পীস অ্যান্ড হারমোনি: শেখ হাসিনাকে নিবেদিত কবিতা

আহমেদ রেজা

প্রকাশিত : জুলাই ১৫, ২০১৮

পৃথিবীর ইতিহাসে বাংলা ভাষা ও বাংলাদেশ নানা কারণে অনন্য। মাতৃভাষার যথাযথ স্বীকৃতি ও মর্যাদা আদায়ের লক্ষ্যে ব্যাপক গণআন্দোলন অন্য কোনো দেশ বা জাতির ইতিহাসে ঘটেনি। ভারত উপমহাদেশ প্রায় দুশো বছর ব্রিটিশ শাসনাধীনে ছিল। তারপর নানা চড়াই উৎড়াই পেরিয়ে ১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তান— এ দু’টি রাষ্ট্রের জন্ম হয়। দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে স্বাধীন হওয়া এ দুটি রাষ্ট্র যে ভ্রান্ত রাষ্ট্রদর্শনের ভিত্তিতে সৃষ্টি হয়েছিল, তা পাকিস্তানের জন্মের অব্যবহিত পরেই বাংলাদেশের (তৎকালীন পূর্ব বাংলার) মানুষ অনুধাবন করেছিল। পাকিস্তান সরকার উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করে বাঙালিদের ওপর চাপিয়ে দিতে চেয়েছিল। এর প্রতিবাদে বাঙালিরা জেগে ওঠে। ১৯৪৮ সালে শুরু হওয়া বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি ১৯৫২ সালে চূড়ান্ত রূপ লাভ করে।

সেই ভাষা আন্দোলনই কালক্রমে বাঙালি জাতিকে স্বাধিকার আন্দোলনের পথে ধাবিত করে। আর সেই স্বাধিকার আন্দোলন পর্যায়ক্রমে স্বাধীনতা সংগ্রামে পরিণত হয়। এ স্বাধীনতা সংগ্রাম চূড়ান্ত রূপ নেয় ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে। দীর্ঘ নয় মাস সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ শেষে বাঙালি ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা অর্জন করে। জন্ম হয় একটি নতুন স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের, নাম যার বাংলাদেশ। বাঙালির স্বাধিকার আদায়ের সংগ্রাম শুরু থেকে শেষাবধি যার নেতৃত্বে পরিচালিত হয়, তিনি আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাঙালিকে হাজার বছর অপেক্ষা করতে হয়েছিল এই ক্ষণজন্মা ভূমিপুত্রের জন্য। তিনি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি। তার জন্ম, বেড়ে ওঠা ও সংগ্রামের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে বাঙালির সংগ্রামের ইতিহাস, গৌরব ও সাফল্য।

বঙ্গবন্ধু একটি ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত উন্নত বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন, যাকে তিনি ‘সোনার বাংলা’ বলে অভিহিত করতেন। কিন্তু তিনি  সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন পূরণ করে যেতে পারেননি। দেশ স্বাধীন হবার মাত্র সাড়ে তিন বছর পরে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট দেশীয় ও আন্তর্জাতিক চক্রান্তে কতিপয় বিপথগামী সামরিক সদস্যের হাতে তিনি সপরিবারে নিহত হন। ভাগ্যক্রমে সেসময় বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানা বিদেশে অবস্থান করছিলেন। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা ছিল বাঙালির ইতিহাসের সবচেয়ে কলঙ্কময় অধ্যায়। এরপর দেশ দীর্ঘকাল সামরিক বা আধা-সামরিক শাসনাধীনে ছিল। মাত্র ৩৪ বছর বয়সে শিশুপুত্র ও কন্যাকে বিদেশের মাটিতে রেখে ১৯৮১ সালের ১৭ মে এক ঝঞ্জা-বিক্ষুব্ধ দিনে দীর্ঘ নির্বাসন শেষে দেশে ফিরে আসেন বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনা।

তিনি বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে সবচাইতে গুরুত্ববহ এবং গৌরবময় ভূমিকার অধিকারী বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের হাল ধরেন। ধাপে ধাপে আন্দোলন-সংগ্রামের মাধ্যমে গণঅভ্যুত্থান সৃষ্টি করে তিনি নব্বইয়ের দশকে দেশে গণতন্ত্র পুন:প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। এরপর গত প্রায় আটাশ বছর ধরে তিনি নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন এদেশের মানুষের কল্যাণ ও সমৃদ্ধির লক্ষ্যে। এই বছরগুলোতে শেখ হাসিনা মোট তিনবার সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন। তবে এখানে বলা প্রয়োজন যে, তার রাজনৈতিক জীবন মোটেই মসৃণ নয়। একাধিকবার তিনি রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে কারান্তরীণ ও গৃহবন্দি ছিলেন। এমন কি ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করার জন্য প্রকাশ্য সভায় গ্রেনেড আক্রমণের মাধ্যমে তাকে হত্যার চেষ্টা করা হয়।

বিভিন্ন সময়ে তাকে ক্ষমতাচ্যুত করার চক্রান্ত হয়েছে। অনেকবার তাকে গভীর রাজনৈতিক সংকটের মুখোমুখি হতে হয়েছে। কারাভোগের সময় তিনি শারীরিকভাবে ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েন। এছাড়া পিতা-মাতা, সহোদর ভ্রাতা ও ভ্রাতৃবধূসহ স্বজন হারানোর ব্যথা তো তার জীবনের নিত্যসঙ্গী হয়ে আছেই। এসব কষ্টকর অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে তিনি সাহস ও ধৈর্যের সাথে সামনে এগিয়ে চলেছেন। দেশ পরিচালনার গুরুদায়িত্ব পালনকালে তিনি সর্বদা এদেশের মানুষের নিরাপত্তা, সুখ ও সমৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার প্রত্যয়ে নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছেন। তিনি জাতির পিতাকে সপরিবারে নির্মম হত্যার বিচারের রায় কার্যকর করেছেন। জেল হত্যার বিচারসহ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছেন। পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তিচুক্তি সম্পাদন করে এদেশের বিভিন্ন ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষের সাথে সম্প্রীতির সেতুবন্ধন রচনা করেছেন।

বিশ্বমন্দার মাঝেও বাংলাদেশের অর্থনীতিকে ক্রমশ সমৃদ্ধ করেছেন। শেখ হাসিনা এদেশের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, শিল্প-বাণিজ্য, আধুনিক ভূমি-ব্যবস্থাপনা এবং অফিস-আদালতের সব পর্যায়ে তথ্য প্রযুক্তি প্রয়োগের সূচনা করে এদেশকে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’-এ রূপান্তরিত করেছেন। তিনি ভারতের সাথে গঙ্গা পানি চুক্তি ও স্থল-সীমানা চুক্তি বাস্তবায়ন করেছেন। তার অনন্য কূটনৈতিক দক্ষতার কারণে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা বৃদ্ধি পেয়েছে। সেইসাথে পরাশক্তির চোখ রাঙানিকে উপক্ষো করে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ সম্পন্নের পথে নিয়ে যাচ্ছেন। উন্নত রাষ্ট্রসমূহ ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তন, দারিদ্র্য বিমোচন, নারীর ক্ষমতায়ন, নিরক্ষরতা দূরীকরণ, শিশু মৃত্যুর হার হ্রাসসহ আইসিটি খাতে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য শেখ হাসিনাকে অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা প্রদান করেছে। জাতিসংঘের ‘চ্যাম্পিয়ন অব দ্যা আর্থ’ পুরস্কার অর্জনের মাধ্যমে তিনি আজ একজন বিশ্বনেতার মর্যাদায় আসীন হয়েছেন।

অতি সম্প্রতি পার্শ্ববর্তী দেশ মিয়ানমার থেকে সীমান্ত অতিক্রম করে প্রায় দশ লক্ষ রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। এই নিপীড়িত, অসহায় ও বিপন্ন মানুষদের পাশে দাঁড়িয়ে মানবতার এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মিয়ানমার থেকে আসা জনগোষ্ঠীর সমস্যার যথাযথ, স্থায়ী ও শান্তিপূর্ণ সমাধানের লক্ষ্যে তিনি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কাজ করে যাচ্ছেন। তার মানবিক বোধ, ইতিবাচক সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও উন্নয়ন কর্মকান্ডে নিরলস প্রচেষ্টার কারণে তিনি আজ বিশ্ব পরিমণ্ডলে ‘মানবতার জননী’ হিসেবে অভিষিক্ত।

বাংলাদেশ কবির দেশ, কবিতার দেশ। বাংলাদেশ পাখির দেশ, নদীর দেশ। আমাদের কবিতায় আর গানে আমাদের ভালোবাসা আর প্রতিবাদ, শ্রদ্ধা আর দ্রোহ, শংকা আর সাহস প্রকাশ করি অসংকোচে, নান্দনিক সৌকর্যে। এদেশের বিশিষ্ট প্রায় সব কবি কবিতা লিখেছেন তাদের পরম প্রিয় নেত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনাকে নিয়ে। কবিদের ভাবনা, আকাঙ্ক্ষা, স্মৃতি, স্বপ্ন, কল্পনা ও পরিকল্পনা তাদের প্রিয় কাণ্ডারি শেখ হাসিনাকে ঘিরে। শেখ হাসিনার চরিত্রের নানা আলো আর বিভা, শোক ও দুঃখ, আনন্দ আর অভিযাত্রা মূর্ত হয়েছে এ কাব্যগ্রন্থে সংকলিত একাত্তুরটি কবিতায়।

একাত্তর সাল বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা অর্জনের বছর হিসেবে আমাদের জাতীয় জীবনে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বছর। আর গত ক’মাস আগে শেখ হাসিনার জীবনের একাত্তুরতম জন্মদিন বাঙালি সানন্দে উদযাপন করেছে। এ দুটি বিষয়কে স্মরণে রেখে আমরা কাব্যপ্রেমিক এই মহান ব্যক্তিকে নিয়ে লেখা একাত্তুরটি অনুপম কবিতা একত্রে প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছি। পাশাপাশি সারাবিশ্বে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের ধারণা প্রসারের যে অনন্য নজির তিনি স্থাপন করেছেন, তা বিবেচনা করে এই গ্রন্থের নাম দিয়েছি ‘শান্তি ও সহাবস্থান’। শুধু বাংলা ভাষাভাষী নয়, পৃথিবীর সকল দেশের ও অঞ্চলের মানুষ যেন এই মহান ব্যক্তি সম্পর্কে এদেশের সারস্বত সমাজের আবেগ ও ভাবনা বিষয়ে অবহিত হতে পারেন, সেই লক্ষ্যে আমাদের বিবেচনায় সেরা একাত্তুরটি কবিতা ইংরেজি অনুবাদসহ একত্রে এ গ্রন্থে উপস্থাপন করেছি।

আমাদের এ শুভ প্রয়াসকে প্রাণিত করেছেন এদেশের  অসংখ্য কবি, লেখক, গবেষক, শিক্ষক, সাংবাদিক, চিকিৎসক, স্থপতি, শিল্পী ও সংস্কৃতিকর্মীসহ আমাদের সহকর্মীবৃন্দ। তাদের সবাইকে জানাই অকুণ্ঠ ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা। অধ্যাপক আহমেদ রেজা এ গ্রন্থের সম্পাদক এবং আনিস মুহম্মদ গ্রন্থের অনুবাদক ও সংকলক। ভূমিকার সময় ও স্থান: একুশে গ্রন্থমেলা ফাল্গুন, ১৪২৪ বঙ্গাব্দ/ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ খ্রিস্টাব্দ, ঢাকা।

একুশে বইমেলা ২০১৮