বাংলাদেশে চিত্রকলাচর্চা

পর্ব ২

ফারুক ইমন

প্রকাশিত : ডিসেম্বর ১৯, ২০১৭

ব্রিটিশ শাসন আমলের আগে এই উপমহাদেশে চিত্রকলা শেখানোর জন্য কোনও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিল না। ১৮৬৪ সালে কলকাতায় স্থাপিত হয় ‘স্কুল অব আর্ট’। আরম্ভ হয় ব্রিটিশ অ্যাকাডেমিক পদ্ধতিতে ছবি আঁকা শেখানো। এর আগে আমাদের দেশের মানুষ ছবি এঁকেছে, তবে সচেতনভাবে নয়; কিন্তু এই প্রতিষ্ঠান থেকে আরম্ভ হয় সচেতনভাবে ছবি আঁকা। ভাবা শুরু হয় চিত্রকলার উদ্দেশ্য নিয়ে, কেন কী কারণে মানুষ ছবি আঁকে; আর ছবি আঁকবে।
প্রাচীন যুগে বাংলাদেশে একদল চিত্রকর ছিলেন, যাদের বলা হতো পটুয়া। পটুয়ারা ছবি আঁকা শিখতেন বংশ পরম্পরায়। ছবি আঁকতেন প্রথাগতভাবে। এরা ছবি আঁকা শিখতেন জ্যেষ্ঠদের আঁকা ছবির ওপর হাত ঘুরিয়ে। যেমন আমরা এখন শিখি অক্ষর লিখতে। তাই বলতে হয়, পটুয়াদের ছবি আঁকা আসলে হয়ে দাঁড়িয়েছিল ছবিলেখা। ঠিক তা আর ছবি আঁকা ছিল না। ‘পট’ বলতে বোঝাত মোটা কাপড়কে। মোটা কাপড়ের ওপর গোবর মেশানো মাটি লেপা হতো। তার ওপর আঁকা হতো ছবি। পটের ওপর ছবি আঁকা হতো বলে, যারা ছবি আঁকতেন তাদের নাম হয় পটুয়া। পরে তারা ছবি আঁকতে শুরু করেন কাগজের ওপর; কিন্তু পুরনো পটুয়া নামটা থেকেই যায়।
পটুয়ারা তাদের ছবি আঁকার রং বানাতেন নিজেরাই। যেমন, হলুদ রং বানাতেন হলুদ মাটির গুঁড়ো থেকে, তাদের সঙ্গে আঠা মিশিয়ে, যা লাগানো যেত পানিতে গুলিয়ে। লাল রং তারা বানাতেন লাক্ষা থেকে। যা হলো, আলতা। আলতা মেয়েরা পায়েও পরতো। সবুজ রং তৈরি করতো তামার গুঁড়োর সঙ্গে কাগজি লেবুর রসের বিক্রিয়া ঘটিয়ে। রেখা টানার জন্য কালো রং তৈরি করতো গাব থেকে। ছবি আঁকার তুলি বানাতো ছাগলের লেজের লোম থেকে। অর্থাৎ তাদের ছবি আঁকার সব উপকরণ তারা নিজেরাই বানাতো।
পটুয়ারা ছবি আঁকতে সরু রেখা ব্যবহার করতো না। ব্যবহার করতো মোটা বলিষ্ঠ রেখা। তাদের ছবিতে উঁচু-নিচু বোঝানোর কোনও চেষ্টাও ছিল না। ছিল না বস্তু নিচয়ের কাছে দূরে বোঝানোর কোনও চেষ্টা। তাদের ছবি হতো চ্যাপ্টা অর্থাৎ ছবিতে থাকত দৈর্ঘ্য-প্রস্থ; কিন্তু থাকত না আলো-ছায়ার প্রয়োগ ঘটিয়ে বেধ বোঝাবার চেষ্টা। ছবিতে বর্ণ প্রয়োগ করা হতো অবিমিশ্রভাবে। তারা রং প্রয়োগ করতেন আঠার সঙ্গে পানিতে রঞ্জক গুলিয়ে; কিন্তু এ রং ছিল অস্বচ্ছ। কতকটা এখনকার দিনের পোস্টার কালারের মতো।
পটুয়ারা একসময় সম্ভবত বাস করতেন গোটা বাংলাভাষাভাষী অঞ্চল এবং দক্ষিণ বিহারজুড়ে। বর্তমান বাংলাদেশে কোথাও পটুয়া নেই; কিন্তু ঢাকার একটি এলাকার এখনো নাম আছে পটুয়াটুলি। ‘টুলি’ শব্দটা হিন্দি ভাষার। শব্দগত অর্থ হলো পাড়া। সম্ভবত অতীতে সেখানে বাস করতেন পটুয়ারা। তাই হতে পেরেছে এই নাম। বর্তমানে পটুয়াদের দেখা যায় প্রধানত পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম ও মেদেনীপুর জেলায়। এরা এখন আর ছবি আঁকে না। পূর্বপুরুষদের আঁকা ছবি দর্শকদের দেখিয়ে ছবির বিষয় বা কাহিনিকে গান গেয়ে ব্যক্ত করেন। এ হলো তাদের জীবিকার উপায়।
পটুয়ারা ধর্মে না হিন্দু, না মুসলমান। এরা মৃতদেহ দাহ করে না। জানাজা পড়ার পর কবর দেন; কিন্তু কবর দেয়ার আগে শবের মুখে আগুন ছুঁয়ে মুখাগ্নি করেন। এরা নামাজ পড়েন কিন্তু এদের ছবির বিষয় প্রধানত হিন্দু দেব-দেবি।
চলবে...