পূর্বপুরুষের বাড়ি

শ্রেয়া চক্রবর্তী

প্রকাশিত : অক্টোবর ১৬, ২০১৮

রিষড়া গঙ্গাধারে সাধুখাঁদের আদিবাড়ি প্রায় একশো বছরের পুরনো। এই বাড়িতে `শিব দুর্গা` প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলার তেরশো বত্রিশ সনে। প্রচলিত পদ্ধতিতে নয়, এখানে দুর্গা ঠাকুরের পুজো হয় বৈষ্ণব মতে। অর্থাৎ দেবী অসুরদলনী রূপে এখানে আরাধ্যা নন, বরং মহাদেবের সাথে তাঁর প্রেমাস্পদ মূর্তিটি পূজিত হয়, যেখানে প্রেম ও পূজা মিলে গেছে একই মন্ত্রে।

পুরনো যা কিছু তার প্রতি আমার কেমন এক দুর্বলতা আছে। পথ চলতে এমন কত পুরনো বাড়ির পাশে থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছি। কত প্রাণের বহমানতা যেন চোখের সামনে বায়োস্কোপের স্লাইডের মতো সরে সরে যেতে দেখেছি। খড়খড়ি দেয়া জানলা দিয়ে অন্তর্গত আলো-অন্ধকার কেঁপে উঠতে দেখেছি নব্বই বছরের ঠাকুমার খকখক কাশির শব্দে। ওই ঘরেই ফুলশয্যা হয়েছিল তার।

সেতুকে দেখানোর ইচ্ছা ছিল তার পূর্বপুরুষের সেই বাড়িটি, যেই বাড়ি থেকে সিঁড়ি সরাসরি নেমে গেছে গঙ্গায়। এই বাড়িতেই বিয়ে হয় আমার দাদাশ্বশুর সিদ্ধেশ্বর সাধুখাঁ ও দিদিশাশুড়ি পারুলবালার, তিনি তখন বছর তেরোর বালিকা, খেলাঘর ছেড়ে কলকাতা থেকে রিষড়ায় আসেন গা ভরা গয়না নিয়ে স্বামীর ঘর করতে।

শুনেছি, আমার দিদিশাশুড়ি কবিতা পড়তে খুব ভালোবাসতেন। আমরা যে বাড়িতে থাকি সেখানকার অ্যান্টিক আসবাবগুলি তারই পছন্দে কেনা পার্কস্ট্রীটের অ্যান্টিক স্টোর থেকে। শেষ বয়সের দীর্ঘ মানসিক অসুস্থতায় প্রায় সবই বিস্মৃত হলেও, রবীন্দ্রনাথের কবিতা ভোলেননি তিনি।

ইচ্ছে হয়, একদিন ওই পুরনো বাড়ির ঘাটে গিয়ে বসি। সন্ধ্যার অন্ধকারে হয়তো দেখবো ধবধবে ফর্সা এক বৃদ্ধা উঠে আসছেন নদীর গভীর থেকে। দূর থেকে তখন ভেসে আসছে দেবী পূজার মন্ত্র, ঢাকের আওয়াজ। বাতাসে কি অদ্ভুত এক সুগন্ধ। ধীরে ধীরে বৃদ্ধা এসে বসবেন আমার পাশে। বিড়বিড় করে কি যেন আওড়াচ্ছেন তিনি। ক্রমশ তার নিকটতর হই, বৃদ্ধা মন্ত্রের মতো পাঠ করছেন:
জীবনে যত পূজা হলো না সারা,
জানি হে জানি তাও হয়নি হারা।

আমি চমকে উঠে জিজ্ঞেস করি, আপনি কে?
সন্ধ্যার অন্ধকারে স্পষ্ট দেখি তার মুখ। হেসে বলেন, আমি পারুলবালা। তোর মেয়ে কই? নিয়ে আয় না। একবার দেখি আমার পুতিটাকে।