ফাইল ফটো

ফাইল ফটো

দেশভাগ, দেশত্যাগ ও একতরফা প্রচার

পর্ব ১

জাকির তালুকদার

প্রকাশিত : আগস্ট ১৪, ২০১৮

প্রথম দুই বাস্তবতার সাথে সবাই একমত। তবে তৃতীয় বাস্তবতার দিকে খুব কম জনেরই দৃষ্টি আকর্ষিত হয়। বাংলাদেশ ছেড়ে হিন্দুদের পশ্চিমবঙ্গে বা ভারতে চলে যাওয়া নিয়ে লেখালেখি এবং প্রচারণার শেষ নেই। সেখানকার লেখকরা মর্মস্পর্শী গল্প-উপন্যাস-কাব্য রচনা করে চলেছেন। সেখানকার মিডিয়া সবসময় এই কথাটি মনে করিয়ে দেয় যে, এই বাংলাদেশ থেকে হিন্দুরা অত্যাচারিত হয়ে হয়ে দেশত্যাগ করে চলেছেন। তাদের এসব লেখা ও কথাবার্তা থেকে মনে দৃঢ় বিশ্বাস জন্মাবে যে, দেশত্যাগ কেবলমাত্র এই বাংলার হিন্দুদের নিয়তি। আর ১৯৪৭-এর পরে সেখানকার কোনো লোক দেশত্যাগ করেনি।

আমার প্রথম আপত্তি, হিন্দুরা কেবলমাত্র অত্যাচারিত হয়ে ভারতে চলে যাচ্ছে, অন্যকোনো কারণ নেই, এই কথায়। দ্বিতীয় আপত্তি, সেখান থেকে বাংলাদেশে চলে আসা বাঙালি এবং অবাঙালিদের বিষয়ে কোনো উল্লেখমাত্রেরও অনুপস্থিতি দেখে। হিন্দুরা পাকিস্তান আমলের একটা পর্যায়ে অত্যাচারিত হয়েছে, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। তবে সেই একই রকম অত্যাচার সইতে হয়েছে ভারতের মুসলমানদেরও। কিন্তু এখনো যখন হিন্দুরা দেশত্যাগের পেছনে ভয়াবহ সব অত্যাচারের বানানো গল্প ছড়ায়, তখন তার পেছনের অসৎ উদ্দেশ্য না খুঁজে উপায় থাকে না। আমার ফার্স্টহ্যান্ড অভিজ্ঞতাগুলোর কয়েকটি বলি।

দেবব্রত সরকার (বাবু) ছিলেন পেশায় আইনজীবী। সেইসাথে পৌরসভায় প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত কাউন্সিলর। তাকে কেউ কোনোদিন হিন্দু হিসাবে কটুকথা পর্যন্ত বলেছে, এমন উদাহরণ নেই। তিনি হঠাৎ চলে গেলেন ভারতে। কিংবা নিতাই সাহা। বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে রেশন ডিলার ছিলেন। রেশনের চাল-চিনি-ডালডা-ময়দা কালোবাজারে বিক্রি করে লক্ষ লক্ষ টাকা কামিয়েছিলেন। রক্ষিবাহিনী হাতে-নাতে ধরেছিল একবার। কিন্তু কিছু হয়নি তার। শঙ্কর গোবিন্দ চৌধুরীর একটা টেলিফোন এক ঘণ্টার মধ্যেই মুক্ত করে দিয়েছিল তাকে। ডিলারশিপও বাতিল হয়নি। একই অপরাধে আরেক ডিলার রহমান প্রামাণিককে অনাদী বসাকের বাহিনী জুতার মালা পরিয়ে শহর প্রদক্ষিণ করিয়েছিল। তার ডিলারশিপ বাতিলও হয়েছিল। নিতাই সাহার কিছু হয়নি। বরং তিনি পরবর্তীতে ধনাঢ্য মহাজন হিসাবে বিবেচিত হতেন। তাকে বা তার পরিবারের কাউকে কেউ কোনোদিন আঙুল উঁচিয়ে কথা বলার সাহসই পায়নি। তিনি হঠাৎ রাতারাতি সব বিক্রি করে দিয়ে উধাও। কিংবা অধ্যাপক মিহির কুমার সান্যাল। রাস্তায় বেরুলে অনবরত আদাব-সালামের উত্তর দিতে হতো তাকে। স্ত্রী-পুত্রকে কলকাতায় পাঠিয়ে দিয়েছিলেন আগেই। রিটায়ারমেন্টের পরে সব ভাতা-পেনশনের টাকা তুলে নিয়ে একেবারে পাড়ি জমালেন ভারতে। এবার রবি দত্ত-র কথা। শহরে সংস্কৃতিমনা পরিবার হিসাবে পরিচিত। তার তিন কন্যার সঙ্গীত পরিবেশন ছাড়া কোনো অনুষ্ঠান পূর্ণতা পেত না। এমপি, নেতা, মহকুমার পুলিশ শাসক, ম্যাজিস্ট্রেট সবার সাথে তার দহরম-মহরম। তার মেয়েরা কোনোদিন ইভ টিজিংয়ের শিকার পর্যন্ত হয়নি। কারণ, যার হাতে পুলিশ তাকে ঘাটানোর সাহস ছুটকো পোলাপানের থাকে না। সেই রবি দত্ত-র তিন সুন্দরী কন্যা সপ্তাহজুড়ে বিভিন্ন দোকান থেকে বাকিতে কিনল হাজার হাজার টাকার জিনিস। তারপর একরাতে সমস্ত পরিবার হঠাৎ উধাও। তারপরে ধরুন, এরশাদ আমলে শহর দাপিয়ে বেড়ানো শামু গুণ্ডা। শ্যামল সার্বভৌম। ভোট দিলে ভালো হয়ে যাব, মানুষকে আর জ্বালাতন করব না, এই কড়ার করে পৌরসভার কাউন্সিলর হলো। মেয়াদ শেষ হবার সাথে সাথে সঞ্চিত সবকিছু নিয়ে লাপাত্তা। ভারতে।

উপরোক্তরা কোনো ধরনের আর্থিক-সামাজিক-মানসিক অত্যাচারের সম্মুখীন হয়েছে, এমন একটা উদাহরণও নেই। তবু তারা দেশ ছেড়ে চলে গেছে। বাংলাদেশের সব এলাকাতেই এমন উদাহরণ পাওয়া যাবে। অত্যাচারের নানা গল্প ফাঁদা, কিন্তু কোনো অত্যাচারের ইতিহাস নেই।

এবার দ্বিতীয় আপত্তির জায়গাতে আসি। ওপার থেকে ১৯৪৭-এর পরে বাংলাদেশে চলে এলো দেড় লক্ষের বেশি বাঙালি পরিবার। আর নয় লক্ষ অবাঙালি। তারা এখন বেড়ে ৪০ লাখে পৌঁছেছে। অবাঙালি বাদ দিয়ে কেবল বাঙালিদের কথাই বলি। উত্তরবঙ্গের ১৬টি জেলার এমন কোনো ইউনিয়ন পর্যায়ের জনপদ নেই, যেখানে পশ্চিমবঙ্গ থেকে আসা মানুষ নেই। মালদহ-মুর্শিদাবাদ-বর্ধমানসহ নানা জায়গা থেকে আসা। কিন্তু স্থানীয়দের কাছে তাদের একটাই পরিচয়, ‘মুর্শিদাবাদিয়া’। রাজশাহী মহানগরের মোট ভোটারের অর্ধেকই এই ‘মুর্শিদাবাদিয়ারা’। কিন্তু যখন দেশভাগ এবং দেশত্যাগের প্রসঙ্গ ওঠে, তখন উদ্বাস্তু হয়ে এই দিকে আসা লোকগুলোর প্রসঙ্গ স্রেফ ভুলে যাওয়া হয়।

ইউরোপ-আমেরিকা-কানাডায় যারা গেছে বাংলাদেশ থেকে, তারাও ভারতে চলে যাওয়াদের মতোই বাধ্য হয়ে গেছে। অন্যেরা সেকথা মানতে নারাজ। তারা ভাবেন কেবলমাত্র উন্নত জীবনের সন্ধানে তারা গেছেন ওইসব দেশে। যারা একথাটিকেই ধ্রুব সত্য হিসাবে মানে, তাদের অনুরোধ করব তাদের সংস্পর্শে যেতে। দেখবেন, তাদের শরীরটাই কেবল আছে ঐসব দেশে। পুরো মনজুড়ে আছে ছেড়ে যাওয়া বাংলাদেশ। এই দেশের উচ্চতম ডিগ্রিধারী, উচ্চপেশার মানুষজন কেন ঐসব দেশে গিয়ে বার্গারের দোকানে সেলসম্যান হন? ট্যাক্সি চালান? গ্যাসস্টেশনে চাকরি করেন? হোটেলে ফ্রন্ট ডেস্ক কেরানি হন? আর তাদের বাড়ির মহিলারা, যারা দেশে থাকতে কোনোদিন একগ্লাস পানিও নিজের হাতে ঢেলে খান না, তারাও কেন ঐভাবে একটানা ৮ ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকার চাকরি করেন? ঘরে ফিরে রান্না-বান্না, ঘর পরিষ্কার, কাপড় ধোয়া, সব কাজ কেন নিজের হাতে করেও সেইসব দেশে বসবাস করেন?

উত্তর একটাই। বাংলাদেশে নিরাপত্তার অভাব। সামাজিক নিরাপত্তা, সড়কের নিরাপত্তা, আইনের নিরাপত্তার অভাব বোধ করেন তারা বাংলাদেশে। ঠিক যে কারণে কোনো প্রত্যক্ষ অত্যাচারের মুখোমুখি না হয়েও হিন্দুদের একটা অংশ ভারতে চলে যাওয়ার জন্য দিন গোনে, সেই একই কারণে শিক্ষিত এবং সুপ্রতিষ্ঠিত মুসলিম জনগোষ্ঠীর বিরাট অংশ দেশত্যাগ করে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হয়ে চলে যায় পাশ্চাত্যে। সেই নিরাপত্তার অভাববোধ। (অসম্পূর্ণ)

লেখক: কথাসাহিত্যিক