নারীর লড়াইটা কঠিন লড়াই

লাবণী মণ্ডল

প্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ২২, ২০১৮

“নারী শোষণে বুর্জোয়া ও সর্বহারায় কোনো পার্থক্য নেই; বুর্জোয়া পুরুষ শুধু সর্বহারা শ্রেণীটিকে শোষণ করে না, শোষণ কওে তার নিজের শ্রেণীর নারীকেও; আর সর্বহারা পুরুষ নিজে শোষিত হয়েও অন্যকে শোষণ করতে দ্বিধা করে না, সে শোষণ করে নিজের শ্রেণীর নারীকে। বিত্তবান শ্রেণীর নারী পরগাছার পরগাছা, বিত্তহীন শ্রেণীর নারী দাসের দাসী। শোষণে সব শ্রেণীর পুরুষ অভিন্ন; শোষণে মিল রয়েছে মার্কিন কোটিপতির সাথে বিকলাঙ্গ বাঙালী ভিখিরির, তারা উভয়েই পুরুষ, মানবজাতি রত্ম। ” হুমায়ুন আজাদ

 

এই ব্যবস্থায় সব শ্রেণীর পুরুষ শোষিত হয় না কিন্তু সকল শ্রেণীর নারীই নির্মমভাবে শোষিত এবং প্রচ-ভাবে শৃংখলিত হয়ে থাকে। এই একটা জায়গায় শ্রেণীবিভক্ত সমাজের প্রশ্নটা আপেক্ষিক অর্থে ব্যবহার করা যায়! সমাজের সবোর্চ্চ স্তর থেকে সর্বনিম্ন স্তর পর্যন্ত সবখানেই নারী নিপীড়িত, নির্যাতিত, নিষ্পেষিত। যদিও নিপীড়নের মাত্রা ভিন্ন। কিন্তু নিপীড়নকে প্রথমে ‘নিপীড়ন’ হিসেবে স্বীকার করতে হবে। পরে এর বিভক্তিকরণ করা যেতে পারে। এর কোনো সঠিক সমাধান এই মুহূর্তেই কেউই দিতে চাচ্ছেন না বা পারছেন না। বুর্জোয়ারা তো এর সমাধান টানবেই না, নিজেদের সুবিধার্থে, নিজেদের প্রয়োজনেই। কিন্তু সমাজতান্ত্রিকরা এরসাথে মানবমুক্তি জড়িত বলে এই বিষয়টাকে সাইটে রেখে দিয়েছে বলেই ধারণা করা যায়। পুঁজিবাদী সমাজে নারীকে সবচেয়ে বেশি পণ্য হিসেবে ব্যবহার কওে মুনাফা লুটছে। নারীই সবচেয়ে বেশি বেচাকেনা হচ্ছে। পুঁজিবাদ নারী স্বাধীনতা নামে, নারীকে ব্যবহার করছে। আর এই ব্যবহারের মাত্রা দিনকে দিন চরমমাত্রায় অগ্রগতি হচ্ছে। যে অগ্রগতিটা নারীকে কোনো মর্যাদা দিচ্ছে না, কোনো সম্মান দিচ্ছে না-এখানেও লাভবান হচ্ছে পুরুষ ও পুঁজি। নারী শ্রম দেয় নিজের জন্য। কিন্তু পুঁজি সেই শ্রমকে বানায় সংসারের জন্য, পুরুষের জন্য। নারী এ বিষয়টাকে এখনও অব্দি ধরতে পারছে না। নারীকে এই যে বেঁধে রাখা, সংসারের মায়াজাল শুধু নারীই থাকতে হবে স্লোগান পুঁজিবাদী সমাজও তুলে থাকে। যা থেকে মুক্ত হতে নারীকে চিন্তার জায়গা থেকে অগ্রসর হতে হবে।

 

পুরুষতন্ত্র ও পুঁজির ঐক্যটা বুঝতে হবে নারীসমাজকে। সবকিছুর মূলে শ্রেণী বিভক্ত সমাজের যেমন দায় আছে ঠিক তেমনিভাবেই নারীকে পুরুষতন্ত্র ও পুঁজির সাথে সাথে সকল নিপীড়নের বিরুদ্ধেই লড়তে হবে। যে লড়াইটা পুরুষের করতে হয় না! পুরুষের লড়াইটা শুধু পুঁজির বিরুদ্ধে! একইসাথে নারীর লড়াইটা অনেক কঠিন। তার পাশে হাঁটা, তার পাশে থাকা, তার পাশে সহযোদ্ধা হিসেবে যে মানুষটি আছে তার পুরুষতন্ত্রেও বিরুদ্ধেও নারীকে লড়তে হবে। একইসাথে হাজার বছর ধওে নিজের ভেতর সচেতন-অবচেতনভাবে যে পুরুষতন্ত্রের চিন্তা আছে তার বিরুদ্ধেও লড়তে হবে- সুতরাং নারীর লড়াইটা কঠিন লড়াই। যে লড়াইয়ে অগ্রগামী হতে পারলেই মুক্তি মিলবে। যে লড়াইয়ের সূত্রপাত শুরু করে দিয়ে গিয়েছেন আমাদের পূর্বসূরীরা- ক্লারা জেটকিন, নাদেজদা ক্রুপস্কায়া, আলেক্সান্দা কোলনতাই, ইনেসা আরমান্দ, মেরি ওলস্টোনক্র্যাফট, সিম্যোন দ্য বেভোয়ার, প্রীতিলতা, ইলামিত্রসহ হাজারও লড়াকু, সংগ্রামী যোদ্ধারা। যে যুদ্ধের শেষ টানতে পারেননি পুরো বিশ্বের কোথাও।

 

পৃথিবীর এমন কোনো রাষ্ট্র নেই যেখানে নারী নিপীড়ন নেই- যেখানে নারী হওয়ার কারণে তাকে আলাদাভাবে নিপীড়নের স্বীকার হতে হয় না। পৃথিবীর কোথাও নারী পূর্ণ স্বাধীন নয়, পৃথিবীর কোথাও নারীর পূর্ণ নিরাপত্তা নেই, পৃথিবীর কোথাও নারী পুর্ণ মানুষের মর্যাদা পায়নি। একথাটি খুব গুরুত্ব দিয়েই উপলব্ধি করতে হবে। যতই নারী স্বাধীনতা, নারী স্বাধীনতা বলে গলা ফাটাক, এই একটা জায়গায় সব রাষ্ট্রের ঐক্য আছে- যেখানে মৌলিক কোনো পার্থক্য নেই। হ্যাঁ, পূর্বেই বলেছি এর চরিত্র বিভিন্ন রাষ্ট্রে বিভিন্নভাবে প্রকাশ ঘটে, নিপীড়নের মাত্রা ভিন্নরূপে দেখা যায়। তথাকথিত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোতে এররূপ ভিন্ন বলে যারা তর্ক তুলবেন তারা ‘নারীমুক্তি’ প্রশ্নে অজ্ঞ বলেই ধরে নিবো!

 

জেরেটস্কির কথা অনুযায়ী, “নারী আসলে পুঁজির জন্যই কাজ করছে পুরুষে রজন্য নয়; দৃশ্যমান ঘটনা হল নারীপুরুষের জন্য কাজ করছে এবং বাস্তব হল নারী কাজ করছে পুঁজির জন্য- এই দুইয়ের তফাৎ না বোঝার জন্য নারী আন্দোলনের অনেক শক্তি দিক্ভ্রান্ত হচ্ছে।” জেরেটস্কির এই গুরুত্বপূর্ণ কথাটাও আজকের নারী সংগঠনগুলোর উপলব্ধি করার ব্যাপার, একইসাথে নারীদের বুঝানোর দায় নেওয়ার ব্যাপার। ফসল-রক্ষা, বন্দর-রক্ষা, নদী-রক্ষার মতো নারীকে রক্ষার প্রয়োজন হচ্ছে কিন্তু পুরুষ রক্ষার কোনো প্রয়োজন হচ্ছে না।

 

পুরুষতান্ত্রিক ধর্ষকামী রাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী ফসল, বন্দর, নদী, নারী সবই সম্পদ এবং তা পুঁজি ও পুরুষের সম্পদ। নারীকে যখন নদী বলে আখ্যায়িত করা হয় নারী তখন বেশ প্রলুব্ধ হয় কিন্তু নারী একবারও ভাবে না এর পিছনে তার দৃষ্টিভঙ্গিটা কী? ‘নদী’ সম্পদ ‘নারী’ও সম্পদ। নদীকে দখল করা যায়, নারীকেও দখল করা যায়, ভোগ করা যায় সম্পত্তি বানানো যায়। ইতিহাসের বড় বড় পণ্ডিত কবি, সাহিত্যিক, দার্শনিকরা এই এক জায়গায় ঐক্যবদ্ধ- তারা নারীকে কতভাবে, কতরূপে, কত দর্শনে যে বর্ণনা করেছে তার শেষ নেই! সবই এসেছে ওই পুরুষতান্ত্রিক, ভোগতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। এই জায়গা থেকে মুক্ত নয় কেউ-ই! সুতরাং, নারীকে ‘মানুষ’ হিসেবেই আখ্যায়িত করাটা জরুরী। নদী, প্রকৃতি, সমুদ্র বলে সম্পদ বানানোর মনমানসিকতার বিরুদ্ধে নারীকেই লড়তে হবে। যে কথাটা বলেছি, নারীকে লড়তে হবে সকল নিপীড়নের বিরুদ্ধে। শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি কোথাও থেকে নারীর মুক্তি নেই। শিল্পীর আঁচড়ে নারী একজন নগ্নচিত্র, সাহিত্যে নারী নদী, প্রকৃতি, সমুদ্র, রূপবতী, গুণবতী, মায়াবতী কত কিছু! সবকিছুর মূলে নারীর শরীরকে ফুটিয়ে তোলা যেটার ভেতরেও লুকিয়ে থাকে পুরুষতান্ত্রিক, ভোগতান্ত্রিক লোলুপ দৃষ্টিভঙ্গি। নারীর মানসিকতাকে কখনও এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজ উপলব্ধি করবে না। সুতরাং নারীকেই এর বিরুদ্ধে লড়তে হবে। প্রকৃতপক্ষে নারীমুক্তি সংগঠনের ছায়াতলে যুক্ত হয়ে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের মধ্যদিয়েই একমাত্র নারীমুক্তি সম্ভব। এই স্লোগানকে জোর থেকে জোরদার করতে হবে।