দিন যায় কথা থাকে

পর্ব ১৭

হামিদ কায়সার

প্রকাশিত : ডিসেম্বর ২৪, ২০১৮

তারা কেউ গান শুনিয়েছেন। কেউ লিখেছেন হিরন্ময় কবিতা। কেউ আবার গল্প-উপন্যাসের মালা গেঁথে সাজিয়েছেন বাংলা সাহিত্যের ঢালি। কেউ বা নিরলস জ্ঞানচর্চায় যোগ করেছেন বুদ্ধিবৃত্তির নতুন মাত্রা। তাদের সেই দিন আজ আর নেই, কেউ হারিয়ে গেছেন মহাকালে, কেউ বা এক পা বাড়িয়ে রেখেছেন সেই পথে। তবে তাদের কথা আছে; তাদের কর্মে আর সৃজনশীলতায় তো বটেই, আমার কাছেও— কাগজের ভাঁজে ভাঁজে, শব্দগুচ্ছের আড়ালে, বিভিন্ন সময়ে গৃহীত সাক্ষাৎকারে। হয়তো সেই কথাগুলো আবারো জেগে ওঠতে পারে আপনার মননস্পর্শ পেলে। চলুন পাঠ নেয়া যাক

 

বই পড়ার ক্ষেত্রে আমার ভেতরে কোনো ইনটেলেকচুয়াল দৃষ্টিভঙ্গি ছিল না যে, বই পড়ে জ্ঞানী হয়ে যাব। মজা পাওয়াটাই ছিল আমার ক্ষেত্রে প্রধান। বই পড়ার ক্ষেত্রে আমার কোনো লিমিটেশন ছিল না। পর্নো থেকে শুরু করে সিরিয়াস বই, সবই পড়েছি— রফিকুন নবী

রফিকুন নবী বাংলাদেশের একজন অন্যতম প্রধান চিত্রশিল্পী। জন্ম ১৯৪৩ সালের ২৮ নভেম্বর চাপাইনবাবগঞ্জে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইন্সস্টিটিউটে শিক্ষাজীবন সমাপ্তির পর শিল্পকলায় উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেন গ্রীসে। ১৯৬৪ সাল থেকে শিক্ষকতা-সূত্রে কর্মজীবনে বাঁধা পড়ে আছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইন্সস্টিটিউটে। বর্তমানে তিনি ইন্সস্টিটিউটের একজন অধ্যাপক। ‘টোকাই’ স্রষ্টা হিসেবে সুখ্যাত শিল্পী রফিকুন নবী বাংলাদেশে কার্টুন জনপ্রিয় করে তোলায় পালন করেছেন স্থপতির ভূমিকা। বেশ কয়েক দশক জুড়ে কার্টুনের মাধ্যমে যেমন তিনি নিজের সৃষ্টিশীলতার পরিচয় দিয়ে যাচ্ছেন, একইসঙ্গে সামাজিক দায়িত্বও পালন করে চলেছেন। ছবি আঁকতেও তিনি সমান ব্যস্ত। দেশে-বিদেশে তার পাঁচটি একক চিত্রপ্রদর্শনী হয়েছে। যৌথ প্রদর্শনীতে অংশ নিয়েছেন ৬৬ থেকে ৬৭ বার। লেখালেখিতেও নিজের দক্ষতার পরিচয় রেখেছেন। তার প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে, উপন্যাস— টেরোডাকটাইল, ফণিমনসার লাশ, কিশোর উপন্যাস— সবখানে যুদ্ধ (এ বইটির জন্য লাভ করেছেন অগ্রণী ব্যংক শিশুসাহিত্য পুরস্কার) এবং ২ খণ্ডে কার্টুন সংগ্রহ টোকাই। মাঝে মধ্যে ছড়াও লিখে থাকেন। শিল্পকলা ক্ষেত্রে অবদানের জন্য একুশে পদকসহ দেশে এবং বিদেশের বহু পুরস্কার অর্জন করেছেন। পৃথিবীর প্রধান প্রধান দেশসমূহে ভ্রমণ করেছেন বহুবার।

ড্রয়িং রুমটিকে মনে হচ্ছিল সবুজবেষ্টিত চা বাগানের বাংলো বাড়ির কোনো লন। প্রকৃতির আলো-হাওয়া বাঁধাহীনভাবে খেলে যাচ্ছে ঘরে। শহুরে জীবনের নামে বেবিট্যাক্সির বিভীষিকাময় শব্দের অত্যাচার এখানে নেই, বরঞ্চ কান পাতলে শোনা যায় পাখিদের কথা। আর, ঘরের ভেতরের জিনিসপত্তরগুলোও এমনভাবে সজ্জিত যাতে নাগরিক কৃত্রিম পরিপাটির ছাপ নেই, রয়েছে অগোছালো প্রাকৃতিক ছাঁচ। একটিও বই নেই ঠিকই (হয়তো ভেতরের কোনো রুমে), কিন্তু দেয়ালে দেয়ালে রয়েছে বেশ কয়েকটি বিশালাকৃতির তৈলচিত্র। ছোটখাট আসবাবপত্রগুলোতেও শিল্পের সুষমা খুঁজে পাওয়া যায়। একটু পরই ড্রইং রুমে শিল্পী নিঃশব্দে উপস্থিত হয়ে বলে উঠলেন, ‘আমি তো লেখক নই, আমার আবার প্রিয় বই কি?’ বললাম, ‘লেখক আর একজন চিত্রশিল্পীর মধ্যে তফাৎটা আর কত দূর।’ সোফাসেটে আসন নিতে নিতে শিল্পী বললেন, ‘বলেন, কি জানতে চান?’

বললাম, আপনার প্রথম পড়া বই কোনটি? কিভাবে বইটি হাতে পেয়েছিলেন?
রফিকুন নবী: সেই কবেকার কথা। এখন কি আর সব মনে আছে। তবে প্রথম বইটি যে ‘আদর্শ-লিপি’ ছিল এটা হলপ করে বলতে পারি। আর পাঠ্যবইয়ের বাইরে যদি হয়, তবে সেটা মনে হয় কোনো বই নয়, শিশুদের পত্রিকা ‘শিশু সাথী।’ এই পত্রপত্রিকা দিয়েই শিশুকালে আমার পাঠের অভ্যাসটা গড়ে উঠেছিল। তারপর যখন ক্লাস ফাইভে পড়ি, তখন মনে আছে পড়েছিলাম ‘বুড়ো আংলা’ অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের— আমার মামি বইটি দিয়েছিলেন এবং পড়ার জন্য উৎসাহিত করেছিলেন।

হামিদ কায়সার: কেমন লেগেছিল পড়ে?
রফিকুন নবী: সেভাবে বুঝিনি। পুরো বইটা অবশ্য পড়ে শেষ করেছিলাম— এক আঙুল সমান পিচ্চি নায়ক— এটাই ছিল আমার উৎসাহের বিষয়।

হামিদ কায়সার: বাড়িতে তো প্রচুর বই ছিল?
রফিকুন নবী: আমার বাড়িতে সেভাবে কোনো লাইব্রেরির মতো ছিল না। তবে বইপত্র প্রচুরই ছিল। পাঁচমিশেলী বই। বই পড়ার প্র্যাকটিসও ছিল। রবীন্দ্রনাথের বইতো থাকতই, সুকুমার রায়, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বইও থাকত। বই সব সময় আসতই। আবার কিছু পুরনো বই সযত্নে রক্ষিত ছিল। যেমন, আবদুল্লাহ, বিষাদসিন্ধু, আনোয়ারা, সালেহা— এসব বইয়ের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ, প্রভাবতী দেবী, শরৎচন্দ্র ও বঙ্কিমচন্দ্রের বই-ও সযত্নে রক্ষিত থাকত। আরো অনেক রকমের পত্রপত্রিকা আসতো বাড়িতে, নিয়মিত। আমাদেরকে ফিড করার জন্যে ছিল উপেন্দ্রকিশোরের নানা বই এবং ঠাকুমার ঝুলি জাতীয় বই। আর থাকত দেব সাহিত্য কুটিরের বেশ কিছু পূজা সংখ্যা।

হামিদ কায়সার: সেই সময়ে বইপড়ার সামাজিক পরিবেশটি কেমন ছিল?
রফিকুন নবী: আমি চল্লিশ দশকের মাঝামাঝি থেকে পঞ্চাশ দশকের প্রথমদিকের কথা বলছি, তখন কিন্তু হিন্দু মুসলমান— প্রায় সবার বাড়িতেই বই দেখতাম। তখন তো এতসব হাবিজাবি জিনিস ছিল না। এন্টারটেইন্টমেন্ট ছিল বায়স্কোপ, বই পড়া। বই-ই ছিল অবসর বিনোদনের সঙ্গী। পাড়ায় পাড়ায় লাইব্রেরি থাকত, বেশ অর্গানাইজড্ লাইব্রেরি। বহু পুরনো বই-ও থাকত সেখানে। আমি একেবারে জরাজীর্ণ বইও দেখেছি সেখানে। সেসব লাইব্রেরি থেকে বই ইস্যু করে বাড়িতে নেয়া যেত। তখন উপহার হিসেবেও বইপত্র দিতে দেখেছি।

হামিদ কায়সার: বিয়েতে, জন্মদিনে?
রফিকুন নবী: বিয়েতে। জন্মদিন তো সেকালে এখনকার মতো কখনোই পালন করতে দেখি নি। কিংবা আমি দেখিনি।

হামিদ কায়সার: শৈশবে কি বই পড়ার নেশা ছিল?
রফিকুন নবী: নেশা ছিল কিনা বলতে পারব না, তবে ঝোঁক ছিল পাঠ্যবইয়ের বাইরের বই পড়ার। বাইরের বইকে খুব আকর্ষণীয় মনে হতো— এ বই পড়ায়তো বাধ্যবাধকতা ছিল না, পরীক্ষা পাশেরও ব্যাপার ছিল না। তবে পড়তে হতো লুকিয়ে লুকিয়ে। পাঠ্য বইটা নিচে রেখে বাইরের বই পড়তাম আর সতর্ক থাকতাম কেউ এলো কীনা। কেউ আসছে টের পেলেই ওটা চলে যেত পাঠ্য বইয়ের নিচে।

হামিদ কায়সার: এই তীব্র আকর্ষণীয় বইগুলো কি ছিল— যা লুকিয়ে পড়তেন পড়ার সময়ও।
রফিকুন নবী: সব-ই প্রায় অ্যাডভেঞ্চারধর্মী। শশধর দত্তের দস্যু মোহন সিরিজের বই, শরদিন্দুর ব্যোমকেশ, নীহাররঞ্জন গুপ্তের কিরিটীর ডিটেকটিভ গল্প পাঠ্যবই সবই পড়তাম চুপেচাপে— বাবা-মা এসব বই পড়ার সময় পড়া এপ্রিসিয়েট করতেন না।

হামিদ কায়সার: বইগুলো জুটতো কিভাবে?
রফিকুন নবী: বন্ধু-বান্ধবদের কাছ থেকে এক্সচেঞ্জে সংগ্রহ হতো। কেনা হতো, লাইব্রেরি থেকে আনতাম। সহায় ছিল স্কুলের লাইব্রেরিও। সেখান থেকেও আনতাম। নাইন-টেইন পর্যন্ত এ-জাতীয় বই পড়েই কেটেছে— এই অ্যাডভেঞ্চার, রহস্য জাতীয়।

হামিদ কায়সার: তারপর নাইন টেইনের পর কি হলো?
রফিকুন নবী: সিরিয়াস বই পড়ার দিকে মন গেল, সিরিয়াস বই পড়ার ঝোঁক তৈরি হলো— এর অবশ্য একটা ব্যাকগ্রাউন্ডও রয়েছে।

হামিদ কায়সার: কি রকম!
রফিকুন নবী: তখন আমাদের পাড়া নারিন্দায় ‘অভিযাত্রিক’ নামে একটি লাইব্রেরি করা হলো। পাড়ার অধিবাসী তখন ছিলেন সওগাত সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিন, রোকনুজ্জামান খান দাদাভাই, তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, আবদুল্লাহ আল মুতি শরফুদ্দিন, মহিউদ্দিন আহমেদ, নুরউদ্দিন আহমেদ— এরা এই লাইব্রেরি গড়ার পেছনে পৃষ্ঠপোষকতার দায়িত্ব পালন করেছেন। তা, লাইব্রেরি গড়ে ওঠার পর সেখানে সাম্প্রতিক সব বইপত্র আনা হলো। আমার সিরিয়াস সাহিত্য পড়াও শুরু হয়ে গেল।

হামিদ কায়সার: সিরিয়াস সাহিত্যের মধ্যে কি কি পড়লেন?
রফিকুন নবী: মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বইপত্র পড়লাম, জীবনানন্দের কবিতার বই ওখান থেকেই নিয়ে পড়েছি। তারপর যেমন রাহুল সংস্কৃত্যায়নের বই ‘ভোলগা থেকে গঙ্গা’, সুকান্ত, প্রেমেন্দ্র মিত্র, প্রবোধ স্যানাল, সমরেশ বসু, বুদ্ধদেব বসু— প্রমুখের বই এ সময়েই পড়া। এরই মধ্যে কলেজ ছাত্র হয়ে গেলাম। ভর্তি হলাম শিল্পকলায়। শিল্পকলায় পড়ার সময়ই বিদেশি বইয়ের প্রতি আকর্ষণ তৈরি হয়।

হামিদ কায়সার: শিল্পকলার প্রতি আপনার আগ্রহ এবং আকর্ষণটা গড়ে উঠলো কিভাবে?
রফিকুন নবী: এটা আসলে মনে হয় কি, মনের ভেতরের একটি সহজাত ব্যাপার, ছবি আঁকার বোধ এবং ক্ষমতাটুকু আমার ভেতরে হয়তো আপনা-আপনিই গড়ে উঠেছে। তবে এটাও ঠিক, অনুপ্রেরণাও একজন শিল্পীকে গড়ে উঠতে সাহায্য করে। সে অনুপ্রেরণা আসে নানাভাবেই। আমার ক্ষেত্রে যেমন একটি ঘটনা ঘটেছিল। শৈশবে আমাদের বাড়িতে যে ম্যাগাজিনগুলো আসত, তা থেকে আমি ছবি আঁকার প্রেরণা পেয়েছি।

হামিদ কায়সার: সেটা কিভাবে?
রফিকুন নবী: ‘শিশু সাথী’, ‘ভারতবর্ষ’, ‘প্রবাসী’, ‘মোহাম্মদী’ এসব ম্যাগাজিনগুলোতে নন্দলাল বসু, যামিনী রায়, হেমেন মজুমদার, রামকিংকর বেইজ, গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর, জয়নুল আবেদীনের রিপ্রিন্ট ছবি থাকত। সেসব ছবি আমার খুবই ভালো লাগত, ছবিগুলো নকল করার চেষ্টা করতাম, বসে যেতাম আঁকতে।

হামিদ কায়সার: ওই যে বলেছিলাম, শিল্পকলায় পড়ার সময় বিদেশি সাহিত্যের প্রতি আপনার আকর্ষণ হলো—
রফিকুন নবী: কলেজে নতুন ভর্তি হলে একটা ভাবসাব গড়ে ওঠে না, ওই আর কি। অন্তত গপ্পো করে তো বেড়ানো যাবে ‘আমি শেক্সপীয়র পড়েছি।’ এটা বলতে পারাটাই তখন একটা সাংঘাতিক ব্যাপার। এভাবেই শেক্সপীয়রের দু’তিনটা নাটক পড়ার চেষ্টা করে ফেললাম। তখন পয়সা বাঁচিয়ে বই কিনতাম শেক্সপীয়র, বার্নার্ড শ-র সব কালেকশন কেনা হয়েছে। শিল্পকলার ওপর সব মোটা মোটা বই কিনেছি। পড়ার চেয়ে আয়োজনটা ছিল বেশি। কিন্তু ঘরে হাতের কাছে বই থাকলে একটু আধটু করে পুরোই পড়া হয়ে যায়। আরেকটু উপরে ওঠে মনোযোগটা অবশ্য চলে গেল ফার্স্ট রিডিং-এর দিকে।

হামিদ কায়সার: মানে!
রফিকুন নবী: হালকা মেজাজের বই আর কি! ডিটেকটিভ ধরনের গল্প কিংবা ডি এইচ লরেন্সের ‘লেডি চ্যাটার্লিজ লাভার’— এ জাতীয় বই। আবার হয়ত হালকা মেজাজের বই পড়তে পড়তেই এরমধ্যে একটা সিরিয়াস বই-ও পড়ে ফেলেছি। ব্যাপারটা নির্ভর করে মুডের ওপর, ভালো লাগার ওপর। একটা সময় ছিল আমি প্রচুর পরিমাণ সায়েন্স ফিকশন পড়েছি। তখন সায়েন্স ফিকশন পড়তেই ভালো লাগত। উদ্ভাবনী শক্তি, আবিষ্কার এসবের জন্য। কাজেই, বই পড়ার ক্ষেত্রে আমার ভেতরে কোনো ইনটেলেকচুয়াল দৃষ্টিভঙ্গি ছিল না যে, বই পড়ে জ্ঞানী হয়ে যাব। মজা পাওয়াটাই ছিল আমার ক্ষেত্রে প্রধান। বই পড়ার ক্ষেত্রে আমার কোনো লিমিটেশন ছিল না। পর্ণো থেকে শুরু করে সিরিয়াস বই— সবই পড়েছি। একদিকে জেন এয়ার, ফ্লবেয়ারের বই যেমন সিরিয়াসলি পড়েছি। অন্যদিকে ফেনি হিলের মত বই-ও বাদ দেইনি। আবার কাফকা, আঁদ্রে ব্রেতোঁ, ইবসেন, কেউই বাদ যায়নি।

হামিদ কায়সার: অর্থাৎ কখনো বাছ-বিচার করে পড়েননি।
রফিকুন নবী: সেভাবে পড়ার সুযোগ-ও আসেনি। নতুন বই আসার খবর পেলেই ছুটে যেতাম, না পেলে যে কিনেছে তার কাছে চেয়ে নিয়ে পড়তাম। প্রথমেই বলেছি মোটেই সিরিয়াস পাঠক ছিলাম না।

হামিদ কায়সার: চিত্রকলা বিষয়ক বইও তো মনে হয় অনেক পড়েছেন?
রফিকুন নবী: যেহেতু শিল্পী, শিল্পকলার চর্চা করি— তাই, রং তুলি দিয়ে শুধু হয় না। নিজের চিত্রকলাকে ভাবনাকে এনরিচ করার জন্যই বই পড়ার প্রয়োজন হয়। বিশ্বের চিত্রকলার সর্বশেষ ট্রেন্ড জানার জন্যও পড়তে হয়। চিত্রকলার ওপর মাস্টারির কারণেও পড়তে হয় বই। যখন ছাত্র ছিলাম তখন একদিন জানলাম যে, শিল্পকলার ছাত্র হলে অবনীন্দ্র্নাথ ঠাকুরের ‘বাগেশ্বরী শিল্প প্রবন্ধাবলী’ পড়া অবশ্যই বাঞ্ছনীয়। সেটা কিনে পড়া শুরু করলাম। কিন্তু, এত কঠিন মনে হয়েছিল যে, বইটা শেষ করতে বেশ ক’বছর লেগে গিয়েছিল। জ্ঞানগর্ভ বই, ছাত্রজীবনে নয় পরবর্তী জীবনে প্রায়ই বইটি পড়তে হয়েছে। এখনো মাঝে মাঝে বইটি আমাকে পড়তে হয় নিজের প্রয়োজনে।

হামিদ কায়সার: আপনার প্রিয় লেখক প্রিয় বই?
রফিকুন নবী: এটা বলা কঠিন। পড়েছি তো অনেক— ভালো লাগার-ওতো শেষ নেই, সেভাবে নির্দিষ্ট করে এ মুহূর্তে বলতে পারছি না।

হামিদ কায়সার: এমন কোনো বই কি রয়েছে, যা আপনি বারবার পড়েন, পড়তে ইচ্ছে করে।
রফিকুন নবী: একমাত্র কবিতার বই-ই বারবার পড়া যায়। বেশ কিছু কবিতার বই আছে যা আমি বারবার পড়ি এবং যখনই পড়ি তখনই মনে হয় নতুন পড়ছি।

হামিদ কায়সার: কোন কোন কবির বই?
রফিকুন নবী: প্রথমেই বলে নিচ্ছি আমি কিন্তু ইনটেলেকচুয়াল পাঠক নই, কনভেনশনাল পাঠক। শামসুর রাহমানকে অসম্ভব ভালো লাগে। সব মিলিয়ে ভালো লাগে জীবনানন্দ দাশকে, অমিয় চক্রবর্তী, মনীশ ঘটক, বুদ্ধদেব বসু, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, সুকান্ত।

হামিদ কায়সার: গল্প উপন্যাসের পাঠক হিসেবে আমাদের দেশের কাদের লেখা আপনার ভালো লাগে বা পড়ে থাকেন?
রফিকুন নবী: শওকত ওসমান, আলাউদ্দিন আল আজাদ, শওকত আলী, হাসান আজিজুল হক, সেলিনা হোসেন, সৈয়দ শামসুল হক, মঞ্জু সরকার, মঈনুল আহসান সাবের এবং হুমায়ুন আহমেদের লেখা; ইমদাদুল হক মিলনের লেখাও আমার ভালো লাগে। মাহমুদুল হকের লেখার আমি খুব ভক্ত ছিলাম, তার লেখা পাই না। সদ্য প্রয়াত আখতারুজ্জামান ইলিয়াসও আমার একজন প্রিয় লেখক।

হামিদ কায়সার: তরুণদের মধ্যে?
রফিকুন নবী: একদম তরুণদের মধ্যে অনেকেই ভালো লিখছেন। অন্যান্য শাখার চেয়ে কবিতা এবং ছড়াক্ষেত্রটি আমার ভালোভাবে জানার সুযোগ হয়েছে। সে অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, তরুণরা খুব ভালো ছড়া লিখছেন। তাদের ছড়ার ধরন-ধারণ খুব এক্সপেরিমেন্টাল হয়। ছড়া কেন, শিশুসাহিত্যটাই আমার ভালো করে পড়া আছে।

হামিদ কায়সার: শিশুসাহিত্য পড়তে ভালো লাগে?
রফিকুন নবী: আমি প্রচুর পরিমাণ শিশুসাহিত্যের বইয়ের প্রচ্ছদ এবং ইলাস্ট্রেশন করেছি। এ মাধ্যমে আমার কাজের ক্ষেত্রটি ছিল শিশুসাহিত্যকে ঘিরেই। সেই ১৯৬৩ সাল থেকে এই সেদিন দু’বছর আগ পর্যন্ত আমি কত যে বইয়ের প্রচ্ছদ এবং ইলাস্ট্রেশন করেছি তার হিসেব নেই। শিশুসাহিত্যের বই-ই মূলত প্রধান। আর যত বইয়ের কাজ করেছি, সবই পড়তে হয়েছে আমাকে।

হামিদ কায়সার: তাহলে তো আপনাকে প্রচ্ছদ অলংকরণের জন্য অনেক বই পড়তে হয়েছে।
রফিকুন নবী: আমি প্রতিটি বই পড়তাম এবং খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়তাম। একটি কথা আমি খুব গর্বের সঙ্গে বলে থাকি, বহু বিখ্যাত বইয়ের প্রথম পাঠক আমি।

হামিদ কায়সার: আপনার প্রিয় শিশুসাহিত্যিক কে এদেশে?
রফিকুন নবী: রোকনুজ্জামান খান দাদাভাই, ফয়েজ আহমেদ, হাবীবুর রহমান, এখলাসউদ্দিন আহমেদ, বুলবন ওসমান, রফিকুল হক (দাদু ভাই) প্রমুখ। শামসুর রাহমান, আতোয়ার রহমান এদের লেখাও আমার প্রিয়।

হামিদ কায়সার: সম্প্রতি আপনি কি বই পড়ছেন?
রফিকুন নবী: অরুন্ধতি রায়ের ‘গড অফ স্মল থিংস।’

হামিদ কায়সার: কেমন লেগেছে।
রফিকুন নবী: এখনো পড়া শেষ হয়নি, অর্ধেকের মতো পড়েছি। তা থেকে বলা যায় ডিটেইলিংটা মজার, ভিন্ন একটা ধরন আছে কাজের। সেটা বেশ টানে। তবে এটার ওপর এত আলোচনা হয়েছে যে, সে-সব পড়ে বইটার প্রতি আমার আকর্ষণ অনেকটাই কমে গেছে। এছাড়া সম্প্রতি পড়েছি মেক্সিকান শিল্পী ফ্রিডা কাহ্লুর জীবনী।

হামিদ কায়সার: ফ্রিডা কাহ্লু!
রফিকুন নবী: ফ্রিডা এ সেঞ্চুরির বিখ্যাত মেক্সিকান শিল্পী রিয়েভারের স্ত্রী। বিশ্বময় তাদের খ্যাতি, তাদের কাজ আমার ভালো লাগে। ওরা মেক্সিকোতে কাজ করেছে, এবং মেক্সিকো থেকেই ওদের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে সারা বিশ্বময়। মেক্সিকো তো আর প্যারিস নয়। গরিব আর টানাপোড়েনের দেশ। সেখানে রাজনৈতিক নানারকম প্রতিকূলতা, বাধা আর বিঘ্ন, অভাব আর অনটন। তারই ভেতর দিয়ে কাজ করে গেছেন দুজন। কখনো প্যারিসের প্রলোভনে দেশ ছাড়েননি। পরে, ইউরোপ আমেরিকা তার শিল্পকর্মকে স্বীকৃতি দিয়েছে। সাদরে গ্রহণ করেছে। তাদেরকে সমীহ করে। কমিউনিজম, সোসালিজম-এর বিস্মৃতির সময়ে তারা প্রগতিশীল আন্দোলনের অংশীদার হিসেবে কাজ করেছেন। নিজেদের অস্তিত্বকে তারা কালচারাল এবং পলিটিক্যালিও দাঁড় করিয়েছেন। তাদের প্রতি আমার রয়েছে ব্যক্তিগত শ্রদ্ধা। সম্প্রতি মেক্সিকো-তে গিয়ে তাদের কাজও দেখে এসেছি। শিল্পাচার্য জয়নুলও দারুণ ভক্ত ছিলেন।

হামিদ কায়সার: শিল্পীদের ওপর তো আরো বেশ কয়েকটি নামকরা জীবনী গ্রন্থ রয়েছে?
রফিকুন নবী: মোটামুটি সবগুলোই আমার পড়া আছে। পল গগ্যার ওপর বইটি, মুন এন্ড সিক্সপেন্স, মিকেলেঞ্জেলা-র জীবনভিত্তিক এগনি এ্যান্ড এক্সিট্যাসি, ভ্যান গগের জীবনী আরভিং স্টোনের  ‘লাস্ট ফর লাইফ’, লাস্ট ফর লাইফ পড়েছিলাম ছাত্র জীবনে। পড়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম শিল্পী যদি হতে হয় ভ্যান গগের মতোই হবো। বইটি কি যে আবেগ সৃষ্টি করেছিল মনের মধ্যে। আবার বইটি যাতে তখন কোনো আত্মীয়-স্বজনের হাতে না পড়ে যায় সেদিকেও সতর্ক থাকতাম।

২ জানুয়ারি ১৯৯৮, সংবাদ সাময়িকী, দৈনিক সংবাদ