দেশভাগ, দেশত্যাগ ও একতরফা প্রচার

পর্ব ২

জাকির তালুকদার

প্রকাশিত : আগস্ট ১৫, ২০১৮

জামায়াত-শিবির কোণঠাসা হলেই বলতে শুরু করে, আমরা ইসলামের কথা বলি, ইসলামকে প্রতিষ্ঠিত করতে চাই বলে আমাদের আক্রমণ করা হয়। ইসলামকে রক্ষা করতে চাই বলে আমাদের ওপর এই আক্রমণ।

কোনো হিন্দু আক্রান্ত হলেই হিবৌখ্রি বলে, হিন্দু বলেই আমাদের ওপর এই আক্রমণ। আমি একথা বোঝাচ্ছি না যে, জামায়াত-শিবির আর হিবৌখ্রি একই ধরনের সংগঠন। বলতে চাই, একই স্ট্রাটেজি ব্যবহার করার কথা।

অথচ হিবৌখ্রি একবারও বলে না, যে ঘটনায় একজন হিন্দু আক্রান্ত হয়েছে, সেই একই ঘটনায় একই সাথে আরো অন্তত ষাটজন মুসলমানও আক্রান্ত হয়েছে। ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় আসার পরে যে প্রতিহিংসার আগুনে পুড়েছিল বাংলাদেশের বিভিন্ন গ্রাম-শহর, সেখানে আক্রমণের লক্ষবস্তু কেবলমাত্র হিন্দু ছিল না, ছিল মুসলমানও।

সিরাজগঞ্জের পূর্ণিমার কথা তো বিশ্ববাসী জানে, কিন্তু আরো যে দুই-শতাধিক নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন, সেকথা প্রচারিত হয়নি। অন্য অনেক ধর্ষণের মতোই ধর্ষিতা এবং তাদের পরিবার গোপন রেখেছে তাদের ওপর নির্যাতনের কথা। আমরা সেগুলো জনসমক্ষে আনতে যাচ্ছি না। তবে মনে করিয়ে দিতে চাই, সিরাজগঞ্জের মাত্র ৪০ কিলোমিটার পশ্চিমে বনপাড়াতে আয়নাল ডাক্তারের নিহত হবার কথা। পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে তার চেম্বার, বাড়ি।

হজ করতে গিয়ে নিজের জন্য মক্কা থেকে কাফনের কাপড় কিনে এনেছিলেন আয়নাল ডাক্তার। সেই কাপড়ও পুড়িয়ে দেয়া হয়েছিল। মক্কার কাফনে কবরে যেতে পারেননি তিনি। কিংবা নলডাঙ্গার ফিরোজ। তাদের পরিবারের সদস্যদের প্রত্যেকে অবর্ণণীয় নির্যাতনের শিকার। বাড়ি তো পোড়ানো হয়েছিল অবশ্যই, সেইসাথে তাদের বিঘার পর বিঘা পাকা ধানের ক্ষেতে পেট্রল ঢেলে পুড়িয়ে দেয়া হয়েছিল ধানগুলো। বিচার চাওয়া তো দূরের কথা, ২০০৭ সালের আগে নিজেদের এলাকাতেই ফিরতে পারেনি তাদের পরিবারের কেউ। হিন্দুদের অনেক অত্যারিত পরিবার ভারতে চলে যেতে পেরেছে। কিন্তু আয়নাল ডাক্তার বা ফিরোজদের তো ভারত নেই। সার্বিকভাবে না দেখে শুধু হিন্দুদের ওপর অত্যাচারের ঘটনাগুলো হাইলাইট করাটা কি হিবৌখ্রির সুবিচার চাওয়া, নাকি হিন্দুদের নিয়ে কোটারি তৈরি করা?

প্রচারণার দ্বারা এমন একটি ধারণা তৈরি করার চেষ্টা করা হয় যেন, বাংলাদেশের হিন্দুরা জুবুথুবু হয়ে জীবনযাপন করে। অতি সন্তর্পণে চলাফেরা করে। দিনরাত ভয়ে ভয়ে অপেক্ষা করে তাদের ওপর নেমে আসা অত্যাচারের জন্য। তাদের জানাচ্ছি যে, গণতন্ত্রের জন্য, সমাজবদলের জন্য রাজপথের লড়াকু সৈনিকদের মধ্যে এক বিরাট অংশ হিন্দু পরিবার থেকে আসা। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের আগে, বিশ্বে সমাজতান্ত্রিক বিপর্যয়ের আগে ছাত্রলীগ বা ছাত্রদল নয়, হিন্দু তরুণসমাজের বড় অংশটি যুক্ত ছিল বামপন্থি ছাত্র সংগঠনের সাথে। এখনো দেশের প্রগতিশীল ছাত্র-যুব-নারী-সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর অগ্রবাহিনীর একটি বিরাট অংশই হিন্দু পরিবারের সন্তান। এরা রাজপথে লড়াই-সংগ্রাম করেন, জেল-জুলুম-হামলার শিকার হন, জীবনের ঝুঁকি নিতেও পিছ-পা হন না। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করেন মুসলমান পরিবার থেকে আসা কমরেডদের সাথে। দেশে জনসংখ্যার ধর্মীয় অনুপাত ধরলে দেখা যাবে, এসব ক্ষেত্রে হিন্দু পরিবার থেকে আসা মানুষের সংখ্যা প্রগতিশীল আন্দোলনে বরং বেশিই।

আবার বিপরীত চিত্রও আছে। চুরি-ডাকাতি, গুণ্ডামি-হাঙ্গামা, চোরাচালান, অস্ত্রব্যবসা, মাদকব্যবসা, নারী পাচারের কাজে হিন্দু যুবকদেরও অংশগ্রহণ আছে। ঢাকার ২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসীর মধ্যে সুব্রত বাইন, প্রকাশ, বিকাশের নাম সবারই জানা। সুব্রত বাইন তো আবার শীর্ষ সন্ত্রাসীদেরও মধ্যেও শীর্ষে। কালা জাহাঙ্গীর যেমন। সমাজকে পূর্ণাঙ্গদৃষ্টিতে দেখতে না জানলে খণ্ডীকরণ চলতে থাকে। সেই খণ্ডীকরণের ফাঁদে পা দিয়ে রেখেছেন অনেক ব্যক্তি, অনেক সংগঠন। খণ্ডীকরণের মাধ্যমে সমস্যার সমাধান হয় না। বরং সমস্যাকে জিইয়ে রাখা নিশ্চিত করা হয়।

দেশভাগ-দেশত্যাগ আমাদের পূর্বপুরুষদের পাপের ফল। সেইসব পূর্বপুরুষদের অনেককেই আমরা আবার প্রাতঃস্মরণীয় হিসাবে পূজা করি। এযাবৎ আমরা তাদের পাপের প্রায়শ্চিত্ত করে যাচ্ছি। এখন দরকার পাপগুলোকে চিহ্নিত করে সেগুলো উৎপাটনের লক্ষ্যে একসাথে কাজ করা।

লেখক: কথাসাহিত্যিক