নারীর সংগ্রাম শুরু হয় জন্মের পরেই

লাবনী মণ্ডল

প্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ২৬, ২০১৮

পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী। যৌনাকাঙ্ক্ষা তার ভেতরে তখনও জন্ম নেয়নি। স্কুল, খেলাধুলা আর দৌড়ঝাপের মধ্যেই বেড়ে ওঠা। হাফপ্যান্টের সাথে একটা ফ্রক পরে। স্তন তখন প্রস্ফুটিত নয়। তবে বোঝা যায়, তার শরীরের পরিবর্তন আসছে। যে পরিবর্তনটা আশপাশের মানুষজন বুঝতে পারে। বিশেষ করে পুরুষদের চোখে খুব সহজেই ধরা পড়ে। চাচাতো, খালাতো ও মামাতো ভাই, কাকা, মামা, দাদা, নানাদের চোখ এড়াতে পারে না এ পরিবর্তন। তাদের লোলুপ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে রক্ষা পাওয়ার কোনো উপায় নেই এই বয়সী বাচ্চাদের। আমি এই বয়সী বাচ্চাদের ‘মেয়ে বাচ্চা’ বলার চেয়ে ‘কিশোরী বা বাচ্চা’ বলতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। কিন্তু এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজে যেদিন শিশু জন্ম নেয় সেদিনই নারী-পুরুষ ভেদাভেদ টেনে দেয়া হয়।

যাই হোক, পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রীটি আমার পরিচিত নয়, তবে তার বড় বোনের সাথেই আমার কথা হয়েছে। তার বড় বোনটি চোখ বড় বড় করে, ঠোঁট কামড়ে আমাকে বলছিল, দিদি এ কেমন সমাজ?
কেনরে, কী হয়েছে, বল?
তখন ওর সাথে পুরুষতান্ত্রিক, ভোগতান্ত্রিক, পুঁজিতান্ত্রিক সমাজ নিয়েই কথা হচ্ছিল।

দিদি, আমার ছোট বোন ক্লাস ফাইভে পড়াকালীন সময়ে আমার আপন মামা তাকে ব্যবহার করেছে। মামা বেড়াতে এসে বোনের সাথেই ঘুমিয়েছিল। রাতে বোনের গায়ে হাত দেয়। তখন বোনটি সজাগ পেয়ে চোখমুখ বন্ধ করে থাকে। যাতে তার মামা বুঝতে না পারে সে কিছু বুঝতে পারছে। তার শরীরের ব্যথা পেয়েছে দিদি! আর বলতে রাজি নয়...

আমারও শোনার মতো ধৈর্য নেই। আমিও শুনতে পাচ্ছিলাম না। চোখমুখ বন্ধ হয়ে আসছিল। এই এক জায়গায় আমি নিজেকে ধরে রাখতে পারি না। আবেগে কেঁদে ফেলি। কখনও উত্তেজিত হয়ে আশপাশে সবকিছুকে তছনছ করে দিতে ইচ্ছে করে। প্রতিটি পুরুষকেই জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে অঙ্গার করে দিতে ইচ্ছে করে। চুপ করে থেকে কিছুই না বলে থাকার চেষ্টা করলাম। কিন্তু ওটাও সম্ভব হয়নি। ওকে আমার বোঝাতে হবে, সমাজটা কেন এমন, সমাজের মামা-চাচাসহ সব পুরুষরাই কেন এরকমভাবে দেখে তাদেরই কাছের মানুষসহ সকল নারীদেরকে?

৫% নারীকেও বাদ দেয়া যায় না যে নারীটি শিশুবয়সে, কৈশোর বয়সে তার খুব নিকটাত্মীয় দ্বারা এধরনের পরিস্থিতিতে পড়েনি। এরকম কোনো শিশু নেই যে শিশুটি ‘নারী শিশু’ হওয়ার কারণেই তার সবচেয়ে আপনজন তাকে ব্যবহার করতে চায়নি! কিন্তু এ বয়সে বা এর চেয়ে ছোট বয়সে একটি নারীর কী করার থাকে! ওই মেয়েটি তার মা-বাবাকে ঘটনাটি বলতে পারেনি। কারণ তার মা-বাবার সাথে তাদের সম্পর্কটা নিবিড় সম্পর্ক না, সামন্তীয় দৃষ্টিভঙ্গিটাই যেখানে প্রাধান্য। বোনটি ঢাকা থেকে বাড়িতে যাওয়ার পরই কান্নাজড়িত কণ্ঠে বোনকে জানায় সেই রাতের কথা, যে রাতের কথা যতদিন বেঁচে থাকবে ততদিন ভোলার মতো নয়। যতদিন এই পুরুষ দেখবে ততদিনই মনে হবে, পুরুষ মানেই জোর করে নারীদের শরীরের হাত দেয়, স্তনে চাপ দেয়, যৌনাঙ্গে আঙুল দেয়। জোর করে পুরুষাঙ্গ ঢুকিয়ে দেয়, বুঝতে পারে ব্যথা পায় তবুও জোর করে, জবরদস্তি করে। হয়তো এই পরিবেশে না থাকলে মেয়েটিকে আরও কত জোর করতো, আরও কতভাবে চেষ্টা করতো, তা আমরা বুঝতে পারি ধর্ষনকামী সমাজের চিত্র দেখলেই।

কোথায় নিরাপদ আমার-আপনার কন্যাশিশুটি? জন্মের পরই শুনতে হয় তার হাজারও অপবাদ। তার পরিবারের নারীরাও তাকে ঠিকভাবে গ্রহণ করতে পারে না। কারণ এই সমাজের পুরুষতান্ত্রিক চিন্তা পুরুষের সাথে সাথে সমানতলে ধারণ করে নারীরা। আমি-আপনি কি আমাদের কন্যা শিশুটিকে আমাদের আত্মীয়-স্বজন কারো কাছে দিয়ে নিরাপদবোধ করতে পারবো? মোটেও না। এটা কোনোভাবেই সম্ভব না। কারণ কন্যা সন্তানটির শরীর দেখলেই এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজের পুরুষদের সকল কিছু উল্টোপাল্ট হয়ে যায়। যৌনাকাঙ্ক্ষা এমনভাবে জেগে ওঠে যাতে কন্যাশিশুটিকে আর কিছু না করতে পারলেও একটু বুকে শক্ত করে ধরে রাখতে পারে, তার ঠোঁট, তার পুরুষাঙ্গ, তার হাতের আঙুলগুলো যাতে কন্যা শিশুদের শরীরের বিভিন্ন জায়গায় স্পর্শ করতে পারে। সুতরাং একটা চকলেট, একটা বিস্কুটের প্যাকেট, একটা পুতুল এনে কন্যা শিশুটিকে কোলে নেয়ার যে নোংরা মানসিকতা তা সচেতন মাদের বোঝা খুবই জরুরি। আমি এই সমাজে কন্যাশিশু জন্ম দিতে রাজি না। আমি এই সমাজের সকল পুরুষতান্ত্রিক পুরুষের মুখে-চোখে থু থু ছাড়া আর কিছুই দিতে রাজি নয়। ঘৃণায়, রাগে, ক্ষোভে স্তব্ধ হয়ে যাই। এটাও কী সম্ভব! কেন সম্ভব!

এটা একটি মেয়ের ঘটনা নয়। এই বয়সে আমি-আপনি-আপনারা কেউই পরিবারের কাছের মানুষজনের হাত থেকে রক্ষা পাননি। কিন্তু আমরা কেউ বলতে চাই না! কারণ সমাজ এগুলো রিসিভ করতে পারে না। সমাজের কাছে এ বিষয়গুলো যখন উপস্থাপন করা হবে সমাজ তখন এই বয়সের বাচ্চাদেরকেই ‘দুশ্চরিত্রা’ বলে আখ্যায়িত করবে। এখন কেন বলতেছে, কোনো ফায়দা লুটার জন্য বলতেছে- পুরুষবিদ্বেষী মনোভাব থেকে বলতেছে বলে উড়িয়ে দেয়ার যে ঝোঁক সেটাই প্রতিষ্ঠিত করবে। কিন্তু আমরা তবুও বলতে চাই, কারণ আমাদেরই দায়িত্ব নিতে এই সমাজটাকে পরিবর্তন করার। নারীদের শরীর নিয়ে, নারীদের সুখ-দুখ, শারীরিক চাহিদা, চাওয়া-পাওয়া নিয়ে কিছু বলতে নেই। কেননা, নারীদের তো কোনো যৌনাকাঙ্ক্ষাই থাকতে নেই, থাকে না, নারীরা পুরুষের সেবা করার জন্যই জন্ম নিয়েছে, সেবাদাস হিসেবেই থাকতে হবে। এই সেবাদাস হিসেবে থাকতে গিয়ে পুরুষদের দ্বারাই যেকোনো যৌন হয়রানির শিকার নারী হতেই পারে। এটা বড় কোনো অপরাধ নয়! এটা নিয়ে বেশি কথা বলা মানেই অসভ্য, বেয়াদপ, বেশ্যা, খাঙ্কি, মাগি! চারদিকে গুণগান মেনে নাও, মানিয়ে নাও! কি হবে বলে, এভাবেই চলছে তো। কিন্তু আমরাও দৃঢ়ভাবে বলতে চাই, এভাবে আর চলতে পারে না!

নারীর কোনো যৌনতা থাকবে না, নারীর কাজ হচ্ছে তার স্বামীর সেবা করা, নারীর যৌনতার বোধ থাকবে না, নারী যৌনতা সম্পর্কে খুব বেশি কিছু জানবে না এবং নারীর যৌনতা নিয়ে তেমন উচ্ছ্বাসও থাকবে না, যৌনকর্মে তার আগ্রহ তেমন থাকবেই না, নারীর কোনো যৌন তাড়না নেই, নারী যৌনতা প্রদর্শন করলে তাকে ‘অসুস্থ’ বলে ধরে নেয়া হয়। যৌনাকাঙ্ক্ষা কেবল পুরুষালী বৈশিষ্ট্যের বিষয় কেবলমাত্র নিম্নশ্রেণির বা নিচু  স্তরের নারী যেমন ‘বেশ্যারাই’ কেবল যৌনাকাঙ্ক্ষা থাকে।

এই চরম পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতাকে আমরা ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করি। নারীর যৌনচাহিদা আছে, বরং পুরুষের তুলনায় অনেকগুণে বেশি আছে। নারী সেটা বলতে পারবে, নারীর যৌন চাহিদা কোনো পুরুষ মিটাতে না পারলে একজন নারীর এক্তিয়ার আছে সেই পুরুষটিকে ছেড়ে চলে আসার- শুধুমাত্র এই কারণেই! সুতরাং নারীর প্রতি যে চরম বৈষম্য শুরু হয় জন্মের পর থেকেই এই বিষয়টি বোঝার মতো মানসিকতা আমাদের পরিবারগুলোকে খুব গুরুত্ব দিয়ে উপলব্ধি করতে হবে। নারীর সাথে যত বৈষম্যপূর্ণ সম্পর্ক বাড়বে, এই সমাজব্যবস্থা ততই পিছনের দিকে ধাবমান হবে। একটা সমাজে নারীর চিত্রই প্রমাণ করে সেই সমাজের গণতন্ত্র। সেই সমাজের অগ্রসরতা! কিন্তু আমাদের সমাজব্যবস্থা এতটাই নিম্নচরিত্রের, এতটাই ধর্ষকামী যেখানে নারীর কোনো অবস্থানই নেই। কোনো শ্রেণির নারীরই কোনো অবস্থান নেই, দৃঢ়চিত্তেই এ কথাটি বলছি। অনেকে দ্বিমত পোষণ করতে পারে, কিন্তু এ নিয়ে সুষ্ঠু গবেষণা হলে বিষয়টি পরিষ্কারভাবে বোঝা যাবে। নারীদের মুখ খোলাটা জরুরি। নারীদের মান-সম্ভ্রমের কথা ভেবে, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র, সংসারের কথা ভেবে এই বৈষম্য মেনে নেওয়ার ঝোঁক থেকে বের হয়ে আসার আহ্বান রাখছি দৃঢ়ভাবেই। চিন্তারমুক্তিটা খুবই দরকার। অর্থনৈতিকভাব মুক্ত হয়ে চিন্তার দাসত্বে থাকার মধ্যে কোনো আধুনিকতা বা কোনো স্বাধীনতা নেই। এই পঞ্চমশ্রেণির ছাত্রীদের মাথায় এটা ঢুকাতে হবে, তোমরা মানুষ, তোমরা এই সমাজের সর্বোচ্চ চূড়ার মানুষ। তোমাদেরকে ভোগ করতে পারে, ব্যবহার করতে পারে এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজের পুরুষরা। এই বোধোদয় তোমাদের মাথায় এই বয়সেই ঢোকাতে চাচ্ছি। কেননা তা না হলে তোমরা অতীতের মতোই মুখ বন্ধ করে, চিৎকার না করে সয়ে যাবে। এই সয়ে যাওয়ার মানসিকতার চেয়ে ভয়াবহ মানসিকতা আর কিছু হতে পারে না। একেবারেই সয়ে যাওয়ার মানসিকতাকে প্রত্যাখ্যান করতে হবে। এতে যদি এই সমাজের ধর্ষকামী চিন্তার কিছুটা পরিবর্তন ঘটে। আমূল পরিবর্তন ঘটবে সামাজিক ব্যবস্থার পরিবর্তনের মধ্যদিয়ে। কিন্তু, যার যার অবস্থান থেকে পরিবার থেকে পরিবর্তনের ডাকটা দৃঢ়ভাবেই দিতে হবে। আর কোনো শিশু যাতে এই ধরনের সিচুয়েশনে না পড়ে, তাদের কোনো মামা-চাচা যাতে তাদের সাথে রাতেবিরাতে, খেলনার লোভ দেখিয়ে এ ধরনের বর্বর কাজ না করতে পারে এই বোধটা ঠিক ওইবয়স থেকেই শেখাতে হবে এবং এই শেখানোর দায়িত্ব প্রাথমিক অবস্থায় পরিবারকেই নিতে হবে। হাজার বছর ধরে চলে আসা যে অপসংস্কৃতি, সামন্তীয় দৃষ্টিভঙ্গি এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বের হয়ে আসার মানসিকতা পরিবারকে নিতে হবে। পরিবারকে বাধ্য করতে হবে এই সমাজকে, এই রাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়ার মানসিকতা অর্জন করতে হবে। যাতে আমার কন্যা সন্তানটি আর কোনো ভয়াল থাবায় না পড়ে, আমার কন্যাসন্তানটিকে যেন কোনো বর্বর পুরুষের যৌনলালসার শিকার না হতে হয়। এরকম ঘটনা লিখতে গেলে, বলতে গেলে পৃথিবীর অন্য কোনো ইস্যু নিয়েই ভাবা সম্ভব না। কিন্তু এটা সমাজের ভয়ংকর ইস্যুৎ, গুরুত্বপূর্ণ এই ইস্যুৎটাকে বাদ দিয়ে সুশীলিয় মনোভাব পোষণ করে, ভদ্রবেশী সুশীল সেজে সমাজের একচুলও পরিবর্তন হবে না! যে বা যারা নারী প্রশ্নটাকে কোনো ভাবেই গুরুত্ব দিতে রাজি নয়, তাদেরকে দিয়ে আর যাই-হোক সমাজের কোনো পরিবর্তন হবে না, সম্ভব না।