বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানসম্মততা: বর্ণমালা ও বানানে

পর্ব ১

চৈতন্য চন্দ্র দাস

প্রকাশিত : জানুয়ারি ২০, ২০১৮

মানুষ সহজাতভাবে মাতৃপ্রেমী হলেও কোনো এক অজ্ঞাত কারণে ‘মাতৃভাষীমাত্রই মাতৃভাষাপ্রেমী নয়’। এর কারণ বহুমাত্রিক। এসব কারণের কারণ খুঁজতে না গিয়ে বরঞ্চ ভালোবাসার প্রক্রিয়া অবলম্বন করে এ সমস্যার অনেকখানি সমাধান করা সম্ভব। পৃথিবীতে একটি মাত্র জায়গায় শামিল হওয়ার জন্যে কোনো প্রকারের প্রাক-যোগ্যতার প্রয়োজন পড়ে না। জায়গাটি হলো প্রেমের জায়গা। খাস দিলে ভালোবাসতে চাওয়াটাই এখানে আসল ব্যাপার। এতে করে ভালোবাসার নয় শুধু, ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্যতাও স্বয়ংক্রিয়ভাবে অর্জিত হয়ে যায়। এভাবেই কেবল একজন খাঁটি মাতৃভাষাপ্রেমী হয়ে ওঠা সম্ভব। অন্যতর উপায়ে নয়।
ভাষাতত্ত্বের সাপেক্ষ বিচারে, ভাষিক ভূগোলে একমাত্র মানুষেরই অধিকার রক্ষিত। কারণ ১,৮৪,০০০ মখলুকাতের মধ্যে একমাত্র মানুষেরই সংস্কৃতি রয়েছে, অন্যদের তা নেই। সঙ্গত কারণেই আমাদের ভাষা রয়েছে এবং অন্যদের তা নেই। অথচ, একমাত্র বিবেকবোধ সম্পন্ন প্রাণী হিসেবে মানুষ যেমন তার বিবেককে যথাযথভাবে ব্যবহার করে না; ঠিক তেমন করে, কোনো মানুষই তার মাতৃভাষাকেও শুদ্ধ করে ব্যবহার করে না।
একটি উদাহরণ তুলে ধরা যাক। সম্প্রতি, বিয়ের অব্যবহিত পরপরই ব্রিটিশ রাজবধূ কেট মিড্ল্টন্- এর একটি চিঠি পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। চিঠিটি ছিল ইংরেজিতে লেখা এবং তাতে বেশ কয়েকটি (সংখ্যা স্মরণে আনতে ব্যর্থ হচ্ছি বলে দুঃখিত) অধিক প্রচলিত ইংরেজি বানান অশুদ্ধ ছিল। যে ইংরেজ সারা পৃথিবীকে ইংরেজি শিখিয়েছে, সেই তাদের রাজবধূ যদি ইংরেজি বানান ভুল করেন, তবে আমরা কোন ছার! একে যুক্তি হিসেবে দাঁড় করিয়ে মাতৃভাষা শিখনে আমরা অনাগ্রহী হয়ে উঠি, এমনটি মোটেই অভিপ্রেত নয়। লন্ডনের রাজপথে বহুসংখ্যক সাইনবোর্ডের বানান, অবশ্যই ইংরেজি বানান, ভুল থাকায় আমরাও যেন নিজেদের বানান ভুলের মহড়াকে বৈধতা দান করবার চেষ্টা না করি। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, তাদের মধ্যে অল্প সংখ্যক লোক ইংরেজি বানান ভুল করেন। আর আমরা অত্যল্প সংখ্যক লোক বাংলা বানান শুদ্ধ করে লিখি। দুঃখটা হলো তার চাইতেও কম সংখ্যক লোক ইংরেজি বানান ভুল করি।
সুস্থতা সকলেরই কাম্য বিষয়। শরীরকে অসুস্থ রেখে যেমন মনকে সুস্থ রাখা যায় না। তেমনিভাবে মনকে অসুস্থ রেখেও শরীরকে সুস্থ রাখা যায় না। ভাষাপ্রেমীরা ভাষাকে সর্বদাই সুস্থ রাখতে চান। ‘শব্দ’ হলো ভাষার প্রথম কার্যকরী উপাদান। একটি শব্দের শরীর হলো তার ‘বানান’। অন্যপক্ষে, ‘উচ্চারণ’ হলো শব্দের প্রাণ-বিশেষ। বানানে-উচ্চারণে যাথার্থ্য বজায় রাখতে পারলেই কেবল শব্দ তথা ভাষা সুস্থ থাকতে পারে, অন্যথায় নয়। বলে রাখা ভালো, আমরা এখানে ভাষা বলতে প্রমিত বাংলা ভাষার কথ্য এবং লেখ্য উভয় রূপকেই বোঝানোর চেষ্টা করছি।
পূর্বাপর মিলিয়ে নিয়ে অন্যতরভাবে প্রসঙ্গটি হলো, আঞ্চলিক ভাষা বা উপভাষার ক্ষেত্রেও শুদ্ধতা বজায় রাখা জরুরি। অবশ্য শুদ্ধতা শব্দটি  ব্যবহার না করে এখানে যথার্থতা, স্বাভাবিকত্ব কিংবা পরিবর্তনহীনতা ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার করাই ভালো। আর, আঞ্চলিক ভাষা বলতে আমরা উপভাষা, সমাজভাষা কিংবা নিভাষা ইত্যকার সকল অভিধাকে নির্দেশ করছি। শহুরে ঠাঁট কিংবা আভিজাত্যের ইঙ্গিতময়তার প্রকাশ ঘটাতে গ্রামের বাড়ি ফিরে চায়ের দোকানে, বাজারে কিংবা প্রতিবেশীর ও পরিপার্শ্বিনীর মনোযোগ আকর্ষণের নিমিত্তে আমরা প্রায়শই এমনটি করে থাকি। এ সমস্তের তাৎক্ষণিক ব্যবহৃত এ ভাষা তখন হয়ে ওঠে ‘নপুংসক’ ভাষা। না তাতে থাকে ‘প্রমিতি’, না থাকে ‘ঔপভাষিক যাথার্থ্য’। এদের স্বভাব তখন কৃত্রিমতার গণ্ডী পেরিয়ে ভণ্ডামিতে রূপপরিগ্রহ করে। এ যেন ‘গাধা আর ঘোড়ার মিশেলের উৎপাদ’ বই অন্য কিছু নয়।
তোতাপাখির মতো করে শুনে আমরা জানি যে, ভাষা নদীর মতো প্রবহমান। একে এর স্বভাব মতো চলতে দেয়াই শ্রেয়। কোনো কিছু চাপিয়ে দিয়ে কিংবা কাটছাঁট করে একে পরিশীলিত করা যায় না। কথাটি সর্বৈব না হলেও সত্য। তথাপি, আরও কথা থাকে। কেবল ভাষা কথনের বা লিখনের ক্ষেত্রেই নয়, পরিবার-সমাজ-রাষ্ট্র সকল ক্ষেত্রেই প্রাতিষ্ঠানিকতার একটি বিষয় রয়ে যায়। সে কারণেই বলায় এবং লেখায় একটি প্রভেদ লক্ষ্যযোগ্য হয়ে ওঠে। লেখবার ক্ষেত্রে প্রায় সর্বত্র ভাষিক শুদ্ধতা দেখতে পাওয়া যায় (সাধুরীতি, চলিত রীতি বা প্রমিত রীতিসহ সকল ক্ষেত্রেই)। কিন্তু বলবার ক্ষেত্রে এর রকমভেদ ঘটে। ঘরের মানুষ, মা-বাবা-ভাই-বোন-বন্ধু-বান্ধব, নানা-নানি, দাদা-দাদি, বয়স্ক-নিরক্ষর ব্যক্তি, ইত্যকার কাছের মানুষের সাথে কথা বলবার সময়ে আমরা খাঁটি আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহার করি। এবং উচিতও তা-ই। অথচ আনুষ্ঠানিক কথনে ব্যবহার করি প্রমিত রীতি। এ ক্ষেত্রে একটি কথা মনে রাখলে ভালো হয় । আমাদের ভাষা কথনে-লিখনে কিছুটা স্বস্তিও এতে করে আসবে। কথাটা হলো, পৃথিবীর তাবৎ ভাষা ব্যবহারকারীদের কেউ-ই, তা তিনি যত বড় পণ্ডিত-গবেষকই হোন না কেন, চব্বিশ ঘণ্টা শতভাগ শুদ্ধ করে কোনো ভাষা লিখতে বা পড়তে এবং বলতে পারেন না। এমনকি মাতৃভাষাও না।
এ ক্ষেত্রে আমাদের পক্ষে যা করা বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক হবে, তা হলো, যতটা সম্ভব ভাষা লিখনে-পঠনে-কথনে শুদ্ধতার শতকরা হার বাড়িয়ে নেয়ার চেষ্টা করা। একটি প্রসঙ্গের উল্লেখ করতেই হচ্ছে। শিক্ষকতার বয়স প্রায় পনেরো বছর। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ছাত্র বলেই হয়তো বা ঘটনাটিতে আমার মন খারাপ হয়েছে পরম মাত্রায়। অবশ্য এতে করে ভাষার ক্ষতি হয়েছে বলেও আমি মনে করি না। মি.সুমিত (প্রতীকী নাম) একজন কলেজ শিক্ষক। একদিন কয়েকজন সহকর্মীর সামনে বলেই ফেললেন যে, বাংলা, ও-তা আবার শিহা লাগে নাহি?
হয়তো সম্মানীয় সহকর্মী তেমন একটা না ভেবেই কথাটি বলেছেন। এতে করে তার খুব একটা যে লাভ হয়েছে তা কিন্তু নয়। বাংলা ভাষারও তাতে কোনো ক্ষতি হয়ে যায়নি। লাভ হয়েছে আমাদের, যারা ভাষাকে সত্যি সত্যিই ভালোবাসবার চেষ্টা করি। এ বিষয়টিকে কেন্দ্র করে, সে কারণেই, নিজের ভেতরকার ভাষাপ্রীতিকে পুনর্বার জাগিয়ে তোলবার প্রয়াস পাচ্ছি। আমার সে তাৎক্ষণিক দুঃখবোধ দীর্ঘকালীন আনন্দে রূপপরিগ্রহ করেছে।
আরও একটি কথা প্রায়শই কানে খট করে আলপিনের মতো এসে বিঁধে। কথাটি হলো, নামে কোনো ভুল নেই। কথাটি সত্য না মিথ্যা তা প্রমাণ হবে বক্তা যদি স্বাক্ষর হন এবং তার নামটি চরম অশুদ্ধভাবে লিখে যদি তারই সামনে হাজির করা যায়। ধরা যাক, এমন একজন গুণিনের নাম শংকর চন্দ্র দাশ (অভিষেক) কিংবা সৈয়দ জব্বার খান (রাসেল)। এ হেন মহামহোপাধ্যায়ের নাম যদি ‘সংকর চন্দ দাষ (অবীশেক)’ কিংবা ‘শৈঅদ যববার ক্ষান (রাষেল)’ লিখে তাদের সামনে উপস্থাপন করা হয় তবেই তাদের মনোভাব বুঝতে পারা সহজতর হবে। এ ক্ষেত্রে বিষয়টি এমনভাবে মিলিয়ে নেয়া যায়, অনেক তথাকথিত প্রগতিশীল ব্যক্তি পোশাকে-আশাকে স্বাধীনতা প্রদান প্রসঙ্গে নারীদেহের অযথা প্রদর্শনীকে মোটেই অপ্রয়োজনীয় বা অশোভন মনে করেন না, তারা এরকম নগ্নতা বেশ ভালোভাবেই উপভোগ করেন। তবে ভেতরের কথাটি হলো এই যে, নিজের স্ত্রী-কন্যা এবং বোন ছাড়া জগতের আর সকল নারী নগ্ন হলেও কোনো সমস্যা তারা দেখেন না। বাংলা ভাষায় অন্য কেউ বানান ভুল করলে সমস্যা না থাকলেও নিজের নামের বানান অন্যে ভুল করলে এক্ষেত্রে সেই ভাষা অ-প্রেমীর মনোভাব উপরিউক্ত গুণিনের তথাকথিত প্রগতিশীলতার মতোই।
যে কথাটি সরাসরি কিংবা ইশারায় বারবার বলতে ইচ্ছে করছে সেটি হলো, মাতৃভাষার শুদ্ধতা বজায় রাখা আমাদের জনন-কর্তব্য। মাতৃভাষাকে অবহেলা করা মানে নিজের মা-কেই অবহেলা করা। মাতৃভাষার প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শনের মানে নিজের মায়ের দুধের ঋণকে অস্বীকার করা। আর এ কাজটি যে সমস্ত শিক্ষিত (আসলে শিক্ষিতরা তো তা করেন না, করেন সনদপ্রাপ্ত অধিকাংশ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণকারী) লোক অবলীলায় করে থাকেন। এবং এটা করাকে মোটেই অসুন্দর মনে করেন না। তাদেরকে কবি আব্দুল হাকিম ‘জারজ’ বলেছেন অনেক আগেই। আমিও এ মহাকবির সাথে ঐক্যমত পোষণ করে এদেরকে সংশ্লিষ্ট ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর মধ্যকার ‘নিকৃষ্ট কীট’ বলে মনে করি।

অনেকেই বলে থাকেন, যে ভাষায় কথা বলি সে ভাষাতেই লিখতে ক্ষতি কী? না, এতে ক্ষতির কিছুই নেই বোধ হয়। তবে, যা আছে তা হলো অসম্ভবতা। বলায়-লেখায় মিল রেখে চলা স্বাভাবিকভাবে প্রায় অসম্ভব। ঘরে-মেসে-হোস্টেলে-হলে-আড্ডার সময় একবার নিজেদের পোশাক-আশাকের পরিচয়টি সৎভাবে মনে করবার চেষ্টা করুন। দেখবেন খালি গা, হাঁটুর ওপরে লুঙি বিশেষ ভঙ্গিতে, কারো বা থাকে নেংটির মতো, ছেঁড়াফাটাও থাকে অনেক সময়; চুলের পারিপাট্য নেই, অস্বাভাবিক ভঙ্গিতে বসা-বলা এবং আচরণ প্রকাশ করা। আর মেয়েদের পরনে ওড়ানাহীন শেমিজ, টেপজাতীয় জামা, নেই অন্তর্বাস। চুল ও মুখমণ্ডল অকৃত্রিম, মানে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সুন্দরতারহিত। নিম্নাংশে প্রায়শই থাকে শর্ট্স্, মেয়াদোত্তীর্ণ সালোয়ার কিংবা বিবর্ণ পেটিকোট।  বিবাহিতদের ক্ষেত্রে অনেক সময় সর্বাঙ্গ জুড়ে থাকে কেবলই একটি ম্যাক্সি। কিন্তু এ সমস্ত ছেলেমেয়ে যখন কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়মুখী হয় কিংবা ক্লাসে অথবা অফিসে অবস্থান করে নতুবা অভিভাবকের সাথে সাক্ষাতের জন্যে গেস্টরুমে যায় তখন কি উল্লিখিত প্রকারের বেশেই তারা সেখানে উপস্থিত হয়? নাকি সম্ভব? প্রতিটি দম্পতি কি জীবনসঙ্গীকে নিজের জীবনের সবটুকু সত্য বলে? একটু ভেবে দেখুন তো, নিজের জীবনে (যতদূর পর্যন্ত মনে করা যায় ততটুকু হলেও যথেষ্ট হবে) এ পর্যন্ত যা যা চিন্তা করেছেন, কারো সম্পর্কে যা যা ভেবেছেন, যা যা করতে বা পেতে চেয়েছেন তার সবটুকু কি সৎভাবে লিখে প্রকাশ করতে পারবেন? আমার ধারণা, তা বোধ হয় আমরা কেউই পারি না। কারও পক্ষেই তা সম্ভব নয়। কারণ বিশেষ করে অর্থ উপার্জন, কর্মজীবন, রাজনীতি এবং যৌনতা বিষয়ক চিন্তাগুলো কারো পক্ষেই যথাযথভাবে লিখে প্রকাশ করা সম্ভব নয়। অর্থাৎ, বিশ্বের সকল মানুষই কার্যত মুখে এবং মনে আলাদা। রাজনীতি ও ধর্মের ক্ষেত্রে এ বিষয়টি সর্বাংশে সত্য।  শিল্পকারখানা আর অর্থবিষয়ক অনেক সংস্থাতেও হিসাবের দু’রকম খাতা থাকে। একটি নিরীক্ষণের জন্যে, অন্যটি নিজেদের জন্যে। ভাষা তো মানুষই ব্যবহার করে। সে কারণেই অন্য সব কিছুর মতো এরও দুটো রূপ-কথ্য রূপ এবং লেখ্য রূপ। সঙ্গত কারণেই ‘কথ্য রূপ’ হলো সেই  ‘আড্ডার পোশাক’ কিংবা ‘হিসাবের নিজস্ব খাতা’-এর মতো। আর ‘লেখ্য রূপটি’ হলো ‘সামাজিক পোশাক’ আর ‘নিরীক্ষণযোগ্য খাতা’ কিংবা জীবনের ঘটে যাওয়া বলবার যোগ্য কথাগুলোর মতো।

চলবে...

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, সরকারি রাজেন্দ্র কলেজ, ফরিদপুর