নিরুদ্দেশ

পর্ব ৩

সজীব দে

প্রকাশিত : জানুয়ারি ১৪, ২০১৮

বেশ কয়েকদিন পর ইলিয়াস ঘর থেকে বের হয়। প্রথমে সে যায় সুপ্রিয়র বাসায়। দরজা খোলে মায়া। দুজন মুখোমুখি। মায়া ইলিয়াসের হাত ধরে। মায়ার হাতের মুঠিটা ইলিয়াস শক্ত করে ধরে। মায়া বলে, মা খাওয়া-দাওয়া প্রায় ছেড়ে দিছে। বিছানায় অসুস্থ হয়ে পড়ে আছে। ধীমান কাকা এসে কাল স্যালাইন দিয়ে গেছে। বাবাও কথা বলেন না।
ইলিয়াস বলে, সুপ্রিয়র লাশের কোনো খোঁজ পাওয়া গেছে?
না। ঘরে আসবেন না?
না।
চলে যাবেন?
ইলিয়াস কোনো কথা বলে না। ইলিয়াস মায়ার হাত ছেড়ে দেয়।
আমরা এখন কী  করবো?
ছোটন কোথায়?
সকালে বের হয়েছে।
কিছু বলে যায়নি?
বলল, বন্ধুর বাসায় যাচ্ছে।
ওকে সাবধানে থাকতে বলো। আর বলবে কাল থেকে যেন বাসা থেকে না বের হয়।
ইলিয়াস চলে আসে।
লাল তাঁতের শাড়ি পড়া অষ্টাদশী মায়া দরজায় দাঁড়িয়ে থাকে যতক্ষণ ইলিয়াসকে না দেখা যায়। মায়া দরজা বন্ধ করে ঘরে ফিরে আসে। মায়া মায়ের কাছে যায়। মা বলে, কে এলো রে?
ইলিয়াস ভাই।
সুপ্রিয়র কোনো খবর জানে ও?
মায়া এ কথার কোনো উত্তর দিতে পারে না।
আর কী বলল?
ছোটনকে সাবধানে থাকতে বলে গেছে। ও যেন ঘর থেকে বের না হয়।
মায়ার মা লক্ষ্মীরানি চোখ বন্ধ করেন। মায়া মায়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। এক সময় লক্ষ্মীরানি ঘুমিয়ে পড়েন।

২৫ মার্চের ঘটনার পর থেকে প্রতিদিন দলে দলে হিন্দু পরিবার জীবন বাঁচাতে ভারতের সীমান্ত দিয়ে ওপার বাংলায় আশ্রয় নেয়। কিন্তু শশিমোহন বসাক লেনের সুপ্রিয়র পরিবার থেকে যায়। ৯ এপ্রিল সুরনাথের সহকর্মী দেবেশ রায় আসেন তার বাসায়। দেবেশ রায় বলেন, দাদা, এ দেশ মনে আর থাকতে পারমু না। যেভাবে হিন্দুগো মারতাছে মনে হয় আমরাও বাঁচমু না। ওদিকে আজগর শেখ হিন্দু জোয়ান পোলা দেখলে কেমন করে জানি তাকায়। পরশুদিনতো বইল্লা ফেলল, তোমার পোলারে কইয়ো আমার লগে যেন দেখা করে। আর শোন এইডা হইলো মুসলমানের দ্যাশ। তোমরা এহানে থাকবা ক্যান? এহানে থাকতে হইলে মুসলমান হইতে হইবো। আমরা আল্লাহর পেয়ারা বান্দা। আল্লাহর হুকুম, এ্যাই দ্যাশ পাকিস্তান ছিল এবং থাকবো।  
তার লাইগ্যা আমরা শান্তিপূর্ণবে জিহাদ ঘোষণা করছি। কোনো হিন্দু এ দ্যাশে থাকবার পারবো না। বুঝলা? জিন্নাহ সাব আমাগো পিতা, গোলাম আজম আমাগো নেতা। এই দ্যাশে হিন্দু থাকবো না ইডা হইল শ্যাষ কথা। যাও এবার।
দেবেশ রায় মাথা নিচু করে চলে আসে।
চলেন দাদা কয়েকদিনের মধ্যে চলে যাই।
সুরনাথ বলে, না এটা আমার দেশ। এ দেশ আমার চৌদ্দ পুরুষের। আমি এ দেশ ছেড়ে যাব কেন? এ দেশের শিকড় ছেড়ে গেলে আমি বাঁচতে পারমু না। আমার ছেলের কোনো খোঁজ পেলাম না।
সুরনাথ কর্মকারের এক কথা, মরলে এদেশেই।
সুরনাথের বন্ধু দেবেশ রায় যখন বলে, ঘরে আপনের জোয়ান মেয়ে। শুনছি আজগর শেখ রাজাকার বাহিনী করছে কিছু জোয়ান পোলা পাইন দিয়া। ছেলেগুলা ভাল না। কোন বাসায় হিন্দু জোয়ান মেয়ে আছে এইসব খোঁজ রাখা তাগো কাজ। আপনের মেয়েটার কথা ভাইবা অন্তত... সুরনাথের কপালে ভাঁজ পড়ে চিন্তার।

ইলিয়াস কেন মুক্তিযুদ্ধে যায় না?
ইলিয়াসের যুদ্ধ করার কোনো আগ্রহ নেই। ওর বরং ঘরে ঘুমাতে ভাল লাগে। ও দেখে, দলে দলে লোকজন মুক্তিযুদ্ধে যাচ্ছে। সবার একটাই স্বপ্ন দেশকে স্বাধীন করার। একজন মানুষ হয়ে আরেকজন মানুষকে মারতে হবে এটা সে মেনে নিতে পারে না। ওর চোখের সামনে প্রিয় বন্ধু সুপ্রিয় মরে গেল। এই মৃত্যুও তাকে প্রতিশোধ পরায়ণ করে তুলতে পারছে না। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া ছাত্র, টগবগে রক্ত, ওরই যাওয়া উচিত কিন্তু ভেতর থেকে সে কোনো সাড়া যায় না। কেন তার রক্ত টিকটিকির মত ঠাণ্ডা সে বুঝতে পারে না।
ইলিয়াস খুব একটা ঘর থেকে বের হয় না। মাঝে মাঝে পড়ার টেবিলে বসে মায়াকে চিঠি লেখে কিন্তু সে চিঠি মায়াকে দেয় হয় না। সুপ্রিয়র মৃত্যুর পর তার ভাবনার জগৎটা শূন্য হয়ে যায়। মায়াকে সে কি লেখে সে কথা আমরা কখনও জানতে পারি না। যেহেতু তার ভাবনার জগৎ শূন্য। তবে আমরা ধরে নিতে পারি, সে আসলে কোনো চিঠি লেখে না। কিছু আঁকিবুঁকি করে কাগজগুলো ভাঁজ করে টেবিলের ওপর রেখে দেয়। গাছে গাছে নতুন পাতা আসতে থাকে। ফুল ফুটে। পাখিরা গান গায়। চড়ুইপাখি তাদের বাসায় বাসা বাঁধে। সে বাসা থেকে তিনটা চড়ুইয়ের বাচ্চা হঠাৎ করে মাটিতে পড়ে যায়। ইলিয়াস সেটা দেখে। পুনরায় সে বাচ্চাগুলোকে বাসায় তুলে রাখে।
এদিকে ঢাকাসহ সারা দেশে ব্যাপক যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। ইলিয়াসের অনেক বন্ধু মুক্তিযুদ্ধে চলে যায়। কিন্তু ইলিয়াসের যাওয়া হয় না।
চলবে...