দিন যায় কথা থাকে

পর্ব ১৮

হামিদ কায়সার

প্রকাশিত : জানুয়ারি ০৭, ২০১৯

তারা কেউ গান শুনিয়েছেন। কেউ লিখেছেন হিরন্ময় কবিতা। কেউ আবার গল্প-উপন্যাসের মালা গেঁথে সাজিয়েছেন বাংলা সাহিত্যের ঢালি। কেউ বা নিরলস জ্ঞানচর্চায় যোগ করেছেন বুদ্ধিবৃত্তির নতুন মাত্রা। তাদের সেই দিন আজ আর নেই, কেউ হারিয়ে গেছেন মহাকালে, কেউ বা এক পা বাড়িয়ে রেখেছেন সেই পথে। তবে তাদের কথা আছে; তাদের কর্মে আর সৃজনশীলতায় তো বটেই, আমার কাছেও— কাগজের ভাঁজে ভাঁজে, শব্দগুচ্ছের আড়ালে, বিভিন্ন সময়ে গৃহীত সাক্ষাৎকারে। হয়তো সেই কথাগুলো আবারো জেগে ওঠতে পারে আপনার মননস্পর্শ পেলে। চলুন পাঠ নেয়া যাক

আমার কাজিন কবি ফররুখ আহমদ যেই শুনলেন শরৎয়ের বইগুলো পাঠানো হচ্ছে আমার জন্যে, তিনি খুব বেঁকে বসলেন, ‘ওইটুকু ছেলের মাথাটা নষ্ট করে দেবে নাকি।’ —জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী


জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী বাংলাদেশের সাহিত্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ নাম। কবি, সমালোচক, প্রবন্ধকার, অনুবাদক এবং শিক্ষাবিদ হিসেবে সমান সুখ্যাতি। তার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মজীবন কেটেছে অধ্যাপনা-সূত্রে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলরের দায়িত্ব পালন করেছেন। রাষ্ট্রপতি শাহাবুদ্দিন আহমদ সরকারের শিক্ষা উপদেষ্টা হিসেবে স্বল্প মেয়াদেই রেখেছিলেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। প্রকাশিত গ্রন্থসমূহের মধ্যে রয়েছে কবিতা— ‘হৃদয়ে জনপদে’, ‘চাদ ডুবে গেলে’, প্রবন্ধ— ‘শব্দের সীমানা’, ‘বাংলাদেশের সাহিত্য ও অন্যান্য প্রবন্ধ’। আলাওল সাহিত্য পুরস্কার, বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কারসহ লাভ করেছেন অসংখ্য পুরস্কার এবং সম্মাননা।

কিছুতেই সময় করে উঠতে পারছিলেন না জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী। অনেক ব্যস্ততা তার— সেমিনার, অফিস, বই লেখা। কিন্তু, তার বইপড়ার অভিজ্ঞতা জানার কৌতূহল আমাকেও বেশ তাড়া করে ফিরছিল। তাই, চিনে-জোঁকের মতো লেগেছিলাম। অবশেষে তার অফিসকক্ষে যাওয়ার অনুমতি মিললো। যথা-সময়ের একটু আগেই উপস্থিত হলাম। আর, মুহূর্তেই তার সরল শিশুর নিষ্পাপ হাসিতে গলে গেল সব বরফ, বললেন, ‘তোমাকে অনেকদিন ঘুরিয়েছি, বলো কি জানতে চাও?’ বললাম, ‘জানতে চাই আপনার বইপড়ার অভিজ্ঞতা, আপনার প্রিয় লেখক সম্পর্কে।
জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী: বই পড়ার সময় অনেক কমে গেছে, আগের মতো আর পড়া হয় না। তবে এখনো আমি বই পড়ি। নিয়মিতই পড়ি। আর, এখনতো বইয়ের সংখ্যাও বেড়ে গেছে। দেশ-বিদেশে প্রতিদিনই বেরুচ্ছে ভালো বই। মাঝে মাঝে আফসোস হয়, এক জীবনে সব বইগুলো পড়া হলো না।

হামিদ কায়সার: সেটা বুঝি সম্ভব না।
জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী: সম্ভব না। এটি একটি ক্ল্যাসিক দুঃখবোধ।
 
হামিদ কায়সার: সম্প্রতি আপনি কি বই পড়ছেন?
জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী: মার্কুইজের ‘লাভ অফ দ্যা টাইম অফ কলেরা’। মার্কুইজের যা পাই, তাই-ই পড়ি। ভালো লাগে তার লেখা। নিঃসন্দেহে আমাদের সময়ের সেরা লেখক। পড়লাম একটি যুদ্ধবিরোধী উপন্যাস ‘দি ইংলিশ পেসেন্ট’। পড়েছি গত ছ-মাস ধরে সবচেয়ে আলোচিত বইটি।
 
হামিদ কায়সার: গড অফ স্মল থিংস!
জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী: অরুন্ধুতি রায়ের। অনেকেই বইটি সম্পর্কে বিরূপ কথাবার্তা বলছেন। আমার কিন্তু গড অফ স্মল থিংস ভালোই লেগেছে। বইটি আমি বেশ উপভোগ করেছি। তারপর পড়লাম টম মরিসনের ‘দি সঙ অফ সলোমন’ এটি কৃষ্ণাঙ্গ মহিলাদের জীবন নিয়ে একজন কৃষ্ণাঙ্গ মহিলার লেখা উপন্যাস। ভালো লেগেছে। এসব বই পড়ে হয় কি, উপন্যাস লেখার ইচ্ছেটাই মরে যায়।

হামিদ কায়সার: উপন্যাস লেখার কথা ভাবছেন বুঝি?
জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী: ভাবি, কিন্তু বিশ্বসাহিত্যের এসব অসাধারণ উপন্যাস পড়ার পর ইচ্ছেটা আর থাকে না। এত ভালো কাজ কি করতে পারবো! কত অন্তর্ভেদী লেখক তারা, জীবনকে কি নিবিড়ভাবে খুঁড়ে খুঁড়ে দেখেছেন— ভাষা, শৈলী প্রকরণেও দেখিয়েছেন কি অনন্য সাধারণ পারঙ্গমতা।

হামিদ কায়সার: উপন্যাসই দেখছি আপনার প্রিয় পাঠ্য।
জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী: আমি কিন্তু অপেশাদার উপন্যাস পাঠক।

হামিদ কায়সার: মানে!
জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী: উপন্যাস পড়ি শখ করে। যারা উপন্যাস লেখেন তারা হয়তো উপন্যাস পড়েন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে, যারা কবিতা লেখেন তারা কবিতা পড়েন খুব পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে। সেই অর্থে বলছি, উপন্যাস আমি শখ করেই পড়ি।

হামিদ কায়সার: প্রথম পড়া বইটি কি ছিল— গল্প, উপন্যাস না শিশুসাহিত্য?
জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী: ‘টুনটুনির গল্প’। উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী। অনেকদিন ধরে বেশ আনন্দের সঙ্গে পড়েছিলাম। দারুণ দারুণ ছবি ছিল, খুব মজা লেগেছিল।

হামিদ কায়সার: এটা কোন বয়সে?
জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী: একেবারে শৈশবের ঘটনা। তারপর যখন আরেকটু বড় হলাম, পড়লাম রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের ‘আরব্য উপন্যাস’। এ বইটিও অনেকদিন ধরে বেশ উৎসাহ নিয়ে পড়েছি। ক্লাস সিক্সে পড়ার সময় পড়ে ফেললাম বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের দুর্গেশনন্দিনী। একটা কাকতালীয় ঘটনা যে দুর্গেশনন্দিনী যেমন আমার পড়া প্রথম উপন্যাস, বাংলা সাহিত্যেরও প্রথম উপন্যাস এবং বঙ্কিমেরও প্রথম উপন্যাস।

হামিদ কায়সার: বইগুলো কিভাবে পেতেন?
জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী: আমাদের পারিবারিক সংগ্রহ থেকে। আমাদের বাড়িতে বইপড়ার রেওয়াজ ছিল। ‘দুর্গেশনন্দিনী’ ছিল বসুমিন্দর সাহিত্য কুটিরের বই। এরপর, পারিবারিক সংগ্রহ থেকেই পড়ার সুযোগ পাই প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের ছোটগল্প এবং উপন্যাস। শরৎচন্দ্রের বইপড়ার জন্যে আমাকে দীর্ঘদিন প্রতীক্ষায় থাকতে হয়েছিল।

হামিদ কায়সার: কেন?
জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী: আমার পিতামহ আমাকে পড়ালেখায় বেশ উৎসাহ দিতেন। আমি যখন ক্লাস এইটে পড়ি, তখন তিনি আমার জন্য কলকাতায় শরৎচন্দ্রের বই কিনলেন, আমাকে পাঠাবেন বলে। কিন্তু, আমার কাজিন কবি ফররুখ আহমদ যেই শুনলেন শরৎয়ের বইগুলো পাঠানো হচ্ছে আমার জন্যে, তিনি খুব বেঁকে বসলেন, ‘ওইটুকু ছেলের মাথাটা নষ্ট করে দেবে নাকি।’ তারপর, যা হলো— শরৎচন্দ্রের বইগুলো আমাদের বাড়িতে আসলো বটে কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে একটি নিষেধাজ্ঞাও আসলো, ও বই আমি পড়তে পারব না, বড় হলে পড়তে পারব। অপেক্ষা করতে হলো দু-বছর... এ দু-বছর বইগুলো পড়ার জন্যে আমার মন খুব ছটফট করতো। তারপর আবার আমার সেই কাজিন কবি ফররুখ আহমদের স্ত্রী বলতেন, ‘তুমিতো বইগুলো পড়তে পারছো না, কিন্তু আমি পড়ে ফেলেছি, খুব মজা পাচ্ছি। তখন খুব কষ্ট হতো।

হামিদ কায়সার: এই দু-বছরে অন্যান্য বই পড়াতো চলছিলই।
জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী: তা চলছিল। বিশেষ করে অ্যাডভেঞ্চার বা গোয়েন্দা কাহিনি খুব পড়ছিলাম, ওই যে কি কড়ি যেন।

হামিদ কায়সার: পাঁচকড়ি।
জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী: পাঁচকড়ি দে। পাঁচকড়ি দে এসব কাহিনি বেশ জমিয়ে লিখতে পারতেন। ‘নীলবসনা সুন্দরী’, ‘বার্মার জঙ্গলে’ এসব খুব পড়েছি।

হামিদ কায়সার: রবীন্দ্রনাথের কিছু পড়া হয়নি তখনো?
জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী: একটু আধটু ছিল— তবে জলপাইগুড়িতে যাবার পর রবীন্দ্রনাথকে ভালোভাবে পড়ার সুযোগ আসে।

হামিদ কায়সার: জলপাইগুড়িতে কোন উপলক্ষে যাওয়া হলো?
জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী: বাবার চাকরির সূত্রে মাগুরা থেকে আমরা জলপাইগুড়ি গিয়ে থেকেছিলাম। সেটা ১৯৪১ সালের ঘটনা। রবীন্দ্রনাথ মারা গেলেন। রবীন্দ্রনাথ মারা যাওয়ার পর আমাদের স্কুলের একজন শিক্ষক ছিলেন আ.ন.ম বজলুর রশীদ।

হামিদ কায়সার: লেখক বজলুর রশীদ?
জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী: তিনিই তো, উনি ছিলেন খুব রবীন্দ্রভক্ত। একে একে বিশ্বভারতীর ‘রবীন্দ্র রচনাবলী’গুলো সব সংগ্রহ করে ফেললেন। সে বই তিনি নিজের কাছে গভীরভাবে আগলে রাখতেন, হাতছাড়া করতেন না। কিন্তু আমাকে দিতেন, আমি একের পর এক খণ্ড করে তার কাছ থেকে নিয়ে পড়েছি। জলপাইগুড়িতে বইপড়ার স্মৃতির মধ্যে এটাই বলার মতো— এরপর তো, আবার চলে এলাম যশোরে।

হামিদ কায়সার: বইপড়া কি আগের মতো অব্যাহত রইল?
জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী: বলতে পারো, বইপড়ার নতুন গতি পেলাম। যশোরে আসার পর লাইব্রেরি থেকে প্রচুর বই সংগ্রহ করে পড়েছি। তখন প্রতিটি জেলা শহরের পাড়ায় পাড়ায় লাইব্রেরি ছিল। যশোরের সম্মিলনী স্কুলের একজন শিক্ষক নিজের বাড়িতেই লাইব্রেরি চালাতেন, বই বিক্রি করতেন— তিনি আমাকে বইয়ের দোকানে যেসব বই আসতো, সবই নেড়েচেড়ে দেবার সুযোগ দিতেন, প্রশ্রয়ও দিতেন। বসে বসে ওখানে অনেক বইপড়া হতো।

হামিদ কায়সার: কিনতেন না?
জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী: তখন অত টাকা পয়সা ছিল না, ছাত্র মানুষ। তারপর কলেজজীবনেও প্রচুর বই পড়েছি— আমি কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র ছিলাম। কলেজের লাইব্রেরিটি ছিল খুবই সমৃদ্ধ। লাইব্রেরিতে বই দেয়ার দায়িত্বে ছিলেন ইসমাইল শাহিদ। তার কথা এখনো আমার মনে ভাসে। তিনি আমাকে দেখলেই বলতেন, ‘যতই পড় না কেন, টি এন সেনের মত পারবে না।’

হামিদ কায়সার: টি এন সেন-টা আবার কে?
জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী: তারকানাথ সেন। কলেজের সবচেয়ে পড়ুয়া ছেলে ছিল— ছাত্রও ছিলেন খুবই ট্যালেন্টেড।

হামিদ কায়সার: আপনি সেই সবচেয়ে পড়ুয়া ছেলেটির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পড়তেন।
জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী: তখন অনেক বই-ই পড়েছি। ইংরেজি সাহিত্য এবং ইতিহাসের বই-ই বেশি পড়েছি। ও দুটো বিষয়ে আমার পড়ার আগ্রহ বরাবরই রয়েছে। এ সময়ে কবিতা লেখায়ও বেশ সক্রিয় ছিলাম।

হামিদ কায়সার: আপনি নিজেও লেখালেখিতে সক্রিয় হয়ে উঠছিলেন এ সময় থেকে—
জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী: হ্যাঁ। তারপরতো অনেক ঘটনা ঘটল। দেশ বিভাগ হলো। দেশ বিভাগের পর চলে এলাম ঢাকায়। এ সময় থেকে কিন্তু আমি শুধু পড়ছি-ই না, সমান তালে লিখছিও। সাময়িকী, পত্র-পত্রিকায় আমার বেশ কবিতা বেরুচ্ছে, গল্প বেরুচ্ছে। কিন্তু, একটা অসুবিধা হলো, খেয়াল খুশিমতো আর পড়তে পারছিলাম না।

হামিদ কায়সার: কেন?
জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী: ইংরেজি সাহিত্য পড়ছি বিশ্ববিদ্যালয়ে। ভালো রেজাল্ট করারও চিন্তা ছিল। পড়া হয়ে গেল পাঠ্য বিষয় সম্পৃক্ত তবে, একটা কাজ হলো, ওয়েস্টার্ন লিটারেচারটা খুব ভালোভাবে পড়া হয়ে গেল।

হামিদ কায়সার: পড়াশোনা কোথায় হতো?
জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী: বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতেই। অন্য কোথাও যাওয়ার প্রয়োজন পড়ত না। তবে পাঠ্যসূচির বাইরে সাহিত্যের সঙ্গে যে একেবারে সম্পর্কহীন হয়ে যাইনি, তা নয়। এ-সময়ই গোপাল হালদারের লেখাগুলো নিজে সংগ্রহ করে পড়তাম। বিষ্ণু দে, বুদ্ধদেব বসু, জীবনানন্দ দাশের বই পেলেই কিনে পড়ি, বন্ধুদেরকেও পড়াতাম। মনে আছে, ফুটপাত থেকে কিনেছিলাম বুদ্ধদেব বসুর ‘বন্দীর বন্দনা’ বইটি। এভাবে বই আমি সব সময়ই খুঁজে খুঁজে বের করেছি এবং নিয়মিত পড়ার ধারাকে অব্যাহত রেখেছি।

হামিদ কায়সার: আপনার কর্মজীবনও বইপড়ার জন্যে সহায়ক ছিল।
জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী: তা ছিল। ছাত্রত্ব শেষ করে অধ্যাপনার সূত্রে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় ১৮ বছর কাটিয়েছি। শুধু নিজে পড়িনি। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠার সঙ্গেও যুক্ত ছিলাম। লাইব্রেরির জন্যে ফান্ডও ছিল প্রচুর, পছন্দের বই আনার সুযোগ ছিল। রাজশাহীর বরেন্দ্র রিচার্স মিউজিয়ামে বই ছিল প্রচুর। রাজশাহী পাবলিক লাইব্রেরিটাও ছিল খুবই সমৃদ্ধ— সেটা ছিল আমার বাড়ির সামনে। আসলে বই যারা পড়তে চায় বই তাদের কাছে এসে যায়। নীরদ সি চৌধুরীর ‘এ আননোন ইন্ডিয়ান’ আমি রাজশাহী থাকতেই পাই— যোগাযোগ হলো আমার অন্যতম প্রিয় লেখকদের সঙ্গে।

হামিদ কায়সার: এরপর নীরদ সি চৌধুরী নিয়মিত পড়েন?
জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী: নিয়মিত। যাদের কোনো লেখাই আমি না পড়ে ফেলে দেব না নীরদ সি চৌধুরী তাদের মধ্যে অন্যতম। তার বাংলা ইংরেজি সব লেখাই আমার কাছে মূল্যবান।

হামিদ কায়সার: নীরদ সি চৌধুরী ছাড়াও আপনার প্রিয় লেখক প্রিয় বইয়ের নাম জানতে পারলে ভালো হয়।
জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী: কালানুক্রমিকভাবে যদি ধরো তাহলে হোমার থেকেই আসতে হবে। হোমারের ওডেসি আমার খুব প্রিয়। চতুর্দশ দশকের কবি চসার, ষোড়শ শতকের শেক্সপিয়র— বিশেষ করে ওর ট্র্যাজেডি এবং কমেডি, সেভেনটিন সেঞ্চুরির মিলটন, এইটিন সেঞ্চুরির ড. জনসন...

হামিদ কায়সার: ড. জনসন সম্পর্কে আমরা কম জানি।
জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী: ইংরেজি সাহিত্যের একজন শ্রেষ্ঠ জীবনী লেখক, ‘লাইফ’স অফ ইংলিশ পোয়েটস’ ‘লাইফ অফ ওয়াল্টার স্যারেজ— তার লেখা বিখ্যাত জীবনীগ্রন্থ। তিনি শেক্সপিয়রও এডিটিং করেছেন— এ বিষয়ে তার একটি অসম্ভব মূল্যবান ভূমিকাও রয়েছে। ভ্রমণকাহিনির লেখক হিসেবেও তিনি সুখ্যাত। তার স্কটল্যান্ড দ্বীপপুঞ্জের ভ্রমণকাহিনি ‘জার্নি অফ দ্যা ওয়েস্টার্ন আইল্যান্ড অফ হেভিডিজ’ আমার প্রিয় বই। শ্রেষ্ঠ ইংরেজি জীবনীগ্রন্থ ‘গজয়েল লাইফ অফ জনসন’-ও আমার প্রিয়। তারপর একালের কারো যদি নাম বলতে হয়, ইয়েটস-এর নাম বলব। যখনই ইয়েটস পড়ি আমার ভেতরের কবিসত্তা জেগে ওঠে! ই এম ফরস্টারের সব লেখাই আমার কাছে উল্লেখযোগ্য। মার্কুইজ, হার্ডি ডিকেন্স, জেন অস্টিন, টিই লরেন্স, ফিল্ডিং, দস্তয়ভস্কি, গোগোল, পুশকিন, তুর্গেনিভ, টলস্টয়— কত জনের নামই তো আছে প্রিয়র তালিকায়। এক সময় রাশিয়ান সাহিত্য প্রচুর পড়েছি। আমাদের সমাজের সঙ্গে কোথায় যেন ওদের মিল রয়েছে। টলস্টয় নিজে কাউন্ট হয়ে ‘রেজারেকশন’-এ যেভাবে সাধারণ মানুষের জীবনকে ফুটিয়ে তুলেছেন— তার কোনো তুলনা নেই। তুর্গনিভ-এর ‘বাবুদের বাসা নেস্ট অফ দ্য জেন্ট্রি’ পড়ার স্মৃতি কোনো দিন আমার মন থেকে মুছবে না।

হামিদ কায়সার: এবার বাংলা সাহিত্যের প্রিয় লেখকদের সম্পর্কে জানতে চাই— কারা আপনার সত্তাকে নাড়া দিতে পেরেছেন তাদের লেখায়?
জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী: অল্প বয়সে সমগ্র মধুসুদন পড়েছি। দাদাজান বলতেন, বাংলা যদি শিখতে হয় মধুসূদন আর বঙ্কিম পড়তে হবে। মধুসূদন আমার এখনো খুব প্রিয় আর রবীন্দ্রনাথের কথা তো বলারই অপেক্ষা রাখে না, রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যের মধ্যে আমার সবচেয়ে প্রিয় হলো গল্পগুচ্ছ। রবীন্দ্র-উত্তর কবিদের মধ্যে প্রিয় সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বুদ্ধদেব বসুর সবধরনের গদ্য রচনা-ই ভালো লাগে। আরো একজনের নাম বলতে হয়, যিনি আমার আত্মার আত্মীয়— অন্নদাশংকর রায়। তার সঙ্গে আমি আমার মন ও মেজাজের মিল খুঁজে পাই। নীরদ সি চৌধুরীর কথা তো আগেই বলেছি— তিনি ইংরেজি ভাষার সৌন্দর্য বর্ধন করেছেন।

হামিদ কায়সার: আপনার সমসাময়িক এবং সাম্প্রতিক কালের কাদের লেখা ভালো লাগে?
জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী: বন্ধু সহপাঠী শামসুর রাহমানের কবিতার আমি মুগ্ধ পাঠক। ভালো লাগে আল মাহমুদের কবিতাও। সৈয়দ শামসুল হকের লেখাও আমি আগ্রহ নিয়ে পড়ি। আর কেন যেন শক্তির চেয়ে সুনীলের কবিতা আমাকে বেশি টানে— সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতায় অন্যরকম এক লাবণ্য আছে। নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর কবিতাও ভালো লাগে। অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের কবিতা মর্মমূলকে ছুঁইয়ে দিয়েছে। উনার কাছ থেকে কবি হিসেবে অনেক কিছু শেখার আছে। এদিকে শামসুর রাহমান আর ও দিকে অলোকরঞ্জন। ষাটের কবিদের মধ্যে রফিক আজাদের কবিতার সাথে আমি সহজেই একাত্ম হতে পারি।

হামিদ কায়সার: কথাসাহিত্যে?
জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী: সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর ‘নয়নতারা’য় অপূর্ব কিছু গল্প রয়েছে। আমি আগেই বলেছি, উপন্যাসের আমি শখের পাঠক। গভীর বিচার বিশ্লেষণ করে পড়ি না, কবিতা যেমনটা পড়ে থাকি। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ-র ‘লালসালু’ উপন্যাসটি বাংলা সাহিত্যের একটি ক্ল্যাসিক সম্পদ। কিন্তু, তার ‘চাঁদের অমাবস্যা’, ‘কাঁদো নদী কাঁদো’ আরেকবার না পড়ে মত দিতে পারব না। মাহমুদুল হকের ‘জীবন আমার বোন’ পড়ে আমি খুব মুগ্ধ হয়েছিলাম। অসাধারণ ভাষা শৈলী তার। সে সম্পদ রয়েছে হাসান আজিজুল হকের-ও। হাসান খুব ভালো বাংলা গদ্য লিখছে, তার গল্প আমার ভালো লাগে। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘খোয়াবনামা’ আমাকে তেমন টানেনি। তবে তার ‘চিলেকোঠার সেপাই’ এবং গল্পগুলো ভালো লেগেছে— তারও নিজস্ব একটি ধারা আছে।

হামিদ কায়সার: তরুণদের মধ্যে?
জিল্লর রহমান সিদ্দিকী: মঞ্জু সরকার, আরেকটি যেন কি নাম, ঐ যে একটি বই আছে ‘সে রাতে পূর্ণিমা ছিল’।  

হামিদ কায়সার: শহীদুল জহির।
জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী: হ্যাঁ, এদের লেখা ভালো লাগে। নাসরীন জাহানের লেখাও শুনেছি ভালো, উড়ুক্কুটা পেলে পড়ব।

হামিদ কায়সার: শেষে জানতে চাইব, এমন কোনো বই কি রয়েছে যা আপনি বারবার পড়েন, অথবা বারবার পড়তে ইচ্ছে করে।
জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী: রয়েছে। অবশ্যই রয়েছে— টি ই লরেন্সের ‘সেভেন পিলারস অফ উইসডম’, ঐতিহাসিক জীবনের ‘ডিক্লাইড অফ ফল অন রোমান ইমপায়ার’, হোমারের ‘ওডেসি’, রবীন্দ্রনাথের ‘গল্পগুচ্ছ’, হাঙ্গেরিয়ান এক লেখিকা— ‘ডন কুইক্সট’, বিভূতিভূষণের ‘পথের পাঁচালী’, টলস্টয়ের ‘রেজারেকশন’, তুর্গেনিভের ‘বাবুদের বাসা’ এবং প্লেটো-র ‘সংলাপ’— এটি সমস্ত সত্তাকে ধরে নাড়া দেয়। এ বইয়ে দার্শনিক ও কবিকে একসঙ্গে পাওয়া যায়।

৮ জানুয়ারি ১৯৯৮, সংবাদ সাময়িকী, দৈনিক সংবাদ