বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের দেবী চৌধুরাণী

মোহাম্মদ খালিদ সাইফুল্লাহ ফয়সল

প্রকাশিত : জুলাই ২১, ২০১৮

দেবী চৌধুরাণী প্রকাশের সময় বঙ্কিমচন্দ্র নিজে জানিয়েছিলেন, “ঐতিহাসিক উপন্যাস রচনা আমার উদ্দেশ্য ছিল না, সুতরাং ঐতিহাসিকতার ভান করি নাই... দেবী চৌধুরাণীরও ঐরূপ (অর্থাৎ আনন্দমঠের মতো) তবে, এখানে একটু ঐতিহাসিক মূল আছে। দেবী চৌধুরাণী গ্রন্থের সঙ্গে ঐতিহাসিক দেবী চৌধুরাণীর সম্বন্ধ বড় অল্প। দেবী চৌধুরাণী, ভবানী পাঠক, গুড্ল্যাড় সাহেব, লেফটেন্যান্ট বেনান এই নামগুলি ঐতিহাসিক। দেবী চৌধুরাণীকে ঐতিহাসিক উপন্যাস বিবেচনা না করিলে বড় বাধিত হইব।” এবং এ কথা সত্য।

জমিদার হরবল্লভের পুত্রবধু প্রফুল্ল। বিয়ের সময় প্রফুল্লকে প্রতিবেশীরা জাতিভ্রষ্টা হিসেবে ঘোষণা করেন। ফলাফল, হরভল্লব বাবু পুত্রবধুকে ঘরে তুলতে অস্বীকৃত জানান। বিয়ের দিন মেয়েরা শ্বশুরালয়ে যায়; প্রফুল্লর দূর্ভাগ্য, তাকে চলে আসতে হল পিত্রালয়ে। প্রফুল্লরা অত্যন্ত গরীব, যতটুকু গরীব হলে দুইবেলা খাবার জোটে না ততটুকু গরিব। খাবারের যন্ত্রণায় প্রফুল্লর মা প্রফুল্লকে শ্বশুরবাড়িতে পাঠিয়ে দিতে চান। জমিদার বাড়ির বউয়ের এমন কষ্ট মায়ের সহ্য হয় না। কিন্তু যাকে একবার হরভল্লব বাবু বাড়িছাড়া করেছেন তাকে আবার ঘরে তুলতে যাবেন কেন?

ভবানী পাঠক ১৭৮৭ সনের জুলাই মাসে ইংরেজ সিপাইদের সঙ্গে যুদ্ধে মারা যায়, স্ব-ইচ্ছায় ধরা দিয়ে দ্বীপান্তরে যাওয়ার পর। মূলত ওয়ারেন হেষ্টিংস পদত্যাগ করার কয়েক বৎসর পর ঐসব ডাকাতদের দমন করা হয় এবং ‘দেবী’ অদৃশ্য হন! দেবী চৌধুরাণী নিজ দল ভেঙে কয়েক বৎসর আগে গুডল্যাড় রঙ্গপুর ছাড়েন, কিন্তু যে চিত্রপটের সামনে এই গ্রন্থের ঘটনাবলি অভিনীত হয়েছে, অর্থাৎ এর সামাজিক আবহাওয়া একেবারে সত্য।

খাঁটি বাঙালিরাও ডাকাতি করত, চলনবিলের ধারে একটি গ্রামের এক বিখ্যাত বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ-বংশের পুরুষের নৌকাযোগে ডাকাতি করতে করতে নিজের নতুন জামাইকে হত্যা করেন এবং সেটার অনুতাপে ঐ পাপ-ব্যবসা ছেড়ে দেন, তা রাজশাহী-পাবনা জেলায় লোক-প্রসিদ্ধ!

শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে সবার হাতেপায়ে ধরেও জায়গা হয় না প্রফুল্লর। এদিকে স্বামী ব্রজমোহন, যে প্রথমবার তাকে দেখেছে, অসাধারণ রূপে মুগ্ধ হয়ে প্রেমে পড়ে যায় প্রফুল্লর। ইতোমধ্যে প্রফুল্লর মা মারা যান, প্রফুল্ল হয়ে পড়ে সম্পূর্ণ একা। এরপর অনেক ঘটনার মধ্য দিয়ে প্রফুল্ল এক ডাকাত সর্দারের হাতে গিয়ে পড়ে। ততদিনে প্রফুল্ল অফুরন্ত ধন-রত্নের মালিক। ডাকাত সর্দার প্রফুল্লর মাঝে দেবীত্ব দেখতে পান। দীর্ঘ দশ বছর দীক্ষার ফলে প্রফুল্লকে তিনি তৈরী করেন অসাধারণ এক নেত্রী হিসেবে, নাম- দেবী চৌধুরানী।

…এভাবেই এগিয়ে চলেছে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের অনন্যসাধারণ উপন্যাস দেবী চৌধুরানীর কাহিনি। বঙ্কিমচন্দ্রের লেখা অনেকের কাছে কঠিন মনে হয়, কিন্তু একবার লেখার ভেতর ঢুকে যেতে পারলে শেষ না করে উঠে যাওয়া সম্ভবপর হয় না!

নিজের পাঠ প্রতিক্রিয়ায় বলতে গেলে খুব কম বলতে পারবো। পুরো উপন্যাস জুড়ে বঙ্কিম সূচারুরূপে প্রতিটি চরিত্রকে ফুটিয়ে তুলেছেন। নামের সাথে ‘দেবী চৌধুরাণী’র চরিত্র অমায়িকভাবে একেঁছেন, পাঠক হৃদয়ে এক অভাবনীয় টান কাজ করে যায় ‘দেবী’র জন্য।

একুশে বইমেলা ২০১৮