বইমেলায় ‘লেখক বলছি’ মঞ্চ থেকে

পাপিয়া জেরীন

প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ১৮, ২০১৯

বাংলা একাডেমির বইমেলায় ‘লেখক বলছি অনুষ্ঠানে আসছিলাম। সেইখানে দর্শকদের দিক থেকে মাত্র দুইজন আমারে প্রশ্ন করে। তারা একজন হইলো মীর রবি, আরেকজন হইলো আচার্য মিলন। একজনের প্রশ্নের উত্তর দেয়ার পর প্রায় একই প্রশ্ন করে আরেকজন। মীর রবি বলছিল, আপনার কবিতা যৌনতায় ভরা, আপনে কি সারাদিন যৌনতা নিয়াই থাকেন?

আমি তারে জিগাইলাম, আপনে কি আমার সব কবিতা পড়ছেন? ঠিক কোন্ কবিতায় যৌনতা পাইছেন, অন্তত একটা উদাহরণ দেন। সে বলছে, তার এখন কবিতা মনে নাই, তবে মনে পড়তেছে সব কবিতায় যৌনতা আছে। আচার্য মিলনও বলল, আপনার আঁকায় ও লেখায় সবকিছুতেই যৌনতা, এইটা কেন?

আমি আগেও জানি, সারাজীবনই জানবো যে পাঠক কোনোদিনই বোঝে না লেখকরে। তাই বললাম, বইমেলার পিছনের লেকের উপর যে খাম্বাটা সেইটার মতোই হইলো লেখালেখি। কেউ এইটারে বলবে ভাস্কর্য আর কেউ এইটারে বলবে খাম্বা। যেহেতু লেখক ও পাঠক দুইজন আলাদা সত্তা, এদের দৃষ্টিভঙ্গিও হবে ভিন্ন। পাঠক আর লেখকের দূরত্ব তাই আর ঘুচবে না।

মীর রবির প্রশ্নটা আবার দেখেন, আপনে কি সারাদিন যৌনতা নিয়া থাকেন? এগুলা যে আপনার লেখায় আসে! আমার বক্তব্য একটাই ছিল, ভাই, আমি তো শরীররে অতিক্রম করতে পারি না। আপনারা হয়তো পারছেন। আমি আসলে এমনি। এখন কথা হইলো, লেখক যা অনুভব করবে সেইটাই তো কলমে আসবে। পাঠক কি টপিক ঠিক কইরা দেবে আমারে?

এখন আমি আসি, আমার কবিতার বই ‘ঊনসপ্ততি’র কবিতাগুলি নিয়া, যেইটাতে বলতেছে ওরা যৌনতায় মাখামাখি, রসালো। প্রথম কবিতা বিহাইন্ড দ্য সিন—

শৌর্যের আগুন নিয়ে সংশপ্তক ভাড়া খাটে বিছানায়,
আর ভোরের বাতাসে কোনো এক বেশ্যার বিভক্ত পায়ে ঝরে অর্ঘ্যের কাঠগোলাপ।

এইখানে যৌনতা কোথায়? সংশপ্তকের তো ভাড়া খাটার কথা না, বেশ্যার পায়েও তো কারো পূজার ফুল দেয়ার কথা না... কিন্তু বর্তমান সময়ে এমনটাই চলতেছে। এইটাই চলতেছে এখন ঘটনার অন্তরালে। এইখানে ধ্বজভঙ্গ পাঠক সুড়সুড়ি কেমনে পায়?

এরপরের কবিতা—
এই জ্বর ঘোরলাগা রাতে তোমার শরীরে গজাই কয়েকশো একর কাগজিলেবু বন,
দুধে ভেজা রুটির মতন শুষে নিতে থাকি অধরান্ত জিভ।

এইটা একটা জ্বরপ্রলাপ। এইখানে প্রেমিকের জিভ দুধে ভিজা পাউরুটির মতো স্বাদযুক্ত মনে হইলে— পাঠক এইটারে কেমনে নিবে? যৌনতা? যৌনতা! হাহা!

এরপরের কবিতায়—
আমার আঁধারে লুকায়ে তোমার আঁধার
চুম্বনে চুম্বনে শ্যাম— ঠোঁটের পীযূষ নিও!

হ্যালো পাঠক, যৌনতায় রসে ডুবে গেলেন? এরপরের কবিতা—

সুরম্য ধ্বংসস্তূপ, এইখানে খোলো বুকের ভাঁজ
দেখি, দেখি তোমার শিলালিপি! দেখি আলজিভ দেখি!

ইহা পইড়াই পাঠকদিগের যৌনতায় ভরা কলস দৃষ্টিগোচর হইলো? এরপর আসেন স্বপ্নাদ্য কবিতায়—

তাকে তাকে জলপাইয়ের আঁচার
ক্যাবিনেটে হরিণরঙা মদ,
হাত রাখো এইখানে তুমি শ্যাম!
এইখানে বরফ ঢাকা রাত;

হে পাঠক, কী অনুভূতি হয়? যৌনতার? এইরকম ৬৯টা কবিতা আছে আমার বইয়ে। সবগুলাই এইরকম। এগুলা কোনোটাই ইরোটিক না, সত্য বলতে। কেউ যদি `আশ্লেষ` শব্দটা আর এর অনুভূতির সাথে পরিচিত না হয়ে থাকেন, সে দায় আমার না। আর এই দেশে মীর রবির মতো পাঠক আছে সহস্রাধিক, যারা আমার কবিতায় `শীৎকার` শব্দটা দেইখা ভাববে, পাপিয়া জেরীন শীৎকার দিতে দিতে কবিতাটা লেখছে।

আচার্য মিলনের মতো লোকও আছে, যারা একটা নারীর আঁকা ছবিতে স্তনটারেই উইয়ার্ড মনে করবে। যুগল ছবিরেও বলবে যৌনগন্ধময়।

ভালো কথা, এইসব আমার এই দুই পাঠক (যেহেতু তারা বলছে তারা আমারে পাঠ করে) কেন জিজ্ঞেস করলো? আমি মেয়েমানুষ এইজন্য? এইজন্যই যে, মেয়ে হইয়া এইসব লেখবো কেন? ওরা দুজন কি আমারে এইরকম কিছু বইলা গেলো, আপনি মেয়ে মানুষ, যৌনতা নিয়া মৌনতা অবলম্বন করুন।

বাহ্! ওহে ধ্বজভঙ্গ পাঠক, আমার কবিতায় স্থুল যৌনতা নাই। আর যদি আসেও, সেইটা আসবে। আপনাদের দৌর্বল্যের কথা বিবেচনা কইরা আমি কবিতায় আশ্লেষ কমাবো না। আপনারা এদিকে আইসেন না।