বিজ্ঞাপন শিল্পে বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ এক অধ্যায়

শেষপর্ব

নজরুল ইসলাম তোফা

প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ১৪, ২০১৮

পশ্চিম ইউরোপের বিভিন্ন স্থানের অনেক বড় বড় শিল্প কারখানা। নতুন পণ্য বাজারজাতের জন্যই বিজ্ঞাপন জরুরি হয়ে ওঠে। সুতরাং বলা চলে, সর্বপ্রথম আকর্ষণীয়ভাবে যে বিজ্ঞাপনটি বেরিয়েছিল সেটি ১৪৮০ সালে, লন্ডনে ছাপা হয়। বিজ্ঞাপন পৃথিবীর প্রথম স্বার্থক বিজ্ঞাপন বলেই শিল্পী জুলসেরে লন্ডনকে বিজ্ঞাপন শিল্পের জন্মস্থান বলেছিলেন। বিশ শতকের বিজ্ঞাপন শিল্প একটি যুগান্তকারী পরিবর্তন আনে। এর সাথে সাথেই মানুষের শিল্পবোধের বৈচিত্র্যময় পরিবর্তন ঘটে। বিজ্ঞাপন শিল্পের কদর দিন দিন আরও বাড়ছে।

বাংলাদেশের বিজ্ঞাপন শিল্পের ইতিহাস টানার সঙ্গে সঙ্গে মনে করি বাংলাদেশের ঐতিহাসিক ও ভৌগোলিক অবকাঠামোও উঠে আসে। সত্যিকার অর্থে যদি দেশীয় রাজনৈতিক পালাবলদগুলিকে বাদ দেয়া হয় এবং যদি বাংলাদেশের অর্থনীতির দিকে দৃষ্টি দেয়া যায়, তবে দেখা যাবে ভারত উপমহাদেশে ইন্ডাস্ট্রিজ বা শিল্প কারখানা যখন শুরু ঠিক তখনই বিজ্ঞাপন শিল্পের সূচনা। যেসব জায়গায় ক্রেতারা ছিল সেসব জায়গায় বিজ্ঞাপন প্রথা শুরু হয়েছিল। তাদের পণ্যকে পরিচিতি করার জন্যেই বা খবর পৌঁছে দেয়ার জন্যে নতুন নতুন কৌশল অবলম্বন করা হয়। ভারতে যখন বিজ্ঞাপনের সূচনা হয়, তখন থেকে এই বাংলায় বিজ্ঞাপন শিল্প শুরু হয়।

বাংলাদেশের বিজ্ঞাপন শিল্পের শুরু অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষার্ধে অর্থাৎ ইংরেজদের হস্তগত হওয়ার পরপরই। এদেশে তখন অনেক সস্তায় প্রিন্ট মেশিন অথবা বিজ্ঞাপন প্রযুক্তি নিয়ে আসে বিলাত থেকে ইংরেজরা। তখন থেকে এদেশীয় সামান্তবাদ প্রভুরা বা বাবুশ্রেণির লোকেরা খুব বেশি উৎসাহী হয়ে ওঠে। তারা বিলাত থেকে আসা শিল্পী বা কারিগরদের পৃষ্ঠপোষকতা শুরু করে। সেই সময়েই শিল্পীদের নাম ও ঠিকানাসহ তাদের পরিচয় তোলে ধরার জন্যেই এক প্রকার
ব্যক্তিগত কৌশলে বিজ্ঞাপন নির্মাণ করে।

অ্যাডভারটাইজিং আর্ট বা বিজ্ঞাপন শিল্প আসলে সে সময় সম্পূর্ণই মুদ্রণ যন্ত্রের ওপর নির্ভরশীল ছিল। ১৮১৬ খ্রিস্টাব্দে সচিত্র বাংলা বইয়ের প্রথম সাক্ষাতেই এটি পাওয়া যায়। এমন এই বই যা গঙ্গা কিশোর ভট্টাচার্য দ্বারা প্রকাশিত হয়েছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি আমলে বাংলাদেশে। তারপর এলো বৃটিশ আমল, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ভারত ও বাংলাদেশের মিত্র বাহিনীর স্বপক্ষে বহু পোস্টার লিফলেটের ভূমিকা এদেশে নতুন একটি ট্রেন্ড তৈরি করে। ভারতীয়দের চৌকষ দৃষ্টিভঙ্গির দ্বারাই পরবর্তী সময়ে কংগ্রেস জাতীয়তা বোধ গড়ে তুলতে এমন এই বিজ্ঞাপন শিল্পের নানা প্রচার প্রচারণার প্রসারতা লাভ করে। ১৯৪৭ সালে ভারত পাকিস্তান ভাগের ফলেই শিল্প কারখানার সিংহভাগ পড়ে যায় পশ্চিম পাকিস্তানে। পণ্যের প্রচারের জন্য বিজ্ঞাপন শিল্পের মূল অফিসগুলো পশ্চিম পাকিস্তানে থেকে যায়। তাই সে সময়ে মুসলিম তরুণ শিল্পী কলকাতা থেকে ঢাকায় আসে। তৎকালীন গোড়া পাকিস্তান সরকার ও শাসকের বিরুদ্ধে শিল্পের ব্যবহারিক প্রয়োজনীয়তা, বাংলাদেশের উন্নতির স্বার্থেই শিল্পকলার প্রয়োজন যে আছে, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীনের তা বোধগম্য হয়। এবং তিনি বিজ্ঞাপনী পোস্টারে প্রতিবাদী হন।

১৯৪৮ সালে আর্ট স্কুল স্থাপিত হলেও বাংলাদেশে বিজ্ঞাপন শিল্পের চাহিদা খুব কম ছিল। বলা যায়, লোক সংখ্যার তুলনায় শিল্পকারখানা কম থাকার ফলে পণ্যের উৎপানের থেকে চাহিদা বেশি থাকায় নতুন পণ্যের বাজার তৈরিতে বেশি বেগ পেতে হয়নি। এ কারণে তখন বিজ্ঞাপন শিল্পের প্রতিযোগিতা কম ছিল। তাই একই ধরনের মনোপলিশি অথবা নিজ খেয়ালখুশি মতো ব্যবসা করে যেত। আবার পাকিস্তান আমলে ৬০ দশকের বিজ্ঞাপন শিল্পকে লক্ষ্য করলে সেসময় বিজ্ঞাপন প্রচার বাংলাদেশে যতটুকু হয়েছিল, তা শুধুই শিল্পপতিরা পশ্চিম পাকিস্তান থেকে করেছে। এমনকি দৈনিক পত্রিকাগুলির বিশেষ সংখ্যা এবং সামলিম্যান্ট প্রিন্টের আগমুহূর্তের জন্য অপেক্ষায় থাকতে হতো পশ্চিম পাকিস্তানে দিকে। তবে সে সময়ের বাংলাদেশে দু’তিনটি বিজ্ঞাপন সংস্থার নাম উল্লেখ করা যায়। যেমন, এভার গ্রিন পাবলিসিটি কামআর্ট, গ্রিন ওয়েজ, এডভারটাইজিং কর্পোরেশন। তারা প্রসাধনী পণ্যের প্যাকোডিজাইন থেকে শুরু করে প্রেস লে-আউট পর্যন্ত করেছে। এ সাফল্যের পাাশাপাশি বাংলা চলচ্চিত্রের বিজ্ঞাপনও করেছে। ১৯৭১ সালের পরই বাংলাদেশে বিজ্ঞাপন শিল্পের প্রচার মাধ্যমগুলির উন্নতি যেন চোখে পড়ে। বিশেষ করে অডিও ভিস্যুয়ালের অনন্য অবদানের জন্যই বলা যায় যে, দেশীয় টিভি, রেডিও, আপসেট প্রিন্ট খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

যেকোনো দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার উপর নির্ভর করে চলে দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থা। দুটি উদাহরণ দিয়েই বলা যেতে পারে, বাংলাদেশের বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থা সুস্পষ্টভাবে বিজ্ঞাপনের সিংহভাগ জায়গা দখল করে রেখেছে সরকারি দরপত্র বিজ্ঞাপনগুলো। কোনও শিল্প উন্নত দেশের দৈনিক পত্রিকাগুলোতে দেখা যাবে, শিল্পপতিদের পণ্যের প্রচারের প্রতিযোগিতায় বিজ্ঞাপন আধিক্য। সমাজের পরিবর্তনের সাথে সাথেই ক্রেতাদের মনোভাবের ওপর খুব প্রভাব বিস্তার করে। গ্রামাঞ্চলের মানুষ দৈনন্দিন উৎপাদিত পণ্য জনসাধারণের নিকটবর্তী করতে ব্যর্থ ছিল। বলা যায়, এক যুগের মতো সময় লেগেছিল দেশের সকল মানুষের কাছে তা পৌঁছাতে এবং তা সম্ভব হয়েছিল বিজ্ঞাপন শিল্পের বদৌলতে। অবশ্য কলকারখানার কারিগরি পদ্ধতি অনেকাংশেই পরিবর্তন ও তার পাশাপাশি মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের পরিবর্তনেরই বিজ্ঞাপন ধারার অনেক উন্নতি হয়েছে। বাংলাদেশের মুদ্রণ যন্ত্রের ব্যবহার অনেকাংশেই যেন বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাই ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে ফটোকম্পোজ, ইলেকট্রনিক ট্রান্সমিশন এবং রি-প্রোডাকশন এর নতুন পদ্ধতি চালু করে বাংলাদেশকে এক ধাপ এগিয়ে নিচ্ছে বলা যায়। যার পরিপেক্ষিতে লেজার প্রেস, আপসেট এবং ফ্লোক্সওগ্রাফির অধিক ক্ষমতা সম্পন্ন কাজের সমন্বয় ঘটিয়ে বহু ধরনের বিজ্ঞাপন নির্মাণ হচ্ছে। বর্তমানে আজ বাংলাদেশে ডিজিটাল প্রযুক্তি আগমনেই ত্বরান্বিত হচ্ছে বিজ্ঞাপন শিল্প। তাই উন্নতিশীল ডিজিটাল বাংলাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা সমৃদ্ধশালী ও পরিচ্ছন্ন হওয়াতে বিজ্ঞাপনের আধিক্য অনেক বেশি।