বাংলাদেশের চেয়ে সিনেমায় পশ্চিমবঙ্গ বহুগুণ এগিয়ে

পর্ব ৮

প্রকাশিত : এপ্রিল ২৮, ২০১৮

মেহেদী উল্লাহ বর্তমান প্রজন্মের একজন মেধাবী গল্পকার। তার ভাষা যেমন কারুকাজময়, তেমনই চিন্তায় রয়েছে প্রথা ভেঙে নতুন কিছু তৈরির আয়োজন। গেল মেলায় প্রকাশিত হয়েছে প্রথম উপন্যাস গোসলের পুকুরসমূহ। প্রকাশিত গল্পের বই চারটি। স্বীকৃতি হিসেবে পেয়েছেন জেমকন তরুণ কথাসাহিত্য পুরস্কার ২০১৩। কবি ও কথাসাহিত্যিক আবু তাহের সরফরাজ তার সঙ্গে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে গপসপ করেছেন। প্রতি শনিবার ধারাবাহিকভাবে সেসব কথামালা প্রকাশ করা হবে:

সরফরাজ: বর্তমানে আমাদের কথাসাহিত্যের মান কোন পর্যায়ে বলে আপনি মনে করেন? বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের কথাসাহিত্যের তুলনামূলক অবস্থান নিয়ে শুনতে চাই?

মেহেদী: কথাসাহিত্যের মান নির্ণয়ের নির্দিষ্ট কোনো মানদণ্ড নেই; পৃথিবীর কোথাও যেমন নেই, এখানেও নেই। নেই বলেই বর্তমানে অজানায় থেকে যাওয়া কোনো কোনো লেখার গুরুত্ব ভবিষ্যতে উদঘাটিত হয়। আবার বর্তমানের অনেক সাড়া জাগানো লেখার কথা মানুষ ভুলে যায়, চর্চা, পাঠ, মূল্যায়ন ইত্যাদি থেমে যায়। তবে মানদণ্ড না থাকলেও একটা প্রক্রিয়া নিশ্চয়ই আছে, যার মধ্য দিয়েই আলোচিত লেখকদের যেতে হচ্ছে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এখন পাঠক দেশীয় বই নির্বাচন করে থাকে মূলত দুটি মাধ্যম দ্বারা প্রভাবিত হয়ে। সোশ্যাল মিডিয়া অর্থাৎ ফেসবুক; অন্যটি একটি জাতীয় দৈনিকের পৃষ্ঠপোষকতাজাত সাহিত্যকর্ম। প্রতি মেলার আগেই ফেসবুকে কয়েকটি বইয়ের তথ্য ভাইরাল হয়ে যায়। সেগুলোকে ভাইরাল করে তোলার জন্য সংশ্লিষ্ট লেখক ও প্রকাশক কিছু গুপ্ত ও প্রকাশ্য পদ্ধতি প্রয়োগ করে থাকে। বইয়ের প্রচারণা ও বিপণনের জায়গা থেকে এটাকে ইতিবাচকভাবেই দেখছি। তবে এ পদ্ধতিতে পাঠকের হাতে পৌঁছানো বইগুলোর সাহিত্যমান নিয়ে মন্তব্য করতে পারব না। যারা পড়ে তারাই বলতে পারবে। সেক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নেয়ার একটা স্বাধীন রাস্তা পাঠকের তৈরি হয়ে যায়, পরের বার ওই লেখকের বই পড়বে কি পড়বে না। একটি জাতীয় দৈনিকের প্রচারিত বইগুলো, কিংবা দৈনিকটির প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থেকে প্রকাশিত কোনো কোনো বইকে মানসম্পন্ন ধরে নিয়েই পাঠক সংগ্রহ করে। এটা পাঠকের এক ধরনের বিশ্বাস। এছাড়া আরো কয়েকটি উপায় আছে বই নির্বাচনের। তার প্রভাব অল্প। ভালো প্রকাশনা থেকে প্রকাশিত বই, যেমন বাংলা একাডেমির বইগুলো (ননফিকশন), বিভিন্ন পুরস্কারপ্রাপ্ত বই। এসব প্রক্রিয়াগত বইকে পাঠক মানসম্পন্ন ভেবে থাকে এবং কেনে, পড়ে। এদেশের নিরানব্বই ভাগ মানুষের ভালো বই নির্বাচনের সাধ-সাধ্য নেই। তারা নানাভাবে প্রভাবিত হয়ে বই সংগ্রহ করে থাকে। বাকি একভাগ পারে নিয়মিত বই পড়ার কারণে এবং একাডেমিক অভ্যাসবশত। বৃহৎ পরিসরে ক্লাসের পাঠ্যবইয়ের বাইরে বই পড়ার রীতি এখানে গড়ে ওঠেনি। এখানকার শিক্ষাব্যবস্থা সেজন্য সময় ও উৎসাহ কোনোটাই রাখেনি। এখানকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বাংলা বিভাগ থেকে ডিগ্রিপ্রাপ্ত অধিকাংশ শিক্ষার্থী পেশাগত জীবনে বাংলা সাহিত্যের সাথে আর সম্পর্ক রাখে না। তারা স্নাতক শেষ করেই এমন চাকরির খোঁজ করে যাতে সাহিত্যের পাঠ চিরতরে চুকিয়ে ফেলা যায়। শিক্ষাব্যবস্থার ত্রুটির কারণেই এরকম ঘটছে। সেই ত্রুটির একটি হচ্ছে, একাডেমিতে যে ভাষায় সাহিত্য চর্চা হচ্ছে সেটি আজকের কথ্যভাষা থেকে অনেক দূরের প্রায় মৃত একটি বাংলা ভাষার রূপ। যে বাংলা ভাষায় সাহিত্যের অধিকাংশ সমালোচনা-পুস্তক লিখিত!

সরফরাজ: একেবারে মোক্ষম পয়েন্টে হাত দিয়েছেন। এরপর? বলে যান...

মেহেদী: ফলে সাহিত্যমানের চেয়ে বিভিন্ন কর্তৃপক্ষ যে সাহিত্য যে যে সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক উদ্দেশ্য থেকে উপস্থাপন করে সেগুলোই এখানে মানসম্পন্ন বলে বিবেচিত হয়ে আসছে। এটা আসলে পুঁজিবাদী বাস্তবতা। পণ্য-সংস্কৃতিতে পণ্য এভাবেই বিজ্ঞাপিত হচ্ছে। দেশভাগের পর থেকেই বাংলাদেশ ও পশ্চিমবাংলার মানচিত্রের মতোই সাহিত্যও আলাদা হয়ে পড়েছে। সাহিত্যের বিষয়ে প্রভাব পড়েছে নিজ নিজ প্রতিবেশ, আর্থসামাজিক ও রাজনীতির প্রভাব। মুক্তিযুদ্ধের পর আমূল বদলে গেছে। ভাষা, সেইসাথে কন্টেন্ট। পশ্চিমবাংলার কথাসাহিত্য অনেক বছর পড়া হয় না। এখন কারা কি লিখছেন ওখানে জানি না। তবে সিনেমা দেখি। যখন যেটা ইউটিউবে নতুন আসে, দেখে ফেলি। বাংলাদেশের চেয়ে সিনেমায় পশ্চিমবঙ্গ বহুগুণ এগিয়ে। সবদিক থেকে। আর এগিয়ে ননফিকশনে। তাদের ননফিকশন প্রয়োজনের খাতিরেই পড়তে হয়, এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই।

চলবে