দ্য গ্রেট থিফ

পর্ব ৪

মুনতাসির মামুন

প্রকাশিত : মে ১০, ২০১৮

হাতে থাকা লেইসের প্যাকেটটা থেকে মনোযোগ দিয়ে চিপস খেতে খেতে অ্যান্ড্রয়েড ফোনে ঘটনার সময়ের সিসিক্যাম ফুটেজ দেখছে মান্নান। সিসিক্যামটা জোগাড় করতে খুব একটা বেগ পেতে হয়নি ওকে। সিসিক্যামটা লাগনো ছিল অনন্তদের বাসার ঠিক উল্টোপাশের ছোট্ট সুপার শপটাতে। শপটার মালিক ওদেরই ডিপার্টমেন্টের এক আপুর বাবা।ওনাকে বিষয়টা বুঝিয়ে নিয়ে ফুটেজটা আদায় করেছে ও। ও যে রুমটায় বসে আছে,সেটা রুম্মনের। ওর ঠিক উল্টো পাশেই খাটে বসে ফেসবুকিং করছে রুম্মন। এসব ফুটেজ দেখাটা বিরক্তিকর মনে হলেও ওর কাছে খুব একটা খারাপ লাগছে না,শব্দহীন সিনেমা যেন এটা একটা! মনে মনে নিজের মতো করে সংলাপ বসিয়ে নিচ্ছে ও চরিত্রগুলোর ঠোঁটে...অনেকটা ভিডিও কোলাজের মতো। এই যেমন,রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়া বাবাটার কোট ছোট্ট ছেলেটা সমানে টানাটানি করে যাচ্ছে...সম্ভবত তাকে যেখানে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে,সেখানে যেতে সে ইচ্ছুক নয়...সম্ভবতঃ কোনো কোচিং সেন্টার। আজকাল তো ছোট্ট কুঁড়ি বয়স থেকেই বাচ্চাদের কোচিং করতে যেতে হয়। ভর্তি কোচিং,গানের কোচিং,স্পোর্টস কোচিং আরো কতো কী!বাপ-মারা যেন চায়,তাদের বাচ্চা অলরাউন্ডার হিসেবে বড় হোক...সবকিছুতে পারদর্শী হতে হবে তাদের! এসব দেখতে দেখতে হঠাৎ একটা জায়গায় এসে চোখ আটকে গেল তার। পজ করে আরে দুইবার দেখলো ঐটুকু অংশ।তবুও খটকা কাটলো না,আবার চালু করলো ঐ অংশটুকু। তো,মান্নান ভিডিও দেখতে থাকুক...এই ফাঁকে আমরা একটু রুম্মনের কাছ থেকে ঘুরে আসি,কী বলেন? ফেসবুকে সদ্য “হবো হবো” গার্লফ্রেন্ডের সাথে চ্যাট করছে রুম্মন।তাদের কথোপকথন এখন বেশ ‘আঠালো’ পর্যায়ের।

-অ্যাই,কতোক্ষণ ধরে মেসেজ দিচ্ছি...রিপ্লাই দিচ্ছো না কেন?আমাকে অফলাইনে রেখে অন্য কোনো মেয়ের সাথে চ্যাট করা হচ্ছিল বুঝি? নাকি কোনো মেয়ের সাথেই আছো? রাগের ইমো দিল মেয়েটা।

-কী যে বলো না তুমি,অন্য ঝামেলায় আছি!”

-কিসের ঝামেলা?

-আর বলো না,বাসার একজনের ল্যাপটপ চুরি হইসে!”

-কে চুরি করেছে,তুমি?

-তোমার কি মনে হয় আমি কিছু চুরি করতে পারি?

-হ্যাঁ,পারোই তো...চুরি তো তুমি করোই।

-মানে!কী চুরি করসি আমি?

-বলবো না!

- প্লীইইজ,বলো।

-না না না...বলবো না,বলবো না,বলবো না।

-তাহলে আমি বলি?

-কী বলবা!

-আমি কী চুরি করেছি।

-না! -একটু বলি না!

-না।

-এই অল্প এইটুকু?

-হুমম!

-তোমাকে।

-আবার বলো তো।

-তোমাকে,তোমাকে,তোমাকে।

-ইস,শখ কতো!

-আমার অনেক শখ তোমাকে নিয়ে। তবে আপাতত আমি তোমাকে শুধ চুরি করতে চাই।

-সেটাতো তুৃমি করেছই!

-আমি তোমাকে বার বার চুরি করতে চাই। হঠাৎ রুম্মনের মনে হয়,ওর দিকে কেউ তাকিয়ে আছে। ফোনের স্ক্রিণ থেকে চোখ তোলে ও। নাকের ডগায় চশমা এঁটে চশমার ওপর দিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে হাসছে মান্নান মিসৌরী। ওর নাকের নিচের মোটা গোঁফটার কারণে মাঝে মাঝে ভ্রম হয়, ও বুঝি গোঁফটা দিয়েই হাসছে!

“হাসতেসিস ক্যান?”মান্নানের হাসিটা দেখে মেজাজটা খিঁচড়ে যায় রুম্মনের।

“মনে হইতাছেনা, চুরি-চামারি তর কাম!”

“কীহ্!”

 

 

“তালি,চুরিডা কেডায় করলো?”হতাশ কন্ঠ অনন্তের।

“আরে ভাইগ্না,অধৈর্য হও ক্যারে, চুর ধরা না পইড়া যাইবো কই...ধরা হ্যারে পড়নই লাগবো।” আশ্বাস দেয় মান্নান।

“আমার কিন্তু রুম্মন ছেলেটাক একট যেন ক্যামন-ক্যামন মনে হয়। আমি বলিচ্ছি না, ওই চুরি করসে...কিন্তু, তুই একটু ভেবে দেখিস।”গলার স্বর একটু নামিয়ে বললো দীপু।

“ভাইবা তো সবই দ্যাখন লাগবো,সেইটা ব্যাপার না...তয় রুম্মইন্যারে আমারো একটু যে সন্দো হয় নাই,তা না...দেহি,আরেকটু খুঁজ-খবর লয়া। আমি রুমের দিক যামু একটু...তরা কি ক্যাম্পাসেই আছস বিকাল পর্যন্ত?”

“আমি বাড়ি ঘুইরা আসুম একবার।”দীপু বললো।

“থাক তালি।”উঠে দাঁড়ালো মান্নান।

 

 

“ল্যাপটপটা কার,তর?”হাতের সিগারেটটা ঠোঁটে নিয়া ধরাতে ধরাতে বললো তামাটে চেহারার লোকটা।

“না,ভাই...এক ফ্রেন্ডের।”

“তুই যেরম বর্ণনা দিতাছস,সেরাম অন্তত দশ-বারোটা মাল এলাকায় ঢুকছে...এই সময়ের মইধ্যে। তার মইধ্যে কোনটা যে তুই খোঁজতাছস,ক্যামনে কই!”

“এগো কেউ জিনিষটা বেচতে আইছিল কিনা, খুঁজ লাগান তোহ্।”ফোনে কয়েকজনের ছবি বের করে লোকটার হাতে দিল মান্নান।

“এগোরেই তুই সন্দো করস?”ফোনটা হাতে নিয়ে চোখ বুলালো লোকটা।

“সন্দে তো অনেকরেই করি,দ্যাহা যাউক।”

“ঐ পিচ্চি,এদিক আয়।”চায়ের দোকানের বেঞ্চে বসে পা দুলাতে দুলাতে টিভিতে হিন্দী সিনেমা দেখতে থাকা একটা হাফপ্যান্ট পড়া ছেলেকে ডাকলো লোকটা।

“ভালো কইরা দেইখা কবি, এদের কাউরে এলাকায় দ্যাখছসনি।”ছেলেটার হাতে ফোনটা দিল লোকটা।

“দেহি নাই।”মুখ শক্ত করে জবাব দিল ছেলেটা, বোঝাই যাচ্ছে...বিনোদনে বাঁধা পড়ায় খুব বিরক্ত সে।

“একজনরেও না?”

“না।”

“আচ্ছা,যা তুই।”

“আমি তাইলে উঠি,ভাই।”বেঞ্চ ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো মান্নান।

“আরেকটা চা খায়া যা?”

“না,ভাই...আইজ আর খামু না,থাকেন,তাইলে,সালামালিকুম।”

“আসিস” ।

দোকানের ভেতরে ঢুকে গেল লোকটা। মান্নান দেখলো,পিচ্চিটা এখনো তার দিকে তাকিয়ে আছে। সে সন্তপর্নে পকেট থেকে ওয়ালেটটা বের করে তার থেকে ৫০ টাকার একটা নোট বের করে ছেলেটাকে দেখিয়ে দেখিয়ে বেঞ্চের উপর রাখলো। কিন্তুু পরক্ষণেই আবার সেটাকে তুলে বুক পকেটে চালান করে দিয়ে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে ফিঁচেল মার্কা একটা হাসি দিয়ে হালকা শিস দিয়ে একটা হিন্দী গানের কলি ভাঁজতে ভাঁজতে সামনের দিকে হাঁটতে লাগলো ধীরে ধীরে। বেশিক্ষণ হাঁটতে হলো না, কিছুদূর হাঁটতেই সে তার বাম পাশে তার আকাঙ্খিত ব্যক্তিটির উপস্থিতি টের পেল।

“চশমা পড়া আছিলো লোকটা,হালকা-পাতলা কইরা।”ফ্যাঁসফেসে স্বরে বললো ছেলেটি।

“এদের মধ্যে কোনজন?”ফোনের ছবিটা আবার এগিয়ে দিল মান্নান। এক পলক দেখেই একটা ছবির ওপর আঙুল রাখলো পিচ্চি…

”এই লোক।” কয়েক সেকেন্ড ‘থ’ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো মান্নান।

“টেকাটা।”ছেলেটার কথায় সৎবিত ফিরে পেল ও।

“উমম,হঅ...ল।”ছেলেটার হাতে নোটটা গুঁজে দিয়ে আনমনে সামনের দিকে হাঁটতে লাগলো ও। ক্যামনে কী! হাত দিয়ে মাথার চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে হঠাৎ ওর মনে পড়লো,সিগারেট নেয়া দরকার ছিল...পেছনে ফিরতে গিয়েও কী মনে করে যেন ফিরল না,থাক ক্যাম্পাস গিয়ে কিনবে...আবার ভাইয়ের মুখোমুখি হতে ইচ্ছে করছে না। পেছনে ফিরলেই সে দেখতে পেতো,একজোড়া চোখ শয়তানি হাসিতে উদ্ভাসিত হয়ে তার চলে যাওয়া দেখছে...এই বয়সী একজনের চোখে যা একেবারেই বেমানান।

 

চলবে