দিন যায় কথা থাকে

পর্ব ১৯

হামিদ কায়সার

প্রকাশিত : জানুয়ারি ১৪, ২০১৯

তারা কেউ গান শুনিয়েছেন। কেউ লিখেছেন হিরন্ময় কবিতা। কেউ আবার গল্প-উপন্যাসের মালা গেঁথে সাজিয়েছেন বাংলা সাহিত্যের ঢালি। কেউ বা নিরলস জ্ঞানচর্চায় যোগ করেছেন বুদ্ধিবৃত্তির নতুন মাত্রা। তাদের সেই দিন আজ আর নেই, কেউ হারিয়ে গেছেন মহাকালে, কেউ বা এক পা বাড়িয়ে রেখেছেন সেই পথে। তবে তাদের কথা আছে; তাদের কর্মে আর সৃজনশীলতায় তো বটেই, আমার কাছেও— কাগজের ভাঁজে ভাঁজে, শব্দগুচ্ছের আড়ালে, বিভিন্ন সময়ে গৃহীত সাক্ষাৎকারে। হয়তো সেই কথাগুলো আবারো জেগে ওঠতে পারে আপনার মননস্পর্শ পেলে। চলুন পাঠ নেয়া যাক

সাঁ-এক্সুপেরির ‘দ্য লিটল প্রিন্স’। পৃথিবীর যে-দেশে যাই সেখানকার ছেলেমেয়েদেরকে তাদের ভাষায় অনূদিত এ বইটি উপহার দেই এবং আমি নিজেও এ বইটি সর্বদা কাছে রাখি। দৈবাৎ মৃত্যুচিন্তায় তাড়িত হলে বইটি আমাকে খুব সাহায্য করে— দ্বিজেন শর্মা
 

এ দেশের গাছপালা ও প্রকৃতি নিয়ে যারা লেখালেখি করেন তাদের মধ্যে দ্বিজেন শর্মার নামটি স্বতন্ত্রভাবেই উচ্চারিত হয়। কারণ, তিনি বিজ্ঞানমনস্ক, বৃক্ষ-বিশেষজ্ঞ ও ভূদৃশ্য পরিকল্পক। বৈজ্ঞানিক প্রাজ্ঞতা নিয়ে তিনি প্রকৃতিকে দেখেন। স্বভাবগতভাবেও নিভৃতচারী। জন্ম ১৯২৯ সালে সিলেটের শিমুলিয়া গ্রামে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উদ্ভিদবিদ্যায় এম.এস.সি ডিগ্রি অর্জনের পর বরিশালের বি.এম কলেজের মাধ্যমে শুরু অধ্যাপনা জীবন। ১৯৭৪ সালে নটরডেম কলেজ থেকে অধ্যাপনা পেশা ছেড়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের স্বর্ণযুগে যোগ দেন মস্কোর প্রগতি প্রকাশনে। বাংলা ভাষায় যারা রুশ সাহিত্য নিয়মিত পড়েছেন তাদের কাছে দ্বিজেন শর্মা এক আদৃত নাম। ১৯৯৩ সালে যবনিকাপাত ঘটে প্রগতি প্রকাশন পর্বের। বর্তমানে তিনি রাশিয়ান পেনশনভোগী। অধিকাংশ সময় ঢাকাতেই কাটান। মাঝে মধ্যে পাড়ি দেন প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়নে। প্রকাশিত গ্রন্থসমূহ— ‘শ্যামলী নিসর্গ’, ‘জীবনের শেষ নেই’, ‘সতীর্থবলয়ে ডারউইন,’ ‘ফুলগুলি যেন কথা’, ’সপুষ্পক উদ্ভিদের শ্রেণীবিন্যাস তত্ত্ব,’ ‘স্বদেশে প্রবাসে,’ ‘গহন কোন বনের ধারে,’ ‘ডারউইন ও প্রজাতির উৎপত্তি’ এবং ‘মম দুঃখের সাধনা’। প্রকাশনার অপেক্ষায় রয়েছে দুটি পাণ্ডুলিপি ‘সমাজতন্ত্রে বসবাস’, ও শিশুদের জন্য ‘পুষ্পে পুষ্পে ভরা’। তিনি নিয়ে গেলেন তার ছোট স্টাডি রুমে, সাদামাটা। দুটি শেলফে কিছু বই। অধিকাংশই গাছপালা, বাগান, জীব-ইতিহাস ও প্রকৃতি সংরক্ষণমূলক। লাল মলাটের বিশাল বিশাল খণ্ডের রবীন্দ্র-রচনাবলিগুলো শোভা বর্ধন করে আছে শেলফের। আর পুরনো গল্পের বইও আছে— অনেক বছর আগে কেনা, ছেঁড়াখোঁড়া। এক কোণে নিজের লেখা অবিক্রিত একটি বইয়ের স্তূপ, ধুলিমলিন। সেখান থেকে একটি বই নিয়ে ঝেড়েমুছে আমার হাতে ধরিয়ে দিলেন ‘মম দুঃখের সাধন’, বইটিতে একনজর চোখ বুলিয়ে জিগ্যেস করলাম, ‘কি বই পড়ছেন সম্প্রতি?’

দ্বিজেন শর্মা: আমি প্রায় ন’মাস মস্কো ও লন্ডন কাটিয়ে কিছুদিন আগে ফিরেছি। মস্কোয় অখণ্ড অবসর ছিল। সেই সুযোগে আবার পড়েছি তলস্তয়ের উপন্যাস ও গল্প। রবীন্দ্রনাথের ‘গোরা’।

হামিদ কায়সার: গোরা এবারই প্রথম!
দ্বিজেন শর্মা: না। গোরা আগে অনেকবার পড়েছি। একাত্তরের সংগ্রামের সময়েও পড়েছি। সব সময়ই মনে হয়েছে তত্ত্বকথায় ভরা। এবার প্রথম বইটি, বলতে পারেন আবিষ্কার করেছি, সম্ভবত তলস্তয়ের প্রভাবে। মনে হয়েছে, ওটি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ উপন্যাসগুলোরই একটি। আমার রুশী বন্ধু, সাহিত্যের পণ্ডিত সের্গেই সেরিব্রিয়ানিকে কথাটা বলি। তিনি জানান, এমনটি নাকি ঘটে, একের আলোয় অন্যকে আবিষ্কার।

হামিদ কায়সার: লন্ডনে কি পড়লেন?
দ্বিজেন শর্মা: লন্ডনে বই পড়ার সুযোগ ছিল না তেমন। বইয়ের দোকান আর কিউ-গার্ডেনে ঘুরেই সময় কেটেছে।

হামিদ কায়সার: এখন কি বই পড়ার কথা ভাবছেন?
দ্বিজেন শর্মা: মহাবিশ্বে উন্নত সভ্যতার অস্তিত্ব নিয়ে বৈজ্ঞানিক আলোচনার কোনো বই। কল্পবিজ্ঞান নয়। তবে ইয়েফ্রেমভের ‘এন্ড্রমিডা নীহারিকা’ও আমিই সম্পাদনা করেছিলাম। বইটি আমাকে খুব প্রভাবিত করেছিল। স্তানিসোয়াত লেমের লেখা ও তার্কভস্কির করা চলচ্চিত্র ‘সোলারিস’ এতে অনুঘটকের কাজ করছে।

হামিদ কায়সার: এখন এ ধরনের বই পড়তেই ভালো লাগে তাই না?
দ্বিজেন শর্মা: হ্যাঁ। আমার ভালো লাগে প্রকৃতি-সংরক্ষণ, আদিম অরণ্যের যেটুকু এখনও টিকে আছে সেখানকার গাছপালার ওপর বই এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন কেন ভাঙলো, সমাজতন্ত্রের ভবিষ্যৎ কী— এই ধরনের সিরিয়াস বিষয়ের ওপর বই পড়তে আমার ভালো লাগে।

হামিদ কায়সার: আচ্ছা, এমন কোনো বই কি রয়েছে, যা আপনি বারবার পড়েন এবং বারবারই পড়তে ইচ্ছে হয়?
দ্বিজেন শর্মা: সাঁ-এক্সুপেরির ‘দ্য লিটল প্রিন্স’। পৃথিবীর যে-দেশে যাই সেখানকার ছেলেমেয়েদেরকে তাদের ভাষায় অনূদিত এ বইটি উপহার দেই এবং আমি নিজেও এ বইটি সর্বদা কাছে রাখি। দৈবাৎ মৃত্যুচিন্তায় তাড়িত হলে বইটি আমাকে খুব সাহায্য করে।

হামিদ কায়সার: বইটির সঙ্গে আপনার পরিচয়টা হয়েছিল কিভাবে?
দ্বিজেন শর্মা: এই প্রসঙ্গে অধ্যাপক জহুরুল হকের কথা বলতেই হয়। তিনিই বইটির কথা প্রথম বলেন। তার অনুবাদেই প্রথম পড়ি। এক্সুপেরির জীবনী লেখার চেষ্টা করেছি, তেমন কোনো আকর গ্রন্থ জোগাড় করতে পারিনি। কিছুদিন আগে ফরাসি ভাষায় একটি চলচ্চিত্র দেখেছি এক্সুপেরির জীবনভিত্তিক। অসাধারণ। আর বারবার পড়ি বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের ‘আরণ্যক’। যতবার পড়ি ততবারই মনে হয় নতুন।

হামিদ কায়সার: আরণ্যক প্রথম পড়া হয় কখন?
দ্বিজেন শর্মা: স্কুলে। মনে আছে, তখন আমাদের বাড়িতে বাবার একটা বড় ফুলবাগান ছিল। তখন ঘরে ঘরেই ফুলের গাছ ছিল।

হামিদ কায়সার: বলুন আপনার শৈশবের কথা, তখনকার বই পড়ার পারিবারিক এবং সামাজিক পরিবেশের কথা।
দ্বিজেন শর্মা: আমার শৈশব কেটেছে জন্মস্থান সিলেটের বড়লেখা থানার শিমুলিয়া গ্রামে। বাবার বিশাল গ্রন্থসংগ্রহ ছিল। প্রধান সবগুলি মাসিকই তিনি রাখতেন। আমাদের পরিবার আজও ‘দেশ’ পত্রিকার নিয়মিত পাঠক। বাবা আবার দীনেন্দ্রকুমার রায়ের রহস্যলহরী সিরিজ আনতেন। রবার্ট ব্লেক ও স্মিথ। গোটা একটা আলমারি ভরা ছিল। ‘নীলবসনা সুন্দরী’ সেকালের বাঙালি লেখকের নামি ডিটেকটিভ। এসব বই লুকিয়ে পড়েছি। স্কুলের লাইব্রেরিও আমার জন্য খোলা ছিল। শিক্ষক রসময় দাস ছিলেন বাবার অনুরাগী। আমাকে বই পড়তে উৎসাহ দিতেন। মেজদা বাবার বই বন্ধুদেরকে গোপনে পড়াতেন, যার ফলে, একটি পাঠচক্র গড়ে উঠেছিল। এই মেজদা ও বই নিয়ে একটি মজার ঘটনা আছে।

হামিদ কায়সার: বলুন প্লিজ!
দ্বিজেন শর্মা: যুদ্ধের সময় একদিন মেজদা বাবার কিছু টাকা চুরি করে বাড়ি থেকে পালিয়ে গেল।

হামিদ কায়সার: হঠাৎ?
দ্বিজেন শর্মা: উদ্দেশ্য যুদ্ধে যাওয়া। সম্ভবত কোয়ালিফাইড হননি। অগত্যা করলেন কি, বাবার প্রিয় প্রকাশনা ‘গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় অ্যান্ড সন্স’ থেকে অনেকগুলি বই কিনে নিয়ে বাড়ি ফিরলেন। রাগ হবেন কি, বই পেয়ে বাবা তো দারুণ খুশি। কিছু বইয়ের নাম আজও মনে আছে— ‘পদ্মা প্রমত্তা নদী’, ‘কাকজ্যোৎস্না’, ‘বনবিহগী’, ‘লীলাকমল’, ‘ময়ূখ ও ধর্মপাল’, ‘অমরপাশা’।

হামিদ কায়সার: আপনার প্রথম পড়া বই ছিল কোনটি মনে আছে?
দ্বিজেন শর্মা: সঠিক কিছু মনে নেই। বর্ণপরিচয়ের ক’টি শব্দ মনে আছে— কি, ঘি, ছবি, ডিম, চিল। পাঠশালার বই পড়ার স্মৃতি মনে নেই। হাইস্কুলে আমাদের অত্যন্ত রাগী-শিক্ষক রসময় দাস নতুন কোনো বই এলে এগুলির লিস্টি করতেন ক্লাসে বসে। আমরা মহা খুশি। সেদিন মারধরের কোনই সম্ভাবনা নেই। কড়া লাল মলাটের একটি বই আজও চোখে ভাসে— ‘সুন্দরবনের মানুষখেকো’। অষ্টম শ্রেণির ট্রানস্লেশন বইতে বঙ্কিমচন্দ্রের ‘দুর্গেশনন্দিনী’র একটা প্যারা ছিল—‘মান্দারনের পথে চলেছেন এক অশ্বারোহী যুবক।’ অতঃপর পুরো বইটি পড়ার প্রবল আগ্রহ জাগে। বাবার গ্রন্থাগারে বঙ্কিম রচনাবলি ছিল। পাওয়া সহজ হয়নি! একটি রূপকথার বইয়ের কথা খুব মনে পড়ে— ‘শতগল্প’। এখনো খুঁজি। পাই না। সম্ভবত এটি দিয়েই আমার গল্পপাঠ শুরু।

হামিদ কায়সার: শৈশবে এই যে বই পড়ার স্বাদ পেলেন, তার ধারাতো একইভাবে অব্যাহত রইলো, নাকি?
দ্বিজেন শর্মা: বইপড়ার অভ্যাস একবার জন্মালে সেটা সেনাইলিটি না হওয়া পর্যন্ত থামে না বলে বিশ্বাস করি। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সিরিয়াস বই পড়ার প্রতি আগ্রহ জন্মেছে। ইংরেজি বইয়ের দিকে ঝোঁক বেড়েছে। তবে কৈশোরের পর আর ডিটেকটিভ বই পড়িনি।

হামিদ কায়সার: প্রথম পড়া ইংরেজি বই?
দ্বিজেন শর্মা: আমার প্রথম পড়া ইংরেজি বই জ্যাক লন্ডনের ‘মার্টিন ইডেন’। জ্যাক লন্ডনের অনেকগুলো বই-ই আমার খুব প্রিয়।

হামিদ কায়সার: ভিনভাষী লেখকদের মধ্যে আর কারা আপনার প্রিয়?
দ্বিজেন শর্মা: অনেকেই। রল্যাঁ, তলস্তয়, দস্তয়েভস্কি, ক্যামু, ডি-এইচ লরেন্স, গার্সিয়া মার্কেজ, স্টেইনবেক, হেমিংওয়ে প্রমুখ। আমাদের ছাত্রজীবনে রল্যাঁর ‘জ্যাঁ ক্রিস্তফ’ খুব জনপ্রিয় ছিল। ইডিয়ট ও আউটসাইডার আমাকে প্রবলভাবে আলোড়িত করেছিল, তবে ভিন্ন ভিন্নভাবে। প্রথমটিকে পেয়েছি ভালোবাসার প্রবল ভাবাবেগ, দ্বিতীয়টিতে জীবন সম্পর্কে অতল হতাশা, যা একেবারে এড়িয়ে যাওয়া চলে না। মনে পড়ে সেই ১৯৫৮ সালের কথা। আমার শেষ পরীক্ষা। নিউমার্কেট থেকে কিনে এনেছি রল্যাঁর ‘বিমুগ্ধ আত্মা’। ভেবেছি পরীক্ষার পরে পড়ব। কিন্তু লোভ সামলানো গেল না। শুরু করে একনাগাড়ে প্রায় না ঘুমিয়েই শেষ করি। পরীক্ষার পড়া শিকেয় উঠল। প্রবল মানসিক অস্থিরতায় অসুস্থ বোধ করি। হলে তখন ছাত্র খুব কম। কার্জন হল চত্বর নীরব। একটা কম্বল নিয়ে আমাদের বোটানিক গার্ডেনের পাইন গাছের তলায় ক’দিন শুয়ে কাটিয়ে তবেই সুস্থ হয়ে ওঠি। রেমার্কের ‘অল কোয়ায়েট অন দি ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট’ পড়ার কথা আজও মনে আছে। শীতের দিনে উঠোনে খড়ের গাদায় শুয়ে পড়া এবং মাঝে মাঝে আকাশে চিলদের ওড়াউড়ি দেখা। ছেলে যুদ্ধ ফেরার আগের দিন রাত জেগে মায়ের হেঁটে বেড়ানোর শব্দ এখনও যেন শুনতে পাই।

হামিদ কায়সার: দেশে আপনার প্রিয় লেখক কে?
দ্বিজেন শর্মা: এখানেও অনেক। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, হাসান আজিজুল হক, মাহমুদুল হক। শেষোক্ত লেখকের ‘কালো বরফ’ আমাকে রীতিমতো সম্মোহিত করেছিল। ‘চিলেকোঠার সিপাই’-এর ‘খিজির’ চরিত্রটিকে আমি মনে করি, বাংলা-সাহিত্যে একটি নতুন টাইপ চরিত্র, এটি অনন্য সৃষ্টি। হাসানের কিছু গল্পও অসাধারণ। শওকত ওসমান ও ওয়াহিদুল হকের গদ্য, শামসুর রাহমানের কবিতা অবশ্যই পড়ি। আমার সহপাঠী শওকত আলীর ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’ মস্কোয় পড়ে চমৎকৃত হয়েছিলাম। মঞ্জু সরকারের ‘তমস’ও তখন পড়ি। খুবই প্রতিশ্রুতিশীল মনে হয়েছিল। একদা জ্যোতিপ্রকাশ দত্তের ‘কালবেলা’ নামের লিটল ম্যাগাজিনে লিখতাম। তিনি খুব কঠিন কঠিন গল্প লিখতেন। তুমুল তর্ক হতো।

হামিদ কায়সার: এবার বলুন ওপার বাংলার লেখকদের সম্পর্কে।
দ্বিজেন শর্মা: পুরনো সবার বই-ই পড়েছি। কিশোর বয়সে শরৎচন্দ্র, তারাশঙ্কর, মানিক বন্দোপাধ্যায়, প্রবোধ স্যান্নাল, বিভূতিভূষণসহ অনেকের বইই। শরৎচন্দ্র আমার মানস গঠনে খুব গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলেছেন— যে জন্য দুঃখিনী অন্নদা দিদিকে আজও ভুলতে পারি না। এক সময় বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের ‘দৃষ্টিপ্রদীপ’ পড়ে সম্মোহিত হই। অমিয়ভূষণ মজুমদারের বই খুব ভালো লাগে। ‘গড় শ্রীখণ্ড’, ‘দীপিতার ঘরে রাত্রি’ অসাধারণ। তার ‘একটি বিপ্লবের মৃত্যু’ গল্পটি ভোলার নয়। লীলা মজুমদারের ‘ঈহা’ গল্পটি আজও বারবার পড়ি। সন্তোষ কুমার ঘোষের ‘শেষ নমস্কার শ্রীচরণেষু মাকে’ অনন্যসাধারণ। বাংলা সাহিত্যের একটি মাইলফলক। জীবনানন্দ দাশের উপন্যাসগুলি সম্প্রতি বেরিয়েছে। মনে হয় তার কবিতারই গদ্যরূপ। খুব ভালো লাগে।

হামিদ কায়সার: এবার বলুন, আমাদের তরুণ লেখকদের সম্পর্কে, কাদের লেখা আপনার ভালো লাগে।
দ্বিজেন শর্মা: বিদেশে থাকি বলে তরুণ লেখকদের বই পড়ার সুযোগ তেমন ঘটে না।  

হামিদ কায়সার: আমরা জানি, মস্কোর প্রগতি প্রকাশনে দীর্ঘদিন অনুবাদ শাখায় কাজ করেছেন— সেসব দিনগুলো আপনার কেমন কেটেছে?
দ্বিজেন শর্মা: শুরুতে খুব কষ্ট হতো। আমি দীর্ঘদিন শিক্ষকতা করেছি। নানাধরনের কাজ করতে হতো তাতে, অনেক সঙ্গী ছিল, বৈচিত্র্য ছিল। কিন্তু অনুবাদকর্ম খুবই একঘেয়ে। তদুপরি, বইগুলো প্রায় সবই রাজনৈতিক। মনমতো সামান্যই জুটত। দেশের জন্য নস্টালজিয়ার প্রবল তাড়নাও কাজে বাঁধা সৃষ্টি করতো। শেষে অবশ্য অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিলাম। ছাপা অনুবাদ দেখতে ভালোই লাগতো। ভাবতাম দেশের মানুষ পড়বে, ভাবতাম, তাদের সঙ্গে দূরে থেকেও একটা যোগাযোগ আমার থাকবেই। বিদেশে অন্য পেশায় থাকলে সেটা হয়ে ওঠে না।

হামিদ কায়সার: অনুবাদের জন্য বই কি আপনি বেছে নিতে পারতেন, নাকি সবটাই চাপিয়ে দেয়া ছিল?
দ্বিজেন শর্মা: (তৎকালীন) সোভিয়েত ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় পরিকল্পনার কোনো হেরফের প্রগতি প্রকাশনেও ঘটত না। সবই ওপর থেকে ঠিক হয়ে আসত। তবে ব্যতিক্রম ঘটেছে। বলে-কয়ে ‘রসায়নের শতগল্প’, ‘কেন আমি বাবার মতন’, ‘সবুজ দ্বীপে প্রাণের মেলা’, অনুবাদ করাতে পেরেছিলাম।

হামিদ কায়সার: আপনার লেখার বিষয়-আশয়ে প্রকৃতির প্রতি যেমন আপনার মনের গভীর টান লক্ষ্য করা যায়, তেমনি পরিচয় পাওয়া যায় বিজ্ঞানমনস্কতার ব্যাপারটি— কিভাবে এটা আপনার মধ্যে গড়ে ওঠে।।
দ্বিজেন শর্মা: ইন্টারমিডিয়েটের পর কোলকাতায় গিয়েছিলাম ডাক্তারি পড়তে। একদিন দেরি হয়ে যাওয়ায় ভর্তি পরীক্ষা দেয়া হলো না। বিএসসিতে ভর্তি হলাম, তখন বোটানি নিয়েছিলাম, এই বিদ্যাটি সাধারণভাবে পড়েছি। কিন্তু প্রকৃতির প্রতি আমার মনের ওপর গভীর প্রভাব পড়ে বরিশাল বিএম কলেজে অধ্যাপনার সময়।

হামিদ কায়সার: সেটা কখন?
দ্বিজেন শর্মা: ১৯৫৮ সালের কথা। বরিশালে ডা. এম আহমেদ বলে একজন চক্ষু বিশেষজ্ঞ ছিলেন। ওর প্রভাবেই আমি ধীরে ধীরে প্রকৃতিপ্রেমিক হয়ে উঠি। তার বাড়িতে নানা জাতের অর্কিড, ক্যাকটাসসহ অনেক রকমের গাছপালা ছিল। তিনিই ‘ভিক্টোরিয়া রিজিয়া’ বাংলাদেশে জন্মান, এর সঙ্গে অবশ্য আমিও জড়িত ছিলাম। বরিশাল থেকে ঢাকা আসার পর বলদা বাগানের অমৃতলাল আচার্যের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হয়। অধ্যাপক অজিত গুহ রবীন্দ্র সাহিত্যে ফুল এ বিষয়ে লেখার জন্য আমাকে প্রায়ই বলতেন। তাদের প্রত্যক্ষ প্রভাবে আমি এ পথে আকৃষ্ট হই। তারপর বলেছি, বাবার ফুলবাগান ছিল, তারপর বিভূতিভূষণের ‘আরণ্যক’। এসবের প্রভাব নিশ্চয়ই সাবকনশাসে ছিল। আর, যেহেতু উদ্ভিদ-এ এমএসসি পড়েছি— পাঠ্যবইও আমাকে প্রভাবিত করে থাকবে। বিশেষ করে আমি শ্রেণিবিন্যাস বিদ্যার প্রতি আকৃষ্ট ছিলাম।

হামিদ কায়সার: পাঠ্যবইয়ের বাইরে আর কোনো প্রকৃতি বিষয়ক বই আপনাকে প্রভাবিত করেনি?
দ্বিজেন শর্মা: অবশ্যই। থরোর ‘ওয়ালডেন’, রবীন্দ্রনাথের গান ও কবিতা, বিশেষ করে ‘বনবাণী’। তারপর জীবনানন্দ দাশ, জসীমউদদীনের কবিতা। তবে কী জানেন, মানুষের প্রতি গভীর ভালোবাসা না জন্মালে সম্ভবত প্রকৃতি প্রেমিক হওয়া যায় না। আমার জন্য এ কাজটি করেছেন কথাসাহিত্যিকরা। প্রকৃতি বিষয়ক যে কোন লেখাই আমি মন দিয়ে পড়ি। এবং যত্ন করে সংগ্রহেও রাখি। এই তো ক’দিন আগে ভোরের কাগজের শিশুদের পাতায় বেগম সুফিয়া কামালের ‘নিম’-এর ওপর একটি কবিতা পড়ে সেটা কেটে রেখেছি। একটি পুরনো কবিতা, পুরনো ঢংয়ে লেখা, সেই কবেকার কবি শেখ ফজলুল করিমের, কিন্তু কবিতাটি আমার প্রিয়, যা আমি মাঝে মাঝে উদ্ধৃত করি।
        ক্ষুদ্র কুটিরের পাশে সযতনে রচি ফুল বন,
        সকাল সন্ধ্যায় নিত্য করিতাম সলিল সেচন।
        ছোট ছোট তরুসারি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শাখা বিস্তারিয়া,
        আকুল পরাণে মোর সুখ শান্তি আনিত বহিয়া
        কচি কচি পাতাগুলি শ্যামল শান্ত কোমল সুন্দর,
        কত পাখি আসে সেথা, কত মুগ্ধ ক্লিষ্ট মধুকর।
এত সুন্দর কথার এই কবিতা কি কখনো পুরনো হতে পারে, বলুন! চর্যাপদের অনেক লাইনও আমার একদম মুখস্থ।

হামিদ কায়সার: বর্তমানের বই পড়ার সামাজিক অবস্থাকে আপনার কেমন মনে হয়?  
দ্বিজেন শর্মা: গোটা সমাজ এখন বড়ই অস্থির। আমাদের দেশের ইতিহাসই অতিরিক্ত রাজনীতি-বিজড়িত। সংগ্রাম চলবেই। পড়াশোনার জন্য একটা স্থিতি দরকার। সেটা আমাদের দেশে কোনোদিনই টিকেনি। তবে জীবনও স্বাভাবিক নিয়মেই একটা পথ করে নেয়, তাই পড়াশোনার পরিবেশ সীমিত ও খণ্ডিত হলেও অনুপস্থিত নেই। সিরিয়াস পাঠক অবশ্যই তৈরি হচ্ছে, যদিও তাদের সঙ্গে আমার তেমন যোগ নেই। দেশে আমার দীর্ঘ অনুপস্থিতির জন্যই হয়তো এই প্রজন্ম-ফারাক। শিক্ষকতায় থাকলে এটা নিশ্চয়ই ঘটতো না।

হামিদ কায়সার: ইলেকট্র্রনিক্স মিডিয়ার দাপটে কি বইয়ের আবেদন ফুরিয়ে যেতে বসলো?
দ্বিজেন শর্মা: যেতে পারে না। বই আছে, বই থাকবে। তবে মেরুকরণ ঘটবে। বইয়ের পাঠক নিশ্চিতই কমে যাবে।

১৫ জানুয়ারি ১৯৯৮, সংবাদ সাময়িকী, দৈনিক সংবাদ