বাসের সিটে বসে চোখ বন্ধ করলেই আইডিয়া আসে

পর্ব ১২

প্রকাশিত : মে ২৬, ২০১৮

মেহেদী উল্লাহ বর্তমান প্রজন্মের একজন মেধাবী গল্পকার। তার ভাষা যেমন কারুকাজময়, তেমনই চিন্তায় রয়েছে প্রথা ভেঙে নতুন কিছু তৈরির আয়োজন। গেল মেলায় প্রকাশিত হয়েছে প্রথম উপন্যাস গোসলের পুকুরসমূহ। প্রকাশিত গল্পের বই চারটি। স্বীকৃতি হিসেবে পেয়েছেন জেমকন তরুণ কথাসাহিত্য পুরস্কার ২০১৩। কবি ও কথাসাহিত্যিক আবু তাহের সরফরাজ তার সঙ্গে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে গপসপ করেছেন। প্রতি শনিবার ধারাবাহিকভাবে সেসব কথামালা প্রকাশ করা হবে:

সরফরাজ: গল্পের আইডিয়া নানাজনের নানাভাবে আসে। আমি যেমন কোনো আইডিয়া না করেই শ্রেফ একটি বাক্যই প্রথমে লিখে ফেলি। এরপর চরিত্রেরা নিজেদের মতো করে তাদের গল্প ঠিক করে নেয়। আমি সেখানে নিমিত্ত। আপনার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা ঠিক কেমন?

মেহেদী: কয়েক বছর আগে একটা সেলুনে নিয়মিত চুল কাটাতে যেতাম। সেখানকার এক নাপিতই চুল কাটতেন, দাড়ি ছেঁটে দিতেন। এক শুক্রবারে গেলাম চুল কাটতে। দেখি, নাপিত বাড়তি খাতির করছে। যেতেই বলল, ভাইজান বসেন। কাকে যেন ডেকে বলল, এই, ভাইরে চা দে। দোকানে তেমন ভিড়ও নেই যে, অপেক্ষা করতে হবে চা খেতে খেতে। চা খেতে বাধ্যই হলাম। খাওয়া শেষে আয়নার সামনে বসতেই নাপিত চুল কাটতে শুরু করল। এই কথা ওই কথার একপর্যায়ে বলল, `ভাই, আমারে নিয়া একটা লেখা লেখবেন?` আমি বেশ অবাক হয়ে জানতে চাইলাম, ‘আমি লেখালেখি করি আপনি জানেন কীভাবে?’ শুনে সে ড্রয়ার থেকে পত্রিকার পাতাটা বের করে মেলে ধরল। দেখলাম, জনকণ্ঠের সাহিত্যপাতাটায় আমার ছবি আর তিরোধানের মুসাবিদার প্রচ্ছদ ছাপা হয়েছে।

সরফরাজ: বেশ কিন্তু মজার... ভালোও লাগে এরকম ঘটনা, তাই না?

মেহেদী: হু, তা তো বটেই। এরপর থেকে সেলুনে গেলেই নাপিত ধরে, তারে নিয়া গল্প লিখতেছি কীনা। তার আগ্রহ দেখে উৎসাহ না দেখানোর উপায় নাই। বললাম, ‘আচ্ছা, আপনার একটা ঘটনা শোনান, দেখি গল্প বানানো যায় কীনা।’ সেদিন চুল কাটতে কাটতে তিনি বেশ চমকে যাওয়ার মতো একটা ঘটনা শোনালেন তার জীবনের। ঘটনার সার এমন, লোকটা নিজের সব কাজ নিজে করতে করতে এমন পর্যায়ে পৌঁছে গেছে যে, এখন অন্য নাপিতকে দিয়ে নিজের চুল কাটাতে তার ভালো লাগে না। ইচ্ছে করে নিজের চুল নিজেই কাটার। সেটা সম্ভব হয় না বলে খুব দুঃখ তার। ঘটনাটা শুনে মনে ধরল, কথাও দিয়েছিলাম তাকে নিয়ে একটা গল্প লিখব। কিন্তু আজো লিখতে পারিনি। কয়েকবার বসেও ছিলাম তার গল্পটা লিখব বলে। কিন্তু হয় না। আসলে, এভাবে শুনে কারো গল্প আমি লিখতে পারি না। হোক সেটা ব্যক্তির কিংবা সমষ্টির। অনেকেই আছেন, গল্প বা উপন্যাস লেখার জন্য ফিল্ডওয়ার্ক করেন, ঘটনাস্থলে যান, নোট নেন। এভাবে আমার হয় না। আমি ফিল্ডওয়ার্ক করে লিখতে পারি না। আইডিয়ার জন্য আমি বাসে জার্নি করি। বাসের সিটে বসে চোখ বন্ধ করলেই আইডিয়া আসে। আমার অধিকাংশ গল্পের আইডিয়া বা থিম বা প্লট যাই বলি না কেন, জার্নি করতে করতে পাওয়া। যখনই আইডিয়ার দরকার হয়েছে আমি বাসে উঠে কোনো রকম একটা সিট নিয়ে চোখ বন্ধ করে হেলান দিয়ে বসে পড়েছি। একটার পর একটা গল্পের প্লট মাথায় এসেছে, সবচেয়ে ভালোটা রেখে অন্যগুলো মুছে দিয়েছি মেমোরি থেকে।

সরফরাজ: সেলুনটা কোথায় ছিল? গন্তব্য ছাড়াই আইডিয়ার জন্য বাসে ওঠেন?

মেহেদী: সেলুনটা গেরুয়া গ্রামে। গেরুয়া জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন একটা গ্রাম। গন্তব্যে যাওয়ার উদ্দেশেই বাসে উঠি, কিন্তু আইডিয়া পাওয়াও একটা মহৎ উদ্দেশ্য। এখনো এভাবেই পাই। আগে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে পেতাম, এখন ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে। আগে ঢাকা থেকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে, এখন ত্রিশালের কবি নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়মিত যাতায়াতের সুবাদে বাসে ওঠা হয়। এভাবেই লেখার আইডিয়া পেয়ে যাচ্ছি।

সরফরাজ: তারমানে প্লট চিন্তা করেই লিখতে বসেন?

মেহেদী: হুম। দু’একটা ছাড়া সবই আগে মাথায় সাজিয়ে নেয়া। পরে লিখতে বসেছি। তবে লিখতে গিয়ে এদিক-সেদিক হয়েছে। ঘটনা, চরিত্র ইত্যাদি অন্যদিকে চলে গেছে।

সরফরাজ: অসুস্থ হলে তো সাধারণত জার্নি করা যায় না। তখন কি করেন?

মেহেদী: গত আট- দশ বছরে সিরিয়াস অসুস্থ হইনি। সর্দি, কাশি, জ্বর এগুলা পাত্তা দিই না। তবে সিরিয়াস অসুস্থ হলে কি করব ভাবি! আসলে, অসুস্থ হলে তেমন পাত্তা দিতাম না আগে। তবে ইদানীং অসুস্থ হলে সুস্থতার চিন্তা ভর করে।

সরফরাজ: লেখালেখির জন্য সুস্থ থাকা খুব দরকার, আর আপনার আইডিয়া পাওয়ার জন্য বাস জার্নি করতে গেলে তো আরো! আশা করি, সুস্থ থাকবেন।

মেহেদী: হা হা... তা তো অবশ্যই।

সরফরাজ: একটা ইন্টারভিউতে আপনি বলেছেন, আড্ডা আপনার খুব প্রিয়। টংয়ের চা দোকান খুব পছন্দ?

মেহেদী: খুউব। শুধু আড্ডাটা কমানো গেলে লেখালেখির পরিমাণ আরো তিনগুণ বাড়ত। কিন্তু জীবনে যে সব কারণে বেঁচে থাকতে ভালো লাগে, কী হবে সেসব ছেড়েটেরে শুধু লিখে! একটা বেঞ্চে বসে সারাদিন আড্ডা দেয়ার ক্ষমতা আমার আছে। লোক যায় লোক আসে, আমি বসেই থাকি, নতুন করে আড্ডা জমাই। অনেকে ব্যঙ্গ করে, বসতে বসতে নাকি শিকড় গজিয়ে ফেলি! আমি এমনই। এমএ পরীক্ষা দিয়েছি চা দোকানে পড়ে। পরীক্ষা চলাকালীন প্রতি পরীক্ষার মাঝে গ্যাপ থাকত তিন চার দিন করে। হলে ভালো লাগত না। বইপত্র চা দোকানে এনে রেখেছিলাম। আড্ডার ফাঁকে ফাঁকে মন চাইলেই পড়েছি। মাঝরাতে দোকান বন্ধ হওয়ার সময় বইপত্র ওখানে রেখেই চলে যেতাম। পরদিন এসে চা-নাস্তা খেয়ে আবার পড়া শুরু করতাম। শুরু হতো আড্ডা। এখনো আছে অভ্যাসটা। ক্লাস নেয়ার ফাঁকে ফাঁকে ভার্সিটির ক্যাফেতে এসে আড্ডাই দিই। ক্লাস শেষে আবার শুরু করি। কয়েকজন সহকর্মী আছেন যাদের সাথে শিল্প-সাহিত্য নিয়ে ভালোই আড্ডা জমে। টং চা দোকান দেখলে যতই কিছুক্ষণ আগে চা খাই না কেন, আবার ওখানে খাই। টংয়ের সামনে বেঞ্চে বা বাঁশের মাঁচায় বসলেই ভালো লাগে। চা খাই, পড়ি, আড্ডা দিই।

সরফরাজ: আড্ডার জন্য কাজের ক্ষতি হয় না?

মেহেদী: খুব একটা নয়। আসলে কাজের ফাঁকেই আড্ডা দিই। কিন্তু নিজের প্রতি যত্ন নেয়া হয় না। একটু রেস্ট নেয়া, নিয়ম করে ঘুমানো এসব আরকি।

চলবে