ফরিদ কবির এবং কতিপয় প্রথমের গল্প

আবু হাসান শাহরিয়ার

প্রকাশিত : জানুয়ারি ১৫, ২০১৯

সাল ১৯৯১। জুনের একুশ। আমি ও ফরিদ কবির একই পত্রিকায় (আজকের কাগজ) একই কক্ষে পাশাপাশি টেবিলে বসে দাপ্তরিক কাজে ব্যস্ত। ঠিক চার মাস আগে সম্পাদকসহ একঝাঁক তরুণ সাংবাদকর্মী নিয়ে নতুন সংবাদপত্রটির জন্ম (২১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৯১)। জন্মরাতে ফরিদ ও আমি উত্তেজনাকর কর্মব্যস্ততার কারণে নৈশ-আহারের কথা ভুলে গিয়েছিলাম এবং কোনও হোটেল খোলা না পেয়ে মধ্যরাতে ফুটপাত থেকে কেনা ভুট্টাপোড়া চিবুতে চিবুতে শহিদ মিনারে গিয়েছিলাম। তো, `আজকের কাগজ`-এর সেই শুরুর দিনগুলোয় আমাদের কান ছিল সংবাদসজাগ। যে-কোনও খবর অন্য সব সংবাদপত্রের সংবাদকর্মীর আগে পাওয়া চাই। ২১ জুন সকালে একটি দুঃসংবাদ অতর্কিত বর্শার মতো বিদ্ধ হল ফরিদ কবির ও আমার কানে। কী? কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ আর নেই। সংবাদপত্রে কাজ করলেও দুজনেই আমরা কবিতা লিখি এবং রুদ্র আমাদের দুজনেরই বন্ধু। খবরটা পেয়ে আমরা দুজনেই কিছুক্ষণের জন্য বাকরুদ্ধ। আমাদের তখন বন্ধুত্বের ডালপালা বিস্তারের সময়। তাই, রুদ্রর অকালপ্রয়াণ কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলাম না। না পারলেও মৃত্যু নামক ব্যাপারটিতে প্রকৃতি সবসময়ই বড়ো নির্মম। যে-অনুজ সহকর্মীর কাছ থেকে আমরা সেদিন রুদ্রর মৃত্যসংবাদ পেয়েছিলাম, কয়েকবছর যেতে না যেতে সুরের কোকিল সেই সঞ্জীব চৌধুরীও অকালে চলে গেলেন বন্ধু-স্বজনদের ছেড়ে। তো, প্রয়াত রুদ্রর বাড়িতে ছুটে গিয়ে অনেক কবিবন্ধুর দেখা মিলল। তাদের ভিড়ে দরজার পাশে তসলিমা নাসরিনকেও নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম। রুদ্র ও তসলিমার তখন ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে (সাবেক স্বামীর মৃত্যুর পর মর্মস্পর্শী একটি স্মৃতিগদ্য লিখেছিলেন নাসরিন, যেখানে রুদ্রর মৃত্যদিন সম্পর্কে খুবই সুন্দর একটি পর্যবেক্ষণ ছিল— রুদ্রর মরদেহকে সবাই `লাশ` বলছিল, যা নাসরিন কিছুতেই মানতে পারছিলেন না)।

কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ চলে গেছেন দেড় যুগ অতিক্রান্ত হয়েছেন। ফিরে এসে ফিরে গেছে আঠারোটি বসন্ত। সব বসন্তেই অনেক ফুল ফুটেছে গাছে গাছে। আবার, ঝরেও গেছে প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে। এই দেড় যুগে তারুণ্যের বেশ কজন কবিবন্ধুকে হারিয়েছি। তাদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ তিনজন— আবিদ আজাদ, ত্রিদিব দস্তিদার ও নাসিমা সুলতানা। এদের সঙ্গে আমার নিবিড় পারিবারিক বন্ধুত্ব ছিল, যেমন ফরিদ কবিরের সঙ্গে এখনও। ফরিদের সঙ্গে আমার কবে-কোথায় প্রথম দেখা হয়েছিল, তা মনে না থাকলেও আমাদের তারুণ্যের প্রধান তিন আড্ডাস্থলে তাকে নিয়মিত পেয়েছি— অধুনালুপ্ত `দৈনিক বাংলা` পত্রিকার ডিআইটি এভিনিউস্থ ভবন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিলগ্ন শরিফের ক্যান্টিন ও শাহবাগ। `দৈনিক বাংলা`র সাহিত্য সম্পাদক কবি আহসান হাবীবের কক্ষটি তখন দেশের তরুণ কবি-লেখকদের অন্যতম তীর্থস্থান। অপ্রস্তুত কর্মবীররা সেখানে ভিড়তে পারত না। আমরা অবাক হয়ে দেখতাম, দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় কবি এবং পত্রিকাটির সম্পাদক শামসুর রাহমানও, হাবীব ভাইকে কবিতা দিতে হলে, দোতলা থেকে সিঁড়ি ভেঙে চারতলার ছোট্ট খুপড়ি ঘরটিতে উঠে আসতেন। আগেই বলেছি, আমাদের তখন বন্ধুত্বের ডালপালা বিস্তারের সময়। খ্যাতিমান কতজনের সঙ্গে যে পরিচয় হয়েছে সেই ঘরে, তার গাছপাথর নেই। সাহিত্যের স্বর্ণযুগ ছিল তখন। এখনকার মতো প্রশংসাকৃপণ ছিলেন না তখনকার কবি-লেখকরা। `নগরে বাউল`খ্যাত অরুণাভ সরকার তো ভালো লাগলে টেলিফোনে তাৎক্ষণিক পাঠ-প্রতিক্রিয়া জানাতেন। মনে রাখতে হবে, তখন ছিল ল্যান্ড ফোনের যুগ এবং সবার বাড়িতে ফোন ছিল না। তাতে কী, পরিচিতদের কারও মারফত হলেও ভালোলাগার বার্তাটি পৌঁছে দিতেন তিনি। আর, মফস্বলের প্রতিভাবান কবি-লেখকরা পেতেন হাবীব ভাইয়ের স্বাক্ষরযুক্ত পোস্টকার্ডে লেখা চিঠি। তাতে লেখা ছাপা হওয়া না-হওয়া বিষয়ক কথা থাকত।

তো, যা বলতে এই লেখা। তারুণ্যের প্রধান তিন সারস্বত আড্ডাস্থলেই ফরিদ কবিরকে একান্তভাবে পেয়েছি আমি। এছাড়াও আমরা পরস্পরের বাসায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা আড্ডা দিয়েছি ঘড়ির দিকে একবারও না তাকিয়ে। আড্ডার সবার পকেট সিগারেটশূন্য হয়ে গেলেও ফরিদের দিকে হাত বাড়ালে যে সেই হাত খালি-খালি ফিরবে না, বিষয়টি আমার তখন থেকেই জানা। মানিব্যাগ কপর্দকশূন্য হলেও ফরিদের সিগারেটের প্যাকেট কখনও শূন্য যেত না আর্থিক টানাটানিতেও। লেখালেখিসূত্রে পরিচয় হলেও জুতোসেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ সবই গুরুত্ব পেত আমাদের আড্ডায়। ফরিদ বরাবরই খুব বন্ধুবৎসল। মুখে সবসময়ই মিষ্টি হাসি লেগে থাকে। অপছন্দের মানুষের মুখোমুখি হলেও সেই হাসিতে ছেদ পড়ে না। পরন্তু, কবি হিসেবে যে-গুণটি তিনি টানা চার দশক ধরে আগলে রেখেছেন, সেটি হলো, নতুন কবিতা ও নবীন কবিদের প্রতি অদম্য আগ্রহ। আর, যে-গুণটির কথা না বললেই নয়, তিনি সহজেই সত্য বলতে পারেন। যারা ফরিদ কবিরের আত্মজৈবনিক বই `আমার গল্প` পড়েছেন, ধারণা করি, এ ব্যাপারে তারা আমার সঙ্গে দ্বিমত করবেন না। এই গুণ আমাদের অধিকাংশ কবি-লেখকেরই নেই। দলকানা বা দলদাস কবি-লেখকদের তো একেবারেই নেই। কলম ধরলে তারা স্বদলের কারও কোনও ত্রুটিই খুঁজে পান না। এক্ষেত্রে ফরিদ কবির সেই বিরলপ্রজদের একজন, যাদের সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ তার `সত্য` শিরোনামের গদ্যে বলেছেন— ‘যাহারা সহজেই সত্য বলিতে পারে তাহাদের সে কী অসাধারণ ক্ষমতা! যাহারা হিসাব করিয়া পরম পারিপাট্যের সহিত সত্য রচনা করিতে থাকে, সত্য তাহাদের মুখে বাঁধিয়া যায়, তাহারা ভরসা করিয়া পরিপূর্ণ সত্য বলিতে পারে না।’

আমার প্রথম শান্তিনিকেতন দর্শনে ফরিদ কবিরও সঙ্গে ছিলেন। নন্দলাল বসুর কালোবাড়ি আর রামকিংকর বেইজের ভাস্কর্যগুচ্ছ প্রথমদর্শনও একই দিন একই সময়। এক বন্ধুর কাঁধে তখন আরেক বন্ধুর হাত। রবীন্দ্রোত্তর পঞ্চ পাণ্ডবের এক পাণ্ডব অমিয় চক্রবর্তী ও রবীন্দ্র-জীবনীকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ে সঙ্গেও দেখা হয়েছিল সেই মহার্ঘ তীর্থকালে। চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়কেও ফরিদ কবির ও আমি প্রথম দেখি একসঙ্গে। অমিয় চক্রবর্তীর সমসাময়িক আরেক কবি প্রেমেন্দ্র মিত্রের সঙ্গে একসঙ্গে এক মঞ্চে কবিতাও পড়ি প্রথম ও একবারই। ওই মঞ্চে শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ও শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের মতো কীর্তিমান কবিরাও ছিলেন। ফরিদ কবির ও আমার একসঙ্গে আরও অনেক প্রথম আছে। উপরে অল্প কয়েকটির নমুনা দিলাম।

তবে, বিশেষ একটি প্রথমের কথা না বললে এ লেখা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে— ফরিদ কবির ও আমার পৃথিবীদর্শনও একই খ্রিস্টীয় বর্ষে— ১৯৫৯, ফরিদ জানুয়ারিতে, আমি জুনে এসেছি এই সবুজ গ্রহে। বছরের শুরুতেই ফরিদের জন্মদিন হওয়ায় দুবন্ধুর আয়ুর সলতে কমে আসার খবরটা ওর জন্মদিনেই আমার জানা হয়ে যায়। ২০১৯-এ আমার বন্ধুটির ষাটপূর্তি। কিন্তু, আমার কাছে কবি ফরিদ কবির চিরকালের একুশ-বাইশ বছরের তরুণ। জন্মেছেনও জানুয়ারির বাইশে।