পাখি নয়, রক্তেভেজা জুতোর ঝাঁক ওড়াউড়ি করে

রথো রাফি

প্রকাশিত : মে ১৮, ২০১৮

যুদ্ধ একটি বিভীষিকা। এরপরও পৃথিবীর বুকে যুদ্ধ চলেছে, চলছে, চলবে। মানুষ নৃশংসভাবে হত্যা করবে মানুষকে। এটাই যেন ভবিতব্য। যে কোনো যুদ্ধের প্রতি আমাদের ঘৃণা। এ ঘৃণা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন লেখকের কলমে উঠে এসেছে। বাংলা ভাষাতেও এর চর্চা থেমে নেই। কবি রথো রাফি ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে কলম ধরেছিলেন ফিলিস্তিনে ইসরাইলি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে। সেসময় সে দেশের বেশ কিছু কবিতা অনুবাদও করেছিলেন। ছাড়পত্রের পাঠকদের জন্যে সেসব লেখা পর্যায়ক্রমে ছাপা হচ্ছে:

 

মার্কিন কালো কবি ল্যাংস্টন হিউজেসের বিচার কবিতা প্রথমে, তারপর অন্যকথা:

বিচারক এক অন্ধ দেবি
যে বিষয়ে আমরা কালোরাই বেশ জ্ঞানী:

তার ব্যান্ডেজ লুকিয়ে রাখে পচে-যাওয়া ক্ষত দুটি
যা হয়তো চোখ ছিল কোনো একদিন।

সত্যি কথা। তবে কালোদের পাশপাশি তা বেশ ভালো বোঝে ওই আরব ফিলিস্তিনিরাও। কিন্তু আমেরিকা, ইউরোপ, এমনকি মধ্যপ্রাচ্যও (অনেক সময়ে) তা কিছুতেই বোঝে না। এর পরিণতি ফিলিস্তিন। যেখানে ইসরায়েলি বোমা কেবল রক্তাক্ত নিহত শিশুর জন্ম দেয়। যেখানে শিশুদের কান্নার নিচে তাদের স্বাধীন দেশের দাবি তলিয়ে যায়। তবে তলিয়ে না গেলেও পশ্চিমা গণমাধ্যম শিশুদের কান্না দিয়ে তা ঠিকই নিখুঁতভাবে ঢেকে দেয়! এই কান্না ছাপিয়ে পরিণত বয়সের ফিলিস্তিনিদের ঠোঁট দুটো কোন দাবি জানায়, আমরা আর কোনোভাবেই তা শুনতে পাই না। কিংবা তাদের চোখগুলো শিশুদের কান্নার প্রতিধ্বনি হওয়া ছাড়া, কিংবা তাদের ঠোঁটদুটি শিশুদের আর্তনাদের প্রতিধ্বনি করা ছাড়া তাদের জন্য ভিন্ন উপায়ও খোলা থাকে না।

মিডিয়ার কল্যাণে শুধু আহত, নিহত শিশু, আর তার পিতামাতা আর তার ভাইবোনের কান্না, আর্তনাদ ছাড়া আর কিছুই শুনতে পায় না বিশ্বাবসী। তাদের চোখের জল আর শিশুদের রক্তেচোবা লালজুতো জোড়া ছাড়া আর কিছুই দেখতে পায় না সারাপৃথিবী। দেখতে পায় শুধু ওই কংক্রিটের স্তূপ হয়ে থাকা বাড়িঘর। বিধ্বস্ত এক দেশ। আর বুদ্ধিবৃত্তির সিংহভাগ জলাঞ্জলি দিয়ে, ওই আহত আর্ত শিশুর প্রতিধ্বনি হয়ে পড়ে সুশীলমহল। ভুলে যেতে যায়, ইউরোপ আর আমেরিকাই ইসরায়েলকে এখানে রোপণ করেছে। পৃথিবীর একমাত্র ‘বিশুদ্ধ ধর্মদেশ’ তৈরি করেছে তারা। অথচ, তাদের কাছেই বিচার দাবি করি আমরা! আজকের ইসরায়েলিরা হয়ে ওঠেছে তখনকার ইউরোপীয় জর্মন খ্রিস্টান। আর ফিলিস্তিনিদের বানিয়ে ছেড়েছে নিজের নির্যাতিত অতীতের প্রতিধ্বনি! নিজেরই অতীতের বিশুদ্ধ প্রতিচ্ছবি!

ফিলিস্তিনিদের আর্তনাদের শব্দ ছাড়া ইসরায়েলি সরকারের এখন ঘুমই হয় না! আর বিশ্বজুড়ে পশ্চিমা মিডিয়া প্রপাগাণ্ডায় মনে হয়, বয়স্ক মানুষের মৃত্যু আর আমাদের স্পর্শ করে না বুঝি, অনুশোচনাগ্রস্ত করে না বুঝি বিবেককে! অপরাধী করাতো দূরের কথা! শুধু শিশুদের মৃত্যুই বুঝি আমাদের মর্মাহত করে। এমন একটা ভ্রান্তিজাল দিয়ে বন্দি করে ফেলে আমাদের ‘মুক্তবিবেক’! তখন সহজ হয়, সুড়ঙ্গের বিপুল ক্ষমতার কথা শোনানো ও দেখানো। সহজ হয় হামাসের প্রবল শক্তিশালী হয়ে ওঠার গল্প ছড়ানো। দশকের পর দশক ধরে দেশের সীমান্ত অবেরোধ করে রেখেছে ইসরায়েল ও মিসর। সমুদ্র অবরোধ করে রেখেছে ইসরায়েলি নৌবাহিনী। তবু হামাসের শক্তিশালী হয়ে ওঠার গল্প শোনানো হয় এই বলে যে, ইসরায়েল ‘জঙ্গি’ হামাসকে ততটা ধরাশায়ী করতে পারছে না।

আমাদের গল্প শোনানো হয়, সেই বস্তির মতো ঘিঞ্জি এক দেশের জনসংখ্যার বৃদ্ধির, যা আতঙ্কিত করে ইসরায়েলকে। যে দেশে এমনকি হামাস লোহার নাগাল পেলে অস্ত্র বানাবে এই আতঙ্ক ছড়িয়ে শিশুদের জন্য প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সামগ্রীও ও আমদানি করতে দেয়া হয় না। ভবন নির্মাণের প্রয়োজনীয় লোহাটুকুও আমদানি করা যায় না। আর তবু ওইসব অবকাঠামোও ভেঙে ছারখার করা হয় বারবার। যে দেশের মানুষ কোনো না কোনোভাবে রিলিফের উপরে নির্ভরশীল, যাদের কোনো শিল্পকারখানাই নেই, সে দেশের মানুষ কিনা ভয়ংকর সশস্ত্র হয়ে উঠতে পারে, এমন মিথ্যে আতঙ্ক অবলীলায় ছড়ানো হতে থাকে। আমাদেরকে আরও কত ধরনের ভূতের গল্প যে শোনানো হয়, মিডিয়ার মাধ্যমে তার শেষ নেই। আর আমাদের বিবেকের ওপরে চমৎকারভাবেই আছর করে ওইসব ভূতের গল্প।

হ্যাঁ, ফিলিস্তিন ভূখণ্ড গাজা বহু বছর হলো পৃথিবীর সবচেয়ে নিষ্ঠুর এবং সবচেয়ে বড়ো কারাগারে পরিণত হয়েছে। এই নিরূপম কারাগার দাগী অপরাধীরা তো নয়ই, এমনকি সাধারণ অপরাধীদের জন্যও নয়। কেবল নিরপরাধী, নিষ্পাপ, নিরীহ মানুষের জন্যই নির্ধারিত। শাস্তিও যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্তদের মতো তুচ্ছ কিছু নয়- একটি জীবন সমাপ্ত হলে যা শেষ হয়ে যায়! তাদের এ শাস্তি, বরং বংশ পরম্পরায় চলতে থাকে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে গড়িয়ে যায়। কারো মৃত্যুই এই বিপুল দণ্ডভার একফোঁটা হ্রাস করতে পারে না। এই কারাগারের এক প্রতিবেশী মিসর। অনেক বছর ধরে বধির। অবরোধ দিয়ে রেখেছে। আরেক প্রতিবেশী ইসরায়েল। যমের দায়িত্ব নিজ কাঁধে নিয়ে দুই দিক ঘিরে রেখেছে ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার পর থেকেই।

নিরপরাধ মানুষ অসংশোধনযোগ্য হওয়ার কারণে দান্তের ক্যারণ সহস্র নদীকে ধারণ করে অপার হয়ে ওঠা এই কারাগারের পাশের সমুদ্র দিয়ে দূরের কোনো নরকে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব পালন করতে পারতো। কিন্তু ওই যমের ভয়ে ভুলেও এই পথ মাড়ান না তিনি। তিনি কেবল যমেরই সহযোগী। আর দান্তের ওই ‘ইউরো-নরকে’ মোহাম্মদের জায়গা থাকতে পারে, কিন্তু ফিলিস্তিনিদের জায়গা নেই। আর নিজের আকাশও ওই বন্দি বাসিন্দাদের আপন নয়। বরং প্রতিবেশীর মতোই বিশুদ্ধ অপর। আর পায়ের নিচে মাটিও ওই আকাশের মতোই একই স্বভাবের। পেটভর্তি বোমা নিয়ে লোহার ফড়িঙগুলো ধাপিয়ে বেড়ায়। জলস্থল আকাশ সবখানেই। সবখানেই লোহার পোকাগুলোর সমান দাপট। যেখানে সেখানে শুধু বোমাবমি করে। আর দিনের চেয়ে রাত আরো বেশি উজ্জ্বল সেখানে। উজ্জ্বল মুর্হুমুহু বোমার ওই আঘাতে।

কখনোই বন্দিদের চোখের পাতা এক হতে দেয় না। ঘুমের বদলে রাতে যেকোনো মুহূর্তে যম আসে, জাপটে ধরে দুই হাতে। শত ছটফটালেও আর ছাড়িয়ে নেয়া যায় না নিজেকে। তখন আকাশ থেকে যেমন, তেমনি ধর্ষকের দোহাই না মানা লিঙ্গের মতো কামানের নল থেকেও ঝাঁক ঝাক বোমা ছুটে আসে বুক বরাবর। তবে প্রতিবেশি দেশের মাতৃভাষা বোমা নয়, নিরাশ্রয় হিব্রু বলেই দাবি করে থাকে গোটা পশ্চিমাবিশ্ব। তারা সবসময়েই এ দাবি করে আসছে। আর সমান্তরালে আয়রন ডোমের জন্য, কামানের, ট্যাংকের নলের জন্য অর্থ-গোলা-বারুদ সরবরাহ করে আসছে। কী দিন কী রাত! দুই দিক থেকে দেয়ালগুলো হঠাৎই চেপে ধরে। শিশুদের হাড়হাড্ডি ও আত্মা চিবিয়ে খায়। বুড়ো-বুড়ি, তরুণ বা নারী কিছুই বাছে না। বিছানা লাফ মেরে ছাদে গিয়ে ঠেকে। সেখানেই থামে না। ছাদ ফেটে মৃতদেহ নিয়ে ওই রক্তাক্ত বিছানা ম্যাজিক কাপের্টের মতো উড়তে থাকে আকাশে। আর উপরের আকাশ যে অপরের। তাই সেই আকাশ দিয়ে এবার ওড়া, শুধু ওড়া, স্বাদ মিটিয়ে। আকাশের এ মাথা থেকে ও মাথা উড়ে চলে শত শত লাল কার্পেট, আর প্রস্রাবের ধারার মতো আকাশ থেকে ওইসব কার্পেট চুঁইয়ে রক্ত ঝরতে থাকে।

রক্তবৃষ্টি চলতেই থাকে। কিন্তু শুকনো ধুলোয় তা কোনো মানচিত্র তৈরি করতে পারে না। পশ্চিমা বিশ্বের রাষ্ট্রনায়করা এমন চমৎকার দৃশ্য বিশ্বের অন্য কোথাও দেখতে পায় না। তাই মুগ্ধ হয়! তাই ইসরায়েলকে অস্ত্র, অর্থ ও সমর্থন সবকিছু দিয়েই বাহবা দিতে থাকে। অথচ এক বাক্স পাথরও পাঠায়নি তারা ফিলিস্তিনিদের আত্মরক্ষার অধিকারকে স্বীকৃতি দিতে! তো বিশ্ববাসীর চোখের উপর দিনরাত ভাসতে থাকে, নিজের শিশুর মতো অগণন নিষ্পাপ মৃতমুখ। বিবেকবানদের ওরা কি তখনো বাবা বলে ডাক দেয়! না হলে পশ্চিমা মিডিয়ার চাতুর্য সত্ত্বেও বিশ্বের অলিতে গলিতে ক্ষোভে ফেটে পড়ে কেন অগণন মানুষ! কবর খননকারী পেশার লোক ভেতরে ভেতরে কাঁদে প্রতিটি নতুন কবর খুঁড়ে তোলার সময়! প্রতিটি কফিন বিক্রির পর একজন কফিন ব্যবসায়ীর চোখও বারবার ভিজে ওঠে। কিন্তু মুনাফালোভি ‘প্রভু’র কানে হায়, ওই বাবা ডাক আর বিশ্ববাসীর ক্ষোভ কত তুচ্ছ হয়ে আছে!

লেখক: কবি ও সংবাদকর্মী