বিদেশে দেশের রাজনীতি

বৈতরণী হক

প্রকাশিত : মার্চ ১৬, ২০১৮

হালাল মাংস আর আমাদের দেশি মাছের জন্য এক কী দেড় মাস অন্তর অন্তর আমার হাজবেন্ড ওয়াসি একটি সিলেটি মালিকানাধীন দোকানে যায়। সিয়ানা হওয়ার অনেক আগ থেকে আমরা যাই এই দোকানে। মালিক থেকে শুরু করে কর্মচারী সবার ব্যবহার ভালো আর ওয়াসি যেহেতু তাদের দেশি ভাই, আলাদা একটা সম্মান দেন উনারা। দোকানটা আমাদের খুব প্রিয়। এদেশে তাজা মাছ পাওয়া যায় না, তাই আমরা কোটি কোটি বছরের পুরনো পচা মাছই গবগব করে খাই। ফ্রোজেন রুই, মৃগেল, আইড়, কাইক্যা, বাইল্যা, রানী মাছ থেকে শুরু করে প্রাণের চাটনি, প্যারাসুট নারকেল তেল, চানাচুর, এনার্জি প্লাস বিস্কুট আরো অনেক দেশি জিনিস পাওয়া যায়। ভোজনরসিক পেটুক বৃহদাকার দম্পতির জান এই দোকান। এই দোকানে একজন কর্মচারী আমার এক সিলেটি ভাই মাংস কেটে দেন। উনি বহু বছর এই দেশে আছেন। মাংসের প্যাকেটের গায়ে পরম যত্নে উনি লিখে দেন BIF (beef)।

আজকে ওয়াসি গিয়েছিল বাজার করতে ওখানে। ও যখন জিনিস দেখে দেখে নিচ্ছিল তখন দেখলো এক শীর্ণকায় বৃদ্ধ দোকানে আসলো। সে একটা দুই লিটারের দুধ নিলো যার দাম এক পাউন্ডের একটু বেশি। ব্রিটিশ বা ইউরোপিয়ান এই লোকটি দোকান মালিককে ঠাট্টা করে বললো, এক পাউন্ড দিবে না। ওমনি দোকান মালিক রাজি হয়ে গেল। তবে লোকটাকে একটা কাগজে সাইন করতে বললো। বৃদ্ধ কোনও কিছু না পড়ে সাইন করে দুধ নিয়ে চলে গেল। এরপর ওয়াসি যখন সব নিয়ে কাউন্টারে পে করতে গেল, কাগজটা দেখলো। সেটি একটা স্মারকলিপি, যাতে খালেদা জিয়ার নিঃশর্ত মুক্তির দাবি জানানো আছে। খুব সম্ভবত এই কাগজটি ব্রিটিশ পার্লামেন্টের এমপিদের কাছে দিবে তারা। মালিকটা ওয়াসিকে চেনে। সে কিছু বলল না। এক স্প্যানিশ কর্মচারী আছে। কাজ করতে করতে সে বেশ ভালো সিলেটি ভাষা রপ্ত করেছে। সে ওয়াসিকে বললো, যদি ওয়াসি এই কাগজে একটা সাইন দেয় ভালো ডিসকাউন্ট দিবে তারা। ওয়াসি বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে বেশ অনাগ্রহী হওয়াতে সাইন দেয়নি।

কয়েক মাস আগে একদিন ওয়াসি গিয়েছিল বাজার করতে। দোকানে ছিল মালিকের ছোট ভাই। উনিও একটা স্মারকলিপিতে ওয়াসিকে সাইন করতে বলেছিল, যাতে অবিলম্বে তারেক জিয়াকে যুক্তরাজ্য থেকে বহিষ্কার করার আবেদন ছিল। যেটাতে ওয়াসি সাইন করেনি। আমাদের বাঙালিদের এত আবেগ কেন? এত আবেগ আর কোথাও মেলে না। দুই নেত্রীর কেউ একজন আসলে এয়ারপোর্ট, হোটেল আর যেসব জায়গায় নেত্রী অবস্থান করেন তার সামনে দুই পার্টি ভিড় জমায়। একদল তাকে স্বাগত জানায় আর বিরোধী দল ইংল্যান্ড ছেড়ে যাওয়ার জন্য স্লোগান দেয়। একবার স্থানীয় নিউজে দেখলাম, দুই দলের মারামারি লেগে গিয়েছে। পুলিশরা তাদের থামাচ্ছে আর হাসতে হাসতে শেষ হয়ে যাচ্ছে। আসলে এখানকার ক্ষমতাসীন দল আর বিরোধী দলের কর্মীদের মারামারি দেখে তো তেমন একটা অভ্যস্ত না তারা। ধরেন দেশে কোনও দল বিক্ষোভ সমাবেশ করেছে। এখানে সেটার সাপোর্টে একটা হালকা বিক্ষোভ হয় আর তার জন্য কোথা থেকে দুই একটা পুলিশ মনে হয় জোর করে এনে দাঁড় করায়া দেয় মিছিলের সামনে একটা বিক্ষোভের আমেজ আনার জন্য।

বালাগঞ্জ আওয়ামী লীগ যুক্তরাজ্য, জগন্নাথপুর বিএনপি যুক্তরাজ্য এমন অনেক খুব গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক শাখা দল আছে এই দেশে। দেশে মারামারি লাগলে তারাও মারামারি করে যেটাকে বলে প্রতীকী মারামারি। আবার এনটিভি ইউকে, এটিএন বাংলা ইউকে, চ্যানেল আই ইউকে আর দুই একটা বাংলা চ্যানেল খুব গুরুত্বের সাথে খবরগুলো দেয়। বড় আবেগী মন আমাদের। আমি তাদের দেশি বোন অথচ আমার এত কম আবেগ যে কেন! আমি না হয় নন সিলেটি, তাদের ডায়রেক্ট দেশি ভাইটার আবেগটাও চলে গিয়েছে আমার কাছে থাকতে থাকতে। কী আর করা!