নিরুদ্দেশ

উপন্যাস (পর্ব ১)

সজীব দে

প্রকাশিত : ডিসেম্বর ২৩, ২০১৭

মার্চের শেষদিক। শহরে লোকজন নেই বললেই চলে। কিছু কাক আছে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে। শুকুনেরা উড়ছে আকাশে। ভোরে কুয়াশার মতো আটকে যায় জীবন হেথায়-হোথায়। ঘটনাটা ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের পরদিন। চারদিক চুপচাপ। ঘর থেকে কেউ বের হয় না। সবার মনে চাপা আতংক।
এলাকার রইস মিয়া গতকাল থেকে স্মৃতি হারিয়ে ফেলেছে। ছেলেমেয়ে কাউকে চিনতে পারে না। ২৬ মার্চ সকাল। আব্দুর রব গতকাল থেকে আর কানে শোনে না। সজলের বোন গতরাতে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে, এখনও জ্ঞান ফেরেনি। মরণ চাঁনের মিষ্টির ওপর অজস্র মাছি আর পিঁপড়ে জমে আছে।
পাড়ার মুচিটা গতকাল সকালে যেখানে বসে জুতো সেলাই করছিল, আজ সেখানে তার লাশ পড়ে আছে।
গল্প-উপন্যাস যাই বলুন, সেসব আমি কিছু লিখব না। গল্প-উপন্যাস স্রেফ ধোঁকা। প্রিয় পাঠক-পাঠিকা, আমাকে ক্ষমা করবেন। কারণ এ লেখার কোনও ধারবাহিকতা নেই। এটা জার্নালও নয়। আমার ছোট কাকা যা বলেছিলেন, আমি হুবহু তা লিখে গেছি। অতএব তার স্মৃতির ওপর ভরসা করা ছাড়া আমার আর কোনও উপায় নেই। কাকা যদি স্মৃতির বাইরে কিছু বলে থাকেন, তবুও এটা তার স্মৃতি। স্মৃতি এক অদ্ভুত জিনিস। স্মৃতি জমে একভাবে। আমরা স্মৃতি রোমন্থন করি আরেকভাবে। বলি আরও অন্যভাবে, আর লেখার সময় তা হয়ে যায় হয় ডায়েরি।
কিন্তু এটা ডায়েরিও নয়। আমি লেখার কাজটা করেছি। কাকার মুক্তিযুদ্ধ দেখার ধরণটা কেমন জানি। তিনি কখনও যুদ্ধ নিয়ে কথা বলেননি। অন্তত আমি শুনতে পাইনি। কাকার বয়স এখন ৬০ ছুঁই ছুঁই। বিয়ে করেননি। কেন করেননি? কেন গল্পটা আমাদের কারও জানা নেই! ৬৯ এর দিকে কাকা একবার নিরুদ্দেশ হয়ে গেছিলেন। আবার ৭০ এর মাঝামাঝি ফিরে আসেন, এটা আমাকে মা বলেছিলেন। কাকা স্কুল পাশ করেননি। কিন্তু পড়াশুনা ছিল। বাইরের পত্রিকা, বই এসব নিয়ে থাকতো। তিনি নীরব হয়ে গেছেন। চোখে কুয়াশা মোড়ানো। তিনি বলেন, চোখে যখন কুয়াশা জড়িয়ে আসে, তখন জগৎটাকে কাল্পনিক মনে হয়। কারও খারাপ কথায়ও মন খারাপ হয় না। অহংকার উড়ে যায়। কেমন সন্ত-সন্ত মনে হয়। যখন সেখানে বসে থাকি, মনে হয়, এটাই জগৎ। নড়তে ইচ্ছে হয় না। কারও কথা মনোযোগ ফিয়ে শুনলেও পরক্ষণেই ভুলে যাই। মনটা কোথায় যেন লুকিয়ে গেছে। মনে হয় ঝিনুকের ভেতর।
এইসব কথা হয় মাঝে মাঝে। আমাদের বাড়িটা দোতলা। কাকা তার ঘরে সারাদিন বসেই থাকে। মা এসে ঘরে খাবার দিয়ে যান। আমার কাকার নাম উদয়ন। উদয়ন নামটা রাখার পিছনে আমার দাদুর যুক্তি ছিল, আমার ছোট ছেলেটা ঠিক সুর্যোদয়ের সময় মায়ের পেট থেকে বেরোয়। কিন্তু কাকা বলে, বাবা এটা মিথ্যা বলে, আমার জন্ম হয় রাত ৮টায়। তখন ঘোর অমাবস্যা। এইসব স্মৃতি, কল্পনার ভেদ, সংস্কার, রঙ্গের বাহুল্যতা দিয়েই মানুষের জীবন। আমর মনে হয়, কারও কথা মিথ্যা নয়। মিথ্যা শব্দটা নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই। অনেকে বলে, আমি মেনে নেই।
কাকা, রাতে তোমার ঘুম হয়?
জানি না।
বুঝতে পারো না?
না। কখন মনে হয়, সারা জীবন আমি কখনও ঘুমাইনি। কখনও মনে হয়, সারা জীবন ধরেই আমি ঘুমিয়ে আছি।
বাইরে যেতে মন চায় না?
চায়। কিন্তু ইচ্ছে কার না।
আমি একদিন তোমাকে বাইরে নিয়ে যাব। যাবে?
হ্যাঁ।
তোমার কি স্মৃতি আছে? মনে পড়ে আগের দিনগুলোর কথা?
কাকার পরিষ্কার জবাব, আমি ঠিক স্মৃতিকে ওভাবে ধরতে পারি না। স্মৃতি কেমন জানি লুকোচুরি খেলা করে। ধর, একটা কথা মনে হলো। বসে ভাবি একটু মন দিয়ে। কিন্তু কই! হারিয়ে ফেলি।
হুম। স্মৃতি তবে মেয়ে মানুষ।
হা-হা-হা। বেশ বলেছিস। ওর কামড় কত! বুক, বগলের নিচে কি চুল আছে? নাভিতে কি পদ্ম ফোটে?
আমি কাকার এইসব কথা শুনে হাসতে থাকি।
কাকা বলে, তুই হাসছিস।
শুনতে পাওনি।
কেমন আবছা আবছা তোর হাসি। তোরও কি বিষণ্নতা আছে?
কখনও মনে হয় আমি বিষাদের সন্তান।
এ কেমন রোগরে তরুণ?
জানি না।
কাকাকে দেখে মনে হয় তিনি ভাবছেন। আমি জিগেশ করি, কী ভাবছ কাকা?
ওই যে বিষাদের সন্তান। ভালোই বলেছিসরে। বড় অদ্ভুত লাগলো কথাটা।
কাকা বসে ঝিমোয়। এটা তার অনেক দিনের অভ্যাস। কোনও কাজ নেই। কাজ করতে তার ভালো লাগে না। কাকা বলে, কাজ না থাকলে কি দিব্যি জীবন চলে, না?
বলি, চলে, তবে আমাদের দেশে নয়। আমাদের গরিব দেশ। কাজ না করলে লোকজন খারাপ মনে করে। বলে, লোকটা আলসে।
চলবে...