নারী-পুরুষের অন্তর্জগৎ

ছায়াবীথি শ্যামলিমা

প্রকাশিত : মার্চ ১৫, ২০১৮

নারী ও পুরুষ সম্পর্ক খুবই জটিল। দৈহিক ও অন্তর্গঠন প্রক্রিয়ায় নারী ও পুরুষের বৈশিষ্ট জানা থাকলে পরস্পর পরস্পরকে ভালোভাবে বুঝতে সাহায্য করবে।

আবেগ: নারী ও পুরুষ মস্তিষ্কের উল্লেখযোগ্য পার্থক্য হচ্ছে মস্তিষ্কের লিম্বিক সিস্টেমের আয়তনের পার্থক্য। নারী মস্তিষ্কের লিম্বিক সিস্টেমের আয়তন এবং গভীরতা পুরুষ মস্তিষ্কের তুলনায় বেশি। এ কারণে নারীরা পুরুষের চেয়ে অনেক বেশি আবেগপ্রবণ হয়ে থাকে এবং যে কোনো আবেগকে পুরুষদের চেয়ে গভীরভাবে প্রকাশ করে থাকে। তুলনামূলক বেশি আবেগপ্রবণ হওয়ার কারণে নারীরা পুরুষের চেয়ে বিষণ্নতায় বেশি ভোগে। এ জন্য নারীদের ক্ষেত্রে আত্মহত্যা প্রবণতা পুরুষদের চেয়ে বেশি।

সম্পর্ক গড়ে তোলা: লিম্বিক সিস্টেমের জন্য পুরুষের চেয়ে নারীরা সম্পর্ক গড়ে তুলতে বেশি তৎপর। পুরুষের চেয়ে নারীরা সুন্দরভাবে গুছিয়ে কথা বলতে পারে। একজন নারী ঠিক যেভাবে কোনো বিষয় সুন্দরভাবে উপস্থাপন করতে পারে একজন পুরুষ তা পারে না। পুরুষেরা সাধারণত কাজের কথায় আসতে খুব বেশি উদ্গ্রীব থাকে, নারীরা এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। পুরুষের সঙ্গে সম্পর্ক দৃঢ় করতে যতটা আবেগ দেখানো প্রয়োজন নারীরা ততটাই দেখাতে পারে।

গাণিতিক দক্ষতা: মস্তিষ্কের ইনফিরিয়র পার্সিয়াল লিব পুরুষের বড় হয়ে থাকে। এ অংশ গাণিতিক বিষয় নিয়ন্ত্রণ করে। পুরুষের অংশটি বড় হওয়ায় গণিতে তারা বেশি দক্ষ হয়।

বিশেষ ক্ষমতা: বিশেষ ক্ষমতা দেখাতে নারীর চেয়ে পুরুষ এগিয়ে। কাজের গতি ও বহুমাত্রিক ভাবনা উপস্থাপনায় পুরুষ এগিয়ে। বিভিন্ন কাজে বহুমাত্রিকতা ও গতি নিয়ে চিন্তার ক্ষেত্রে নারীদের সীমাবদ্ধতা রয়েছে।

নিয়ত পরিবর্তনশীল: নারীরা মাসের ত্রিশ দিনই তাদের আশপাশের ব্যক্তিদের দ্বারা সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত হয়। তাদের হরমোন নিঃসরণের পরিমাণ তাৎক্ষণিকভাবে প্রতিনিয়ত পরিবর্তন হয়। এ হরমোন পরিবর্তনজনিত কারণে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি, কর্মস্পৃহা ও সংবেদনশীলতা একেক সময় একেক রকম থাকে। যেমন রজঃপ্রাপ্তির দশদিন পর পর্যন্ত নারীরা খুবই চনমনে আর প্রাণবন্ত থাকে। নিজেদের অবচেতনে তারা এ সময় সেসব পোশাক পরে, যেসব পোশাকে তাদের আবেদনময়ী দেখায়। এর ঠিক এক সপ্তাহ পর তাদের মস্তিষ্কে প্রোজেস্টরেন হরমোনের পরিমাণ বেড়ে যায়। এ হরমোন তাদের মধ্যে ছলাকলার পরিমাণ বাড়িয়ে দেয় ও সাহসী হতে উদ্দীপ্ত করে। এ সময় নারীরা চা খেতে এবং ভালো বই পড়তে বেশি ভালোবাসে। এ সময় তারা খুব সহজেই কাঁদতে পারে, অন্যকেও উত্ত্যক্ত করতে ভালোবাসে। তবে তাদের এ কান্না পুরোপুরি ছলনা।

অন্তর্যামী নারী: শুধু সংসার সামলানো ও ছলাকলায় নয়, মনের না বলা কথা বুঝতেও জুড়ি নেই নারীর। তারা কাছের মানুষদের না বলা কথা ধরতে পারে খুব সহজেই। নারীদের ঘ্রাণশক্তি খুবই তীক্ষ্ণ। সূক্ষ্ম গন্ধ ও ভিন্ন রকমের স্বাদ নিতে নারীরা অনন্য। তাদের অফিসের বস কিংবা স্বামী কোন বিষয়টা নিয়ে বেশি চিন্তিত কিংবা পরিকল্পনা করছে তাও সহজেই ধরতে পারে নারীরা।

আক্রমণে অনীহা: নারীদের অনেকে ঝগড়াটে স্বভাবের মনে করলেও তারা সরাসরি আক্রমণ বা সংঘর্ষ এড়িয়ে চলে। এ ছাড়া ঝুঁকিপূর্ণ কাজে পিছিয়ে থাকে। শিশুসহ পরিবারের অন্যরা তাদের ওপর নির্ভরশীল হওয়ায় তারা শারীরিক আক্রমণ ও ঝুঁকিপূর্ণ কাজ এড়িয়ে চলে। এটা ভাবার কোনো কারণ নেই যে, তারা নিরীহ। তারা খুবই আক্রমণাত্মক, তবে পুরুষের চেয়ে ভিন্ন পথে। তারা মানসিকভাবে আক্রমণ করতে ভালোবাসে। শারীরিক আক্রমণ তারা পছন্দ করে না।

অনুভূতি: ব্যথা এবং ভয়ে ক্ষেত্রেও নারীদের অনুভূতি ও প্রতিক্রিয়া আলাদা। এ দুটি ক্ষেত্রে নারীদের মস্তিষ্ক অধিকতর স্পর্শকাতর। কোনো কারণে ভয় পেলে পুরুষ তার মস্তিষ্কের স্বাভাবিক কর্মদক্ষতা অনেক ক্ষেত্রেই হারিয়ে ফেলে। দুশ্চিন্তায় পড়ে। পরবর্তীকালে তার দৈনন্দিন কাজেও প্রভাব পড়ে। দুঃখ পেলে অথবা চিন্তিত থাকলে পুরুষের সমস্যা হয় ঘুমের। চিন্তার কারণে পুরুষের ওজনও কমে যায়। অন্যদিকে, নারী চিন্তিত থাকলে অথবা কোনো কারণে দুঃখ পেলে বেশি ঘুমায়। দুশ্চিন্তা নারীর ওজন না কমিয়ে বরং বাড়িয়ে দেয়। এ ক্ষেত্রে অ্যালকোহল পুরুষের দুশ্চিন্তা কমাতে পারে।

মস্তিষ্কের ক্ষিপ্রতা: সংঘর্ষ এড়াতে নারী মস্তিষ্কে অভ্যন্তরীণভাবে আলাদা সেন্সিটিভিটি কাজ করে। সংঘর্ষের আগে মেয়েদের মস্তিষ্কে হরমোনের প্রবাহ বেড়ে যায়। গল্প বলার ক্ষেত্রেও পটু তারা। একটি মেয়ে একটি গল্প বলতে যে ধরনের অভিব্যক্তি প্রকাশ করে একই বয়সের একটি ছেলে কখনোই সে রকমভাবে প্রকাশ করতে পারে না। সাধারণত ৪৫ বছর বয়সের পর থেকে পুরুষ হারাতে থাকে তার মস্তিষ্কের ধার, কিন্তু নারীর বেলায় কথাটি সত্য নয়। বয়স বাড়লেও মস্তিষ্কের তীক্ষ্ণতা ধরে রাখতে পারে নারী। বেশি বয়সেও নারীর সংসারিক জ্ঞান অক্ষুণ্ণ থাকে এবং তা ক্রমেই আরও পূর্ণতা লাভ করে। কোনো কাজ না থাকলে মেয়েরাই বেশি হতাশায় ভোগে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নারীদের হতাশায় ভোগার প্রবণতা পুরুষের চেয়ে দুই গুণ বেশি।

গর্ভাবস্থায়: গর্ভবতী হওয়ার প্রথম আট সপ্তাহ নারীদের প্রোজেস্টরেন হরমোনের নিঃসরণ বেড়ে যায়। এ সময় তারা খুবই শান্ত থাকে। প্রোজেস্টরেন হচ্ছে সবচেয়ে ভালো ঘুমের ওষুধ। সন্তান প্রসবের সময় এ হরমোন চার শতাংশ কমে যায়। ফলে এ সময়টায় তারা সবচেয়ে চঞ্চল থাকে এবং ঘুম কম হয়।

মায়ের প্রভাব: নারীদের শারীরিক হরমোনজনিত আবেগ ও সামাজিক বিষয়গুলো অনেকটা তার মায়ের ওপর নির্ভর করে। কারণ জন্মের পর থেকেই তারা মায়ের বিভিন্ন কার্যকলাপ সরাসরি দেখে থাকে। মেয়েদের ওপর মায়ের প্রভাব সবচেয়ে বেশি। গর্ভাবস্থায় মায়ের মানসিক অবস্থার ওপর ভিত্তি করেই শিশুর প্রাথমিক গঠন তৈরি হয়। মায়ের দৈনন্দিন আচার-আচরণের ওপর ভিত্তি করে নারীদের মানসিক ও সামাজিক ভিত্তি তৈরি হয়।

শৈশব-যৌবনের মধ্যবর্তী সময়: শৈশব ও যৌবনের মধ্যবর্তীকালে নারী-পুরুষ কেউ ফিরে যেতে চায় না। এ সময়টার শারীরিক ও হরমোনঘটিত পরিবর্তন নারীদের জন্য খুবই অস্বস্তিকর। এ সময় নারীরা নিজেদের আত্মপরিচয়ের সংকটে ভোগে। এ ক্ষেত্রে পরিবারের পক্ষ থেকে সমর্থন পায় এমন ভাগ্যবানের সংখ্যা খুবই কম। নারীরা চল্লিশ বছর বয়সের পর দ্বিতীয়বারের মতো শৈশব ও যৌবনের মতো আরেক সময় পৌঁছায়। তবে বিভিন্ন নারীর ক্ষেত্রে এ সময়টা বিভিন্ন বয়সে আসে। সর্বোচ্চ ৪৮ বছর বয়সে এ সময়টা আসে। এ সময় নারীরা টিনএজারদের মতোই আচরণ করে।