দিন যায় কথা থাকে

পর্ব ১৫

হামিদ কায়সার

প্রকাশিত : ডিসেম্বর ১১, ২০১৮

তারা কেউ গান শুনিয়েছেন। কেউ লিখেছেন হিরন্ময় কবিতা। কেউ আবার গল্প-উপন্যাসের মালা গেঁথে সাজিয়েছেন বাংলা সাহিত্যের ঢালি। কেউ বা নিরলস জ্ঞানচর্চায় যোগ করেছেন বুদ্ধিবৃত্তির নতুন মাত্রা। তাদের সেই দিন আজ আর নেই, কেউ হারিয়ে গেছেন মহাকালে, কেউ বা এক পা বাড়িয়ে রেখেছেন সেই পথে। তবে তাদের কথা আছে; তাদের কর্মে আর সৃজনশীলতায় তো বটেই, আমার কাছেও— কাগজের ভাঁজে ভাঁজে, শব্দগুচ্ছের আড়ালে, বিভিন্ন সময়ে গৃহীত সাক্ষাৎকারে। হয়তো সেই কথাগুলো আবারো জেগে ওঠতে পারে আপনার মননস্পর্শ পেলে। চলুন পাঠ নেয়া যাক

 

বাড়ি ছেড়ে দু-চার দিনের জন্য কোথাও যেতে হলে কাপড়-জামার চাইতেও আমার আগে মনে পড়ে, কী কী বই সঙ্গে নেব তার কথা— কবীর চৌধুরী

 

গুলশানের কোনো বাড়িতে ড্রয়িংরুম শুধু বইয়ে সাজানো, তা কী সাধারণভাবে, কখনো ভাবা যায়? ভাবা যায় না। কিন্তু ড্রয়িংরুমটি যদি হয় সাহিত্য ব্যক্তিত্ব কবীর চৌধুরীর— তখন সেটা স্বাভাবিকই লাগে। কারণ, যেখানে বাগান সেখানে ফুলের সুঘ্রাণ মিলবেই। তাই দরজা খুলে দিয়ে কবীর চৌধুরী যখন সাদর অভ্যর্থনায় ড্রয়িংরুমে ঢোকালেন, তখন মনে প্রশান্তির হাওয়া বয়ে গেল। বিশাল ড্রয়িংরুমের অজস্র বইয়ের সুরভিতে ক্ষীণকাল মন্ত্রমুগ্ধ থাকার পর জানতে চাইলাম, ‘আপনার প্রথম পঠিত বই কোনটি। বইটি পড়ার স্মৃতি কি মনে আছে?` প্রিয় প্রসঙ্গ যে তা তার কণ্ঠস্বরেই বোঝা গেল। কবীর চৌধুরী সরব  হয়ে উঠলেন—

কবীর চৌধুরী: ঠিক কোন বইটি যে প্রথম পড়েছিলাম তা মনে নেই, তবে যে বইটির কথা মনে আছে, সেটা আমার হাতে আসার ব্যাপারটি বেশ কৌতূহলোদ্দীপক। তখন আমি স্কুলের ছাত্র, ক্লাস নাইনে পড়ি। ১৯৩৭ সালের কথা। পাশের বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে একটা বই হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করছিলাম। দু-এক পাতা পড়ে ভীষণ ভালো লাগলো। বইয়ের সামনের দু-তিন পাতা নেই। লেখকের নাম জানার উপায় ছিলো না। বইটি নিজের বাড়িতে নিয়ে এসে মুগ্ধ হয়ে প্রায় এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেলি। পরে আবিষ্কার করি যে বইটি ‘অপরাজিত’ যার লেখক বাংলা কথাসাহিত্যের অবিস্মরণীয় পুরুষ বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। পরবর্তী সময়ে তার প্রায় সব লেখা গভীর আগ্রহ এবং তৃপ্তি নিয়ে পড়েছি। তার ছোটগল্প পুঁইমাচা এখনো আমাকে আলোড়িত করে।

হামিদ কায়সার: শৈশবে আপনার বই পড়ার পারিবারিক এবং সামাজিক পরিবেশটি কেমন ছিল?
কবীর চৌধুরী: চমৎকার। বাবা ছিলেন সরকারি আমলা; কিন্তু ব্যতিক্রমী চরিত্রের। পড়তে ভালোবাসতেন, পড়াতেও। স্কুল জীবনেই বাড়িতে এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা দেখেছি। এখনো আছে আমার কাছে। ১৯১১ সালের সংস্করণ। অনেক কিছু তাতে নেই, কিন্তু সেটার আলাদা মূল্য আছে। আর পুরনো প্রসঙ্গে তো তথ্যের তেমন হেরফেরও হয়নি। সামাজিক পরিবেশ বই পড়ার অনুকূল ছিলো। পাড়ায় লাইব্রেরি ছিলো, স্কুলেও ছিলো। বই নিয়ে গল্প-আলাপ হতো। কিশোরদের পত্রপত্রিকা— মৌচাক, রংমশাল-এ প্রকাশিত রচনা নিয়ে আলোচনায় অনেক উজ্জ্বল মুহূর্ত কেটেছে।

হামিদ কায়সার: বই পড়ার নেশা ছিল না? থাকলে কিভাবে বই পেতেন?
কবীর চৌধুরী: হ্যাঁ। স্কুল-কলেজ জীবনে পড়ার বইয়ের পাশাপাশি গল্প-উপন্যাস পড়া একটা প্রবল নেশায় পরিণত হয়েছিল। ইংরেজি ও বাংলা দু’ভাষার বই-ই। রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস ছাড়াও তখন ব্দ্ধুদেব বসু, প্রেমেন্দ্র মিত্র, তারাশঙ্করের উপন্যাস ও গল্প এবং ত্রিশের দশকের আধুনিক বাংলা কবিতার প্রতি গভীরভাবে আকৃষ্ট হই। আরেকটি বিষয়ও ভীষণ আকর্ষণ করে সেই সময়। তা হল রহস্য কাহিনী। হেমেন্দ্র কুমার রায়, মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য, ভট্টাচার্যই বোধহয়, যার ডিটেকটিভ নায়ক ছিল জাপানি হুকাকাশি, ব্যোমকেশ বক্সির স্রষ্টা শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়— এদের লেখা গোগ্রাসে গিলতাম। ইংরেজি রহস্য কাহিনিও প্রচুর পড়েছি। এখনো মাঝে মাঝে পড়ি। কোনাল ডয়েল, আগাথা ক্রিস্টি, ডরোথি এল সেয়ার্স, রেক্স স্টাউটসহ বেশ কয়েকজন রহস্য রোমাঞ্চ কাহিনির লেখক আমার অনেক সময় আনন্দ-উত্তেজনায় পূর্ণ করেছেন।

হামিদ কায়সার: বেড়ে উঠার সঙ্গে সঙ্গে যে-সব বই পাঠ করেছেন, সে-সব বই সম্পর্কে আপনার কাছে কিছু জানতে চাই।
কবীর চৌধুরী: নানা দেশের এবং ইংরেজি ও বাংলা অনুবাদের মাধ্যমে নানা ভাষার বই পড়তে শুরু করি চল্লিশের দশকের প্রথম দিক থেকেই। নানা শাখারও। কবিতার ক্ষেত্রে বোদলেয়ার, ওমর খৈয়াম, পুশকিন, ওয়াল্ট হুইটম্যান, কথাসাহিত্যের ক্ষেত্রে ম্যাক্সিম গোর্কি, দস্তয়েভস্কি, তলস্তোয়, রোমা রল্যাঁ, টমাস মান, নাটকের ক্ষেত্রে চেখভ, ইবসেন, স্ট্রিন্ডবার্গ প্রমুখের রচনা আগ্রহ নিয়ে পড়ি তখন। সে ধারা এখনো অব্যাহত আছে। তার সঙ্গে এখন যুক্ত হয়েছে লাতিন আমেরিকান, নাইজেরিয়া, মিসর ও অন্যান্য দেশের সাহিত্যকর্ম পাঠের আগ্রহ। নগীব মাহফুজের কায়রো ট্রিলজি, বিশেষ করে প্রথম খণ্ড, চমৎকার লেগেছে। মার্কেজের লাভ ইন দি টাইম অব কলেরা, এককথায়, অনবদ্য। চিনুয়া আচেবের উপন্যাস, ওল সোয়িঙ্কার নাটক মনকে নাড়া দেয়।

হামিদ কায়সার: আপনার লেখালেখির পেছনে কি বই পড়ার কোনো ভূমিকা আছে?
কবীর চৌধুরী: পড়তে পড়তেই লেখার প্রতি আগ্রহ জেগেছে। চল্লিশের দশকের শেষদিকে অনেকগুলো নাটক পড়ে ফেলি, ইংরেজি ও মার্কিন নাটক এবং ইংরেজিতে অনূদিত কয়েকটি ভিনদেশী নাটক। আদর্শ হিসেবে সমাজতন্ত্রে আকৃষ্ট হই। মার্কিন নাট্যকার ক্লিফোর্ড ওডেটস্-এর ওয়েটিং ফর লেফটি এবং লিলিয়ান হেলম্যানের ওয়াচ অন দি রাইন বাংলায় রূপান্তরিত করার জন্যে মনের মধ্যে ভীষণ একটা প্রেরণা অনুভব করি। প্রথমে আহ্বান এবং পরে শহীদের প্রতীক্ষায় নাম দিয়ে ওডেটস-এর নাটকটি বাংলায় রূপান্তরিত করি, অনুবাদ নয়, অ্যাডাপ্টেশন। জীবনের গভীরে যে দ্বান্দ্বিকতা বিরাজ করে তার রূপায়ণ, প্রতিবাদী চেতনা, মানুষের মনের বিচিত্র রহস্যময় গতিপ্রকৃতি, ভাষার কারুকাজ— এসব যে জাতীয় রচনায় আছে তাতে আকৃষ্ট হয়ে তার বাংলা রূপান্তর বা অনুবাদকর্মে ব্রতী হবার অনুপ্রেরণা পাই। এরই ফলে অনুবাদ করি জ্যাক লন্ডনের সী উলফ, রবার্ট পেন ওয়ারেনের অল দি কিংস মেন, স্টাইনবেকের গ্রেপস অব র‌্যথ, ইউজিন ও’নীলের লঙ্গ ডেজ জার্নি ইন টু নাইট, বুলগেরীয় কবি ভাৎসারোভের একটি কাব্যগ্রন্থ, ব্রেশটের মাদার কারেজ অ্যান্ড হার চিলড্রেন, আইরিশ নাট্যকার সিঙ্গের রাইডার্স টু দি সী এবং আরো বেশ কিছু নাটক-উপন্যাস-কবিতা অনুবাদ করে ফেলি। একই প্রেরণা থেকে আমাদের বাংলা ভাষার কিছু সাহিত্য-কর্মও আমি ইংরেজিতে অনুবাদ করি। যেমন, শওকত ওসমানের ক্রীতদাসের হাসি, আনোয়ার পাশার রাইফেল রোটি আওরাত, মুনীর চৌধুরীর কবর, সেলিনা হোসেনের নীল ময়ুরের যৌবন এবং শামসুর রাহমান ও আবুল হোসেনের কবিতাবলি। আমার লেখালেখির ব্যাপারে অনুজ মুনীর চৌধুরীর উৎসাহ ও প্রেরণা একটা বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে। ইউজিন ও’নীলের অসামান্য নাটক লং ডেজ জার্নি ইন টু নাইট বাংলায় অনুবাদ করার জন্য মুনীর চৌধুরীই আমাকে বিশেষভাবে উৎসাহিত করেছিলেন। সমুদ্রের স্বাদ নামে জ্যাক লন্ডন-এর সী উলফ উপন্যাসের আমার করা বাংলা অনুবাদ সম্পর্কে মুনীর ঢাকার বেতার থেকে একটি গভীর বিশ্লেষণমূলক সপ্রশংস কথিকা প্রচার করেছিল, যা থেকে আমার লেখার কাজে আমি প্রভূত অনুপ্রেরণা পাই।

হামিদ কায়সার: আপনি কি বেছে বেছে বই পড়েন?
কবীর চৌধুরী: বেশ কিছুকাল ধরেই বেছে বেছে পড়ছি। এ ছাড়া উপায় নেই। আমার ঝোঁক তো নানাদিকে। তার উপর সাড়াজাগানো বইও তো কম প্রকাশিত হচ্ছে না। ইতিহাসভিত্তিক নাটক ও উপন্যাস এবং শিল্প-সাহিত্যের জগতের প্রখ্যাত ব্যক্তিদের জীবন ও কর্মকে ভিত্তি করে রচিত কথাসাহিত্য, মিশিমা ও কিনজাবুরো ওয়ের মতো লেখকদের বই, দারিয়া ফো-র নাটক, সিম্ব্রোসকায়ার কবিতা খুঁজে পেলে সংগ্রহ করে পড়ি।

হামিদ কায়সার: আপনার প্রিয় বই এবং প্রিয় লেখক সম্বন্ধে জানতে চাচ্ছি।
কবীর চৌধুরী: বেশ কয়েকজন এবং বেশ কয়েকটি। রবীন্দ্রনাথের গোরা ও চতুরঙ্গ, শরৎচন্দ্রের শ্রীকান্ত, তলস্তোয়ের যুদ্ধ এবং শান্তি ও আনা কারেনিনা, রোমা রল্যাঁর জাঁ ক্রিস্তফ, সমারসেট মম-এর কেকস অ্যান্ড এইল, কাহলিল জিবরানের দি প্রফেট, শামসুর রাহমানের কবিতাসমগ্র, মুনীর চৌধুরীর কবর— কয়েকটি নাম করলাম, আরো আছে।

হামিদ কায়সার: চিত্রকলার প্রতি আপনার দুর্বলতা লক্ষণীয়। চিত্রকলার প্রতি আপনার আগ্রহ কীভাবে জন্মে, এ বিষয়ক বই পাঠের অভিজ্ঞতা জানালে ভালো হয়।
কবীর চৌধুরী: বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় ইংরেজি সাহিত্যের সূত্র ধরে চিত্রকলার প্রতি আগ্রহ জন্মে। রেনেসাঁ সম্পর্কে পড়াশোনা করতে গিয়ে রাফায়েল, মাইকেল এঞ্জেলো, লিওনার্দো দা ভিঞ্চি, বত্তিচেল্লি সম্পর্কে কৌতূহলী হই, তাদের জীবন ও চিত্রকর্ম নিয়ে কিছু বইপত্র পড়ি, তাদের ছবির প্রিন্ট দেখি। পরে অবশ্য বিশ্বের নানা চিত্রশালায় তাদের এবং আরো বহু বিশ্বনন্দিত শিল্পীদের কাজ মূলে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। ইংরেজি সাহিত্যের সূত্র ধরেই এক সময় ব্লেক, ওয়াল্টার পেটার, রাস্কিন, রগেটি প্রমুখের রচনার মাধ্যমে চিত্রকলার প্রতি আগ্রহ আরো বৃদ্ধি পায়। হার্বাট রীড, কেনেথ ক্লার্ক, এরিখ নিউটনসহ আরো অনেক চিত্রকলা সমালোচক ও বিশেষজ্ঞদের বই পড়ে ফেলি। তাছাড়া কয়েকজন অবিস্মরণীয় চিত্রশিল্পীর জীবন নিয়ে লেখা কতিপয় উপন্যাস পড়ার স্মৃতি আজো অম্লান হয়ে আছে, যেমন মিকেল এঞ্জেলোর জীবন নিয়ে লেখা অ্যাগনি অ্যান্ড ইকস্ট্যাসি, পিসারোর জীবন নিয়ে লেখা ডেপথস্ অব গ্লোরি, গয়্যার জীবন নিয়ে লেখা দিস ইজ দি আওয়ার, ভ্যানগগের জীবন নিয়ে লেখা লাস্ট ফর লাইফ, তুলোজ লত্রেকের জীবন নিয়ে লেখা মূল্যাঁ রুজ, গগ্যাঁর জীবন নিয়ে লেখা দি মুন অ্যান্ড সিক্স পেন্স। ভাস্কর রদ্যার জীবন নিয়ে লেখা নেকেড কেইম আই-এর নামও এ প্রসঙ্গে অবশ্য উল্লেখনীয়। ভাস্কর্য ও চিত্রকলার সঙ্গে সম্পর্কিত নানা বইপত্র পড়ার ভিত্তিতেই আমি রচনা করেছি আমার ফরাসী চিত্রশিল্পীদের কথা এবং রেমব্রাই— ভালাসুকুয়েজ— রুবেনস্, রদ্যাঁ এবং পিকাসো নামের তিনটি গ্রন্থ। বতিচেল্লির উপর লেখা একটি বইও শিগগিরই প্রকাশিত হবে। এই মুহূর্তে লিখছি গয়্যার উপর একটি বই। চিত্রকলা বিষয়ক গ্রন্থাদি পাঠক হিসেবে আমাকে যেমন তৃপ্তি দিয়েছে, তেমনি লেখক হতেও অনুপ্রাণিত করেছে।

হামিদ কায়সার: এমন কোনো বই কি রয়েছে, যা আপনি বারবার পড়েন?
কবীর চৌধুরী: হ্যাঁ, আছে। তিনটি বই-এর নাম করছি। রোমা রল্যাঁর জাঁ ক্রিস্তফ, রবীন্দ্রনাথের গোরা, কাহলিল জিবরানের দি প্রফেট।

হামিদ কায়সার: আপনার পূর্ববর্তী ও সমসাময়িক বাংলাদেশি লেখকদেও লেখা কি পড়েন— তাদের সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কি?
কবীর চৌধুরী: আগ্রহ ও উৎসাহ নিয়ে পড়তাম। শত্তকত ওসমানের ছোটগল্প, শামসুদ্দীন আবুল কালাম, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, সরদার জয়েনউদ্দিন, আবু জাফর শামসুদ্দীন— এদের লেখা গল্প, উপন্যাস, আবুল হোসেন, আবদুল গনি হাজারী, সিকান্দার আবু জাফর প্রমুখের কবিতা নিয়মিত পড়তাম। এদের সবার লেখাই প্রশংসনীয় মানের।

হামিদ কায়সার: আর পরবর্তী প্রজন্মের লেখকদের মধ্যে কাদের লেখা আপনার মনোযোগ আকর্ষণ করেছে?
কবীর চৌধুরী: আমার পরবর্তী প্রজন্মের লেখকদের মধ্যে কথাসাহিত্যেও অঙ্গনে হাসান আজিজুল হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, সেলিনা হোসেন, শত্তকত আলী এবং তারও পরের লেখকদের মধ্যে মঈনুল আহসান সাবের, মঞ্জু সরকার, হুমায়ূন আহমেদ, ইমদাদুল হক মিলন এবং কবিতার ক্ষেত্রে মোহাম্মদ রফিক, রফিক আজাদ, নির্মলেন্দু গুণ, মহাদেব সাহা, কাব্যনাটকের ক্ষেত্রে সৈয়দ শামসুল হক প্রমুখকে আমি উচ্চ মূল্যায়ন করি। এর বাইরেও আরো কয়েকজন আছেন, সবার নাম এ মুহূর্তে মনে পড়ছে না।

হামিদ কায়সার: পশ্চিম বঙ্গের লেখকদের মধ্যে ভালো লাগে কার কার লেখা?
কবীর চৌধুরী: অন্নদাশঙ্কর রায়, দেবেশ রায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, সমরেশ মজুমদার, সমরেশ বসু, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়, নবনীতা দেবসেন, অরুণ মিত্র, শক্তি চট্টোপ্যাধ্যায় প্রমুখ আমার প্রিয় লেখক। এদের রচনা আমি সর্বদা সাগ্রহে পড়ি।

হামিদ কায়সার: ভারতে সাম্প্রতিককালে ইংরেজিতে উপন্যাস লেখালেখি হচ্ছে— এক্ষেত্রে আপনার পাঠাভিজ্ঞতা জানালে ভালো হয়।
কবীর চৌধুরী: চমৎকার লিখছেন কয়েকজন। বিক্রম শেঠ, সালমান রুশদি, উপমন্যু চ্যাটার্জি, অমিতাভ ঘোষ, ভারতী মুখার্জি, অরুন্ধতী রায় এবং এদের অগ্রজ আর কে নারায়ণ নিঃসন্দেহে ভালো লেখক। অরুন্ধতী রায়ের ‘ক্ষুদ্র বিষয়সমূহের ঈশ্বর’ অসামান্য এক সৃষ্টি। আমি ওই উপন্যাসটির উপর একটি বড় আলোচনা লিখেছি। ত্রৈমাসিক সুন্দরম পত্রিকায় আগামী সংখ্যায় তা প্রকাশিত হবে। সালমান রুশদির মিডনাইটস চিলড্রেন ও বিক্রম শেঠ-এর এ স্যুটেবল বয় অভিনন্দনযোগ্য সাহিত্যকর্ম।

হামিদ কায়সার: সম্প্রতি কি বই পড়ছেন? পড়াশোনা কি মনের মতো করতে পারেন?
কবীর চৌধুরী: আমি একসঙ্গে একাধিক বই পড়ি। দীর্ঘ দিনের স্বভাব এটা। অর্ধপঠিত বই দু-তিন দিন পর আবার হাতে তুলে নিলে খেই ধরতে কোনো অসুবিধা হয় না। পেজ মার্ক দিই না আমি বইয়ে। পাতা খুঁজে বার করতে কোনো কষ্ট হয় না তার জন্য। এখন পড়ছি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রথম আলো। ভালো লাগছে। রবীন্দ্রনাথ-কাদম্বরীর সম্পর্কের বিষয়টি সুনীল কীভাবে তুলে ধরেন তা দেখার জন্য উৎসুক ছিলাম। লেখক দক্ষতার সঙ্গে সে কাজটি করেছেন। আমার জানতে ইচ্ছা করে কাদম্বরীর আত্মহত্যার নিকট প্রেক্ষাপট লেখক যেভাবে নির্মাণ করেছেন তা কতটুকু বাস্তব তথ্যভিত্তিক। অবশ্য যদি সেটা খুব বেশি নাও হয় তাতেও মহাভারত অশুদ্ধ হবে না। উপন্যাসের বাস্তবতায় ভিন্ন সংজ্ঞা আছে। আরো দুটো বই পড়ছি। একটা হলো মাইকেল ওন্দাতইয়ের দি ইংলিশ পেশেন্ট। অনেকদিন ধরে নাম শোনা ছিলো, যোগাড়ও করে রেখেছিলাম, কিন্তু পড়া হয়নি। খুবই ভালো লাগছে পড়তে। নতুন ধরনের। আর পড়ছি একটি বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী। নাম দি ডিমলিশ্ড্ ম্যান লেখক আলফ্রেড বেস্টার। এ জাতীয় বইয়ের ভিন্ন ধরনের আকর্ষণ আছে। আসিমভের সায়েন্স ফিকশন আমার খুব প্রিয়। বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর লেখক হিসেবে বেস্টার বেশ খ্যাতি অর্জন করেন। ১৯৮৭ সালে মৃত্যুর পূর্বে তিনি অ্যামেরিকায় সায়েন্স ফিকশন অ্যান্ড ফ্যান্টাসি রাইটারস্-এর গ্র্যান্ড মাস্টার অ্যাওয়ার্ডে ভূষিত হন। দি ডিমলিশ্ড ম্যাক পড়তে ভালোই লাগছে। অনেক কথা বললাম। আগে তো ছিলোই, এখনো বই পড়াই আমার প্রধান নেশা। বাড়ি ছেড়ে দু-চার দিনের জন্য কোথাও যেতে হলে কাপড়-জামার চাইতেও আমার আগে মনে পড়ে কী কী বই সঙ্গে নেবো তার কথা।  

২৭ নভেম্বর ১৯৯৭, সংবাদ সাময়িকী, দৈনিক সংবাদ