পাগলাগারদে কবি তারিক আজিজের সঙ্গে কথাবার্তা

স্বকৃত নোমান

প্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ১৬, ২০১৮

বাইরে ভাদ্রের কড়া রোদ। পাবনা মানসিক হাসপাতালের একটি ওয়ার্ডের সামনে চার-পাঁচজন দর্শনার্থী দাঁড়িয়ে। কবি অরবিন্দ চক্রবর্তী আর আমিও দাঁড়ালাম। ওয়ার্ডের ভেতরে দশ-বারোজন মানসিক রোগী, যাদের আমরা পাগল বলি। বয়সে সবাই তরুণ। একজন বক্তৃতা দিচ্ছে, আরেকজন আত্মকথা বলছে, বাকিদের কেউ বিড়ি ফুঁকছে, কেউ নীরবে কলাপসিবল গেট ধরে দাঁড়িয়ে। আত্মকথা বয়ানকারীর বয়স বত্রিশ-চৌত্রিশের বেশি হবে না। সুরা ফাতেহা পড়তে না পারার কারণে বিয়ের পরদিন কীভাবে সে নববধূকে বেদম প্রহার করেছিল, গর্বের সঙ্গে সেই ঘটনার বর্ণনা দিচ্ছে। কিছুদিন আগে একটা খুনও করেছে। মাস দুয়েক হলো এই হাসপাতালে এসেছে। এর আগে ভারতের বিভিন্ন মানসিক চিকিৎসালয়ে ছিল। কথা বলতে বলতে সে একটা বিড়ি ধরাল। সুখটান দিয়ে আবার বলতে শুরু করল নিজের কথা।

কবি অরবিন্দ চক্রবর্তীর গাত্রবর্ণ তো ফর্সা। এক মানসিক রোগী তার উদ্দেশে বলল, ‘হ্যালো, আর ইউ চাইনিজ?’ অরবিন্দ হেসে উঠলেন। আমি বললাম, ‘নো, হি ইজ এন ইংলিশ। হি হেজ কাম ফর্ম অ্যামেরিকা।’ রোগী বলল, ‘একটা বাংলা গান শুনবেন?’ বললাম, ‘হ্যাঁ, শোনান।’ বাংলা সিনেমার একটা জনপ্রিয় গান গাইল সে। পাশের আরেক রোগী বলল, ‘আমিও একটা গাইব।’ আরেক রোগী বলল, ‘আমিও গাইব।’ গান গাওয়া নিয়ে রোগীদের মধ্যে শুরু হলো তর্কাতর্কি। একজন আরেকজনকে ধমকাতে লাগল। শোরগোলের ভেতর থেকে ভেসে এলো একটা কণ্ঠস্বর, ‘আমি একটা সিরিয়াস কবিতা আবৃত্তি করব, কেউ কি শুনবেন? কথাটা আমার কান এড়ালো না। আমি রোগীটির দিকে তাকালাম। পঁয়ত্রিশ থেকে চল্লিশের মধ্যে বয়স। পরনে প্যান্ট, গায়ে ফুল শার্ট, চোখেমুখে এক ধরনের সারল্য।

বললাম, ‘হ্যাঁ, শুনতে চাই।’ রোগী শুরু করল। কবি পুর্ণেন্দু পত্রীর একটি কবিতা বিশুদ্ধ উচ্চারণে আবৃত্তি করল। তার আবৃত্তি শুনে খানিক অবাক হলাম। অরবিন্দও। আবৃত্তির জন্য টাকা দাবি করল সে। আমি দশ টাকার একটা নোট দিয়ে তার নাম জিজ্ঞেস করলাম। বললেন, ‘তারিক আজিজ।’ নামটা পরিচিত মনে হলো। কোথাও যেন শুনেছি। মনে হচ্ছে এই নামে যেন কোনো এক কবি আছেন কিংবা ছিলেন। শুরু করলাম তার ঠিকুজি-কুলুজির অনুসন্ধান। একের পর এক প্রশ্ন করতে লাগলাম, আর তিনি উত্তর দিয়ে যেতে লাগলেন। তার বাড়ি নোয়াখালী। ঢাকার তেঁজগাও কলেজে পড়তেন। ইন্টারমিডিয়েট পর্যন্ত পড়ে আর পড়েননি। প্রথম দশকের শুরুতে কবিতাচর্চা শুরু করেছিলেন। দৈনিক আজকের কাগজ, জনকণ্ঠ, ইত্তেফাকসহ নানা পত্রপত্রিকার সাহিত্য সাময়িকীতে ছাপা হতো তার কবিতা।

বললাম, ‘আপনার লেখা একটা কবিতা শুনতে চাই।’ তিনি স্বরচিত একটা কবিতা আবৃত্তি শুরু করলেন:

বালক বলিল ও আমার ফুলকুড়ানি মন
শ্রাবণ বাতাস জানে, পোড়া দুপুরে মেঘের জরায়ু থেকে
খসে পড়া পরদেশি রোদ জানে
বুকের গহীনে বেড়ে ওঠা বেনামি সকল সর্পিল বালিকাগাছ
আর ঠুনকো বালিঘর বাঁধভাঙা বালকমনে
চোখ বদলের মতো অমোঘ ঋতুতে ভেঙে যায়
চুরে যায়, ভেসে যায় যুবতী বাতাস
ও আমার নেশালাগা ভোর মেয়ে,
বকুল কুড়ানো সকালগুলো এখনো
কারো কারো মালা পাবার আশায় সান্ত্বনায় বসে থাকে।

আমি বললাম, ‘আরেকটি শুনতে চাই।’ তিনি শুরু করলেন। কবিতার নাম ‘আত্মপরিচয় তালিকায়’। দুই লাইনের কবিতা, আমার ভেতর থেকে আমার পিতৃপুরুষ তার লকলকে যৌনাঙ্গ রাষ্ট্রকে দেখিয়ে বলেছিলেন, ব্যক্তিত্বের অপর নাম...(অস্পষ্ট)।

(তার আবৃত্তি আমি মোবাইলে রেকর্ড করেছিলাম, এখন লিখছি সেই রেকর্ড থেকে। ফলে কবিতার শব্দ বা পঙক্তি-বিভাজনে ভুল হতে পারে)। আবৃত্তি শেষ করে তারিক বললেন, ‘দিন, টাকা দিন।’ আমি তার হাতে এবার ৫০ টাকার একটা নোট দিলাম। পাশ থেকে আরেক তরুণ রোগী নোটটা কেড়ে নেয়ার চেষ্টা করল তারিকের হাত থেকে। পারল না। তারিক আমার সঙ্গে কথা বলছেন। তরুণ রোগী তাকে ধমক দিয়ে বলল, ‘ওই বেটা, তুই থামবি?’ আমি বললাম, ‘তুমি থামো মিয়া। তিনি কবি। অনেক বড় মাপের মানুষ। তাকে সম্মান করো।’ তরুণ রোগী বলল, ‘আমি কি ছোট মাপের মানুষ? আমি এখান থেকে ঠেটঠেট করে মারব আর ওখানে সব ধ্বংস হয়ে যাবে।’ বললাম, ‘পরে ধ্বংস করো, এখন আমাদের কথা বলতে দাও।’ বকাবকি করতে করতে তরুণ রোগী একপাশে সরে দাঁড়াল।

তারিক আজিজ আমার নাম জানতে চাইলেন। জানালাম। তিনি মনে করার চেষ্টা করলেন। না, ঠিক মনে পড়ল না। বললেন, ‘আপনিও কবি?’ বললাম, ‘না, আমি গল্প-উপন্যাস লেখার চেষ্টা করি।’ ইমদাদুল হক মিলন, আহমাদ মোস্তফা কামাল ও প্রশান্ত মৃধাকে চিনি কিনা জানতে চাইলেন। বললাম, ‘হ্যাঁ, সবাইকে চিনি।’ অরবিন্দ জানতে চাইলেন, ‘আপনার কয়েকজন বন্ধুর নাম বলুন।’ তারিক বললেন, ‘কবি সোমেশ্বর অলির সাথে আমার বন্ধুত্ব ছিল। জানি না এখনো আমাকে মনে রেখেছে কিনা।’ তারপর বলতে লাগলেন তার পরিচিত কবিদের নাম। চঞ্চল আশরাফ, টোকন ঠাকুর, সরকার আমিন, মজনু শাহ, আলফ্রেড খোকনসহ দশ-বারোজন কবির নাম বললেন। সবার নাম মনে নেই আমার। মাহবুব আজীজ এখনো যুগান্তরে কাজ করেন কিনা জানতে চাইলেন। বললাম, ‘না, তিনি এখন দৈনিক সমকালের ফিচার এডিটর।’ সবশেষে জানতে চাইলেন কবি শামীম রেজার কথা। তিনি কোথায় আছেন, কী করেন ইত্যাদি জানতে চাইলেন। আমি সবই জানালাম। আমি পাবনা কেন এসেছি সেই ব্যাপারে জানতে চাইলেন। জানালাম, কবি ও কথাসাহিত্যিক মোখলেছ মুকুলের আমন্ত্রণে এসেছি। তাকে নিয়ে একটা অনুষ্ঠান চলছে জেলা পরিষদ মিলনায়তনে। কবি মাকিদ হায়দার, কথাসাহিত্যিক রফিকুর রশীদ, কবি ও কথাসাহিত্যিক ঝর্ণা রহমান, কথাসহিত্যিক মণি হায়দারসহ অনেকে এসেছেন।’ সবাইকে চিনতে পারলেন তিনি। সবার লেখাজোখা তিনি পড়েছেন।

কিন্তু কবি তারিক আজিজ মানসিক হাসপাতালে কেন? কেন তিনি পাগল হলেন? তারিক জানালেন, একটা সময় খুব নেশা করতেন। হেন নেশা নেই যাতে তিনি আসক্ত ছিলেন না। একটা সময় মানসিক সমস্যা দেখা দেয়। তার বাবা তাকে তাজ্যপুত্র ঘোষণা করেন। তার এক চাচা তাকে মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে দেন। আমি বললাম, ‘এখনো কি নেশা করতে মন চায়?’ বললেন, ‘না না, আমার মনে হচ্ছে আমি সুস্থ হয়ে গেছি।’ বললাম, ‘আমার তো সুস্থই মনে হচ্ছে আপনাকে। আপনি একজন কবি। ভালো-খারাপের পার্থক্য আপনি নিশ্চয়ই বোঝেন। নেশার কারণে যদি এভাবে বন্দি থাকতে হয়, তাহলে নেশা করার কী দরকার?’ তারিক মাথা দোলালেন। তার বাবার মোবাইল নম্বরটি দিয়ে বললেন, ‘আমি বাড়ি ফিরে যেতে চাই। আমার বাবাকে বলবেন আমি আর নেশা করব না। আমি এখন সুস্থ। বাড়িতে বসে আমি লেখালেখি করতে চাই।’ আমি বললাম, ‘ঠিক আছে, আমি আপনার বাবা বা চাচার সঙ্গে যোগাযোগ করে আপনার কথাগুলো জানাবার চেষ্টা করব।’

আমি হাত বাড়িয়ে দিলাম। গেটের ফাঁকে তিনি হাতটি বের করলেন। করমর্দন করলাম। তাকে মোট ৬০ টাকা দিয়েছিলাম। তিনি নোট দুটি আমার হাতে গুঁজে দিয়ে বললেল, ‘এই নিন, আমার টাকা লাগবে না। আপনার সঙ্গে কথা বলে ভালো লেগেছে।’ না, আমি টাকা ফেরত নিলাম না। কিন্তু তিনি ফেরত দেবেনই। বারবারই ফেরত নেয়ার কথা বলছেন। আমি বললাম, ‘ফেরত দিতে হবে না। এই টাকা দিয়ে আপনি কিছু কিনে খাবেন।’ এমন সময় তার হাত থেকে টান দিয়ে সেই মানসিক রোগী, যে কিনা একটা খুন করেছিল, দশ টাকার নোটটি নিয়ে নিল। তারিক প্রতিবাদ করলেন না। বুঝতে পারি, আমার কাছ থেকে টাকা নেয়াটা তার আত্মসম্মানে লেগেছে, তাই ফেরত দিতে চাইছেন। তবে প্রথমে কেন টাকা চাইলেন? চাইলেন এই জন্য যে, সব মানসিক রোগী দর্শনার্থীদের কাছে নানা কথা বলে টাকা চাচ্ছে, তাই তিনিও চেয়েছেন। সঙ্গদোষে লোহা ভাসে। সঙ্গদোষে তিনিও চেয়েছিলেন। কিন্তু আমাদের সঙ্গে কথা বলার পর তার কবিসত্তা জেগে উঠেছে। তাই ফেরত দিতে চাচ্ছেন। কিন্তু শেষপর্যন্ত টাকা আমি ফেরত নিলাম না।

পাবনা জেলা পরিষদ মিলনায়তনে মোখলেছ মুকুলের অনুষ্ঠান চলছে। আমাদের যেতে হবে সেখানে। তারিক আজিজের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে পেছনে সরে দাঁড়ালাম। অরবিন্দ তখনো তারিকের সঙ্গে কথা বলছেন। এক অচেনা তরুণ সামনে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আপনার সঙ্গে একটা ছবি তুলতে চাই।’ বললাম, ‘নিশ্চয়ই।’ তরুণ নাকি আমাকে চেনে। বাইরে নিয়ে চা খাওয়াতে চাইল। আমি রাজি হলাম না। কারণ দ্রুত আমাদের ফিরতে হবে। অরবিন্দকে ডাকলাম। দুজন রিকশায় উঠে বসলাম। রিকশা চলতে থাকে। আমি ভাবতে থাকি, এই পাগলা গারদ থেকে কবি তারিক আজিজের মুক্তি দরকার। মনে হচ্ছে না তিনি এখন সম্পূর্ণ উন্মাদ। মনে হচ্ছে না তিনি আর নেশা করবেন। এখনো তার ভেতর কবিত্বশক্তি আছে। তার মুক্তি দরকার। কিন্তু কীভাবে? তার বাবা কি সন্তানকে হাসপাতাল থেকে বাড়িতে ফিরিয়ে নেয়ার উদ্যোগ নেবেন? পুত্রস্নেহে আবার বাড়িতে ঠাঁই দেবেন? জানি না। এই লেখা তার বাবার চোখে পড়তেও তো পারে। তিনি একজন সাংবাদিক। এই লেখা পড়ে তার মনটা গলে যেতেও তো পারে। পিতৃহৃদয় তো আর পাথর হতে পারে না।

টুকে রাখা কথামালা
১৬.০৯.২০১৮