সম্পর্কে এটা খুব চমৎকার তথ্যপূর্ণ বই ছিল। সে সময়ে কলকাতা থেকে একটি পত্রিকা বের হতো ‘অচলপত্র’ নামে। এটা একটু হালকা ধরনের পত্রিকা ছিল। পড়ে খুব মজা পেতাম। আমাদের স্কুলে কিছুকাল পড়িয়েছিলেন আবদুল খালেক খান। দৈনিক বাংলার সাংবাদিক ছিলেন, রিটায়ার করেছেন। ওঁর ধারণা ছিল আমি সাহিত্যচর্চা করি, তাই আমাকে একদিন জিজ্ঞেস করলেন যে, ‘সাহিত্য পত্রিকা কি পড়’? আমি বললাম ‘অচলপত্র’। উনি হাসলেন, বললেন, ‘এসব তো হালকা কাগজ, সিরিয়াস কাগজ কিছু পড়।’ সিরিয়াস কি পড়ব জিজ্ঞেস করতেই বললেন ‘চতুরঙ্গ’, ‘ক্রান্তি’। তখন থেকে ‘চতুরঙ্গ’ খুঁজে পড়তে শুরু করলাম। এই যে ইংরেজি সাহিত্যের প্রতি আগ্রহের কথা বলি। আমাদের স্কুলে— তখন নাইন কিংবা টেনে পড়ি— কোনো এক শিক্ষক ছুটিতে গেলেন। তার বদলে আরেকজন পড়াতে এসে বললেন, ‘দেখ, উনি তো ছুটিতে গেছেন, শীঘ্রি চলে আসবেন— আমি আর কি পড়াব, তারচেয়ে গল্প করি।’ আমরা তো মহা উৎসাহে চেঁচিয়ে উঠলাম, ‘স্যার গল্প বলেন, গল্প বলেন।’ তো উনি প্রত্যেক দিন একটা ইউরোপিয়ান ক্ল্যাসিকের গল্প শোনাতেন। স্যার সে-সব গল্প আমাদের উপযোগী করে বলতেন। প্রথমে ‘লা মিজারেবল’ তারপর ‘এ টেল অব টু সিটিজ’— এ ধরনের গল্প শুনে শুনে মূল বইও খুঁজতে আরম্ভ করলাম। ক্লাস এইটে আমার পাঠ্য বই ছিল ল্যাম্বের ‘স্টোরিজ ফ্রম শেক্সপীয়র’। বইটি পড়ে মনে হলো শেক্সপীয়রের মূল নাটক পড়তে হবে। মূল নাটক পড়তে গিয়ে দেখলাম যে, আমার পক্ষে দুরূহ। তখন বাংলায় শেক্সপীয়রের নাটকের যত কাহিনী পেয়েছি, প্রত্যেকটি পড়েছি— দশ বারোটি তো হবেই। এভাবে শিক্ষকরাও একধরনের প্রেরণা দিয়েছেন, অনুসন্ধিৎসার পথ খুলেছে। যখন শান্তিনগরে ছিলাম, প্রতিবেশী এক ভদ্রলোক ছিলেন আবদুল মালেক বলে। তিনি র্যাডিক্যাল হিউম্যানিস্ট ছিলেন— এক হাত কাটা ছিল— সাহিত্য খুব ভালো পড়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথের অসংখ্য কবিতা তার মুখস্থ ছিল। আর ওখানে ছিলেন ফারুক সাহেব, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগ থেকে সম্প্রতি রিটায়ার করলেন। তো, আমরা রাস্তায় হাঁটতাম। মালেক ভাই আরম্ভ করতেন— রবীন্দ্রনাথের ‘শেষের কবিতা’র ‘আনিলাম অপরিচিতের নাম ধরণীতে’ কিংবা ‘কালের যাত্রার ধ্বনি’— পুরো কবিতার আবৃত্তি শেষ হলো। ফারুক ভাই হয়তো ‘বিজয়িনী’ আবৃত্তি করলেন। এইটা কোন বই না খাতা না, কোন উপলক্ষ না, কোন কথা না— এই, গল্প করতে করতে হঠাৎ হঠাৎ পুরো কবিতা আবৃত্তি হয়ে গেল। তখনই খোঁজ খোঁজ, ‘শেষের কবিতা’ পড়তে হবে। এভাবে মানুষের সংস্পর্শে— খালি যে পড়ব মনে করে না— মনের মধ্যে আগ্রহ জাগার অনেকগুলো ক্ষেত্র তৈরি হয়েছিল— বাড়িতে, স্কুলে, কলেজে আবার এই পরিচিতদের মধ্যে। হয়ত, এই একটু পড়তাম বলে আমার চেয়ে যারা বয়সে বড়, তাদের সঙ্গেও চলাফেরার সুযোগ পেতাম। তখন, আমরা ছিলাম শান্তিনগরে, আমাদের পাশেই ছিল রামকৃষ্ণপুর।

হামিদ কায়সার: রামকৃষ্ণপুর? শান্তিনগরের পাশে?
আনিসুজ্জামান: হ্যাঁ, রামকৃষ্ণপুর। সেটার পরে নাম হয় নয়া পল্টন। পুরানা পল্টনের পর রামকৃষ্ণপুর, তারপর শান্তিনগর। একদিন জুমার নামাজের পর মুসল্লিরা ঠিক করলেন যে, পাকিস্তানে রামকৃষ্ণপুর নাম রাখা ঠিক নয়- পুরানা পল্টনের পর নয়া পল্টন করে দিলেন। তখনো তারা জানতেন না যে, আজিমপুরে একটা নতুন পল্টন আছে। তো, নয়াপল্টনে থাকতেন আবদার রশীদ সাহেব। পরে ঢাকা কলেজ এবং অন্যান্য সরকারি কলেজের প্রিন্সিপ্যাল হয়েছিলেন। রশীদ সাহেবরা কয় ভাই একসঙ্গে থাকতেন। তাঁদের খুব সমৃদ্ধ লাইব্রেরি ছিল— অসাধারণ! পাড়াসূত্রে আলাপ হলো, ক্লাস টেনে পড়ার সময় রায়টের জন্যে স্কুল বন্ধ হয়ে গেল, ওঁদের বাড়ির সংগ্রহ থেকে আমি কত যে বই পড়েছি— তা বলার না। তখন, ইংরেজি সাহিত্য পড়াও আরম্ভ করি। আমি নাইনে থাকতেই আমার মামাতো ভাই সৈয়দ কামরুজ্জামানের দেখাদেখি বার্নাড শ’ পড়া শুরু করেছিলাম। যখন ক্লাস টেনে উঠলাম, বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায় আর বার্নাড শ’ মারা গেলেন প্রায় একই সময়ে। স্কুলের শোকসভায় আমি দুজনের যে কারো সম্বন্ধে প্রবন্ধ পড়তে চাই। শিক্ষকরা বললেন, বার্নাড শ’ সম্পর্কে লিখতে। আমি বার্নাড শ’ সম্পর্কে লিখি এবং পড়ি। কাজেই সেটা আমার স্পষ্ট মনে আছে— এই সময় আমি বার্নাড শ’ পড়েছি— খুব বেশি নয়— ‘প্লেজ প্লেজেন্ট অ্যান্ড আনপ্লেজেন্ট’ আর ‘ম্যান এ্যান্ড সুপারম্যান’- শেষেরটা কিছুই বুঝিনি। তবু তার থেকে মৃত্যু সম্পর্কে বার্নাড শ’র একটি মন্তব্য দিয়ে শোকসভার প্রবন্ধ শুরু করেছিলাম- “জীবন সবাইকে সমান করে দেয়, যে বিশিষ্ট মৃত্যুই তাকে তুলে ধরে”। আর শেষ করেছিলাম এই বলে, বার্নাড শ’র মৃত্যুতে এই কথার প্রমাণ হলো। রশীদ ভাই আমাকে ‘লেডিস চ্যাটার্লিজ লাভার’-ও পড়তে দিয়েছিলেন। আমার মামাত ভাই দেখে বললেন ‘কি পড়ছ?’ আমি বললাম, ‘লেডিস চ্যাটার্লিজ লাভার।’ তিনি বললেন যে, ‘এটা পড়ার বয়স এখনও তোমার হয়নি।’ এর মধ্যে আমি পৃষ্ঠা বিশেক পড়ে ফেলেছিলাম। ভাইকে খুব মান্য করতাম। তাই, পড়া বাকি রেখেই বইটি ফেরত দিয়েছিলাম। আর এই সময় রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, বঙ্কিমচন্দ্র, মধুসূদন— এঁদের লেখাও পড়ি।

হামিদ কায়সার: সব লেখাই?
আনিসুজ্জামান: মানে, বসুমতী সাহিত্য মন্দির— সংস্করণ বঙ্কিমচন্দ্র গ্রন্থাবলী, মধুসূদন গ্রন্থাবলী। মধুসূদন গ্রন্থাবলীর মধ্যে আমি নাটক সব পড়ে ফেলি। কিন্তু ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ পড়তে গিয়ে আমি এগোতে পারি নি।  

হামিদ কায়সার: তখন ভালো লাগেনি?
আনিসুজ্জামান: না। তাঁর নাটক সব পড়ে ফেলি। বঙ্কিমচন্দ্রের সমস্ত উপন্যাস এবং কমলাকান্ত পড়েছি। রবীন্দ্রনাথ কিন্তু একইভাবে পড়া হল না একসঙ্গে— তখন ‘গল্পগুচ্ছ’ পড়েছি— হয়ত কবিতার বই একটা পেলাম, পড়লাম, একটা উপন্যাস পেলাম, পড়লাম— অনেক পরে অবশ্য রবীন্দ্রনাথ গুছিয়ে পড়তে পেরেছিলাম। শরৎচন্দ্র এলোমেলোভাবেই অধিকাংশ ম্যাট্রিক পাসের আগে পর্যন্ত পড়ে ফেলেছি। তখন আর তো কোনো বাধা ছিল না— কাজেই গোগ্রাসে পড়তে পেরেছি।

হামিদ কায়সার: শরৎ আর বঙ্কিমের মধ্যে তখন কার লেখা ভালো লাগত?
আনিসুজ্জামান: শরৎচন্দ্রের। তখন দু’জনের মধ্যে শরৎচন্দ্রকেই ভালো লাগত। এখন অবশ্য অন্যরকম মনে হয়। আমার স্পষ্ট মনে আছে, রবীন্দ্রনাথের ‘চার অধ্যায়’ তখনই আমি পড়ি। ‘চার অধ্যায়’ আমার ভালো লাগেনি, ‘ঘরে বাইরেও’ না। ‘গোরা’ তখনও পড়িনি। ‘গল্পগুচ্ছ’ খুব আনন্দের সাথে পড়েছি। তার কিছুদিন পরে, বেঙ্গল পাবলিশার্স থেকে শ্রেষ্ঠ গল্প সিরিজ বের হতে লাগল। তাতে, প্রভাতকুমারের গল্প প্রথম পড়লাম। আর, ঐ সিরিজে জগদীশ ভট্টাচার্য খুব চমৎকার ভূমিকা লিখতেন। ভূমিকা পড়ে খুব আনন্দ পেতাম। গল্প পড়ে আনন্দ পাচ্ছি, আবার ভূমিকাও বারবার পড়ছি। তখন বনফুল, দুই বিভূতিভূষণ, মানিক বন্দোপাধ্যায়, এমন অনেকের গল্প হয় প্রথমবার নয় নতুন করে পড়লাম। তারও একটু পরে শরদিন্দু বন্দোপাধ্যায়— ঐ ব্যোমকেশের গল্পও খুব আনন্দের সঙ্গে পড়েছি।

হামিদ কায়সার: শুধু কি পড়েই যাচ্ছিলেন? লেখালেখি?
আনিসুজ্জামান: হাতের লেখা পত্রিকায় একটু আধটু লিখতাম। আসলে, ক্লাস এইটে থাকতে একটি গল্প লিখেছিলাম— খানিকটা শিবরাম চক্রবর্তীর ছায়া অবলম্বনে। শিবরামের একটি গল্প ছিল টেলিফোনের রং কানেকশন নিয়ে— কলকাতায় ‘ইত্তেহাদে’ রোকনুজ্জামান খান (দাদাভাই)-কে দেখেছিলাম রিসেপশনিস্ট হিসেবে। আমিও সেরকম একজনকে কল্পনা করলাম, যে চরিত্রটি রিসেপশনে কাজ করে। তার নানারকম রং নাম্বার আসে। বিরক্ত হয়ে সে এক সময়ে আর টেলিফোন ধরে না। কিন্তু যে টেলিফোনটি সে ধরল না, সেটিই ছিল মালিক বা সম্পাদক এরকম কারো একজনের। তো, এই অপরাধে তার চাকরি চলে গেল। খুলনায় একটা হাতে-লেখা পত্রিকায় এটা বেরিয়েছিল ১৯৪৮ সালে। ঢাকায় এসে গল্পটা আবার নতুন করে লিখে গোলাম মোস্তফা পরিচালিত ‘নওবাহার’ পত্রিকায় পাঠিয়ে দিই— সঙ্গে সঙ্গে ছাপা হয়। গল্পটির নাম ছিল ‘টেলিফোন’— এ সময়ে আমি ক্লাস টেনের ছাত্র।

হামিদ কায়সার: এটাই প্রথম?
আনিসুজ্জামান: হ্যাঁ, এটিই প্রথম গল্প। আর, দ্বিতীয় গল্পটিও প্রথম গল্প প্রকাশের দু’তিন মাস পরই বেরিয়ে গেল। আবদার রশীদ আর আমার সম্পাদিত এবং (পরে সচিত্র সন্ধানীর সম্পাদক) গাজী শাহাবুদ্দিন প্রকাশিত পাড়ার হাতে-লেখা পত্রিকায় আমার একটা ছোটগল্প ছিল। সে গল্পটা দেখে তখনকার ‘মাহে নও’ পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক আলী আহমদের ভালো লেগে গিয়েছিল। উনি বললেন, ‘গল্পটা আমাকে কপি করে দাও, ‘মাহে নও’য়ে ছাপব’। দু’তিন মাসের ব্যবধানে দ্বিতীয় গল্পটিও প্রকাশিত হলো। এমনও হতে পারে যে একটি ’৪৯-এর ডিসেম্বর এবং আরেকটি ’৫০-এর ফেব্রুয়ারিতে বেরিয়েছিল। এরপর থেকে ছোটগল্প লিখে যেতে লাগলাম। এই সময়ে আমি বনফুলের ছোট ছোট এক পাতার গল্পের খুব অনুরাগী ছিলাম। তো, আমিও এরকম বেশ কয়েকটি গল্প লিখেছিলাম। তার মধ্যে তিনটি দিয়েছিলাম ‘আজাদ’-এ ছাপতে, আহসান হাবীবের হাতে বাছাই হয়ে ‘আজাদ’ বোধ হয় দুটো ছেপেছিল ‘শিক্ষার মূল্য’ নামে। ‘সংবাদ’-এ দুটো দিয়েছিলাম হাবীবুর রহমানের হাতে। একটা গল্পের নাম ‘খবর’, আরেকটা গল্পের নাম ‘সভ্যতা’। ততদিন কলেজ জীবন শুরু হয়েছে।

হামিদ কায়সার: আপনার বই পড়ায় কি তখন কোনো নতুন প্রবণতা এলো?
আনিসুজ্জামান: কলেজে এসে ইংরেজি একটু বেশি করে পড়েছি। ছোটগল্প, উপন্যাস ইত্যাদি। হয়তো সমারসেট মমের গল্প বা উপন্যাস, আবার হয়তো বার্নাড শ’র নাটক পড়লাম, ইবসেনের নাটক পড়লাম। আমাদের বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে ছিলেন মুর্তজা বশীর, আমিনুল ইসলাম। আর্ট স্কুলের ছাত্র। এদের মুখে শুনতাম শিল্পীদের জীবন নিয়ে লেখা উপন্যাসের কথা। ঐগুলো আবার খুঁজে বের করে পড়তাম— ‘লাস্ট ফর লাইফ’, ‘মুন এ্যান্ড মিক্স পেনস’, এইসব। তখন সিগনেট প্রেসের বই খুব আগ্রহ নিয়ে পড়তাম। সত্যজিৎ রায় কভার করতেন, দিলীপ কুমার গুপ্ত ছিলেন প্রকাশক। এমন রুচিস্নিগ্ধ মানুষ বাংলা প্রকাশনা শিল্পে খুব কম এসেছেন। আমরা এ প্রেসের বইগুলো ভাগাভাগি করে পড়তাম, হয়তো আমি একটা কিনতাম, অন্যজনে আরেকটি কিনত। পরে আমরা পরস্পরের কাছ থেকে নিয়ে পড়তাম।

হামিদ কায়সার: সিগনেট প্রেসের বইয়ের প্রতি এত আকর্ষণ থাকার কারণ?
আনিসুজ্জামান: ওদের বইগুলোর মধ্যে একটি নতুনত্ব ছিল— মুদ্রণ অঙ্গসজ্জা, বাঁধানো— এক নতুন স্বাদ এনে দিয়েছিল। ওরা তখন পুরনো বইও রিপ্রিন্ট করছিলেন— বুদ্ধদেব বসুর, প্রেমেন্দ্র মিত্রের, জীবনানন্দ দাশের, অচিন্ত্যকুমারের। তারপর বিদেশি সাহিত্যের বাংলা অনুবাদ— লরেন্সের গল্প, পিরানদেল্লোর গল্প, আধুনিক সোভিয়েত গল্প— এসব নিয়ে সিরিজ ছিল। এরিখ মারিয়া রেমার্কের ‘অল কোয়ায়েট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট’, ‘থ্রি কমরেডস’ এগুলো বাংলায় পড়েছি। তো ‘অল কোয়ায়েট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট’ যখন পড়লাম, তখন আমার মনে হলো যে, এটা ইংরেজিতে পড়া উচিত। কলেজের লাইব্রেরিতে গিয়ে চাইলাম। লাইব্রেরিয়ান বললেন যে, ‘পাঠ্যবই ছাড়া কিছু দেওয়া হবে না।’ কলেজে যখন ছাত্র সংসদ-এর ইলেকশন এলো— তখন এটাকে আমরা একটি ইস্যু বানিয়ে ফেললাম, ‘কলেজের লাইব্রেরি থেকে সৎ সাহিত্যের বই পড়তে পাওয়া যায় না।’ লিফলেট পর্যন্ত ছেপেছিলাম। আমাদের প্রিন্সিপাল ছিলেন আবদুর রহমান খাঁ, উনি একদিন সমস্ত ছাত্রদের ডেকে মিটিং বসালেন বিরাট ক্লাসরুমে। তিনি এই ইস্যুর প্রসঙ্গটি ইংরেজিতে উল্লেখ করে বললেন, ‘এটা কার লেখা, বলো।’ সবাই চুপ। তিনি আবার হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন, ‘এটা কার লেখা, বলো?’ আমি দাঁড়িয়ে বললাম, ‘স্যার, আমার লেখা’। উনি জানতে চাইলেন, ‘তুমি যে অভিযোগগুলো করেছ, সব সত্যি?’ আমি বললাম, ‘হ্যাঁ। তিনি বললেন, ‘তুমি কি লাইব্রেরিতে গিয়ে বই পাওনি?’ আমি বললাম, ‘না’। তিনি তখন বললেন, ‘তুমি কি আমাকে তা জানিয়েছিলে?’ আমি বললাম, ‘না’। তিনি বললেন যে, ‘তুমি কলেজ কর্তৃপক্ষের কাছে প্রতিকার চাইলে না, অথচ এটা প্রচারপত্রে লিখে ছড়িয়ে দিলে? এটা কি ঠিক কাজ হলো?’ তিনি এমনভাবে কথাটি বললেন, আমি আর কোনো জবাব দিতে পারলাম না। স্বীকার করলাম যে, বিষয়টি নির্বাচনের ইস্যুতে না এনে কর্তৃপক্ষকে আগে জানানো উচিত ছিল। প্রসঙ্গটি আমি এখানে উল্লেখ করলাম এ কারণে, এখন এইটা ভাবা খুব মুশকিল যে, কোনো কলেজ ছাত্র সংসদ নির্বাচনে লাইব্রেরিতে সাহিত্যের বই পাওয়া যাচ্ছে না বলে সেটা ইলেকশনের ইস্যু করা হবে। আমি জগন্নাথ কলেজে ভর্তি হয়েছিলাম এ-কারণেই আমি ম্যাট্রিক পরীক্ষার আগেই স্থির করে ফেলেছিলাম যে, বাংলায় এম এ পড়ব। তখন ইন্টারমিডিয়েটে বাংলা সাহিত্যের নাম ছিল স্পেশাল বেঙ্গলি— পড়ানো হতো দিনে জগন্নাথ কলেজে আর রাতে সেন্ট গ্রেগরিজ কলেজে, যেটি পরে নটরডেম কলেজ হয়ে গেল। আমাদের সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ওখানকার ছাত্র ছিলেন। আমি ঐ বাংলা পড়ার আকর্ষণে জগন্নাথ কলেজে ভর্তি হলাম। পরের বছরে ঢাকা কলেজে স্পেশাল বেঙ্গলি চালু হয়েছিল আবু হেনা মোস্তফা কামালের জন্য।

হামিদ কায়সার: শুধু আবু হেনা মোস্তফা কামালের জন্য?
আনিসুজ্জামান: যাতে আবু হেনা মোস্তফা কামাল পড়তে পারে, সে জন্য মুহম্মদ মনসুরউদ্দিন সাহেব এটা করেছিলেন। আবু হেনারও বাংলা পড়ার আগ্রহ। তখন মনসুরউদ্দিন সাহেব বলেছিলেন যে, ‘এখানে ভর্তি হও, আমি ব্যবস্থা করে দিই।’ এই বলে উনি ইউনিভার্সিটির বিশেষ অনুমতি আনলেন। চিন্তা করো আবহটা, একজন ছাত্রের কথা মনে রেখে, উনি কলেজ কর্তৃপক্ষকে রাজি করিয়ে ইউনিভার্সিটি থেকে বিষয় পড়াবার অনুমতি এনেছিলেন। জগন্নাথ কলেজে শিক্ষক হিসেবে যাদের পেয়েছিলাম, তাদের মধ্যে অজিতকুমার গুহ ও মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী। অজিতকুমার গুহ আমাদেরকে রবীন্দ্রনাথের ‘প্রায়শ্চিত্ত’ নাটক পড়াতেন। মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী পড়াতেন, রবীন্দ্রনাথের ‘লোক সাহিত্য’ ও ‘মানসী’। অজিতবাবু তো অসাধারণ পড়াতেন। ‘প্রায়শ্চিত্ত’ পড়ার জন্য তিনি আমাদের উৎসাহ দিতেন। ‘বউঠাকুরানীর হাট’ উপন্যাস ও ‘পরিত্রাণ’ নাটক পড়ার জন্য। মোফাজ্জল হায়দার ভাল পড়াতেন, কিন্তু তিনি যা করতেন, তা হলো সমালোচনার বই পড়তে উৎসাহিত করতেন। আমাদের ‘মানসী’ পড়াতে গিয়ে বললেন, ‘তোমরা যদি কবিতাগুলো আরো ভাল করে বুঝতে চাও তাহলে প্রমথনাথ বিশীর ‘রবীন্দ্রকাব্যপ্রবাহ’ পড়ো। আরো একটা বই আছে নীহাররঞ্জন রায়ের ‘রবীন্দ্র-সাহিত্যের ভূমিকা’। তো, আমি পড়েছি, বইগুলোর সবটুকু নয়, ভূমিকার কিছু অংশ, ‘মানসী’ সম্পর্কে আলোচনার অংশ— এই যে আমার সমালোচনা সাহিত্যের সঙ্গে পরিচয়, এটা কিন্তু অজিতকুমার গুহ এবং মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীর মাধ্যমে। পরে তো আমি প্রথমনাথ বিশীর রবীন্দ্রকাব্যপ্রবাহের অনুকরণে লিখে ফেললাম সুকান্তকাব্যপ্রবাহ।

হামিদ কায়সার: বিশাল সাইজের?
আনিসুজ্জামান: ঐ রকমই আর কি। এই সুকান্তের কবিতা ধরে ধরে আলোচনা।

হামিদ কায়সার: তো, তখনকার সাহিত্যিক আবহাওয়ার পরিম-ল কেমন ছিল?
আনিসুজ্জামান: তখন, ১৯৫১ সালের শেষ দিকে ‘পাকিস্তান সাহিত্য সংসদ’ বলে একটি প্রতিষ্ঠান হলো। কাজী মোতাহার হোসেন সভাপতি, ফয়েজ আহমদ সম্পাদক। আমিও জড়িয়ে পড়লাম। এখানে খুব একটা বড় সাহিত্যিক আবহাওয়া পেলাম। যারা খুব প্রতিষ্ঠিত লেখক তারা আসছেন, নতুন লেখকরা আসছেন— প্রতি পক্ষে গল্প কবিতা প্রবন্ধ পড়া হচ্ছে— আলোচনা হচ্ছে। এটা আমার সাহিত্যিক রুচি গঠনে অনেকখানি সাহায্য করল। আমি নিজেও সমালোচনা করছি। কেউ একটু বেশি বাড়াবাড়ি করলে তার আবার প্রতিবাদ করতে দাঁড়াচ্ছি। এসব মিলে একটা হৈ চৈ। ১৯৫৩ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই। তার আগে মোটামুটি আমার সাহিত্যপাঠের প্রস্তুতিটা হয়ে গেছে। যার ফলে, আমি যখন ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হই, তখন সহপাঠীদের মধ্যে আমি সবচেয়ে বেশি বাংলা সাহিত্য পড়ে ফেলেছি।

হামিদ কায়সার: ঐ সময়ে যারা আপনার সঙ্গে লেখালেখি করতেন— সবার লেখাই তো পড়তেন?
আনিসুজ্জামান: ঐ যে, পাকিস্তান সাহিত্য সংসদ করতাম। সে সূত্রে আমরা পরস্পরের লেখালেখির খোঁজ-খবর জানতাম। এর মধ্যেই, বোধহয় তখন ক্লাস টেন অথবা ফার্স্ট ইয়ারে পড়তাম, ‘দাঙ্গার পাঁচটি গল্প’ বের হলো— পড়লাম। আলাউদ্দিন আল আজাদের ‘জেগে আছি’ বের হলো— পড়লাম। তারপরে, ফজলে লোহানী সম্পাদিত ‘অগত্যা’ পড়তাম নিয়মিত। ‘অগত্যা’য় একদিন দেখলাম এক বিজ্ঞাপন—, ‘এক হাজার এক রাত্রি’ বলে একটি গল্প— লিখেছেন এত বন্ধুবান্ধব থাকতেও যাকে না খেয়ে থাকতে হয় সেই আলাউদ্দিন আল আজাদ। আমার মনে এমন লাগল যে, আমি মাকে বলে শান্তিনগর থেকে হেঁটে বাংলাবাজারে গিয়ে আজাদকে বললাম যে, ‘আপনি কাল রাতে আমাদের বাড়িতে খাবেন’।

হামিদ কায়সার: এটা স্যার, কত সালে?
আনিসুজ্জামান: বোধহয় ’৫১ সালে, ভাষা আন্দোলনের আগের ঘটনা। তারপর, যা বলছিলাম। ‘নতুন কবিতা’ সংকলন বের হল। আবদুর রশীদ খান ও আশরাফ সিদ্দিকী যেটার সম্পাদনা করেছিলেন— সেটা পড়ছি। বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর ঐ সংকলনের কনিষ্ঠতম কবি, সে লিখছে গল্প-কবিতা— পড়ছি। হাসান হাফিজুর রহমান গল্পকবিতা লিখছেন, অনেক লেখাই তিনি প্রথম আমাকে পড়ে শোনাচ্ছেন। আলাউদ্দিন আল আজাদ বের করলেন ‘ধানকন্যা’— দ্বিতীয় গল্পের বই। ওটা বিক্রি করতে হবে, আমি পাঁচ কপি বিক্রি করার দায়িত্ব নিলাম। বিক্রি করে তাকে টাকা ফেরত দিতে গেলাম, তিনি আবার আমাকে কমিশনের পয়সা দিতে গেলেন— আমি নিলাম না, এরকম কত ঘটনা, এটা’ ৫৩-৫৪ সালের কথা। এই যে বড় লকদের লেখা পড়ছি, আবার সঙ্গে সঙ্গে নতুন যারা লিখছেন তাদের লেখা পড়ছি, তাদের সঙ্গে ব্যক্তিগত যোগাযোগ হচ্ছে। কাজী মোতাহার হোসেন একদিন, তখন আমরা ঠাঠারীবাজারে চলে এসেছি— সেগুন বাগিচা থেকে আমার বাসায় গিয়ে আমাকে নাম ধরে ডাকলেন, তারপর বললেন, ‘কাল রাতে একটা প্রবন্ধ লিখেছি, ভাবলাম তোমাকে শোনাই।’ আমার তো মনে হলো যে, এটা আমার জীবনের একট স্মরণীয় ঘটনা— কাজী মোতাহার হোসেনের মতো মানুষ প্রবন্ধ শোনানোর জন্য আমার বাসায় চলে এসেছেন।

হামিদ কায়সার: ওঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল কিভাবে?
আনিসুজ্জামান: ঐ যে, পাকিস্তান সাহিত্য সংসদ। তিনি ছিলেন সংসদের সভাপতি। এই আবহটা এখনকার সঙ্গে কিছুতেই আর মেলানো যায় না। এই যে শিল্পী বন্ধুদের কথাই বলি, এদের সঙ্গে থাকায় শিল্প সম্পর্কে অল্পস্বল্প পড়েছি। আগে অবনীন্দ্রনাথের বই পড়েছিলাম আনন্দের সঙ্গে— ‘বুড়ো আংলা’, ‘রাজকাহিনী’, ‘নালক’। এবারে পড়তে হলো ‘শিল্পায়ন’, বুঝি না, তবু ছাড়ি না— পড়ে যাচ্ছি বারবার। জানার আগ্রহে বিদেশি শিল্পীদের জীবনী পড়ছি, তাদের সম্পর্কে জানছি। ও, এখন মনে পড়ছে, আমি ইন্টারমিডিয়েটে যখন পড়ি তখন আইফর ইভানসের ‘এ শর্ট হিস্ট্রি অফ ইংলিশ লিটারেচার’ আর রিচার্ড হেয়ারের ‘রাশান লিটারেচর’ কিনেছিলাম। ইউনিভার্সিটিতে ঢুকে কিনেছিলাম ‘এ হিস্ট্রি অব ওয়েস্টার্ন লিটারেচর’। এগুলো পড়েছি এ কারণে, শুধু বাংলা ভাষায় কি হচ্ছে জানলে তো হবে না, বিদেশি সাহিত্যও জানতে হবে।

হামিদ কায়সার: তাহলে দেখা যাচ্ছে, বন্ধুদের সাহচার্য, আড্ডা এসব ভীষণ কাজে লেগেছে।
আনিসুজ্জামান: হ্যাঁ, তা লেগেছে। বন্ধুদের কেউ যেমন বললেন, ‘এটা পড়েছ’? বলতাম, ‘না পড়িনি’ সঙ্গে সঙ্গেই ওরা বললেন, ‘এটা পড়, ওটা পড়’। যেমন, আমার মনে আছে, ‘নীলাঙ্গুরীয়’ পড়ার কথা। এক আড্ডাতে প্রশ্ন ওঠেছিল, ‘সবচেয়ে ভাল প্রেমের উপন্যাস কোনটি?’ প্রায় সবাই রায় দিয়েছিলেন, ‘নীলাঙ্গুরীয়’। তখন ‘নীলাঙ্গুরীয়’ খুঁজে পড়ে ফেললাম। এভাবেই আর কি— মনটা তৈরি হয়েছিল। বাংলা সাহিত্য পড়ছি, কনটেম্পররি লেখা পড়ছি— এসময়ে অনুবাদে উর্দু সাহিত্যও পড়েছি। দাঙ্গা, দেশবিভাগ এসব নিয়ে লেখা উর্দু গল্পগুলো পড়ছি— মনে দাগও কাটছে এবং বাস্তব সম্পর্কেও সচেতন হচ্ছি।

হামিদ কায়সার: এই উর্দু গল্পগুলোর লেখক?
আনিসুজ্জামান: খাজা আহমদ আব্বাস, কৃষণ চন্দর— সাদাত হাসান মান্টো গল্প অনুবাদে কিংবা এখানেও এই রকম বিষয় নিয়ে যারা লিখেছেন— মুনীর চৌধুরীর নাটক, আলাউদ্দিন আল আজাদের গল্প, হাসান হাফিজুর রহমানের গল্প।

হামিদ কায়সার: অর্থাৎ, স্বদেশচেতনা আপনার মধ্যে কাজ করছে।
আনিসুজ্জামান: স্বদেশচতনা, অসাম্প্রদায়িক চেতনা, একটু বামপন্থী চেতনা— ধীরে ধীরে সাহিত্যে পথ পেয়ে যাচ্ছি।

হামিদ কায়সার: আপনার জীবনের প্রস্তুতিপর্বের কথা শুনলাম, এরপর যখন কর্মজীবনে প্রবেশ করলেন?
আনিসুজ্জামান: জীবনের একটি পর্বের কথা কিন্তু বাদ থেকে গেল।

হামিদ কায়সার: হ্যাঁ, হ্যাঁ। আপনার বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবন— সম্ভবত বই পড়ার এক উৎকৃষ্ট সময়।
আনিসুজ্জামান: বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে পড়াশোনায় সুশৃঙ্খলা এলো। সুশৃঙ্খলা বলছি এই কারণে, একে হচ্ছে সিলেবাসে যা ছিল সবই পড়ছি। আবার বঙ্কিমচন্দ্র, শরৎচন্দ্র সব পড়লাম। তখন দেখি যে, শরৎচন্দ্রের চেয়ে বঙ্কিমচন্দ্র বেশি ভালো লাগে। তারপর, রবীন্দ্রনাথের উপন্যাস সিলেবাসে ছিল না। কিন্তু সব মনোযোগ দিয়ে প্রায় ধারাবাহিকভাবে পড়লাম। ‘সঞ্চয়িতা’র অর্ধেকটা পাঠ্য ছিল। আবার ভালো করে পুরোপুরি পড়লাম। এসবের সমালোচনাও খুব পড়ছি। সব লেখক সম্পর্কেই। টেক্সট পড়ছি, সমানে সমালোচনাও পড়ছি।

হামিদ কায়সার: সমালোচনা সাহিত্যই কি আপনাকে বেশি আকর্ষণ করেছিল?
আনিসুজ্জামান: না প্রথমে তো পড়েছি গল্প, তারপর কবিতা, উপন্যাস— তারপর সমালোচনা সাহিত্যে আমি মজা পেয়ে গেলাম, এটা বলতে পারি। সমালোচনার বই পড়েও যে আনন্দ আছে সেটা বেশ বুঝেছিলাম। নিজের কাজের সমালোচনা করতে হবে— সেটা পরীক্ষার হলেই হোক আর অন্য যেখানেই হোক।

হামিদ কায়সার: বলছিলেন, বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে আপনার পড়ালেখায় সুশৃঙ্খলতা এসেছিল।
আনিসুজ্জামান: হ্যাঁ, ইউনিভার্সিটিতে এসে  পড়াশোনা খুব সুশৃঙ্খল হলো। এখানে এসে সাহিত্য করছি, খানিকটা ছাত্র আন্দোলন করেছি। কিন্তু আমি যেটা করতে পেরেছিলাম— মোটামুটি রোজকার পড়াটা সেরে ফেলতাম। তার ফলে ঐ যে জমে যাওয়া বা পরীক্ষার আগে টেনশন বা রাত জেগে পড়া— সেটা করতে হতো না। রোজ জেগে আমি অবশ্য স্বাভাবিক নিয়মেই পড়তাম। আমি ‘গোরা’ পড়েছিলাম সন্ধ্যা থেকে শুরু করে ভোর রাত পর্যন্ত, বই শেষ না করে উঠিনি।

হামিদ কায়সার: এক রাতে পড়েই শেষ করে ফেলেছিলেন?
আনিসুজ্জামান: এক রাতেই। প্রতি রাতে আমি নিয়মিত পড়তাম। এটা আমার বেশ কাজেও লেগেছে। এরপর, প্রফেশনে ঢুকে বাধ্য হয়েই নিজেকে তৈরি করা আরম্ভ করলাম। প্রথমে যেটা হলো আমরা কি পড়াব, তা নিজেরা চাইতে পারতাম না। যা অ্যাসাইন করা হতো, তাই পড়াতে হতো। প্রথম দিকে ফার্স্ট ইয়ারে, সেকেন্ড ইয়ারে পড়াতে হতো সাবসিডিয়ারি ক্লাসে। অনার্স আরেকটু পরে। প্রিলিমিনারিতে আমাকে কবিতা পড়াতে হতো। কবিতায় যে বিশেষ আগ্রহ ছিল, তা নয়। ছাত্রজীবনে যেটা ভালো লেগেছে সেটা বারবার পড়েছি। আর পড়াতে গিয়ে নিজের বিষয়ের বাইরে, নিজের পছন্দের বাইরের বইও বারবার পড়তে হতো। পড়ে পড়ে নিজের ভেতরে একটা আগ্রহ তৈরি করে নিতাম— নইলে ছাত্রদের মনে কিভাবে আগ্রহ জাগবে? কাজেই, তখন আনুষাঙ্গিক যা পড়ার, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়তাম।

হামিদ কায়সার: গবেষণাকর্ম কি এ পর্বেই শুরু করেছিলেন?
আনিসুজ্জামান: হ্যাঁ, গবেষণার প্রতি এ সময়েই ঝোঁক হলো। আমি গল্প লিখছি, প্রবন্ধ লিখছি, তখন গবেষণার দিকে একটু ঝুঁকলাম। তার ফল বেরোল সলিমুল্লাহ হল বার্ষিকীতে। ব্যাপারটা অন্যভাবে বলি। সেটা হচ্ছে যে, ইন্টামিডিয়েট পরীক্ষা দিতে যখন বসেছিলাম, তখন আমার মনে হয়েছিল যে, বঙ্কিমচন্দ্র সম্বন্ধে আমাদের সমাজে বিরাগ আছে, এ বিরাগ অনেকখানি না পড়েই বিরাগ। ‘আনন্দমঠ’, যে মুসলমানদের সবচাইতে অপছন্দের বই তা আমি জানতাম, তো আমি ‘আনন্দমঠ’ বিশ্লেষণ করেই একটি প্রবন্ধ লিখলাম। যখন আমি ইউনিভার্সিটিতে ফার্স্ট ইয়ারে পড়ি, তখন পাকিস্তান সাহিত্য সংসদের এক অধিবেশনে প্রবন্ধটা পড়লাম। পুরো অধিবেশনটাই আমার এই প্রবন্ধ নিয়ে। সৈয়দ আলী আহসান সাহেবের আলোচনা করার কথা ছিল, তিনি যান নি। মনসুরউদ্দিন সাহেব ছিলেন এমনিতেই উপস্থিত। উনি এত উত্তেজিত হয়ে গেলেন যে, বললেন, ‘এই ছেলেকে এক্ষুণি পাকিস্তান থেকে বের করে দেওয়া দরকার।’

হামিদ কায়সার: একেবারে পাকিস্তান থেকে?
আনিসুজ্জামান: পাকিস্তান থেকে বের করে দিতে হবে। ওঁরই এক কনিষ্ঠ সহকর্মী ছিলেন হেশামউদ্দিন সাহেব। উনি উঠে বললেন, ‘আমি খুব আনন্দিত হয়েছি যে, ইউনিভার্সিটির ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্র বঙ্কিমচন্দ্রই খালি ভালো করে পড়েনি, কার্ল মার্কস পড়েছে এবং একটি বস্তুবাদী দৃষ্টি থেকে আলোচনা করেছে’ তারপর চিন্তা করলাম, তাহলে এখন মুসলমানদের স্বাতন্ত্র্যসূচক লেখার ওপর প্রবন্ধ লিখতে হয়। একটা প্রবন্ধ লিখলাম খুব খেটেখুটে ‘বাংলা সাহিত্যে মুসলিম পুনর্জাগরণের পটভূমি’। আমরা দু’বছরের সলিমুল্লাহ হল বার্ষিকী একসঙ্গে বের করেছিলাম। সম্পাদক এক বছরে আলাউদ্দিন আল আজাদ, এক বছরে আজহারুল ইসলাম। সহকারী সম্পাদক প্রথম বছরে কবিরউদ্দিন আহমদ— এখন ডেইলী স্টার-এ কবির ইউ আহমদ নামে কলাম লেখেন— উনি আর আমি। আর দ্বিতীয় বছরে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী আর মোজাফফর আহমদ। আমি, সিরাজ আর মোজাফফর এই তিনজন মিলে কাজ শুরু করি। বাকি সম্পাদকদের ঠিকমত পাওয়া গেল না। আমরা ঐ হলের বার্ষিকীকেই সাহিত্য পত্রিকার রূপ দিয়েছিলাম। প্রবন্ধটি সেখানেই ছাপা হয়েছিল। এবং ওটা দেখেই মোহাম্মদ আবদুল হাই সাহেব আমাকে বললেন যে, ‘তুমি গবেষণা করবে? তোমার এ লেখা দেখে মনে হয় যে, তোমার গবেষণা করার প্রবণতা আছে। চিন্তা করো। তোমার তো এম.এ পাস করার আরো দেড় দু’বছর দেরি আছে— মনে মনে তৈরি হও। এম.এ পাস করে গবেষণা করো— তারপর, চাকরি করার সুযোগ পাবে।’ তখন আমি থার্ড ইয়ারের ছাত্র। এই ভাবেই হাই সাহেবের উৎসাহে গবেষণার প্রতি ঝুঁকলাম।

হামিদ কায়সার: সম্প্রতি আপনি কি বই পড়ার অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন?
আনিসুজ্জামান: সাম্প্রতিককালে পড়লাম পল জনসনের ‘ইনটেলেকচুয়ালস’। অষ্টাদশ শতাব্দীর ১০/১২ জন ইনটেলেকচুয়ালের জীবন ও চিন্তাভাবনার পরিচিতি। লেখক চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলেছেন, এই যেসব ইনটেলেকচুয়াল উপদেশ দেয় তাদের জীবনটা খুঁটিয়ে দেখা দরকার— তারা নিজেরা সেসব উপদেশ পালন করে চলেন কিনা। তো, তিনি যে-সমস্ত ইনটেলেকচুয়ালকে বেছে নিয়েছেন তারা সবাই বড় লোক, যেমন : রুশোর কথা বলছেন, তলস্তয় ও রাসেলের কথা বলেছেন। লেখক দেখাচ্ছেন যে, ইনটেলেকচুয়ালরা যা বলছেন তা করছেন না, যা বলছেন তা সব সময়ে বিশ্বাসের জন্য বলছেন না। খুবই ইন্টারেস্টিং বই এটা। ইদানিং পড়লাম, কোন একটা কাজের জন্যে, বাক স্বাধীনতা লেখার স্বাধীনতা সম্পর্কিত কিছু বই, যেমন— এফবিআই ফাইলস অবলম্বনে দুটি বই— বিশিষ্ট লেখকদের সম্পর্কে ওদের ফাইলে কি ছিল— সে বিষয়ে হাবার্ট মিটগাঙের ‘ডেঞ্জারাস ডসিয়ারস’ আর নাটালি রবিনসের ‘এলিয়েন ইনক’। মনস্তত্ত্ববিদ ইয়ুংকে নিয়ে লেখা মরিস ওয়েস্টের পুরনো উপন্যাস ‘দি ওয়ার্ল্ড ইজ মেড অফ প্লাস’। হালে পড়লাম।

হামিদ কায়সার: আগের মতো কি পড়তে পারেন?
আনিসুজ্জামান: এখন পড়ার সময় অনেক কমে গেছে। একটা প্রধান কারণ হচ্ছে, সভা-সমিতির চাপ। এ চাপের পর যে সময়টা থাকে তা যায় কিছু বাধ্যতামূলক লেখা লিখে। ফলে যেমন করে চাই, তেমন করে পড়া হয় না।

৬ নভেম্বর ১৯৯৭, সংবাদ সাময়িকী, দৈনিক সংবাদ