ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

বাঙালির মুক্তির সংগ্রাম ও সুভাষ-মুজিব সম্পর্ক

আশরাফুল ইসলাম

প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ১৭, ২০১৮

ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ব্রিটিশদের দ্বারা দ্বিখণ্ডিত করা ভারতবর্ষে ভারত ও পাকিস্তান নামক যে দুটি রাষ্ট্রের জন্ম হয়, তা এ অঞ্চলের পরবর্তী প্রজন্মের অনেক ঐতিহাসিক সত্যকেই ভুলিয়ে দিয়েছে। উগ্র সাম্প্রদায়িক ও শোষণনীতির পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠি বাঙালি জাতির ওপর পৃথিবীর যে নজিরবিহীন নিষ্পেষণ ও বর্বরতা শুরু করে, তা রুঁখে দিয়ে রক্তাক্ত সংগ্রামের মধ্য দিয়ে জন্ম লাভ করে স্বাধীন ভূখণ্ড বাংলাদেশ।

একটি অঞ্চলের এই যে শাসনতান্ত্রিক ভাঙাগড়ার খেলা, তাতে যেমন চাপা পড়ে বাঙালি জাতির বহু আত্মত্যাগের ইতিহাস, তেমনি প্রজন্মের উত্তরাধিকারদের মাঝেও এ নিয়ে জন্মেনি তেমন কোনো অনুরাগ। দেড় দশক প্রবল আগ্রহ ও ভালোবাসা নিয়ে নেতাজির আদর্শ ও তার আত্মত্যাগ, সংগ্রামী ইতিহাস অধ্যয়নে বারবার এ কথাই প্রতিধ্বনিত হয়েছে। নেতাজির আদর্শ চির অমলিন। সবসময়ের জন্যই তিনি প্রাসঙ্গিক। ভারতীয় উপমহাদেশের কলঙ্কজনক দুই অধ্যায় ব্রিটিশ ও পাকিস্তান শাসনামলের নিষ্পেষণ-শোষণের বিরুদ্ধে পরিচালিত আজাদ হিন্দ ফৌজ ও মুক্তিবাহিনীর সর্বাত্মক সংগ্রামে মধ্যে বহু সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যাবে। এ দুটি মুক্তি সংগ্রামের মধ্যেই অসাম্প্রদায়িক ও শোষণহীন রাষ্ট্রের আকাঙ্ক্ষা যেমন ছিল, তেমনি হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিস্টানসহ সর্বধর্মের বীরযোদ্ধাদের অকাতর বলিদান উভয় সংগ্রামকেই এক মহোত্তম ত্যাগের চিরকালীন মর্যাদা দিয়েছে।

এখানে উল্লেখ্য, ব্রিটিশ ও পাকিস্তানের বিরুদ্ধে দুটি মুক্তির সংগ্রামের নেতৃত্বেই ছিলেন সর্বকালের শ্রেষ্ঠ দুই বাঙালি নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। যা বাঙালির মুক্তির চেতনার ঐতিহাসিক পরম্পরারই পরিচয় মেলে ধরে। প্রায় দুশো বছরের ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণের শৃঙ্খল থেকে ভারতীয় উপমহাদেশকে মুক্ত করতে বহু বৈপ্লবিক সশস্ত্র প্রচেষ্টা প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে হলেও একথা অনস্বীকার্য যে, ব্রিটিশদের ভিত প্রবলভাবে নাড়াতে সক্ষম হন নেতাজিই, যা দারুণভাবে প্রভাবিত করে তরুণ শেখ মুজিবকেও। প্রখর মেধাবী সুভাষ ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস (আইসিএস) পরীক্ষায় চতুর্থ হয়েও তাতে যোগ না দিয়ে পরাধীন দেশমাতাকে উদ্ধারের সংকল্প করেন। জাতীয়তাবাদী নেতা দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের হাত ধরে সেই সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়ে রাজনীতিতে এসে পূর্ণ স্বরাজের দাবি তুললেন, যেখানে তৎকালীন জাতীয় নেতারা ক্ষমতার অংশীদার হতে সর্বোচ্চ স্বায়ত্বশাসন পর্যন্ত দাবি তুলতে পেরেছিলেন। স্বাধীনতার প্রশ্নে কোটি কোটি ভারতবাসীর অন্তরের কথা যেন সুভাষের কণ্ঠেই ধ্বনিত হলো।

দেশবাসী কংগ্রেস সভাপতি পদে তাকে সমর্থন দিয়ে জয়যুক্ত করল। ব্রিটিশদের কাছে ক্রমেই বিজ্জনক হয়ে উঠতে থাকলেন সুভাষ। আপসকামী রাজনীতিবিদদের কুটচালে দ্বিতীয়বার কংগ্রেস সভাপতি পদে বিপুল সংখ্যাগরিষ্টতা নিয়ে জয়ী হলেও পদত্যাগ করতে হলো তাকে। একযোগে সুভাষচন্দ্র বসুকে লড়তে হয় ব্রিটিশ ও নিজ দেশের ষড়যন্ত্রকারীদের সঙ্গে, সমানতালে। স্বাধীন বাংলাদেশে একই অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয় বাংলাদেশের জাতির জনককে। কংগ্রেস সভাপতি পদত্যাগ করার পর ফের কারারুদ্ধ সুভাষ অনশন শুরু করলেন। অবস্থা বেগতিক দেখে কলকাতার নিজ বাড়িতে অন্তরীণ করা হলো তাকে। ব্রিটিশের পুলিশ-গোয়েন্দাদের হাজারো চোখকে ধুলো দিয়ে সুভাষচন্দ্র বসু বেরিয়ে পড়লেন ঘর থেকে। এরপরের ঘটনায় তিনি কেবল ভারতবর্ষের নন, বিশ্বের এক কিংবদন্তি স্বাধীনতা সংগ্রামী মহান নেতায় পরিণত হলেন। হলেন সবার প্রিয় নেতাজি। তৎকালে বিশ্বের মহাশক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর প্রধানরা নেতাজির অনন্য ব্যক্তিত্বের সামনে বিবর্ণ হয়ে যান। অবনত শ্রদ্ধায় রাষ্ট্রনায়কের মর্যাদায় তাকে বরণ করে নিতে থাকেন। নেতাজি বিশ্বের ক্ষমতাধরদের কাছ থেকে ভারতমাতাকে উদ্ধারের সমর্থন-সহযোগিতা আদায় করতে বেশি সময় নেননি। শক্তিশালী ব্রিটিশ-মার্কিন যৌথশক্তির বিরুদ্ধে নেতাজির এই যুদ্ধে আরেক ক্ষমতাধর জাপানসহ বেশকিছু দেশ পাশে থাকলেও তার মূলশক্তি ছিল দেশপ্রেমের, সততার ও আদর্শের। সামরিকভাবে শক্তিশালী পাকিস্তানি জান্তাদের সঙ্গে নিরস্ত্র বাঙালির সংগ্রামে শেখ মুজিবেরও অস্ত্র ছিল দেশপ্রেমের মন্ত্র। নেতাজি তার গঠিত আজাদ হিন্দ ফৌজের প্রতিটি সেনার অন্তরের সেই আদর্শের বীজ যথাযথভাবে রোপণ করতে পেরেছিলেন। সেই যুদ্ধে আজাদ হিন্দ ফৌজের ২৬ হারেরও অধিক সৈন্যের শাহাদাৎবরণসহ বহু বীরত্বগাথা ইতিহাসে ঠাঁই পায়নি।

জাপানের সহায়তায় নেতাজির নেতৃত্বে আজাদ হিন্দ ফৌজ ব্রিটিশের বিরুদ্ধে পরিচালিত যুদ্ধে অভূতপূর্ব সাফল্য পায়। রক্তক্ষয়ী সেই যুদ্ধে ব্রিটিশদের পরাভূত করে মণিপুর-আন্দামান ও নিকোবরসহ (নেতাজি যার নাম দেন ‘শহীদ দ্বীপ’ ও ‘স্বরাজ দ্বীপ’) বিস্তীর্ণ ভারতভূমি অধিকার করে আজাদ হিন্দ ফৌজ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সেই সময়ে জাপানের আত্মসমর্পণ নেতাজির লড়াইয়ে ছন্দপতন ঘটায়। কিন্তু দেশজুড়ে গণমানুষের মাঝে যে অগ্নিস্ফূলিঙ্গ তিনি ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হন তা ব্রিটিশদের বিতাড়নের পথকে প্রশস্ত করে। স্বাধীনতার প্রশ্নে গণজোয়ারের সঙ্গে নৌবাহিনীতে বিদ্রোহ শুরু হয়। ফলশ্রুতিতে দেশভাগের মতো সুদূরপ্রসারী সর্বনাশ করে ভারত ছেড়ে যায় ব্রিটিশরা। তবে রেখে যায় তাদের অনুগত দোসরদের, যারা নেতাজিকে মৃত প্রতিপন্ন করার চক্রান্তে মেতে ওঠে। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর প্রকাশ্যে শারীরিক অনুপস্থিতির (১৯৪৫ এর পর থেকে) সাত দশক পেরিয়ে বহু তথ্য বহু কল্পকাহিনি ডানা মেলেছে। তার বেঁচে থাকার বহু তথ্য প্রকাশ্যে এলেও ‘নেতাজি মৃত’ এমন প্রমাণ আজও অনুপস্থিত। অপরদিকে, স্বাধীন দেশে মাত্র চার বছরের মাথায় উচ্চবিলাসী সেনা সদস্যদের হাতে সপরিবারে প্রাণ দিতে হয় বঙ্গবন্ধুকে। বাংলাদেশের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর গভীর আদর্শিক সম্পর্কের কথা স্থান পায়নি ইতিহাসের পাতায়। তবে ২০১২ সালে প্রকাশিত জেলাখানায় বসে লেখা শেখ মুজিবুর রহমানের ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ তে সুভাষ-মুজিবের আদর্শিক সম্পর্কের অনেক চিত্র উঠে এসেছে। যেখানে মুজিব তার তরুণ বয়েসে নেতাজির দ্বারা উদ্বেলিত-আলোড়িত হওয়ার কথা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্বীকার করেছেন।

নেতাজি-বঙ্গবন্ধু সম্পর্ক নিয়ে সম্প্রতি এক আলাপচারিতায় অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য তুলে ধরেন ইস্টওয়েস্ট মিডিয়া গ্রুপের গণমাধ্যম বিষয়ক উপদেষ্টা মোহাম্মদ আবু তৈয়ব, যিনি দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেছেন কলকাতার ডেপুটি হাইকমিশনে। নেতাজির দারুণ অনুরাগী এই ব্যক্তি জানালেন নেতাজি ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শিক সম্পর্কের অজানা অনেক অধ্যায়। তার প্রদত্ত তথ্য রীতিমতো আন্দোলিত করার মতো। দুই প্রজন্মের এই দুই নেতার অনুরাগীর কথপোকথনের কিছু তুলে ধরলে তা স্পষ্ট হয়ে উঠবে।

চলবে...