দিন যায় কথা থাকে

পর্ব ১৬

হামিদ কায়সার

প্রকাশিত : ডিসেম্বর ১৭, ২০১৮

তারা কেউ গান শুনিয়েছেন। কেউ লিখেছেন হিরন্ময় কবিতা। কেউ আবার গল্প-উপন্যাসের মালা গেঁথে সাজিয়েছেন বাংলা সাহিত্যের ঢালি। কেউ বা নিরলস জ্ঞানচর্চায় যোগ করেছেন বুদ্ধিবৃত্তির নতুন মাত্রা। তাদের সেই দিন আজ আর নেই, কেউ হারিয়ে গেছেন মহাকালে, কেউ বা এক পা বাড়িয়ে রেখেছেন সেই পথে। তবে তাদের কথা আছে; তাদের কর্মে আর সৃজনশীলতায় তো বটেই, আমার কাছেও— কাগজের ভাঁজে ভাঁজে, শব্দগুচ্ছের আড়ালে, বিভিন্ন সময়ে গৃহীত সাক্ষাৎকারে। হয়তো সেই কথাগুলো আবারো জেগে ওঠতে পারে আপনার মননস্পর্শ পেলে। চলুন পাঠ নেয়া যাক

ছোটবেলা থেকেই বিজ্ঞানভিত্তিক বই পড়তে আমার ভালো লাগতো এবং এ ধরনের বই পেলে লুফে নিতাম। স্কুলে তখন নানা উপলক্ষে যেমন খেলাধুলা, ভালো রেজাল্টের কারণে প্রাইজ হিসেবে বই পেতাম। একবার মনে আছে, উড়োজাহাজ আবিষ্কারের উপর একটি বই পেয়েছিলাম— জহুরুল হক


এই ব্যাপক কবিতা চর্চার দেশে, যে ক’জন হাতে গোনা ব্যক্তিত্ব বিজ্ঞান-চর্চায় ব্রতী হয়েছেন এবং বিজ্ঞানের চেতনা অন্যান্যদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন তাদের মধ্যে জহুরুল হক অন্যতম একজন। কিন্তু বিজ্ঞানী হলে কি হবে, তিনি ভেতরে ভেতরে প্রবল সাহিত্য-অনুরক্ত। বিজ্ঞানের বইয়ের মতোই সমান আগ্রহ নিয়েই সারাজীবন পাঠ করেছেন কবিতা, গল্প, উপন্যাস।

এই বই-পিপাসু মানুষটির কাছে প্রথমেই জানতে চাইলাম, ‘সম্প্রতি আপনি কি বই পড়েছেন?’
জহুরুল হক: অরুন্ধুতি রায়ের ‘গড অব স্মল থিংস।’

হামিদ কায়সার: এ বইটা কেন পড়লেন?
জহুরুল হক: চারিদিকে এত হৈ চৈ দেখে ভাবলাম পড়ে দেখি। তবে বইটি আমার খুব ভালো লাগেনি। অনেকটা দায়িত্বহীন লেখা মনে হয়েছে আমার কাছে। প্রথম দিকে তো শুধু কথার খেলা, অসংবদ্ধতা। আর পড়লাম সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘প্রথম আলো’ দ্বিতীয় খণ্ড।

হামিদ কায়সার: কেমন লেগেছে পড়ে?
জহুরুল হক: সুনীলের এটার কোনো কোনো অংশ খুবই ভাল। ঐতিহাসিক অনেক চরিত্রই পাওয়া যায় এ উপন্যাসে— যারা এক সময়ে এদেশে সমাজসেবায় জড়িত ছিলেন, তাদেরকে বেশ অন্তরঙ্গভাবে পাওয়া যাচ্ছে।

হামিদ কায়সার: কি ধরনের বই পড়তে আপনার ভালো লাগে?
জহুরুল হক: বিজ্ঞানের বই পড়ি। আত্মজীবনী জাতীয় বই ভালো লাগে। সমাজ, রাজনীতি, দর্শন— এসব বই পড়তেও ভালো লাগে। যে বইয়ের মধ্যে সমাজবাস্তবতা আছে— মানুষকে, এই জগৎকে জানবার পথ আছে— সে বই-ই পড়তে ভালো লাগে। তা সেটা উপন্যাসই হোক আর দর্শন-শাস্ত্রই হোক।

হামিদ কায়সার: বই পড়ার অভ্যাসটাতো গড়ে উঠেছিল ছোটবেলা থেকেই।
জহুরুল হক: হ্যাঁ, ছোটবেলা থেকেই। আমাদের ফ্যামিলিতে সাহিত্যচর্চা ছিল। আমার বড় চাচা নাটক লিখতেন। আমার এক দূর-সম্পর্কীয় চাচাও নাটকের চর্চা করতেন— তিনি গ্রামের নাটক পরিচালনা করতেন। তাছাড়া আমার বাবা লিখতেন না বটে, কিন্তু সৃজনশীল সাহিত্যের প্রতি তার ঝোঁক ছিল প্রচণ্ড। তিনি নিয়মিত পড়তেন। মনে আছে, আমি যখন ক্লাস ফোরে পড়ি, বাবা আমাকে ‘শিশুসাথী’ পত্রিকার গ্রাহক করে দিয়েছিলেন। সেটা বাবা আমার চেয়ে বেশি আগ্রহ নিয়ে পড়তেন, বিশেষ করে ধাঁ-ধাঁর উত্তরগুলো বের করার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠতেন— ধাঁ-ধাঁ নিয়ে আমাদের সাথে ডিসকাসও করতেন। মার-ও ছিল বই পড়ার নেশা। মা-র শিশুকালে পড়া বই-ও আমি পেয়েছি এবং পড়েছি। আর আমাদের স্কুলের লাইব্রেরিতেও প্রচুর বই ছিল।

হামিদ কায়সার: কেমন জায়গায় ছিল স্কুলটা?
জহুরুল হক: চাঁপাইনবাবগঞ্জ, আমার জন্মস্থানে। সে লাইব্রেরিতে প্রচুর বইয়ের সংগ্রহ ছিল। দেখতেও ভালো লাগত। আমি যে সব বই বুঝতাম তা না। বুঝলেও নিতাম, না বুঝলেও নিতাম।

হামিদ কায়সার: আপনার ভেতরে বৈজ্ঞানিক মানস গড়ে উঠলো কিভাবে? এখানে কি বই পড়ার কোনো অবদান আছে?
জহুরুল হক: প্রত্যক্ষভাবে আছে কিনা তা বলতে পারব না; তবে ছোটবেলা থেকেই বিজ্ঞানভিত্তিক বই পড়তে আমার ভালো লাগতো এবং এ ধরনের বই পেলে লুফে নিতাম। স্কুলে তখন নানা উপলক্ষে যেমন খেলাধুলা, ভালো রেজাল্টের কারণে প্রাইজ হিসেবে বই পেতাম। একবার মনে আছে উড়োজাহাজ আবিষ্কারের উপর একটি বই পেয়েছিলাম— তখন সেটা মন্ত্রমুগ্ধের মতো পড়েছি। সে সময়েই, পড়েছি জগদানন্দ রায়ের ‘নক্ষত্র পরিচয়’। বার্ষিকীগুলোতেও বিজ্ঞান-এর উপর অনেক কিছু পড়ার সুযোগ হয়েছে। বিশেষ করে, তখন সে বয়সে বিজ্ঞানের কল্পকাহিনী পড়তে ভালো লাগত। এখন কিন্তু বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী পড়তে আমি একদমই পছন্দ করি না।  

হামিদ কায়সার: কারণ?
জহুরুল হক: আসল বিজ্ঞানকাহিনী পড়ি। সেটাতেই যথেষ্ট বিস্ময় আছে। কল্পকাহিনীগুলোকে বরঞ্চ অবাস্তব মনে হয়। ছোটবেলায় বিজ্ঞানের উপর আরেকটি ভালো বই পড়ার সুযোগ আমার হয়েছিল— পরবর্তীকালে এ বইটা আমাকে খুব প্রভাবিত করেছে।

হামিদ কায়সার: বইটার নাম?
জহুরুল হক: Discovery। নামকরা এক বিজ্ঞানী লর্ড ক্যালভিনের লেখা। মামার পুরনো বই ঘাটতে ঘাটতে বইটা আমার হাতে এসে গিয়েছিল। বইটা পেয়েছিলাম ছেঁড়া অবস্থায়। পরে আমি ভালো করে বাঁধিয়ে নিয়েছি। এখনো মাঝে মাঝেই বইটি আমি পড়ে থাকি।

হামিদ কায়সার: পুরনো পড়া বই-ও তাহলে পড়েন?
জহুরুল হক: পুরনো অনেক বই-ই আছে, যা বারবার পড়ি। প্রতিবারই পড়তে ভালো লাগে। তাছাড়া আজকাল নামকরা ইংরেজি বইয়ের যা দাম— নতুন বই বেশি যোগাড়ও করতে পারি না।

হামিদ কায়সার: আপনার এই বারবার পড়া বইগুলো সম্পর্কে কৌতূহল হচ্ছে।
জহুরুল হক: অনেক বই-ই আছে। রোমারোলার ‘জা ক্রিস্তফ’, টলস্টয়ের ‘রেজারেকশন’। ভালো প্রবন্ধের বই এমারসনের ‘ESSAYS’ থরোর ‘ওয়ালডেন’। ‘ওয়ালডেন’ বইটাতো খুবই বিখ্যাত। ‘ওয়ালডন’ একটি পুকুরের নাম। মহাত্মা গান্ধীও বইটা পড়ে খুব প্রভাবিত হয়েছিলেন।

হামিদ কায়সার: সাহিত্যের বইয়ের প্রতিও তো দেখছি আপনার সমান আকর্ষণ।
জহুরুল হক: হ্যাঁ, উপন্যাস পড়তে আমার খুবই ভালো লাগে। উপন্যাস আমি বলা যায়, পাঠ্যপুস্তকের মতোই পড়ি, বিশেষ করে সামাজিক বাস্তবতা যেসব লেখায় খুঁজে পাই। মানিকের ‘পদ্মা নদীর মাঝি’, শরৎচন্দ্রের ‘চরিত্রহীন’, ‘গৃহদাহ’ আমি বারবার পড়েছি। এসব বইয়ের মানুষকে বোঝার চেষ্টা রয়েছে।

হামিদ কায়সার: দেশ-বিদেশে আপনার প্রিয় ঔপন্যাসিক কে?
জহুরুল হক: সে অর্থে প্রিয় তো অনেকেই—  উপন্যাস, গল্প, প্রবন্ধের অনেকেরটাই ভালো লাগে। এ মুহূর্তে বিদেশী লেখকদের মধ্যে নাম মনে পড়ছে ডিএইচ লরেন্স, ওর ‘সান সান’ বইটা আমার খুব প্রিয়। তারপর ‘রোমারোলা’, স্টেইনবাক।

হামিদ কায়সার: বাংলা সাহিত্যে?
জহুরুল হক: আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, মানিক বন্দোপাধ্যায়। শরৎচন্দ্র তো বটেই। শরৎ আমি বারবারই পড়ি। সাম্প্রতিকদের মধ্যে ভালো লাগে সৈয়দ শামসুল হক, বিপ্রদাশ বড়ুয়া, মঞ্জু সরকারের লেখা।

হামিদ কায়সার: তরুণদের মধ্যে কার লেখা ভালো লাগে
জহুরুল হক: আমি মঞ্জু সরকার পর্যন্তই পড়েছি

হামিদ কায়সার: কবিতা পড়তে কেমন লাগে?
জহুরুল হক: ভালো লাগে। কবিতা পেলেই আমি পড়ি। সব সময় বুঝতে পারি না। তবু, পেলেই পড়ি। ভালো লাগে শামসুর রাহমান, মহাদেব সাহার কবিতা, ও, হ্যাঁ-রামেন্দুসুন্দর ত্রিবেদীর নামটা বলতে ভুলে গেছি। রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধগুলো আমার খুবই প্রিয়।

হামিদ কায়সার: বাংলাদেশের বিজ্ঞানভিত্তিক লেখা সম্পর্কে আপনার কি মূল্যায়ন?
জহুরুল হক: বাংলা ভাষায় সে অর্থে বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ খুব বেশি লেখা হয়নি। আমাদের এখানে তো দু’একজন সেই পুরনো লেখক ছাড়া এ বিষয়ে আর কারো লেখা চোখে পড়ছে না। আবদুল্লাহ আল মুতী শরফুদ্দিন, আলী আসগর, হারুনুর রশীদ প্রমুখই বিজ্ঞানভিত্তিক লেখাগুলো লিখেছেন এবং তারাই এক্ষেত্রে সক্রিয়।

হামিদ কায়সার: আপনার শৈশব-কৈশোরের বিজ্ঞানভিত্তিক পড়াশোনার অভিজ্ঞতার কথা জেনেছি। কিন্তু পরবর্তীকালের প্রসঙ্গ এখনো অজ্ঞাত রয়ে গেল।
জহুরুল হক: এখন আমি বিজ্ঞানের সামাজিক দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গির উপর লেখাগুলো পড়তে পছন্দ করি। আমার পড়ার অভিজ্ঞতায় যে সমস্ত বিজ্ঞানের বই রয়েছে, তাৎক্ষণিকভাবে এখন মনে পড়ছে রেনে দুভে’র সেলিব্রেশন অফ দ্য লাইফ। এটি আমার খুব প্রিয় বই। রেনে দুভে ফরাসী হলেও আমেরিকায় বসবাস করেছেন, বলা যায় সেখানকারই মানুষ। স্টিফেন হকিং-এর ‘ব্রিফ হিস্টরি অফ এ টাইম’ পড়েও গভীর আনন্দ পেয়েছি। সম্প্রতি মারা গেলেন কার্ল সাগান (এস্টনমি)। তার ‘কসমস’সহ অন্য বইগুলোও আমার প্রিয়। কার্ল সাগান আমার পছন্দের লেখক এ কারণে, মানুষের জীবন, জীবনের অস্তিত্ব—  বিশেষ করে প্রাণের আবিষ্কার সম্পর্কে যুক্তিগ্রাহী বিশ্লেষণ প্রদান করে গেছেন। এরা ছাড়াও প্রিয় বিজ্ঞানের লেখকগণ হলেন জুলিয়ান হাক্সলি, হোয়াইটেড, জে বি এস হালড্রেন প্রমুখ। এ প্রসঙ্গে একটু বলতে হচ্ছে; এ ধরনের বইয়ের স্বাদ এবং আনন্দরস যাতে অন্যরাও পায় সেজন্য আমি অনুবাদও করে থাকি। সম্প্রতি বিখ্যাত কয়েকজন বিজ্ঞানীর লেখার সংকলন নিয়ে বেরিয়েছে আমার ‘বিশ শতকের ভাবনা’ নামের একটি বই। আমার উদ্দেশ্য হলো, এদেশের মানুষকে বিজ্ঞানমনস্ক করা। অর্থকড়ির বিদ্যা-বিজ্ঞান নয়, মানসিক গঠন হিসেবে বিজ্ঞানের চেতনাকে বিকাশ করতে চেষ্টা করি। সে জন্যই বলছি, বই পড়ার বিকল্প নেই।

হামিদ কায়সার: কিন্তু এখনতো বিজ্ঞানের পরম উৎকর্ষই বই পড়ার ব্যাপারটিকে হুমকির সম্মুখীন করে দিয়েছে—  
জহুরুল হক: বইয়ের আবেদন চিরকালই থাকবে। ইলেকট্রনিক্স মিডিয়া কখনই বইয়ের জায়গা দখল করে নিতে পারবে না। মিডিয়ার ছবি সঙ্গে সঙ্গেই হারিয়ে যায় মুছে যায়। কিন্তু বই হাতে থেকেই যায়। আবারও ভিন্ন মনোযোগ দিয়ে বইয়ের রস আহরণের সুযোগ থাকে এবং তা একেবারে নিজের মতো করে— এমন সুবিধা ইলেকট্রনিক্স মিডিয়া আমাকে কখনই দেবে না। ইলেকট্রনিক্স মিডিয়া তো আমাকে একেবারেই টানে না, আমি শুধু তথ্যমূলক অনুষ্ঠানগুলো সময় পেলে দেখি, যেমন বিবিসি, আগে দেখতাম ‘ডিসকভারি’।

হামিদ কায়সার: আপনি বলেছেন, ‘আত্মজীবনী’ পড়তেও ভালো লাগে’—  এ প্রসঙ্গে আপনার পাঠ-অভিজ্ঞতা জানতে চাই।
জহুরুল হক: আসলে ক’টা বইয়ের নাম বলবো। পড়েছি তো কম নয়। কয়েকদিন আগেই তো পড়লাম ম্যান্ডেলার ‘লং ওয়ার্ক টু ফ্রিডম’। পড়েছি রাসেলের জীবনী। সেদিন পড়লাম বিমল করের ‘উড়ো খই’। এসব বই পড়ার মজাটাই অন্য রকম। একজন মানুষ সারাজীবন কিভাবে বেঁচেছেন, জীবনকে কিভাবে দেখেছেন, চিনেছেন—  তার অন্তরঙ্গ পরিচয় খুঁজে পাওয়া যায় এ জাতীয় গ্রন্থ থেকে।

২৫ ডিসেম্বর ১৯৯৭, সংবাদ সাময়িকী, দৈনিক সংবাদ