‘ধূলি সারগাম’ থেকে আটটি কবিতা

প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ১২, ২০১৮

প্রথম দশকের ভিন্ন স্বরের কবি তুষার কবিরের ১১তম কবিতার বই `ধূলি সারগাম` বের হয়েছে একুশে বইমেলায়। বইটি প্রকাশ করেছে অনিন্দ্য প্রকাশ; প্যাভিলিয়ন নম্বর ১৩। এ বই প্রসংগে তুষার কবির বলেন, `ধূলি সারগাম` কাব্যগ্রন্থটিতে পাঠক খুঁজে পাবে শব্দ, সংগীত ও ইমেজের এক অভিনব ফিউশন। এ বইয়ের কবিতাগুলোয় খুঁজে ফিরেছি কবিতার অন্য এক প্রকরণকৌশল, ভিন্ন এক বাক্ প্রতিমা। `ধূলি সারগাম` পাণ্ডুলিপি থেকে আটটি কবিতা...

স্বরগ্রাম

শ্বেতপায়রার পাখসাটে উড়ে আসা
এই স্বরগ্রাম—খড়কুটোর খোলনলচে খুলে
জেগে ওঠা এই গান—
তুমি কি আমাকে আজ শুনতে পাচ্ছ
দূর থেকে ভেসে আসা রক্তবীজ প্রাণ?

হাওয়া আমাকে ডেকে নিচ্ছে দ্যাখো
কোনো এক সুরের ডেরায়—নিয়ে যাচ্ছে
ঘুমঘোর এক সরোবরে—
ডাহুকি ও ডাকিনীর বুক চিরে
দূরের সরোদ ওঠে বেজে সান্ধ্যস্বরে!

ধূলিপথে ধীরপায়ে আমি যাই হেঁটে
সেই জলভ্রমে—যার তিয়াসার ফেনাপাত্রে
ভেসে ওঠে শুধু রক্ত বুদ্বুদ—ফেলে দেয়া

হাড়ের মর্মর— আর মৃত নর্তকির ঘ্রাণ!

রেস্তোরাঁর সেরেনাদে শুধু শোনা যায়
ঘুমপিয়ানোর সুর— স্বরময় সরাইখানায়

জেগে ওঠে নৈশগীতি— শব্দ প্রসবের টান!

শ্বেতপায়রার রক্তপালকেই তবে লেখা হবে
এই ভাঁজপত্র— রণরক্তগান?

সরাইখানা

রুটি ও আখরোটের ঘ্রাণে ঘুরে ঘুরে আমি পৌঁছে যাই এক সান্ধ্য সরাইখানায়। উটের চামড়া দিয়ে মোড়া গালিচায় বসে দেখি, জানালার ফাঁক গলে আছড়ে পড়ছে ফালি ফালি চাঁদের টুকরো। এ সরাইখানার পাশেই আছে এক কয়েদিঘর যার কার্নিশ থেকে উড়ে আসে কয়েকটি বুনো প্রজাপতি। মদ, মধু ও রণলিপ্সা উস্কে দিয়ে কামিনী ফুলের ঘ্রাণ চকিতে ছড়িয়ে পড়ে সরাইখানার বারান্দায়। হ্রেষা জাগে ঘোটকীর— পুরনো খড়ের গন্ধে— নৈশ আস্তাবলে। পিয়ানোর টুংটাং সুর আর তরল আরক শেষ হওয়ার পর খুলে যায় নীলাভ নেকাব— বেজে ওঠে নর্তকের কর্তিত ঘুঙুর। সরোদের তার ছিঁড়ে বেজে ওঠে ছিন্ন আঙুলের কান্না। পয়ারের অন্ত্যমিল না দিতে পারায় এক তরুণ কবির যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায় পড়ে শোনায় এক প্রাজ্ঞ পুরোহিত। আচমকা সরাইখানায় নেমে আসে নীরবতা। তক্ষকের মায়াডাকে শুধু শোনা যায় রাতচেরা লালাবাই। সম্রাজ্ঞীকে প্রেম নিবেদন করা এক প্রেমিক কবিকে টেনে নিয়ে যাওয়া হয় ফাঁসিকাঠে। আততায়ী চাঁদের আলোয় খসে পড়ে যাজকের রঙিন রুমাল। আর একটু দূরেই পড়ে থাকে কবির রক্তাভ দেহ— খণ্ডিত মস্তক!

সান্ধ্যগান

সরাইখানার সান্ধ্যগান ঢের শোনা হলো
এই গোধূলির ধূলিওড়া পথে—
ময়ূরীর মনোলগ শুনে শুনে
কেটে গেল কুঠুরির রক্তস্বর ভোর!

দূরের বেহালা ধ্বনি যেন আজ
আছড়ে পড়ল এই ঘুমঘোর সরোবরে—
ফেলে দেয়া সারগামে শুধু যেন
বাজতে থাকল অন্ধ নর্তকির কান্না!

শ্বেতপায়রার পালকের নিচে
দ্যাখো আমি ঠায় বসে আছি— তার ফাঁক দিয়ে
উঁকি দেয় রক্তাভ মাংসের আভা—
তার ডানা চিরে দ্যাখো হানা দেয়
মদ, মধু আর ধাঁধা!

কার্নিশের ছায়াভ্রমে লেখা হলো
এই সান্ধ্যগান— ডাকিনীর ডাকবাক্সে জড়ো হলো
যত মনোব্যথা— পাখসাটে মৃদুশব্দে
কোথাও বা বাজতে থাকল শুধু
বিষাদের দাহগাথা!

ছায়া ও ছাতিমতলা

এই দূর মফস্বলে আমাকে ডাকছে শুধু হু হু দোয়েল-দুপুর, বিকেলের ঘুঘুডাক, গোধূলির সান্ধ্যভাষ— বিলাপ ও নৈঃশব্দ্য!

 

একটি রঙিন রিক্শায় দেখি উড়ে বসে কয়েকটি প্রজাপতি, ডাহুকির ডানা চিরে বেজে ওঠে বিকেলের ধূলিরেখা, ভাঙা ডাকবাক্স আর কোটরের টিয়াগান!

 

ছায়া ও ছাতিমতলা পার হয়ে এই দূর মফস্বলে আমাকে ডাকছে শুধু চায়ের টংঘর, কচুরি ফুলের ডিঙিস্বর, হুইসেলে জংশনের সুর!

প্রেম ও প্র্যাকটিস

এতদিন ঘুরে ঘুরে তুমি বুঝে নিয়েছ যেনবা প্রেম কিছু নয়; কেবল একটা প্র্যাকটিস!

 

যেমন চায়ের কাপে তুমি রোজ যে ক’চামচ চিনি খাও, আপেলে কামড় বসানোর পর তা যতক্ষণ চিবোতে থাকো, পপকর্ন খেতে খেতে উড়ে যাও হাল্কা হাওয়ার ভেতর, রেস্তোরাঁয় বসে বসে বিড়বিড় করে সুর ভাঁজ, ভাঁটফুলে বুঁদ হয়ে যেমন খুঁজতে থাকো কোনো ভ্রমরের পদচ্ছাপ!

 

ভুলে যাওয়ার পর প্রেমিকাকে মনে হতে পারে ওটা এক সাদাকালো আর্কাইভ— যেমন কবিতা লেখা ভুলে গেলে একদিন তোমারও মনে হতে পারে ওগুলো আর কিছুই নয়— খালি টুকরো টুকরো ছন্দ আর শব্দের ফসিল!

এসরাজ

ফেলে দেয়া নোটবুক খুলে
তুমি পেয়ে গেছ যত
ভ্রম স্বরগ্রাম— বিকেলের ধূলিরেখা—
আর চেরাই কাঠের সান্ধ্যগান।

মায়াজালে ঘুরপাক খাচ্ছে
দ্যাখো তোমার কোটর;
নেমে যাচ্ছে ঠাণ্ডা জলস্রোতে—
করোটির রেখাপথে ভেঙে যাচ্ছে
কৌণিক প্রিজম—
টুকরো টুকরো কৃস্টালের কণা।

এবার গানের খাতা খোলো;
জমে থাকা ধূলি ঝেড়ে
গোধূলির স্বরলিপি থেকে—

বাজছে বাজছে দ্যাখো অই সুরহীন এসরাজ!

বীণা

রক্তচন্দনের বনে— বুঝি হারিয়ে ফেলেছি সেই নোটবুক— যার শাদা পাতাজুড়ে লেখা ছিল সুরহীন ঘুমের মল্লার। পাখোয়াজ ভাঁজ খুলে দেখি তোমার হারানো বীণা বেজে ওঠে কার্নিশের রেখাপথে।

 

এই বসন্ত দুপুরে, মৃদু হাতে সুর তুলে কে বাজিয়ে যায় দরবার-ই-কানাড়া? ঘরভর্তি নিমের সুবাসে আসে দখিনের মাতাল হাওয়া। তুমিই তবে এই কুরুক্ষেত্রে লিখে চলেছ যত দুঃখগাথা— গোধূলির ধূলিওড়া পথে?

 

ধূলিখামে চিঠি আসে— দুই কান পেতে আমি শুধু শুনে চলি বাগ্দেবীর কড়া নাড়া!

বেহালা

বিকেলের ভাঁজপত্র খুলে
তুমি পেয়ে গেছ হারানো পুরাণ কথা
ঘোটকির হ্রেষালিপি
আর ঘুমবেহালার ছড়—

কাহারবা বেজে ওঠে ধীরে ধীরে
শহরের শেষ রেখাপথে—
শোনো, ওটা ছিল এক ঝাড়বাতিঅলা বাঈজিমহল—
খিলানের ছায়াভ্রমে
আজো শোনা যায়
শ্বেতাভ কাকাতুয়ার সান্ধ্যগান—
ঝিনুকের অনুষ্টুপ
আর ভ্রমরের স্বরগ্রাম!

জানি, তুমি হারিয়ে ফেলেছ সব স্বর—
পাতার ডেরায় ডুব দিয়ে
তুমি শুনে যাচ্ছ শুধু জমে থাকা জলের লিরিক!