সংগৃহিত

সংগৃহিত

বাংলার আটপৌরে ভাষা

মোরশেদ হাসান

প্রকাশিত : এপ্রিল ০৯, ২০১৮

ডিমকে চট্টগ্রামের ভাষায় বলা হয় `বদা`। অনেকে `বজা` বলেন। আমি বাংলাদেশে আর কোনো অঞ্চলে ডিমের এ নাম শুনিনি। চট্টগ্রামের শহরে ও মফস্বলে আমার শৈশব কেটেছে। মফস্বলের এমন একটি এলাকায় ছিলাম, সে এলাকাটি শুধু আমার দৃষ্টিতে নয়, আমার বন্ধু যাঁরা তাঁদের বাবার সরকারি চাকরির সুবাদে ছিলেন সবার কাছেই এক আশ্চর্য সুন্দর জায়গা। সবাই যখন একত্রিত হই এখনও আমাদের সেরা স্মৃতিগুলো সেখানকার। সে আলাপ নিশ্চয়ই অন্যদিন।
ডিমের বজা বা বদা এসেছে আরবি থেকে। আরবরা ব্যবসা উপলক্ষে হাজার বছরের ওপরে সব উপকূলীয় শহরেই এসেছিলেন, বসতি গেড়েছিলেন। তাঁদের শব্দগুলো রয়ে গেছে এই শহরগুলোতে।
আরবিতে ডিমকে `বায়যাহ` বা `বায়দাহ` বলে।
 
‘কোয়াইশ’ শব্দটি বেশ মনে পড়ে। অর্থ মনের মতো। কোয়াইশ গরি কথা হইবা ময়দানের মাডত। এই কোয়াইশও আরবি শব্দ আমার ভুল না হলে।
আরবিতে ধীরে ধীরে হাঁটাকে বলে ‘দাব্বা’।  চাটগাঁতে বলে দাবা। ‘পোয়া ইবা দাবাই দাবাই হাডের’।
 
ফারসি শব্দ প্রচুর আছে। একটি এখন বলছি, ‘আফোয়াইদ্যা’। ফারসিতে স্বাদ অর্থ ‘ফোয়াইদ্যা’। এর সাথে ‘আ’ উপসর্গ যোগ করে ‘আফোয়াইদ্যা’। নোয়াখালিতে স্বাদকে বলে ‘হোয়াদ’। ফারসি ‘গপ’ আছে চাটগাঁর ভাষায় বড় বড় কথা হয়ে। ওড্যা ডঅঁর ডঅঁর গপ্ ন মারিস (বড় বড় কথা বলিস না)।
আর উর্দু শব্দ তো আছে বেশুমার। 
পুচ (জিজ্ঞাসা), ‘গরদিশ’ মানে ঘটনাচক্রে—মাইয়াপোয়া ইবারে গরদিশে পাইয়ে ফান লাঁর।
তেরিমেরি – তেরিমেরি (তোমার-আমার) গরর ক্যা।
লালচ। 
মাগনা হয়েছে মা-না। চট্টগ্রামে তিন অক্ষরের অনেক শব্দই মাঝের বর্ণ লোপ পায়। যেমন—ছাগল (ছল), পাগল (পল)।
ছোটোবেলায় শোনা একটি গান দিয়ে শেষ করি। 
“যে আছিল আঁর মনর মানুষ
গেইয়ে বিদেশত
মুই অভাগীর কথা কি তার
ন উঠেরে মনত
আরও যে বসন্তকাল
কোকিল মারে টিটকারি।।”

নোয়াখালিতে তরকারিকে বলে ‘ছালোন’। এরে, ছালোন ইয়ান বাক্কা মজা হইছে। আরেক্কানি দিবিনি আঁরে।
এই ‘বাক্কা’ শব্দের আরাম আপনি আর কোন ভাষায় পাবেন? ‘বাক্কা’ বলতে না পারলে তো নোয়াখালির মানুষের সর্বনাশ হবে।
 
বাক্কা মানে খুব ভালো বা সুন্দর।
 
কিশোরীকে জ্বালাতন করার পর মুহূর্তেই পিচ্ছিল কাদামাটিতে আছাড় খেয়ে মুখ বিকৃত করতে না করতেই কিশোর দেখল ছিপছিপে বেতের মতো তনুটি শুন্যে ছুঁড়ে দিয়ে মুখের ভাঁজে ভাঁজে তৃপ্তি নিয়ে কিশোরী বলছে,
এইয়ে না, বাক্কা অইছে। বাক্কা মজা অইছে। দানা ভাইঙছেনি?
 
--চাটগাঁতে যেমন হিরা-জহরতের মূল্যেও তারা আপনাকে ‘কোয়াইশ’ শব্দ বলার আরাম থেকে এক বিন্দু ছাড় দেবে না, তেমনি নোয়াখালীতেও তা-ই। বস্তুত আঞ্চলিক ভাষার শব্দসম্ভার সেই অঞ্চলের অমূল্য সম্পদ।
‘বেচইন’ শব্দটি ফারসি। এর অর্থ অস্থির হওয়া। সাহিত্যে এর ব্যাপক ব্যবহার আছে।
জৈষ্ঠ্যের খরতাপে বেচইন হয়ে ঘরে ফিরে এলে আপনাকে এখানে যা দিয়ে হাওয়া দিয়ে স্থির করার চেষ্টা করা হবে তার নাম ‘বিচইন’ অর্থাৎ হাতপাখা।
 
এখানে মাথা হয়ে গেছে ‘কল্লা’, ঘাড় হয়েছে ঘেঁডি’, বিচি কলা >আঁইড্ডা কেলা, ভাপা পিঠা>ধুই হিডা, বাতাস>হা-বা।
 
ভোজ শব্দটি আরবি ‘দিয়াফত’ থেকে প্রমিত বাংলায় হয়েছে জেয়াফত। নোয়াখালিতে হয়েছে ‘জে-বত’। --এরে আইজকা তোর হুর (ফুফু) বাড়ি জেবত আছে। নোঁয়া শার্ট গাত দি যাইছ।
ফারসি ‘জেব’ হয়েছে পকেট। -- জেবে টেঁয়া-হইসা আছেনি, চাও না একবার। ওমা তুঁই আঁর দিকে রেনি রইছ কিল্লাই। জেবের দিকে না চাইবা।
‘রেনি’ মানে এক দৃষ্টিতে দেখা।
নোয়াখালীই একমাত্র বাংলা আঞ্চলিক ভাষা যার সর্বনামে জেন্ডার আছে। ছেলে হলে হ্যাতে, মেয়ে হলে হেতি। উচ্চারণে অর্ধস্ফুট ‘হ’ এর ছড়াছড়ি; প- বর্ণকে এখানে হ বলে এ তো সর্বজনবিদিত।
 
এটা ধরা হয় প্রায় এক কোটি মানুষ নোয়াখালির ভাষায় কথা বলে। বৃহত্তর নোয়াখালী ছাড়াও কুমিল্লার -- লাকসাম, চৌদ্দগ্রাম, চাঁদপুরের কিছু এলাকা, ভোলা, চট্টগ্রামের মিরসরাই, সীতাকুন্ড ও সন্দ্বীপের মানুষ এ ভাষাটিকেই ব্যবহার করছে। সমুদ্র বন্দরের সুবাদে এ জেলার মানুষ ভাগ্যান্বেষণে হাজার বছর ধরে বিশ্বের নানান দেশে বিচরণ করেছে। আবার নানান দেশের মানুষও এ অঞ্চলে এসেছে ব্যবসার উদ্দেশ্যে। কোম্পানীগঞ্জের ‘যুগদীয়া’ আর সুধারামের ‘শান্তাসিতা’ বন্দর ছিল অন্যতম। জনযোগাযোগ ছিলো সারা বিশ্বের সাথে। লেনদেন হয়েছে নানান ভাষারও। এ অঞ্চলের ভাষার সঙ্গে মিশে গেছে গ্রিক, ফ্রেঞ্চ, ইংরেজি, ল্যাটিন, পর্তুগিজসহ নানান ইউরোপীয় ভাষা। আর আরবি, ফারসি তো আছেই।
 
আমেরিকান ভাষাবিজ্ঞানী নোয়াম চমস্কি উপভাষাকে ‘মূল ভাষা-দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ’ বলে উল্লেখ করেছেন। তাঁর মতে দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ মিলে যেমন দেহ, ভাষাও তেমনি কোনো দেশের জনসমষ্টির পূর্ণাঙ্গ দেহের সাথে তুলনীয়; আর উপভাষা হল দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সদৃশ। প্রকৃত অর্থে উপভাষা ভাষা অপেক্ষা ভিন্ন নয়।
জার্মান পণ্ডিত ম্যাকসমুলারের মতে, ‘ভাষার স্বাভাবিক ও যথার্থ জীবন উপভাষায় পাওয়া যায়’। প্রকৃতপক্ষে রাষ্ট্রভাষা এবং মাতৃভাষা এক কথা নয়। রাষ্ট্রভাষা রাষ্ট্রীয় কাজে ব্যবহৃত রাষ্ট্রের প্রমিত বা সর্বজনবোধ্য ভাষা, আর মাতৃভাষা মায়ের মুখ থেকে শেখা ভাষা। সুতরাং রাষ্ট্রভাষা পোশাকি এবং মাতৃভাষা আটপৌরে।
 
শেষ করে দিই একটি শ্লোক বলে,
 
আমে ভাতে মিলি গেলে
বারাগা ভেটকাই রইছে।
(আপনে আপনে মিল হয়। আর অপরের সাথে অমিল হয়।)