দিন যায় কথা থাকে

পর্ব ২৩

হামিদ কায়সার

প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ১৮, ২০১৯

তারা কেউ গান শুনিয়েছেন। কেউ লিখেছেন হিরন্ময় কবিতা। কেউ আবার গল্প-উপন্যাসের মালা গেঁথে সাজিয়েছেন বাংলা সাহিত্যের ঢালি। কেউ বা নিরলস জ্ঞানচর্চায় যোগ করেছেন বুদ্ধিবৃত্তির নতুন মাত্রা। তাদের সেই দিন আজ আর নেই, কেউ হারিয়ে গেছেন মহাকালে, কেউ বা এক পা বাড়িয়ে রেখেছেন সেই পথে। তবে তাদের কথা আছে; তাদের কর্মে আর সৃজনশীলতায় তো বটেই, আমার কাছেও— কাগজের ভাঁজে ভাঁজে, শব্দগুচ্ছের আড়ালে, বিভিন্ন সময়ে গৃহীত সাক্ষাৎকারে। হয়তো সেই কথাগুলো আবারো জেগে ওঠতে পারে আপনার মননস্পর্শ পেলে। চলুন পাঠ নেয়া যাক

বর্তমান পর্যায়ে এসে যেহেতু আমার সময় কম এবং যেহেতু একটা বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে আমি পড়ি, এজন্য আমি কয়েক পৃষ্ঠা উল্টিয়ে দেখি, এটা পড়ার উপযুক্ত কিনা, এটা পড়ার জন্য আমি সময় দিতে পারব কিনা। যদি মনে হয়, উপযুক্ত, তখন পড়ি— হাসনাত আবদুল হাই

সালটা মনে নেই, তবে সময়টা সত্তর দশকের মাঝামাঝি হবে। ঈদসংখ্যা রোববার নাকি পূর্বাণী দুটোর যে কোনো একটায় হাসনাত আবদুল হাইয়ের ‘বাইরে একজন’ উপন্যাসটি পড়ে অদ্ভুত এক ঘোরে বেশ কয়েকদিন আচ্ছন্ন হয়েছিলাম। না, সমাজবাস্তবতাকেন্দ্রিক লেখা সেটা ছিল না। ব্যক্তিমানুষের নিঃসঙ্গচারিতার আখ্যান। আবু হোসেন নাকি আবু আহমদ অদ্ভুত এক চরিত্র। ভিড়ের ভেতরেও সে একা, সবার মাঝে থেকেও কোথায় যেন হারিয়ে থাকে। সমাজবিচ্ছিন্ন একজন মানুষ অথচ সমাজ এবং বাস্তবতাকে সে অনুধাবনও করে প্রতি পলে পলে, তবে ঠিক খাপ খাইয়ে নিতে পারছে না কোনোকিছুর সঙ্গেই, এ ধরনের চরিত্রকে বোধ হয় আউটসাইডার বলে। ‘বাইরে একজন’ এত ভালো লাগার কারণ কি ছিল? এই এত বছর পর প্রশ্নটা ছুঁড়ে নিজেই উত্তর খোঁজার চেষ্টা করি, আবু হোসেন নাকি আবু আহমদ ওর সঙ্গে নিজের মানসচৈতন্যের মিল পেয়েছিলাম বলে? সেই থেকে, সেই বাইরে একজন থেকে হাসনাত আবদুল হাইয়ের সাহিত্যের সঙ্গে আমার নিরন্তর যাত্রা। তার উপন্যাস, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনি, জর্নাল, জীবনীমূলক উপন্যাস— এই জীবনীমূলক উপন্যাস রচনার তিনিই বোধ হয় পথিকৃৎ আমাদের এই বাংলাদেশে, আমার পরম সৌভাগ্য যে, নব্বই দশকের সূচনালগ্নে, তিনি যখন দেশের একজন ডাকসাইটে আমলা, এই সাক্ষাৎকারটি গ্রহণের সূত্রে আমি তার বেইলী রোডের বাসার ব্যক্তিগত লাইব্রেরি পরিভ্রমণের সুযোগ পেয়েছিলাম। কত যে আকাশ গ্রহ নক্ষত্রে পরিপূর্ণ এবং সমৃদ্ধ সে লাইব্রেরি, ঘুরে দেখতে দেখতে আমার বেশকিছু সময় পেরিয়ে গেছে। স্যার আমাকে হাতে ধরে ধরে দেখিয়েছেন কোন বইগুলো কোন প্রয়োজনে সংগ্রহ করে এখানে রেখেছেন, কীভাবে রেখেছেন! কোন বইগুলো কেন মহার্ঘ্য! সে-এক বড় পয়মন্ত দিন ছিল! আসুন পাঠক! সেদিনের গৃহীত সাক্ষাৎকারটিতে এখন প্রবেশ করা যাক। গ্রন্থ জগতের বিস্ময়কর অনেক বইয়ের মণিমুক্তোর খোঁজ মিলবে!

হামিদ কায়সার: তাহলে আপনার শৈশব-কৈশোরের বই পড়ার অভিজ্ঞতা দিয়েই শুরু করা যাক। আপনার পড়া শুরু হয়েছিল কোন্ বই দিয়ে।
হাসনাত আবদুল হাই: বাংলাদেশের অন্যান্য শিশু-কিশোরের মতো আমারো বই পড়া শুরু হয় রূপকথা দিয়ে। ঠাকুরমার ঝুলি, এধরনের গল্পের বই হাতের কাছে যা পেয়েছি, পড়েছি। কিন্তু সেই ছোটবেলায় আরো একটি ঘটনা ঘটেছে, যেটা হয়তো কিছুটা অস্বাভাবিক মনে হতে পারে। ঘটনাটি হলো, আমি যখন ক্লাশ থ্রিতে পড়ি তখনই ‘বিষাদ সিন্ধু’ পড়ে শেষ করে ফেলি।

হামিদ কায়সার: মাত্র ক্লাস থ্রিতে পড়া অবস্থায়?
হাসনাত আবদুল হাই: হ্যাঁ, ক্লাস থ্রিতে থাকতেই ‘বিষাদ সিন্ধু’ পড়ে শেষ করে ফেলি। পরে এটা একটা ব্যতিক্রমী ব্যাপার বলে আমার কাছে মনে হয়েছে। রীতিমতো অকালপক্বতা যাকে বলে আর কি। এছাড়া অন্যদের মতন শিশু এবং কিশোর বয়সে রূপকথাই বেশি পড়েছি। এরপর ক্লাস ফোরে পড়ার সময় পর্যটক রমানাথ বিশ্বাসের ‘লাল চীন’ বইটা পড়ি। এটা ভ্রমণকাহিনী। তখনই আমার মধ্যে ভ্রমণকাহিনী এবং ভ্রমণের ব্যাপারে একটা বেশ আগ্রহ জন্মে। আমার আব্বা তখন সরকারি চাকরি করতেন, বদলির চাকরি। সেই সুবাদে উভয় বাংলার নানা জেলায় ভ্রমণের অভিজ্ঞতা হয়ে যায়। ভেতরে একটা যাযাবর ভাব আসে। দেশ বিভাগের পরে আমরা ঢাকায় আসি। তারপর যশোরে যাই। ক্লাস ফাইভে ভর্তি হই। যশোর তখন হিন্দু প্রধান ছিল। সেই কারণে আমার প্রায় বন্ধুই হিন্দু ছিল। সেখানে গিয়ে দেখলাম পাড়ায় পাড়ায় বইয়ের লাইব্রেরি আছে এবং বই পড়ার ব্যাপারে ছেলেমেয়েদের মধ্যে একটা প্রতিযোগিতা আছে। এভাবে আমিও প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে ফেললাম। তখন প্রহেলিকা সিরিজ কাঞ্চনজঙ্ঘা সিরিজের রহস্য রোমাঞ্চ বই বিশেষ করে হেমেন্দ্র কুমার রায়, পাঁচকড়ি দে, সৌরিন্দ্র মোহন, নীহাররঞ্জন এদের বই আমি প্রায় কয়েক মাসেই পড়ে শেষ করে ফেললাম। এরপরে একটু প্রাপ্ত-বয়স্কদের জন্য লেখা মোহন সিরিজের বই পড়া শুরু হয়ে গেল, শশধর দত্তের লেখা। সেটা ঠিক কিশোরদের জন্য লেখা না। একটু প্রাপ্ত-বয়স্কদের জন্য। কিন্তু আমরা বন্ধুরা মিলে সেগুলো পড়েও শেষ করে ফেললাম। তার পরে আমরা, একেবারেই প্রাপ্ত-বয়স্কদের জন্য লেখা, যেমন, মনোজ বসু, তারাশংকর, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, অচিন্ত্য কুমার সেনগুপ্ত, সুশীল জানা, বনফুল— এদের বই-পত্র পড়া শুরু করে দিলাম। এইভাবে পড়ার ব্যাপারে আমার মধ্যে একটা অকালপক্কতা এসে যায়। এর কারণ হিসেবে বুঝতে পারি, ঐ যে, যশোরে আমার যে বন্ধুরা, তাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা আর পাড়ায় পাড়ায় যে বইয়ের লাইব্রেরি ছিল— ওসবই সহায়ক হয়েছে।

হামিদ কায়সার: হ্যাঁ, পরিবেশটাই ছিল বই পড়ার জন্যে অনুকূল।
হাসনাত আবদুল হাই: আমার বন্ধুরা, তারা যে খুব বড়লোক, উচ্চবিত্ত ছিল, তা না। নিম্ন-মধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত শ্রেণির, কিন্তু তাদের মধ্যে পড়াশোনার খুব চর্চা ছিল। এবং আড্ডার সময়ও এই পড়া নিয়ে আলোচনা হতো। যশোর থেকে যখন ফরিদপুরে গিয়ে ক্লাস সেভেনে ভর্তি হই তখন পড়ুয়া বন্ধুরা তেমন ছিল না, কিন্তু পড়ার অভ্যাস তো হয়ে গিয়েছে। তাই একা একাই সতীনাথ ভাদুড়ী, সৈয়দ মুজতবা আলী এদের লেখা পড়তে থাকি। মুজতবা আলীর ‘দেশে বিদেশ’-এর চেয়ে ‘পঞ্চতন্ত্র’ যে বেশি ভালো লাগে তার পেছনে ছিলো মননশীলতার প্রতি আকর্ষণ। সেই সময়, স্কুলে থাকতে একটা রচনা লিখে যে পুরস্কারের টাকা পাই তা দিয়ে কিনি ‘পঞ্চতন্ত্র’, আলাউদ্দিন আল আজাদের ‘জেগে আছি’, ‘ধানকন্যা’ এই সব বই। আজাদ খুব সিরিয়াস লেখক ছিলেন। খুব প্রিয় হয়ে গিয়েছিলেন আলাউদ্দিন আল আজাদ। দুঃখের বিষয় শেষের দিকে তার লেখায় উৎকর্ষ থাকলো না। এ ভাবেই আমার কৈশোর কাটে মানে বই পড়ার বিষয় নিয়ে যদি আলোচনা করি। এরপর ১৯৫৪ সালে ম্যাট্রিক পাশ করে যখন কলেজে পড়ি, তখন কবিতা আর প্রবন্ধের বই পড়া শুরু করলাম।

হামিদ কায়সার: কলেজ জীবনটা কোন্ কলেজে কেটেছে?
হাসনাত আবদুল হাই: ঢাকা কলেজে। মনে আছে কলেজে এসে স্কলারশিপের যে টাকা পেলাম, সে টাকা দিয়ে ‘সমর সেনের কবিতা’ সংকলন কিনলাম। বুদ্ধদেব বসুর ‘প্রবন্ধ সংগ্রহ’ সেটি এবং সুধীন্দ্রনাথ দত্তের ‘স্বগত সংলাপ’ বই কিনলাম। তারপর, আঁন্দ্রে জিদের ‘জার্নাল’ এবং সমারসেট মমের ‘এ রাইটার’স নোটবুক’ বইটিও কেনা হলো। এই বইগুলি এখনো বুক শেলফে আছে, ঐ যে— (আমি তাকাই তার লাইব্রেরির দিকে, সীমাহীন এক বিস্তৃতি)

হামিদ কায়সার: অনেক পুরনো...
হাসনাত আবদুল হাই: পুরনো তো বটেই। সেই ১৯৫৪-তে কেনা। তখনতো বেশি টাকা স্কলারশিপ দিত না। প্রথম গ্রেডের বৃত্তির জন্য ১৫ টাকা দিত বা ৩০ টাকা, যা হোক, সে টাকা দিয়ে এসব বই কিনলাম। (বই হাতে নিয়ে) সমারসেট মমের বইয়ের কথা বলছিলাম। সত্যি সত্যি এটা একটি লেখার নোটবই। তিনি যখন যেখানে গিয়েছেন, যা দেখেছেন সঙ্গে সঙ্গে নোট করেছেন— বেশ কিছু গল্প উপন্যাসে এসব তিনি ব্যবহার করেছেন। যেমন, তার বিখ্যাত গল্প ‘দি রেইন’ যেখানে একজন পাদ্রীর মতিভ্রম হলো, পরে আত্মহত্যা করল— এ গল্পটির সূত্রও এই নোটবইয়ে আছে। দেখা যায় যে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই গল্প-উপন্যাস যারা লেখেন, তারা যা লিখেন পুরোটাই কিন্তু কল্পনা না। বাস্তবে সামান্য কিছু হলেও তা ঘটে থাকে— আমার বেলায়ও তাই হয়। মমের সব বইয়ের মধ্যে এই নোটবুকটি আমার প্রিয়। যেমন প্রিয় আঁদ্রে জিদের জার্নাল। দুজনেই খুব পরিশ্রমী এবং আন্তরিক ছিলেন। লেখার ব্যাপারে। রুশোর ‘কনফেসনের’ মতো অতোটা হয়তো অবারিত ছিলেন না তারা। তবু...

হামিদ কায়সার: আপনিও নিয়মিত নোট করেন?
হাসনাত আবদুল হাই: আমি ঠিক এভাবে জার্নাল মেইনটেইন করি না। তবে, হঠাৎ করে একটা ঘটনা, কি একটা সংলাপ, কি একটা দৃশ্য— যেটা আমার কাছে মনে হয় কোনো গল্প বা উপন্যাসের উপজীব্য হতে পারে— সেটা আমি আমার একটা ডায়েরিতে লিখি, পরে যখন একটা লেখার অনুরোধ আসে— নিজের গরজে আজকাল তো লেখাটেখা হয় না, যখন কেউ অনুরোধ করে, চাপ দেয়— তখন আমি ডায়েরিটা খুলে দেখি যে, আচ্ছা, এ পত্রিকার জন্য এই বিশেষ সংখ্যার জন্য কোন লেখাটা, কোন্ আইডিয়াটা ডেভেলপ করলে যথাযথ হবে। সেই সূত্র ধরে লেখাটা দাঁড় করাই। আর আমি যখন ভ্রমণকাহিনি লিখি, তখন আমি পুরোপুরি ডায়েরির উপর নির্ভরশীল। একটা দেশে যাবার পর পথের দু’ধারে কি দেখছি, কার সঙ্গে কথা হচ্ছে, কি বলছি, কি শুনছি তা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে ডায়েরিতে নোট করি। পরে অবশ্যই বইপত্র পড়ে পড়ে এ নোট সাপ্লিমেন্ট করতে হয়। একটা দেশ সম্পর্কে সবই তো আর যা দেখলাম, যা শুনলাম-এর উপর ভিত্তি করে লিখলে হয় না। সেজন্য, সম্পূর্ণতা আনার জন্য, আমি ঐ দেশের ওপরে বইপত্র পড়ি। যেমন, আমি স্পেনের ওপর লিখেছি, তখন আমি নোট তো ব্যবহার করেছি-ই, নোটের সঙ্গে স্পেনের উপর অনেক বই পড়েছি। যেমন, সিভিল ওয়ার বিষয়ে।

হামিদ কায়সার: আপনি কলেজ-জীবনে পড়বার কথা বলছিলেন।
হাসনাত আবদুল হাই: কলেজ-জীবনে আরেকজন লেখকের লেখা পড়েছিলাম, যার তিন খণ্ডের রচনাবলি এখনও আমার লাইব্রেরিতে আছে— ধূর্জটি প্রসাদ। খুবই মননশীল লেখক। ধূর্জটি প্রসাদ একজন অর্থনীতিবিদ, কিন্তু তিনি একজন সাহিত্যিক— মননশীল সাহিত্যিক, প্রবন্ধকার এবং রবীন্দ্রনাথ কর্তৃক প্রশংসিত একজন সঙ্গীতজ্ঞ। উনি নিজে গাইতেন না, কিন্তু সঙ্গীত বিশ্লেষণে, সঙ্গীতকে উপভোগ করার যে ব্যাকরণ— এ সম্পর্কে তার যে জ্ঞান তা অসাধারণ। কলেজে গিয়ে ধূর্জটি প্রসাদের বইয়ের সঙ্গে পরিচয় হলো, পড়া হলো। এভাবেই পড়ার ব্যাপারে এবং লেখকের ব্যাপারে একটা রুচি আস্তে আস্তে আমার মধ্যে গড়ে উঠেছে। যার উপর ভিত্তি করে বিনোদনমূলক যারা লেখেন তাদের চাইতে যারা একটু চিন্তা-ভাবনা করে লিখেন, মননশীল এ ধরনের যারা, তাদের লেখার প্রতি আমার আগ্রহ ক্রমান্বয়ে বেড়ে চলেছে। বিনোদনের জন্যে বই আমি পড়ি না।

হামিদ কায়সার: ভ্রমণ-এর প্রতি আপনার মধ্যে গভীর আগ্রহ লক্ষ্য করা যায়। ভ্রমণ-সাহিত্যের মধ্যে আপনার প্রিয় বই কি?
হাসনাত আবদুল হাই: অন্নদাশংকরের ‘পথে প্রবাসে’। এটি একটি অত্যন্ত বিদগ্ধ, মননশীল ভ্রমণ-কাহিনি। যে বইয়ে শুধু কোথায় গেলাম, কী খেলাম তার উল্লেখ নেই— চমৎকার সব বিশ্লেষণ আছে। সবচেয়ে বড় কথা হলো, ‘পথে প্রবাসে’র যে ভাষা পরিশিলীত সাহিত্যিক ভাষা। ঐ সময়েই দেবেশ দাশ ‘ইউরোপা’ নামে একটি ভ্রমণ-কাহিনি লিখেছিলেন। তিনি ইংল্যান্ডে পড়তেন, ছুটিতে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে গিয়েছেন। এ বইতে তিনি তার ভ্রমণ অভিজ্ঞতা লিখেছেন। এটিও অত্যন্ত মননশীল এবং বিদগ্ধ একটি ভ্রমণ কাহিনি। ১৯৫৪ সালে কেনা এই বইটি এখনো আমার কাছে আছে। এ বইটি আমি প্রায়ই পড়ি। এর ভাষা এতোই অনবদ্য যে, বার বার পড়তে ইচ্ছে করে শুধু ভাষার জন্যে। আর কী গভীর অর্ন্তদৃষ্টি! যেমন, আমি যখন স্পেনে গেলাম, তিনি স্পেন সম্পর্কে যা বলেছেন, গিয়ে দেখলাম যে, সব অক্ষরে অক্ষরে সত্যি। তিনি স্পেন নিয়ে লাইব্রেরিতে বসে যে গবেষণা করেছেন, তা নয়। যা দেখেছেন, তা-ই বিশ্লেষণ করেছেন। সামান্য যা কিছু জানতেন, তার উপর ভিত্তি করে যা লিখেছেন, তাতেই মনে হয় গবেষণা-নির্ভর ঐতিহাসিক বই— দেবেশ দাশের ‘ইউরোপা’। স্কুলে থাকতেই পড়েছিলাম একটি বই, তখনকার বিখ্যাত এবং জনপ্রিয় বই যাযাবরের ‘দৃষ্টিপাত’। কলেজে এসে যখন দেবেশ দাশের ‘ইউরোপা’ এবং অন্নদাশংকর রায়ের ‘পথে প্রবাসে’ পড়লাম, তখন আমার মনে হলো যে, যাযাবর ‘দৃষ্টিপাত’ লিখতে গিয়ে ভাষার ব্যাপারে এ দু’জনের কাছে বেশ ঋণী। এরা দু’জন বাংলা ভাষায় যে সমস্ত নতুনত্ব এনেছেন, বৈদগ্ধ্য এনেছেন, ঔজ্জ্বল্য এনেছেন— এসবের উৎসমূল ঐ দু’জনের লেখা উল্লিখিত দু’টি বই। কিন্তু, যেখানে যাযাবর এ দু’জনকে ছাড়িয়ে গেছেন— সেটা হলো তার কৌতুক-বোধ এবং হাস্য-রসিকতা সম্ভারে। পরায়ণতা একদম নেই— খুব সিরিয়াস। যাযাবরের ‘দৃষ্টিপাত’ আমার কাছে ভ্রমণ কাহিনির একটি মডেল। আমি এ ধরনের ভ্রমণ কাহিনি লেখার চেষ্টা করি। পারি কিনা জানি না।

হামিদ কায়সার: যাযাবরের লেখায় রসবোধ আছে।
হাসনাত আবদুল হাই: হ্যাঁ, সেখানে রস্বোধ আছে, ইতিহাস, রাজনীতি, সমাজনীতি আছে— এসব নিয়ে গুরুগম্ভীর আলোচনা আছে। তার পাশেই আবার হাস্যরস আছে, কৌতুকবোধ আছে, রোমান্টিসিজম আছে। সব মিলিয়েই একটা খুব হিউম্যান ব্যাপার, যান্ত্রিক কিছু মনে হয় না। কিন্তু অন্নদাশংকর রায়ের ‘পথে প্রবাসে’ কিংবা দেবেশ দাশের ‘ইউরোপা’ মনে হয় যেন, মেশিন থেকে বেরিয়ে এসেছে, রক্ত-মাংসের মানুষটাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এজন্য, যাযাবরের ‘দৃষ্টিপাত’ আমার কাছে একটা আদর্শ ভ্রমণ-কাহিনি এবং আমি প্রায়ই সেটা পড়ি। কিন্তু, দুঃখের বিষয়, আজকালকার ছেলেমেয়েরা বোধহয় যাযাবরের নামও শোনে নি। তার বইও মনে হয় পড়ে নি। কিন্তু বইটি এতো চমৎকার, কী বিদগ্ধ চিন্তা আর বুদ্ধিদীপ্ত ভাষা!

হামিদ কায়সার: এখনও ঐ বইটা থেকে অনেকেই অনেক কথা ‘কোট’ করে।
হাসনাত আবদুল হাই: করে?

হামিদ কায়সার: যেমন, ‘আধুনিক বিজ্ঞান দিয়াছে বেগ, কাড়িয়া নিয়াছে আবেগ’। অনেক তরুণের মুখে এ কথা শোনা যায়।
হাসনাত আবদুল হাই : হ্যাঁ। এ ধরনের চমৎকার সব উক্তি, বাক্যবন্ধ আছে। এফোরিজম।

হামিদ কায়সার: যাযাবরের ‘দৃষ্টিপাত’ বইটি এখনো অনেকের বাড়িতেই আছে।
হাসনাত আবদুল হাই: তাই নাকি? চমৎকার। যা হোক ওসব বাংলা ভ্রমণ-কাহিনি পড়ার অনেক পর রবার্ট বায়রন, লরেন্স ভ্যানডার পোস্ট, পল থেরো, ব্রুস চ্যাটউইন, উইলিয়াম ডারলিম্পল, জান মরিস এদের লেখা ভ্রমণ-কাহিনি পড়ি। এরা সবাই এক এক দিকে চমৎকার। সব মিলিয়ে এদের মধ্যে রুস চ্যাটউইনের লেখা আমার সবচেয়ে ভালো লাগে। অস্ট্রেলিয়ার এবোরিজিনসদের দিয়ে লেখা তার ‘সংলাইনস’ ভ্রমণ-সাহিত্যে ক্লাসিক হবার মতো। ইউনিভার্সিটিতে এসে আমাদের সাহিত্যচর্চা-পড়া-লেখার পরিবেশটা আরো বিস্তৃত হলো। সেখানে দেয়াল পত্রিকা বের হতো। জহির রায়হান বের করতেন একটা। পাশপাশি আমার সম্পাদনাতে একটা।

হামিদ কায়সার: এটা কি ক্যাম্পাসে?
হাসনাত আবদুল হাই: হ্যাঁ, ক্যাম্পাসে। এটা এখন মেডিক্যাল কলেজ হয়েছে। সিঁড়ি দিয়ে উঠবার সামনেই গাড়ি বারান্দার দেয়ালে হাতে লেখা গল্প-কবিতা শোভা পেত। আমরা এসে দেখে ঠিক করলাম আমরাও একটা দেওয়াল পত্রিকা বের করবো। সে উপলক্ষে লেখা যোগাড় করা, সম্পাদনা এসব চলতো। পাশাপাশি আমরা সাহিত্য-সভাও করতাম। সবাইকে আমন্ত্রণ জানানো হতো। এভাবে ঐ সময় ক্যাম্পাসে শিশু-সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চার একটা খুব সুস্থ পরিবেশ গড়ে উঠেছিল। প্রতিযোগিতা ছিল। কে ভালো গল্প লিখতে পারে, কে ভালো বক্তৃতা দিতে পারে, কে ভালো কবিতা পড়তে পারে। ঐসব সাহিত্য-সভায় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকেরা সভাপতিত্ব করতেন। ক্লাস শেষে ৫টার পরে, বিশাল একটা রুমে সভা বসতো। এ রকম সাংস্কৃতিক একটা পরিবেশ ছিল তখন। যার জন্য বই পড়া, বই লেখার একটা প্রেরণা ছিল। তখন অবশ্য পত্র-পত্রিকা অনেক কম ছিল। ‘মাহে নও’ বলে একটা পত্রিকা ছিল। ‘মোহাম্মদী’ অনিয়মিতভাবে বেরোত। আবদুল গাফফার চৌধুরী ‘প্রবাহ’ নামে একটা পত্রিকা বের করতেন, পরে ‘মেঘনা’ বের করতেন। আহমদ মীর বার করতেন ‘স্পন্দন’ নামে লিটল ম্যাগাজিন। বোধ করি এদেশের প্রথম লিটল ম্যাগাজিন। সেখানেই প্রথম সৈয়দ শামসুল হকের লেখা পড়ি। তখন খুব রোমান্টিক গল্প-উপন্যাস লিখতেন তিনি। আহমদ মীরও লিখতেন। তার একটা গল্পের নাম ছিল ‘ধোবিয়া তলাও’। রমাপদ চৌধুরীর আদলে লেখা।

হামিদ কায়সার: তখন আর কারা লিখতেন? পড়তেনই বা কাদের লেখা?
হাসনাত আবদুল হাই: সে সময়ে যারা লিখতেন মানে তখন যাদের গল্প উপন্যাসের বই দেখতাম, তারমধ্যে শওকত ওসমানের গল্প-উপন্যাস, সরদার জয়েনউদ্দিন-এর, আবু রুশদেরও বই বেরোত, তবে কম। আর সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ ছিলেন অস্তিত্ববাদী ধারার লেখক। জহির রায়হান, গাফফার চৌধুরী। জহির রায়হান আমার প্রিয় লেখক হয়ে আছেন। তারপর হঠাৎ করে রশীদ করীমের উপন্যাস আমরা পেলাম, উত্তম পুরুষ, প্রসন্ন পাষাণ। এর আগে তার নাম শুনিনি। দুটোই খুব আধুনিক আর বড় মাপের বই। ভাষার ব্যাপারে তার বেশ বৈদগ্ধ্য আছে— আভিজাত্য আছে। রশীদ করীম তখন থেকেই আমার প্রিয় লেখক হয়েছেন। শামসুদ্দিন আবুল কালাম, তার উপন্যাসও আমি পড়েছি। তার কিছু কিছু গল্প আমার খুব ভালো লেগেছে— যেমন ‘অনেক দিনের আশা’, ‘একটি বারবণিতার গল্প’। তার লেখার মধ্যে গ্রাম বাংলার ছবি খুব সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে।

হামিদ কায়সার: ‘কাশবনের কন্যা’।
হাসনাত আবদুল হাই: কাশবনের কন্যা, উপন্যাস। মৃত্যুর পর বেরিয়েছে তার এপিক উপন্যাস ‘কাঞ্চনগ্রাম’। তিনিও আমার প্রিয় লেখক ছিলেন। সরদার জয়েনউদ্দিনের উপন্যাস তো বটেই, গল্পেও গ্রাম-বাংলা বিশেষভাবে ফুটে ওঠেছে— গ্রামীণ জীবন এদের লেখায় যতটুকু পাওয়া যায়, আজকালকার লেখকদের লেখায় সেভাবে পাওয়া যায় না। গ্রামীণ জীবন নিয়ে হাসান আজিজুল হক, আবু বকর সিদ্দিক কিছু সার্থক ছোটগল্প লিখেছেন। ড্রাইভার-হেলপারদের নিয়ে লেখা শওকত আলীর ছোটগল্পও সফল।

হামিদ কায়সার: কবিতা পড়া হতো না?
হাসনাত আবদুল হাই: কলেজে সমর সেন, জীবনানন্দ দাশ আর বুদ্ধদেব বসুর কবিতা পড়েছি। জীবনানন্দ বেশ প্রভাব ফেলেছিলেন তার স্বপ্নময়তা আর নিভৃতির অবগাহনে। বাংলাকে মনে হয়েছে সত্যি রূপসী, এমন তার বর্ণনা। তবে আমি কবিতার ব্যাপারে অতো আগ্রহী ছিলাম না। যদিও ইউনিভার্সিটিতে এসে ছড়া লিখেছিলাম। কবিতার বই খুব একটা পড়তাম না। ঐ সময়ে কবিতার বই খুব নয়, কিছু বেরিয়েছে, তবে কবিরা বেশ সক্রিয় ছিলেন। যেহেতু আমি নিজে কবিতা লিখতাম না, তাই কবিতার প্রতি আগ্রহ কমই ছিল। আমার পড়াশোনা বিশেষ করে গল্প-উপন্যাসেই সীমাবদ্ধ ছিল। তবে শামসুর রাহমানের রোমান্টিক সব কবিতা, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর ছড়ায় মুগ্ধ হয়েছি কবিতার ব্যাকরণ না বুঝেই। সেই সময় শামসুর রাহমানের ‘রূপালী স্নান’ কবিতাটিকে মনে হয়েছে কবি-সাহিত্যকদের ঘোষণাপত্রের মতো।

হামিদ কায়সার: বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে বিদেশি সাহিত্যেরও সংস্পর্শ পেয়েছিলেন?
হাসনাত আবদুল হাই: হ্যাঁ। বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে বিদেশি সাহিত্যের প্রতি খুব আগ্রহ জন্মালো। টলস্টয়ের ‘ওয়ার অ্যান্ড পীস’ পড়া হলো। ডস্টয়ভস্কি দারুণ প্রিয় হয়ে গেলেন। গোর্কির ‘মা’, অভিভূত করে ফেললো। সলোকোভের ‘ধীরে বহে ডন’, পার্ল বার্কের ‘গুড আর্থ’-ও ঐ সময়ে পড়ি। এরপর ফরাসী লেখকদের প্রতি দারুণ আকর্ষণ বোধ করি। সাঁর্ত্রে, কামু, আঁদ্রে ব্রেঁতো, লুই আরাগঁ, জাঁ করতোঁ আন্দ্র্ েজিদ, ফ্লবেয়ার। এদের মধ্যে সাঁর্ত্রে আর কামুই প্রিয় হয়ে থাকেন শেষ পর্যন্ত, তাদের উপন্যাসেও দর্শন আছে অস্তিত্ববাদ, এলিয়েশন ইত্যাদি। কাফকার গল্প-উপন্যাস তীব্রভাবে কাছে টানে। তার সব বই আমি তখন পড়েছি— সব বইয়ের সংগ্রহ আছে আমার কাছে। এই সব লেখকদের পাশাপাশি ইংরেজ লেখক ডি এইচ লরেন্স, ব্রন্টি ভগিনীদ্বয়, জর্জ এলিয়ট, কনরাড, জর্জ অরওয়েলের বই ঐ সময়ে পড়া হয়ে যায়। এইভাবে দেশি সাহিত্য, বিদেশি সাহিত্য একসঙ্গে পড়ে যাচ্ছিলাম সে সময়ে কিন্তু পশ্চিম বঙ্গের সাহিত্যের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন ছিলাম।

হামিদ কায়সার: কেন, কি কারণে?
হাসনাত আবদুল হাই: ঐ সময়ে মানে ষাটের দশকে পশ্চিম বাংলার বই আসতো না। যা পড়েছি সেই স্কুলের ছাত্র জীবনে— বনফুল, তারাশংকর, মানিক। এরপরে যে একটা গ্রুপ এসেছে— তার খবর রাখতাম না, বইও পাওয়া যেত না, পড়তামও না। ১৯৫৬ থেকে ১৯৬০ সাল আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবন— এই সময়কালে আমাদের নিজেদের লেখকদের মানে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের লেখকদের লেখাই বেশি পড়েছি— সরদার জয়েনউদ্দিন, রশীদ করীম, সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ, শামসুদ্দিন আবুল কালাম, আবু রুশদ, সৈয়দ শামসুল হক, হাসান আজিজুল হক, জহির রায়হান, আলাউদ্দিন আল আজাদ, টিপু সুলতান, শওকত আলী, এদের লেখা। পাশাপাশি বিশ্বসাহিত্যের প্রতি তখন আমার আগ্রহ আরো বেড়ে গেছে। কারণ, বিদেশি বই ব্রিটিশ কাউন্সিলে পাওয়া যাচ্ছে, নিউ মার্কেটের বিভিন্ন দোকানে পেঙ্গুইন সিরিজের, সিগনেটের বই সাড়ে তিন শিলিং আর পঁচিশ কি পঞ্চাশ সেন্ট দিয়ে পাওয়া যেত। ঐ সময়ে আমার পড়ার ব্যাপারে এভাবে বেশ বৈচিত্র্য আসলো। শুধু উপন্যাস-গল্প নয়। যেমন টয়েনবী, টয়েনবীর যে ইতিহাস সেটা আমাকে বেশ মুগ্ধ করে ফেললো— ‘স্টাডি অফ হিস্ট্রি’ দর্শনও, উইল ডুরান্তের ‘দি স্টোরি অব ফিলোসফি’, বিজ্ঞান বিষয়েও কিছুটা আগ্রহ দেখা দিল। বিশেষ করে ডারউইনের তত্ত্ব। মহাকাশ নিয়ে তখন অবশ্য কার্ল সাগান, স্টিফেন হকিং, পল ডেঙিস বা ওয়াহিন বার্গের পপুলার সায়েন্স বই বের হয় নি। কসমোলজি নিয়ে আমার আগ্রহ, সম্প্রতি বই পাবার সুযোগ হয়েছে। বিজ্ঞান-ইতিহাস এবং শিল্প। শিল্প বলতে আর্ট। আর্টের বিভিন্ন বই পড়লাম। যেমন, আরভিং স্টোন পড়লাম, আরভিং স্টোনের ‘লাস্ট ফর লাইফ’-এ ভ্যান গগের যে জীবন, ‘তা পড়ে শিল্পীদের প্রতি আগ্রহ জন্মালো।’ তারপর থেকেই, শিল্পীদের প্রদর্শনী দেখতে যেতাম। তাদের ওপর লেখা বইপত্র পেলেই পড়তাম।

হামিদ কায়সার: ‘লাস্ট ফর লাইফ’ বইটি পড়ার প্রভাব থেকেই এটা হলো?
হাসনাত আবদুল হাই: এই বইটা পড়ার ফলেই। আমার মনে হলো শিল্পীদের জীবন তো খুব কষ্টের, ত্যাগের। বাইরে থেকে মনে হয় গ্ল্যামারাস। অথচ গ্ল্যামারাস তো নয়। বেশ কষ্টের— পরিশ্রমের, বেশ ত্যাগের। খুব সাফারিং আছে ওদের লাইফে। তারপর থেকেই ওদের জীবন, ওদের শিল্পকর্মের প্রতি আমার বেশ আগ্রহ জন্মালো। শিল্পের ওপর প্রচুর বই পড়তে শুরু করলাম, শিল্প বোঝার চেষ্টা করলাম! এসব বইয়ের মধ্যে ভাসারির লেখা ‘লাইভস অফ দি আর্টিস্টস’ এবং হারবার্ট রিডের ‘মিনিং অফ আর্ট’ উল্লেখযোগ্য। হারবার্ট রিড আমার প্রিয় শিল্প-সমালোচক। এরপর ’৬০ সালে আমি আমেরিকায় চলে যাই।

হামিদ কায়সার: পড়াশোনাতেও নিশ্চয়ই বড় ধরনের একটা বাঁক এলো?
হাসনাত আবদুল হাই: ব্যাপকভাবে। ঐ দেশে গিয়ে আমেরিকান সাহিত্য, বিশেষ করে বিট জেনারেশনের যে দিকপাল জ্যাঁক ক্যারুয়াক, লরেন্স মার্লেনগেতি, অ্যালেন গিপ্সবার্গ এদের বইপত্র খুব পড়লাম। ক্যাম্পাসে বিটদের একটা গ্রুপ ছিল। তাদের সঙ্গেও আমার বেশ দেখাশোনা, আলোচনা হতো। বিট জেনারেশনের বই আমি ওখানে খুব পড়লাম। পাশপাশি অবশ্য মূলধারার যারা ছিলেন তাদের লেখাও পড়লাম।

হামিদ কায়সার: ফকনার।
হাসনাত আবদুল হাই: ফকনার, স্টেইনব্যাক, জন ডল্স প্যাসেস, মেলভিল, থিওডর ড্রেইজার, হেনরি জেমস, সিনক্লেয়ার লুইস, হেমিংওয়ে, সেলিঞ্জার, র‌্যালফ এলিসন, ট্রুমান ক্যাপোর্ট, নেলসন আলগ্রেন, এইসব লেখকের বই। মোট কথা, আমেরিকায় যারা প্রধান ঔপন্যাসিক ছিলেন তাদের বই পড়লাম। এদের মধ্য হেমিংওয়ে, সেলিঞ্জার, ট্রুমান ক্যাপোর্ট আর র‌্যালফ এলিসন প্রিয় হয়ে গেলেন। হেমিংওয়ে ‘দি ওল্ড ম্যান এ্যান্ড দি সি’, ট্রুমান ক্যাপোটের গল্পগ্রন্থ ‘আদার ভয়েসেজ, আদার রুমস’। র‌্যালফ এলিসনের ‘ইনভিজিবল ম্যান’ পড়ি। ঐ সময় একটা বই পড়লাম, জেমস এ্যাগি বলে একজন সাংবাদিকের লেখা বই, ‘লেট আস্ প্রেজ দি ফেমাস’। এটা হলো ঐ যে, ওকলাহোমায়, যখন খরার সময়, তিনি ওখানে গিয়েছিলেন। গিয়ে কিছু কিছু চরিত্রের তিনি ইন্টারভিউ নিয়েছিলেন, তারা যে ওখানে অসম সাহসিকতার সঙ্গে প্রতিকূল পরিবেশে লড়াই করে যাচ্ছে। এদের ব্যাপারে উনি বললেন যে, এরাই হলো হিরো ‘লেট আস্ প্রেজ দি ফেমাস’। এদেরই ইতিহাসের আসল নায়ক হওয়া উচিত। এ বইটা আমাকে ভীষণভাবে আলোড়িত করেছিল। বইটি পড়ার কিছুদিন পরই, আরেকটি সম-সাময়িক ঘটনা; ক্যালিফোর্নিয়ায় কিছু সস্তা শ্রমিক আসতো মেক্সিকো থেকে, ইল্লিগ্যাল। ওরা এসে ভেজিটেবল, টমেটো এগুলো হারবেস্ট করতো। ওদেরকে ঠিক সরকারি যে হারে মজুরি দেওয়ার কথা, তা দেওয়া হতো না। নানানভাবে এক্সপ্লয়েট করা হতো। এর উপর একটা টেলিভিশন ফিল্ম হয় ‘বিটার হারভেস্ট’ নামে, ওটার সঙ্গে স্টেইনব্যাকের ‘গ্রেপস অব র‌্যাথস’-এর একটা সাদৃশ্য আছে— একই ব্যাপার প্রায়। আমেরিকায় গিয়ে এভাবেই অনেক আমেরিকান গল্প-উপন্যাস পড়া হলো। লেখকদের মধ্যে জ্যাঁক ক্যাকোয়াক-এর বেশ ভক্ত হয়ে গেলাম। তার ‘অন দ্য রোড’, ‘ধর্মবাম’, ‘সাবতারিয়ান’— এগুলো পড়েছি। মূলধারার বাইরে হলেও বেশ শক্তিশালী তার লেখা। আর বিট কবিদের মধ্যে গিনসবার্গের ‘হাউল’ তো তখনই দারুণ তোলপাড় তুলেছিলো। ‘আই হ্যাভ সিন দ্য বেস্ট মাইন্ড অফ মাই জেনারেশন গন রেভিং ম্যাড’, কি বলিষ্ঠ উচ্চারণ দ্রোহের এই সব কথায়।

হামিদ কায়সার: শুধুই কি পড়তেন? লেখালেখি?
হাসনাত আবদুল হাই: তখন আমি লিখতাম না। বলতে গেলে লেখা ছেড়ে দিয়েছি। ১৯৬০-এ বিদেশ যাওয়ার পর আমি আর লিখি নি। বিট-দের যে জীবন দর্শন— ঘুরতে হবে, বন্ধনমুক্ত হয়ে থাকতে হবে, এটা আমাকে মোটামুটি একটা বোহেমিয়ান লাইফে নিয়ে যেতে প্রভাবান্বিত করেছে। ঐ সময়, আর্থার মিলারের নাটক সব আমি পড়লাম। আর্থার মিলার-এর ‘ডেথ অব এ সেলসম্যান’, ‘ইউ ফ্রম দ্য ব্রিজ দ্য ক্রসিবল’— যেটা সালেমের উইচ হানটিং নিয়ে লেখা। কিন্তু, একচুয়্যালি বইটা রূপক। ঐ বইয়ের মাধ্যমে উইচ হানটিং বলতে তিনি বোঝাতে চেয়েছেন ম্যাককাথিজমকে। ষাটের দশকের আগে ম্যাকার্থি নামের এক সিনেটর বিভিন্ন মহলে শিল্পী-সাহিত্যিক-অভিনেতা-রাজনীতিকদের মধ্যে কে কমিউনিস্ট এটা নিয়ে সাংঘাতিক একটা বিচার এবং জেরার ব্যবস্থা করেন— ওটার ওপর ভিত্তি করে আর্থার মিলার ‘দ্য ক্রুসিবল’ নাটকটি লেখেন। অবশ্য তার সবচাইতে বিখ্যাত নাটক হলো, ‘ডেথ অব এ সেলসম্যান।’ এটা ক্লাসিক। এই নাটকটিও আমার দেখার সৌভাগ্য হলো। এবং আর্থার মিলার আমার একজন প্রিয় লেখক হয়ে গেছেন। যদিও আমি এর আগে কোনো নাটক পড়িনি এবং নাট্যকারের প্রতি আগ্রহ ছিল না। কিন্তু, এরপর আর্থার মিলারের সব বই কিনলাম, পড়লাম। আর্থার মিলার একটা ফিল্ম স্ক্রিপ্ট লেখেন, পরে বইয়ের আকারে বেরিযেছে। ওটাও পড়ার মতন। ক্লার্ক গ্যাম্বল ছিলেন প্রধান চরিত্রে আর মেরেলিন মনরো হলো নায়িকা। আর্থার মিলার সত্তর দশকের পরে আরো একটি স্ক্রিপ্ট লিখেছেন, ‘আফটার দ্য ফল’— এটা লিখেছেন তিনি তার প্রয়াত’ স্ত্রীকে নিয়ে। একজন অভিনেত্রী, কিভাবে আস্তে আস্তে মানসিক বৈকল্যের শিকার হচ্ছে এই বিশ্লেষণ নিয়ে বই— এটা লেখার জন্য তিনি খুব সমালোচিত হয়েছেন, যে, তার নিজের একজন কাছের মানুষ, হতে পারে ডিভোর্স হয়েছে— একজন খুব নিকটের মানুষের প্রাইভেসিকে তিনি এক্সপোজড করলেন, ব্যবহার করলেন— এজন্যে তিনি সমালোচিত হয়েছেন। ঠিক ইদানীং যেমন কাগজে পড়লাম।

হামিদ কায়সার: ইংল্যান্ডের রাজ কবি...
হাসনাত আবদুল হাই: ইংল্যান্ডের নোবেল লরিয়েট টেড হিউজ সম্পর্কে যে, তিনি তার স্ত্রী সিলভিয়া প্লাথের উপরে বিভিন্ন কবিতা লিখেছেন যাতে প্লাথের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ক্ষুণ্ণ হয়েছে। এটা নিয়েও লোকে কিছুটা সমালোচনা করেছে। যাহোক, ঐ সময়ে গল্পকার ঔপন্যাসিকদের পাশাপাশি নাট্যকার আর্থার মিলার আমাকে মুগ্ধ করেছে। এরপরে আমি অন্য নাটকও পড়া শুরু করলাম। যেমন, টেনেসি উইলিয়ামসের নাটক। হয়তো তার নাটকে তেমন গভীরতা নেই, কিন্তু বেশ সমসাময়িক এবং বুদ্ধিদীপ্ত, ‘ক্যাট অন এ হট টিন রুফ,’ নামগুলিই কি চমৎকার, ‘সাডেনলি লাস্ট সামার,’ ‘স্ট্রিট কার নেম্ড্ ডিজায়ার।’ তার অনেকগুলি নাটকই পরে সিনেমা হয়েছে। তার অনেক নাটক এখনো আমার লাইব্রেরিতে রয়েছে। ইউজিন ও নীল অবশ্য টেনেসি উইলিয়ামের চেয়েও বুদ্ধিদীপ্ত, তার লেখা ‘দি মিল্ক ট্রেন ডাজ নট স্পপ হিয়ার এনি মোর’ পড়ার পর খুব অভিভূত হই। পরে সিনেমা দেখি— বেশ বিমূর্ত চিন্তা, দার্শনিক ব্যাপার-স্যাপার। তবে আমেরিকান নাট্যকারদের মধ্যে মিলারই আমার প্রিয়। তারপরই এডওয়ার্ড এলবি। তিনি বেশ পরে এসেছেন।

হামিদ কায়সার: মূলধারার বাইরে আমেরিকান আর কোন লেখকের লেখা পড়েছেন তখন? কারা প্রিয় ছিলেন তাদের মধ্যে?
হাসনাত আবদুল হাই: বিট-জেনারেশনের কথা তো বলেছি। মূলধারার বাইরে গোষ্ঠীবদ্ধ না, প্রায় একাকী সাহিত্যচর্চা করেছেন এদের মধ্যে উইলিয়াম বারোজ ড্রাগ খাওয়ার পর প্রতিক্রিয়ার অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখেন ‘দি নেকেড লাঞ্চ’ এবং এরপর ‘মেথড রাইটিং’ নামে নিরীক্ষামূলক উপন্যাস ‘দি টিকেট দ্যাট এক্সপ্লোডেড’। অনুকরণীয় কিছু নয় কিন্তু পড়তে ভালো লাগে ব্যতিক্রমী হওয়ার জন্য। আর যৌনতা নিয়ে বাড়াবাড়ির জন্য যিনি কুখ্যাত হয়ে যান ‘ট্রপিক অফ ক্যান্সারের’ লেখক হেনরি মিলার তার সব বইও পড়ি তখন। তেমন সাহিত্যমূল্য নেই, তবে পড়তে কষ্ট হয় না। ‘ট্রপিক অফ ক্যান্সার’-এ প্যারিস শহরের রাস্তা, অলি-গলির যে বিশদ বর্ণনা তাতে কোনো ট্রাভেল গাইডের প্রয়োজন পড়ে না। আমার ভ্রমণ-কাহিনিতে রাস্তাঘাট, পারিপার্শ্বিকের যে বিশদ বর্ণনা দেই সেটা অনেকটা তার প্রভাবে বলা যায়।

হামিদ কায়সার: আমেরিকা পর্বের পর? দেশে ফিরে এলেন, এরপর?
হাসনাত আবদুল হাই: এরপর, ’৬২-র দিকে আমি ইংল্যান্ড চলে আসি। এমনি বেড়াবো কিছু দিন এমন পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হয়ে গেলে থেকে গেলাম। বললাম না, বোহেমিয়ান ভাব এসে গেছিল। সেখানে দু’বছর মানে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত থাকি। ইংল্যান্ডে এসে আবার আরেক গ্রুপ ‘অ্যাংরি ইয়াংম্যানদের’ লেখার সঙ্গে পরিচিত হবার সুযোগ পেলাম। জন অসবর্ন, এলান সিলেটো, ওয়েসকার, নাট্যকার, ঔপন্যাসিক এইসব কয়েকজন। এদের লেখা আমি পড়তে শুরু করলাম, জন অসবর্নের ‘লুক ব্যাক ইন এ্যাঙ্গার’ নাটকটিকেই ধরা হয় এদের মানিফেস্টো বলে। অ্যাংরি ইয়াংম্যান, এই গোষ্ঠীটির বিদ্রোহ হলো ওয়েল ফেয়ার স্টেট ইংল্যান্ডে কোন চ্যালেঞ্জ নেই। সবকিছু রাষ্ট্রই করছে। এটার ব্যাপারে তাদের একটা বিদ্রোহ, ক্ষোভ যে, সেখানে আর কিছু করার নাই। সব গভর্নমেন্ট করে দিচ্ছে। একটা অতৃপ্তি— জন অসবর্ন, আর্নেন্ড ওয়েস্কার এঁরা নাটকের মাধ্যমে রাগী যুবকদের দর্শনকে তুলে ধরতে লাগলো। আর ঔপন্যাসিক এলান সিলিটের ‘স্যাটারডে নাইট এ্যান্ড সানডে মর্নিং’ উপন্যাসের নায়ক হলো এই বিদ্রোহী প্রজন্মের প্রতিভূ। শুনেছি আমাদের এখানে বিশেষ করে কোলকাতাতে তখন এদের একটা অনুগামী দল সৃষ্টি হয়েছিল। আমি যখন ইংল্যান্ডে গেলাম, তখন অ্যাংরি ইয়াংম্যানদের খুব প্রতাপ। বিশেষ করে নাটকে। এদের নাটক পড়েছি, কিছু কিছু নাটক দেখেছি— সব নাটক তো আর দেখতে পারি নি। কারণ, টিকেটের খুব দাম। তবু, যতটা পেরেছি দেখেছি। তখন ওরাও আমাকে বেশ ইনফ্লুয়েন্স করেছে, এই জন্য যে, ওরা একটা নতুন জিনিস করছে। ঐ সময়ে আরেক ধরনের বই ইংল্যান্ডে আমার পড়ার এবং দেখার সুযোগ হয়েছে। সেটা হলো, অ্যাবসার্ড সমস্ত নাটক; আয়েনেস্কো, বেকেট— এদের নাটক দু’একটি দেখেছি। সব দেখার মত সচ্ছলতা আমার ছিল না। তবে, তাদের বই আমি কিনেছি, বেকেটের প্রায় সব বই আমার আছে, তার উপন্যাসগুলো আমার বেশি প্রিয়। লন্ডন প্রবাসের এই দু’বছরে, মেইনস্ট্রিম থেকে একটু আলাদা হয়ে, পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছে, এ ধরনের যারা লেখে, তারা আমাকে বেশ আকর্ষণ করলো। এ কারণেই আয়েনেস্কো, বেকেটÑএদের নাটক পড়তে শুরু করি। ১৯৬৪-তে কেনা ‘ওয়েটিং ফর গডো’ বইটি এখনো আমার সংগ্রহে আছে। বইটি কিনে পড়ার পর নাটকটি আমি দেখতেও গিয়েছিলাম। তখন খুব একটা বুঝতে পেরেছি বলবো না। কিন্তু, ব্যাপারটি যে খুব সিরিয়াস এবং এরমধ্যে যে একটি দর্শন আছে, তা বেশ বোঝা গেছে। ইংল্যান্ডের সেই দু’বছর আমার জন্যে বেশ ফলপ্রসু ছিল, পড়ার দিক দিয়ে প্রোডাকটিব ছিল। আমি কিন্তু তখন লিখি নি। এই যে আমেরিকায় দু’বছর থাকলাম, ইংল্যা-ে দু’বছর থাকলাম এসময়ে আমি কিছুই লিখিনি; নোট-ফোট কিছুই না— শুধু পড়েছি; কোনদিন যে আবার লিখবো, সে ধারণাও আমার মনে আসে নি।

হামিদ কায়সার: এর আগে কি কিছু লিখেন নি?
হাসনাত আবদুল হাই: লিখেছি। ১৯৫৫ থেকে ১৯৬০ সাল পর্যন্ত, বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে বিদেশে যাবার আগে। তবে প্রকাশিত বই ছিল না। অনেক গল্প লিখেছি। দু’তিনটা উপন্যাস লিখেছি। ১৯৬০ সালে। পত্রিকার বিশেষ সংখ্যায়, উপন্যাস বেরিয়েছে। রোমান্টিক-উপন্যাস ‘সাগর থেকে ফেরা’। ‘অরণ্য নগর’টা অবশ্য একটু সিরিয়াস ছিল, গ্রামীণ পটভূমি। গ্রাম বদলে যাচ্ছে রাস্তা হচ্ছে, এ ধরনেরই একটি কাহিনী। কোন বই ছাপা হয় নি। তখন বই প্রকাশ করাটা অতো সহজসাধ্য ছিল না, এত প্রকাশক ছিল না। আর আমারও আগ্রহ ছিল না পাণ্ডুলিপি নিয়ে প্রকাশকদের কাছে ধর্ণা দেওয়ার। যাই হোক, ইংল্যান্ডে ঐ দু’বছর নাটক দেখে, অ্যাংরি ইয়াংম্যানদের বই পড়ে আমার বেশ কাটলো। ঐ সময় বেকেট আমাকে মুগ্ধ করে রেখেছিল। তার লেখার শৈলী, বিশেষ করে অগতানুগতিক সংলাপ আমার খুব ভালো লেগেছিল। কিংসলে আমিস, মার্টিন এমিস তার ছেলে- সেও ঔপন্যাসিক হয়েছে। মার্টিন এমিস-এর বাবা কিংসলে আমিস-এর লেখা অতোটা ভালো না হলেও মোটামুটি পর্যায়ের। জন ব্রেইনের ‘রুম এ্যাট দ্য টপ’ সাড়া জাগিয়েছিলো। পরে সিনেমাও হয়। কিন্তু ঐ দলের ঔপন্যাসিকদের মধ্যে এলান সিলিটোই ছিলো আমার প্রিয়। তার দুটো উপন্যাসই সিনেমা হয়েছে। ১৯৬৪-এর মাঝামাঝি আমি দেশে চলে আসি। কিছুদিন অধ্যাপনা করলাম। ঐ এক বছর খুব একটা পড়াশোনা হয় নি। কারণ, আমি সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা দেওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। এরপর সরকারি চাকুরিতে ঢুকলাম।

হামিদ কায়সার: আবার নিশ্চয়ই পূর্ণ উদ্যমে পড়াশোনা শুরু হলো?
হাসনাত আবদুল হাই: না। পড়া কম হয়েছে। যা পড়েছি তাও ইতিহাসের বই— বিশেষ করে কলোনিয়াল হিস্ট্রি। এগুলি খুব পড়েছি। পেন্ডোরাল মুনের ‘ডিভাই- এন্ড কুইট’। ফিলিপ উডবাফের ‘দি ম্যান হু রুলড ইন্ডিয়া’ আরো একজন যার নাম এই মুহূর্তে মনে আসছে না। তাঁর লেখা ‘দি গ্রেট ডিভাইড’, দেশ বিভাগের ওপর এইসব বই। তারপর, ব্রিটিশ কলোনিয়াল অ্যাডমিনিস্ট্রেটরদের বেশ কিছু লেখা— সব ইতিহাসগামী লেখা। এই সময়ে সুইডিস অর্থনীতিবিদ গুনার মরডালের তিন খণ্ডে লেখা ‘দি এশিয়ান ড্রামা’ বইগুলি পড়ে ফেলি। আমি অর্থনীতির ছাত্র, তিনি আমার প্রিয় অর্থনীতিবিদ। এরপর আমি যখন চাকুরির সুবাদে পশ্চিম পাকিস্তানে থাকি তখন পশ্চিম পাকিস্তানী লেখক সাদত হাসান মান্টো, পশ্চিম পাকিস্তানি বলবো না, উর্দু ঔপন্যাসিক; খাজা আহমদ আব্বাস, ইসমাত চুগতাই, কৃষণ চন্দর— এদের বই কিছু কিছু অনুবাদ পেয়েছি ইংরেজিতে। সেগুলো পড়েছি। বিশেষ করে সাদত হাসান মান্টোর লেখা আমার খুব ভালো লেগেছে। সাদত হাসান মান্টো আমার প্রিয় লেখক। ১৯৭১ সালে, স্বাধীনতার পরে, লেখার প্রতি আমার আবার আগ্রহ হলো। তখন চারিদিকে সৃজনশীলতার একটা প্রবাহ বয়ে যাচ্ছে— নাটক হচ্ছে, নাট্যোন্দোলন হচ্ছে, কবিরা কবিতা পাঠ করছে। ছাত্র জীবনে ইউনিভার্সিটিতে এসে আমরা যেরকম এবং উৎসাহ নিয়ে কাজ করেছি, পরিবেশটা তখন সেরকমই। ঐ সময়ে আবার, যেহেতু আর কোন বিধি-নিষেধ নেই, এই প্রথম শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়, শীর্ষেন্দু, সমরেশ বসু, মহাশ্বেতা দেবী, কমলকুমার মজুমদার এইসব পশ্চিম বাংলার লেখকদের বইপত্র আসা শুরু করলো। আমি ওঁদের লেখা পড়লাম। এদের মধ্যে কমলকুমার মজুমদার, মহাশ্বেতা দেবী, সমরেশ বসুর লেখা আমাকে বেশ প্রভাবান্বিত করলো। এদের মধ্যে কমলকুমার আমার প্রিয় লেখক হয়ে গেলেন তার গদ্যের জন্য, তীক্ষ্ণ দৃষ্টিভঙ্গীর গুণে।

হামিদ কায়সার: সমরেশ বসু আর কমলকুমারের কোন বইগুলো পড়েছিলেন তখন?
হাসনাত আবদুল হাই: মহাকালের রথের ঘোড়া, বাঘিনী এইসব। তার একটা ছোটগল্প তো দারুণভাবে চমকে দিয়েছিলো ‘সানা বাউরীর কথকতা’। মারাত্মক ছোটগল্প ইনসেস্ট নিয়ে লেখা। তিনি ছোটগল্পও খুব ভালো লিখেছেন। কমলকুমারের অন্তর্জলী যাত্রা, সুহাসিনীর পমেটম এই সব। ইদানীং, এখন যারা পশ্চিম বাংলায় লিখছেন তাদের মধ্যে জগদীশ মিশ্র, অনিল ঘড়াই, তারপর দেবেশ রায়, দেবেশ রায়ের লেখায় নতুনত্ব আছে। খুব জীবনমুখী লেখক। দেবেশ রায়কে আমার সবচেয়ে ভালো লাগে এখন, পশ্চিম বাংলায় যারা লিখছেন তাদের মধ্যে। ‘তিস্তাপারের বৃত্তান্ত’ খুব শক্তিশালী লেখা। তার লেখার মধ্যে নতুনত্ব আছে, মুন্সীয়ানা আছে, আর খুব জীবনঘনিষ্ঠ এবং বাস্তববাদী। তিনি আমার একজন প্রিয় লেখক। জগদীশ মিশ্র— তার লেখায় লোককথা, পুরাণ এগুলোকে নিয়ে এসে বেশ একটা নতুন শৈলী সৃষ্টি করেছেন।

হামিদ কায়সার: বাংলাদেশের লেখকদের মধ্যে ভালো লাগে কার লেখা?
হাসনাত আবদুল হাই: বাংলাদেশে অবশ্যই আমার প্রিয় লেখকদের মধ্যে একজন সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ— তার লেখায় আভিজাত্য আছে, নতুনত্ব আছে, পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রবণতা আছে। শক্তিশালী লেখক। তার লালসালু, চাঁদের অমাবস্যা, কাঁদো নদী কাঁদো— এসব উপন্যাস একেকটি ক্ল্যাসিক। জ্যোতিপ্রকাশ দত্তের কিছু লেখা, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের কিছু লেখা বেশ ভালো লাগে। হাসান আজিজুল হকের কিছু লেখা, আবু বকর সিদ্দিকের কিছু লেখা, সৈয়দ শামসুল হক-এর কিছু লেখা, সেলিনা হোসেন-এর কিছু লেখা, শওকত আলীর কিছু লেখা, মাহমুদুল হক-এর কিছু লেখা, রিজিয়া রহমান, রাবেয়া খাতুনের এবং রাহাত খানের কিছু লেখা ভালো লাগে। এতবার ‘কিছু লেখা’ বললাম এই জন্য যে তাদের সব লেখাই আমার ভালো লাগে না, এটাই স্বাভাবিক। আর আমাদের চেয়ে বয়সে কম, এদের মধ্যে ইমতিয়ার শামীম, নাসরীন জাহান। কনিষ্ঠ লেখকদের মধ্যে নাসরীন জাহানকে আমি অত্যন্ত উঁচুদরের লেখক বলে মনে করি। খুবই শক্তিশালী। আমাদের সমাজে একজন মেয়ে কি করে তার অভিজ্ঞতার এতো ব্যাপকতা আনতে পারে লেখায় এবং এতো নিষ্ঠার সঙ্গে, এতো ট্রথফুলি, এতো সত্যনিষ্ঠভাবে— এটা ভাবলে অবাক লাগে। আমরা পুরুষরা অভিজ্ঞতা নানাভাবে অর্জন করতে পারি— ইচ্ছেমতো এখানে সেখানে যেতে পারি। কিন্তু, একটা মেয়ের পক্ষে এ সুযোগ নেই। ওঁর যে লেখা, সে লেখার মধ্যে যে বক্তব্য, যে ঘটনা, যে পরম্পরা, চরিত্রের যে চিত্রণ তা এতো জীবন ঘনিষ্ঠ— মনে হয় যেন ঐসব জীবন সে নিজেই যাপন করে এসেছে। আর ঐ ছেলেটার নাম কি, আমি ভুলে গেলাম, যে লিখেছে ‘সে রাতে পূর্ণিমা ছিল’—

হামিদ কায়সার: শহীদুল জহির।
হাসনাত আবদুল হাই: হ্যাঁ, শহীদুল জহির। শহীদুল জহির খুব শক্তিশালী লেখক এবং তার লেখায় নতুনত্ব আছে, গতানুগতিক না। আরেকটি ছেলে, আমি নাম মনে করতে পারছি না। এক্সপোর্ট প্রমোশন ব্যুরোতে চাকরি করে।

হামিদ কায়সার: ওহ! ওয়াসি আহমেদ।
হাসনাত আবদুল হাই: হ্যা, ওয়াসি আহমেদ। ওয়াসি আহমেদ-এর লেখাও আমার খুব প্রিয়। সে-ও খুবই শক্তিশালী লেখক। কম লিখে, কিন্তু ভালো লেখে। ওয়াসি আহমেদের লেখা আমি প্রথম পড়েছি ঈদসংখ্যা বিচিত্রায়, উপন্যাস। গল্পও পড়েছি। দুটোতেই সিদ্ধহস্ত। এরপরে, আরেকটি উপন্যাস সে লিখেছিল সেটা অবশ্য অতোটা আমার ভালো লাগে নি। কিন্তু, ওয়াসি আহমেদ নতুনদের মধ্যে ভালো লেখে। ওর বয়স কতো আমি জানি না। আমার সঙ্গে পরিচয় নেই। তবে তার আরো লেখা উচিত। শামীম আখতার বলে একটি মেয়ের গদ্য লেখাও আমাকে মুগ্ধ করেছে। প্রবীণ গদ্য লেখকদের মধ্যে খান সারওয়ার মুরশিদ, আহমদ শরীফ, জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, আনিসুজ্জামান, আবদুল মান্নান সৈয়দ আমার প্রিয়। সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, নজরুল ইসলাম, মইনুদ্দিন খালেদ, রবিউল হুসাইন, এরা সফল শিল্প-সমালোচক। তবে বুদ্ধিদীপ্ত এবং স্টাইলিশ গদ্যের জন্য অধ্যাপক খান সারওয়ার মুরশিদের লেখা আমার খুব প্রিয়।

হামিদ কায়সার: ঐ বুক সেলফে অনেক জাপানী বই দেখছি। জাপানী লেখা, লেখকদের সম্বন্ধে কিছু বলুন।
হাসনাত আবদুল হাই: জাপানী সাহিত্য বলতে বাসোর কিছু হাইকু, কাওয়াবাতা আর মিসিমার উপন্যাসই বুঝতাম। ১৯৯৫-এর অক্টোবর থেকে ছয় মাসের জন্য জাপানে ভিজিটিং রিসার্চ ফেলো হয়ে গিয়ে প্রচুর জাপানী বই পড়ার সুযোগ হলো। কিনলামও অনেক। দেখতে পাচ্ছো। সব রকমের বই আছে। শিল্প, ফিল্ম, বাগান তৈরি, স্থাপত্য, ইতিহাস দর্শন আর অবশ্যই গল্প উপন্যাস। কাওয়াবাতার প্রতি আমার দুর্বলতা অক্ষুণ্ন থাকলো। লিরিকাল মিস্টিসিজম আছে তার লেখায়, যা জাপানী চরিত্রের একটা প্রধান দিক। কোবো আবের গল্প উপন্যাস দারুণ আধুনিক। আর নিরীক্ষা-ধর্মী। তারই নোবেল পাওয়া উচিত ছিলো। কেনজাবুরোর ‘দি সাইলেন্ট ক্রাই’ ছাড়া আর কোন বই ভালো লাগে নি।

হামিদ কায়সার: বাংলাদেশের প্রবীণ-নবীন লেখকদের সম্বন্ধে আপনার সাধারণ ধারণা কি?
হাসনাত আবদুল হাই: অনুকরণ প্রিয়, মানে আঙ্গিক এবং শৈলীর দিক দিয়ে। যখন পরাবাস্তববাদ ফ্যাশনেবল তখন সেই আদলে লেখা, যখন অস্তিত্ববাদ তখন তার প্রভাবে লেখা, যেমন সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ লিখেছেন। আবার যখন ল্যাতিন আমেরিকা উদ্ভূত ম্যাজিক রিয়েলিজমে না লিখলে আধুনিক মনে হয় না তখন সেটা অনুসরণ করা। নাটকে সাইদ আহমেদের মতো শক্তিশালী নাট্যকার এ্যাবসার্ড নাটকের বৃত্ত থেকে বেরুতে পারলেন না। অথচ আমাদের প্রধান লেখকদের সবাই না হলেও কিছু কিছু লেখকের স্বকীয়তা অর্জনের ক্ষমতা ও প্রতিভা ছিলো এবং আছে।
এই হলো মোটামুটি আমার প্রিয় লেখকদের তালিকা। তারপর আমি কিভাবে বই পড়েছি তার বিবরণ। একটা কথা দিয়ে শেষ করি। এটা কোন ¯œবারি বা উন্নাসিকতা না, এখন, বর্তমান পর্যায়ে এসে যেহেতু আমার সময় কম এবং যেহেতু একটা বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে আমি পড়ি—এই জন্য সবার লেখা আমি পড়ি না। এমনকি, আমার যারা প্রিয় লেখক, যাদের নাম বললাম, এদেরও নতুন একটা লেখা বেরোলে আমি কয়েক পৃষ্ঠা উল্টিয়ে দেখি, এটা পড়ার উপযুক্ত কিনা, এটা পড়ার জন্য আমি সময় দিতে পারব কিনা। যদি মনে হয় যে উপযুক্ত, তখন পড়ি। এভাবে আমি খুব সিলেকটিভিটির— মানদণ্ডটা হলো, বইটিতে নতুন কিছু আছে কিনা-ভাষার দিক দিয়েই হোক, বিষয়ের দিক দিয়েই হোক, উপস্থাপনার দিক দিয়েই হোক। নতুন যদি কিছু না থাকে, শুধু গতানুগতিকভাবে গল্প ‘বলে গেল, এটা আমাকে আর এখন আকর্ষণ করে না। এইজন্য আমার যারা প্রিয় লেখক তাদের সব বই আমি কিনে এনে বইয়ের পাতা উল্টিয়ে দেখি যে এটি আমার পড়া ঠিক হবে কিনা, মানে পড়ার জন্যে আমি সময় দিতে পারবো কিনা। কারণ, আমার সময়তো এখন সীমাবদ্ধ। এই যে আমার লাইব্রেরি, এখানে এক তৃতীয়াংশ বইই আমার পড়া হয় নি। জয়েসের ইউলিসিস পড়তে লেগেছে একটানা চারদিন, তাও সব স্পষ্ট হয় নি। টমাস পিনচন যাকে আধুনিক জেমস জয়েস বলা হয়ে থাকে, তার গ্যাভেটিজ রেইনবো পড়তেও তিনদিন। আর এই যে প্রুস্তের রিমেমব্রাস অফ থিংস পাস্ট, এর তিন খ- পড়বার অপেক্ষায় আছি সেই কবে থেকে। একসঙ্গে পড়া আর লেখা খুব কঠিন। তারপর দিনগত না পর্যায়ের মতো হলেও জীবিকা অর্জনে রাখতেই হয় নিষ্ঠা। কোনোটার দাবিই তো কম না। অথচ একটাই জীবন। দেখে শুনে তারাশঙ্করের ‘কবি’ উপন্যাসের নায়িকার মতো বলতে ইচ্ছে করে, “জীবন এতো ছোট ক্যানো?”


২৯ অক্টোবর ১৯৯৮, সংবাদ সাময়িকী, দৈনিক সংবাদ