পুরস্কার মুখ্য নয়

পর্ব ৬

প্রকাশিত : এপ্রিল ১৪, ২০১৮

মেহেদী উল্লাহ বর্তমান প্রজন্মের একজন মেধাবী গল্পকার। তার ভাষা যেমন কারুকাজময়, তেমনই চিন্তায় রয়েছে প্রথা ভেঙে নতুন কিছু তৈরির আয়োজন। গেল মেলায় প্রকাশিত হয়েছে প্রথম উপন্যাস গোসলের পুকুরসমূহ। প্রকাশিত গল্পের বই চারটি। স্বীকৃতি হিসেবে পেয়েছেন জেমকন তরুণ কথাসাহিত্য পুরস্কার ২০১৩। কবি ও কথাসাহিত্যিক আবু তাহের সরফরাজ তার সঙ্গে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে গপসপ করেছেন। প্রতি শনিবার ধারাবাহিকভাবে সেসব কথামালা প্রকাশ করা হবে:

 

সরফরাজ: আপনার প্রকাশিত বই নিয়ে বলুন।

মেহেদী: প্রথম গল্পের বই `তিরোধানের মুসাবিদা` প্রকাশ করে কাগজ প্রকাশন, ২০১৪ সালে। কাগজ প্রকাশন জেমকন গ্রুপের প্রতিষ্ঠান। প্রথম বই করব বলে পাণ্ডুলিপি তৈরি করেছিলাম ২০১২ সালে। সে সময়  বিজ্ঞাপন মারফত জানলাম যে, প্রতিবছর জেমকন একজন তরুণ লেখককে পুরস্কৃত করে, আর পুরস্কৃত পাণ্ডুলিপিটি তারাই প্রকাশের দায়িত্ব নেয়। চিন্তা করলাম, পুরস্কার মুখ্য না, পেলে পাণ্ডুলিপিটা বই হয়ে যাবে, এমনিতে কোনো প্রকাশককে তো চিনি না। বই প্রকাশের ভাবনা থেকেই জেমকনে পাণ্ডুলিপি দিয়েছিলাম। সে বছর পুরস্কার পাইনি। তবে পাণ্ডুলিপি সেরা পাঁচে ছিল। পুরস্কারপ্রদান অনুষ্ঠানে সেই তথ্য জানতে পারি, কর্তৃপক্ষ সেরা পাঁচটি পাণ্ডুলিপির নাম ঘোষণা করেছিল। পরের বছর আবার পাণ্ডুলিপি জমা দিই, যেহেতু ওই সময়ের মধ্যে কোনো প্রকাশক পাইনি। পরের বার পাণ্ডুলিপিটি পুরস্কারের জন্য নির্বাচিত হলো। নাম ছিল `পূর্ণদৈর্ঘ্য বাংলা ছায়াছবি`। কিন্তু নামটা পছন্দ না হওয়ায় পুরস্কারের আগের রাতে করলাম, `পোস্টমাস্টার ও অন্যান্য গল্প`। দুই নামেই পাণ্ডুলিপিতে গল্প ছিল। কিন্তু পরের নামটিও পছন্দ হচ্ছিল না। এদিকে ফেব্রুয়ারি ছুঁই ছুঁই। নতুন নামকরণজনিত হাপিত্তেস  নিজের মধ্যে। হঠাৎ খেয়াল হলো, পাণ্ডুলিপির গল্পগুলোর মধ্যে একটা ঐক্য আছে, তা হলো মরণ। অধিকাংশ গল্পের বিষয় মৃত্যু। তৈমুর রেজার কাছে ছুটে গেলাম। সাহিত্য বিষয়ক যে কোনো পরামর্শের জন্য তৈমুর ভাই বিরাট আশির্বাদ! তৈমুর ভাই চার-পাঁচটি নাম লিখে পাঠালেন, চিন্তাভাবনা করে। এরমধ্যে প্রথম নামটিই ছিল `তিরোধানের মুসাবিদা`। মানে মৃত্যুর খসড়া। নামটার মধ্যে কী যেন আছে! তখন বুঝি নাই। এখন অনেকে বলেন, নামটা ক্লাসিক হইছে! তথাস্তু! যথারীতি বই মেলায় এলো। আশাতীত সাড়া। দুই ধরনের প্রডাকশন আনল কাগজ প্রকাশন। বুকবাইন্ড ও পেপারব্যাক সংস্করণ। পেপারব্যাকের দাম একটু কম। এই ধরনটা বেশি পছন্দ হইছিল। গত দুইমেলা ধরে তিরোধানের মুসাবিদার কোনো এডিশন বাজারে নাই। কাগজ প্রকাশন ইচ্ছা থাকলেও বোধ হয় আনতে পারছে না, প্রতিবছরের পুরস্কৃত পাণ্ডুলিপিটি তাদের আনতে হয়। কিন্তু এটা লেখকের জন্য মঙ্গলজনক নয়, প্রকাশকের জন্য তো অবশ্যই। বইটার চাহিদা আছে বাজারে। অনেকেই চান। তখন পিডিএফ কপি দিই পড়তে। আশা করি, সামনের মেলায় বইটির দ্বিতীয় সংস্করণ আসবে। অন্য প্রকাশক যোগাযোগ করেছে। কিন্তু বিষয়টায় মন টানছে না। কাগজ প্রকাশন আমার প্রথম বই এনেছে, অন্যরকম আবেগ এটা। বলে বুঝানোর মতো না। আমি খুব করে চাই বইটা তারা আনুক, ব্যবসা করুক। গল্পের বই এমনিতে বিক্রি হয় কম। কিন্তু এটার চাহিদা আছে। লেখক হিসাবে বিপণন নিয়ে ভাবতে চাই না বলে তাদের কখনো ফোন করা হয়নি। আমি চাই, তারা ইতিবাচক হোক।

সরফরাজ: এটা কি কাগজ প্রকাশনীর ব্যবসায়িক পলিসি? যেহেতু বইটা পাঠক নিয়েছে। আর অনেক বছর বাদে কোনো গল্পের বই নিয়ে পাঠকমহলে এত তাড়া। ব্যক্তিগতভাবে এটা আমারও পছন্দের একটি বই। বইয়ের তাকে গুরুত্বপূর্ণ বইগুলোর সাথেই এর স্থান হতেই পারে, যা বাংলাদেশের ছোটগল্পের জন্য প্রভূত সমৃদ্ধির। কাগজ কি চাইছে বই সংকটের কারণে একটা মিথ তৈরি হোক, তারপর আবার আনবে?

মেহেদী: পাঠক কোথায় কোন তাকে রাখে সেটা তার ব্যক্তিগত বিষয়। পলিসি কীনা জানি না। তবে পাঠক বই পাচ্ছে না, এটাই এখন লেখকের যন্ত্রণা। একই অভিজ্ঞতা দ্বিতীয় গল্পের বই `রিসতা`র ক্ষেত্রেও। পরের বছর ২০১৫ সালে শুদ্ধস্বর বইটি এনেছে। কিন্তু শুদ্ধস্বরের কোনো বইই এখন আর বাজারে নাই। প্রকাশক আহমেদুর রশিদ টুটুল দেশ ছেড়ে এখন বিদেশে অবস্থান করছেন। রিসতা মার্কেটে নাই, এটা আমার সেকরিফাইস। বইটা অন্য প্রকাশককে দিতে চাই না। দিলে নিজেকে স্বার্থপর মনে হবে। বরং এই ইতিহাসের সাথে লেখক হিসাবে জড়িয়ে পড়াটা মর্যাদার।

সরফরাজ: আপনার এমন অনুভূতিকে শ্রদ্ধা জানাই। আশা করব, রিসতা আবার পাঠকের কাছে সমাদৃত হোক। যতদূর জানি, এই বইয়ের গল্পগুলোর বিষয় সম্পর্ক। নতুন সময়ে সম্পর্কের যে পরিবর্তন-বিবর্তন সেটা। এবং বইটি প্রকাশিত হওয়ার বছরেই বইটি পাঠ করে কথাসাহিত্যিক মঈনুল আহসান সাবের তার  ফেসবুক পোস্টে আপনার সম্পর্কে প্রত্যাশা ব্যক্ত করেছিলেন, `আমরা একজন বড় লেখক পেতে যাচ্ছি।` সেটা নিশ্চই অণুপ্রেরণার। তো তার পরের বছর ফারিয়া?

মেহেদী: হ্যাঁ। ফারিয়া মুরগির বাচ্চা গলা টিপে টিপে মারে। চৈতন্য প্রকাশ করেছে ২০১৬ তে। বইটি প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে একশ্রেণির পাঠকের কাছে আমি ব্যাপকভাবে নিন্দিত। কিন্তু তাদের প্রতি আমার শ্রদ্ধা অটুট আছে। তারা এমন নাম নিতে পারেনি। এখনো বই পড়ুয়া গ্রুপগুলোতে বইটির নাম নিয়ে হাসাহাসি হয়। এমনকি ওই সময়, একজন এমন পোস্টও ফেসবুকে দিয়েছে যে, এই হচ্ছে বড় লেখকের নমুনা। তিনি মূলত সাবের ভাইয়ের কথাকে ব্যঙ্গ করেছেন। বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে আমি বলেছি, বইটার নাম গল্পটি রাজনৈতিক গল্প। সমকালীন দেশীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি এই গল্পের বিবেচ্য। আমি বলি, নাম নিয়ে কথা নয়। এক্ষেত্রে পাঠ ও বিবেচনাই একমাত্র সমাধান। গল্পটা বেশি বড়ও নয়। যতক্ষণ ধরে গ্রুপগুলোতে আমাকে গালি দেয়া হয়, ততক্ষণে এই গল্প একশোবার পড়া সম্ভব। কিন্তু পড়া নয়, খিস্তিতেই অনেকের আনন্দ।
পৃথিবীতে কত অদ্ভুত নামের বই বিচিত্র কারণে আছে। সেগুলোর নাম অন্যনামে দিলে সংশ্লিষ্ট এসেন্সই তৈরি হতো না। গাভ্রিয়েল ত্রোয়েপোলস্কির একটা বিখ্যাত বই আছে, নাম `ধলা কুকুর শ্যামলা কান`। নামের এমনি কোনো গুরুত্ব নেই, গল্পের কন্টেন্টই নামের যথার্থতা তৈরি করে। টেক্সট না পড়ে কথা বললে তো মুশকিল! তবে এতকিছুর পরও ফারিয়া বেস্টসেলার বইয়ের একটি, চৈতন্য প্রকাশিত বইগুলোর মধ্যেও। অবশ্য সাম্প্রতিককালে দেখছি, অনেকেই বইটির পক্ষে অবস্থান নিচ্ছে। গ্রুপে কেউ নেতিবাচক পোস্ট দিলে প্রতিবাদ করছে। বইটি আগে পড়ার পরামর্শ দিচ্ছে। নাম গল্পটির লিংক দিচ্ছে। যেটি বই প্রকাশের আগেই যুগান্তর পত্রিকার সাহিত্য পাতায় ছাপা হয়েছিল। গল্পটি পড়ার পর ভুল ভাঙে। নেতিবাচক পোস্ট ডিলিট করে দেয়।

চলবে