বিনয়, জীবনানন্দ: পরোক্ষ অর্গাজমের ভ্রান্তিবিলাস

চয়ন খায়রুল হাবিব

প্রকাশিত : ডিসেম্বর ২৫, ২০১৭

প্রাককথন   
বিনয় মজুমদার জীবনানন্দের প্রধান ফসল শিরোনামে বন্ধু রিফাত চৌধুরী একটি দরকারি রচনা সদ্য প্রকাশ করেছে। শিরোনাম ও রচনার অন্তর্গত সিদ্ধান্তগুলোর সাথে একমত হবার পরেও আমার মনে হয়েছে, সংশ্লিষ্ট প্রস্তাবনাগুলোর সম্পূরক সম্প্রসারণ হতে পারে। রিফাতের প্রেমিস থেকে সে-সম্প্রসারণ যে সম্ভব নয়, সে-ডিস্কোর্সের আগে `পরোক্ষ অর্গাজম` শব্দ বন্ধনিটির ব্যাখ্যা দেয়া যাক: পরোক্ষ অর্গাসম  সোজা অর্থে প্রত্যক্ষ অর্গাজম নয়। এ পরোক্ষতা আসছে যৌন পরোক্ষতা থেকে, যা যৌন নিরপেক্ষতা বা অযৌন নয়। অর্গাজম কি বা তা কিভাবে হয় সেটার গ্রাফিক্স এ রচনার লক্ষ্য নয়, এটাকে এখানে ধরা হচ্ছে প্রতীকী মেটাফোর হিশেবে। একজনের অভিজ্ঞতা বা অভিব্যক্তি অনেক সময় প্রত্যক্ষ না হলেও নিবিড় বা গভীর হতে পারে। মগ্ন চেতনা প্রবাহের যে স্তরেই আমরা চিন্তামিথুনে লিপ্ত হই না কেন, তা আরেকটা চিন্তা বা আরেকটা অভিজ্ঞতার দেয়ালে বাড়ি খেয়ে আমাদের দিকে ফিরে আসে। যেরকম অর্গাজমও একজন নারী বা পুরুষ নিজে নিজে ঘটাতে পারে, আবার অন্যের সাথে মিলেও ঘটাতে পারে। পরোক্ষতা কারও বিচারবোধে অশ্লীল হলেও সেটা পরোক্ষ অশ্লীলতা। যৌন বিদ্বেষ থেকেও যৌন পরোক্ষতা আসছে না। এখানে যৌন শব্দটিকে যৌনায়ন বা সেকসুয়াল অরিয়েন্টেশান/জেন্ডার অরিয়েন্টেশান জায়গা মিলিয়ে দেখা যেতে পারে। যেসব সামাজিক, সাংস্কৃতিক কারণে নারী-পুরুষ উভয় লিঙ্গে পারস্পরিক বিদ্বেষ ঘটে থাকে, এ পরোক্ষতা তার সাথে সম্পর্কিত নয়। বরং জেন্ডারগত পারস্পরিক সম্ভ্রম এবং সাংস্কৃতিক সিমা সরহদ্দের মিশেল এ-পরোক্ষতার উদ্গাতা চলক। আমরা যখন সম্পর্ক, সম্বোধন, যৌনায়নে ব্যক্তির নাম যোগ করি তখন এ পরোক্ষতাকে প্রাথমিকভাবে সর্বনামমুক্ত করে যৌন প্রত্যক্ষতা বা পার্সোনিফিকেশানে আসা হয়। যৌনায়নের বা জেন্ডার অরিয়েন্টেশানের প্রত্যক্ষতার ক্ষেত্রে বৈবাহিক সম্পর্ক যে যথেষ্ট নয় এবং অনেক ক্ষেত্রে পুরোপুরি অন্তরায়, তা আমরা যাপনে এবং নান্দনিক রুপায়ণে বিভিন্নভাবে শুনেছি, পড়েছি, দেখেছি। আবার প্রতীক, উপমাগুলোকে নির্ভর করে এই পরোক্ষতাকে নান্দনিক রসায়নে, প্রায়োগিক যাপনে বিস্তার ঘটানো হয়।
 
ইমাকুলেট কন্সেপশান
দূর দেশে থেকেও মননের ঐকতানে যে একটি সময়খণ্ডের সতীর্থরা তাদের গোড়ার প্রবর্তনাগুলো ধরে রাখে, রিফাতের লেখাটি তার প্রমাণ। রিফাত য্যানো ঘুরেঘুরে ওর উৎস জলপ্রপাতে ফিরে যাচ্ছে। একই জলপ্রপাতে, একই জীবনানন্দে, একই বিনয়ে আমিও অবগাহন করি, ভিন্ন ম্যানারিজমে। তবে লক্ষ্য তো সেই একই! আমরা সকলে মিলে একটা লেখাতেই বিচিত্র দৃষ্টিকোণ যোগ করছি। রিফাত, ওর লেখাতে বিনয়ের অন্যতম সংগ্রহ ‘ফিরে এসো, চাকা’র  প্রশংসায় লিখেছে, `এই বইটার মধ্যে অন্যরকম একটা চিন্তা আছে, একটা দার্শনিকতা আছে। বিজ্ঞান ও মহা জাগতিক সত্য-মিথ্যা এই দুটিকে তিনি সাবলীল ভাবে তার কবিতায় স্থানান্তরিত করতে পেরেছিলেন একটি নারীর সীমাবদ্ধতায়।’
বিনয় উদযাপিত এ নারীর নাম গায়ত্রী চক্রবর্তি স্পিভাক। বিনয়ের প্রশংসায়, গায়ত্রীর প্রতি রিফাতের প্রশংসা আছে কি নাই, সেটা এখানে বিবেচ্য না। `নামে কি বা এসে যায়` জাতীয় নিরপেক্ষতায় বিনয় নিজেও যে বিশ্বস্ত, তা তার সর্বনামমুক্ত চাকা নামকরণে বোঝা যায়। আবার ভুট্টাকে যৌন প্রতীকে লক্ষ্যভেদিভাবে ব্যাবহার করেও বিনয় দেখিয়েছেন, যৌনায়নে সে জীবনানন্দিয়ভাবে পরোক্ষ বা আড়ালচারি নয়, আবার পুরোপুরি প্রত্যক্ষও নয়। আমি নিজে দীর্ঘ কবিতা লেখার আগে অনেকদিন ধরে ভাবনার সুতো পাকাই, ভাবনাটার ওপরে তা দিতে থাকি, ইঙ্কিউবেটার চিন্তাপদ্ধতি এড়িয়ে। `খুলিতত্ত্ব সিরিজে` শামসুর রাহমান, আবুল হাসান, সুরাইয়া খানম, সিলভিয়া প্লাথ, টেড হিউজের পাশে যখন বিনয়কেও নির্বাচন করি, তখন `পরোক্ষ বা আড়ালচারি নয়, আবার পুরোপুরি প্রত্যক্ষও নয়।` এই টুয়েলাইট রহস্যময়তা ধরতে মাথাতে প্রথম ঝলক দিয়ে ওঠে `ইমাকুলেট কনশেপশান` অর্থাৎ যেখানে যৌন সহবাস ছাড়াও গর্ভধারণ হচ্ছে, সন্তানের জন্ম হচ্ছে, যিশু যেভাবে জন্ম নিয়েছে। বিনয়ের যাপন, প্রণয়, নিবেদন, ধারণ, প্রতীক নির্বাচন, প্রকাশন সবকিছুতে এই `ইমাকুলেট কন্সেপশন` পেয়েছি। কিন্তু তাকে নিজস্ব রসায়নে জারণের বা পার্সোনিফিকেশানের জন্য আমার কবিতায় গায়ত্রী, বিনয় ও জীবনানন্দের একটি ত্রিভুজ মানষিক আবর্তন কল্পনা করে নেই, আর চেষ্টা করতে থাকি শব্দের সাথে অর্থের দাঙা না বাধিয়ে এই ত্রিভূজকে কবিতায় নিয়ে আসতে।

রঙিন জানালার কাচ, মার্ক শাগাল
প্রথমে উল্লেখ করেছিলাম যে, রিফাত যে প্রেমিস থেকে ওর লেখাটি শুরু করেছে তা দিয়ে এই প্রত্যক্ষ যৌনায়ন বা পার্সোনিফিকেশানে আসা সম্ভব না। এটা রিফাতের অপারগতা নয়, বরং অগ্রাধিকারের বিবেচনা। রিফাত শুরুতে লিখছে, গল্প-উপন্যাস পড়তে যে আমার কেবল ভাল লাগে তা নয়, এগুলো সম্পর্কে আমার মনে একটা বিরূপতা আছে। মানুষের স্বভাবের অপেক্ষাকৃত দুর্বল দিকগুলো তার কামনা-বাসনা, তার বিচিত্র মানসিক বিকার এইসবই গল্প উপন্যাসের প্রধান উপজীব্য। আর প্রেম। মনে হবে মানুষের জীবনে প্রেম-প্রণয় ছাড়া আর কোনও সমস্যা, অন্তত জরুরি সমস্যা নাই।
দুজন মহৎ কবির পারম্পর্য যখন তৃতীয় আরেকজন কবি কাটাছেড়া করে, তখন সজ্ঞা ও সঙ্গার সঙ্ঘাত অনিবার্য। এ সঙ্ঘাতে যে রিফাত সঙ্গার কৃত্রিমতায় না গিয়ে সজ্ঞার অন্তরংগতায় বিশ্বস্ত থেকেছে, তা আমাদের মননের উপকারে আসে। এই অন্তরংগতায় দাঁড়িয়ে রিফাত ওর লেখাটি যেখানে শেষ করছে, তা কিন্তু স্ববিরোধ নয়, বরং তার সময়খণ্ডের কেউ কেউ কোথায় বিনয়কে পিছে ফেলে এসেছে, তার দার্ঢ্যতাসূচক  স্মারক। বিনয় বিস্ময়ের দ্বারা ইনসুলেটেড। নারীর প্রত্যাখ্যাত প্রেমকে তিনি অধ্যাবদি অনুভবের বিষয় ভাবেন।......বোদলেয়ার একবার লিখেছিলেন, শিশুর দৃষ্টি অজ্ঞের দৃষ্টি, প্রতিভাবান জ্ঞানত সেই সরল দৃষ্টি লাভ করেন। এখন আমি নিশ্চিত নই বিনয় প্রজ্ঞান শব্দটিকে জড়িয়ে রয়েছেন কি না, কিন্ত তার কবিতায় করবী কুসুম ও প্রিয়া প্রতাড়িত প্রেমিকের দেখা মেলে।
রিফাত ওর লেখাটির স্বল্প পরিসরে বিনয়ের, জীবনানন্দের বিষয়, লোকন, পারম্পর্য নিয়ে আলোচনা করলেও তাদের লৈখিক সংগঠন বা ছান্দিক মাপন নিয়ে আলোকপাত করে নাই। কবিতার সমকালীন চর্চাকারী হিশেবে আমাদের জন্য জরুরি যেটা, তা হচ্ছে জীবনানন্দের পর বিনয় মজুমদার তার গাণিতিক নিতিক পাতনের অভিনবত্ব দিয়ে অক্ষরবৃত্ত ছন্দের প্রয়োগকে প্রায় অভেদ্য নান্দনিক প্রবর্তনায় দাঁড় করিয়ে ফেলেছিল, যার মোটা পাচিলে প্রথম, সফল ও প্রবর্তনাগত ফাটল ধরিয়ে দেয় বাংলাদেশে আশির দশকের ফৃ জেনারেশান।

ফৃ জেনারেশান
একটু পেছন দিকে না তাকালে বিনয়, জীবনানন্দ ছাড়াও আজকের আরও অনেক উপস্থাপনাকে মনে হবে আকাশবাণী। আজকে যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা সূত্র উল্লেখ না করে কপি, পেস্ট করছে তার কালচার একদিনে তৈরি হয় নাই। নারীবাদী অনেক লেখক যেভাবে লিখছে তাতে মনে হচ্ছে নারীবাদ ব্যাপারটা স্বপ্নে পাওয়া, বাংলা একাডেমিতে নিয়োগপ্রাপ্ত দলিয় রাজনীতিদুষ্ট কথিত গবেষকদের রোবোটিক প্রকাশনাগুলোকে মনে হচ্ছে আসমানি কিতাব। যে রোবোটের পাশে কায়েমি প্রকৌশল যত ভারি, তার অখাদ্য তত বেশি খাদ্যগুণ দাবি আদায় করে নিচ্ছে। তার ওপর আছে লালন, হাছনের অপব্যাখ্যাজাত আঞ্চলিকতার ঝাড়ফুক, পিরফকিরি ফন্দিফিকির। দ্বিভাষিক দুর্বলতার সুযোগে বিদেশি মনিষাদের দেখিয়ে প্রতিমার বেদি ভাঙার তোড়জোড়! অনেকে চে গুয়েভারার তকমা এঁটে ঘাপ্টি মেরে থেকে, এর ওর কাছে ঘুরে, এর ওর নামে লাগিয়ে করে খাচ্ছে।একটি প্রজন্ম একটি প্রবাল দ্বীপের মতো, সময় নিয়ে তৈরি হয়। আজকে অনেক জায়গা থেকে থেকে ইচ্ছা করে আশির, নব্বইর প্রজন্মগত ন্যারেটিভগুলো লোপাট করে দেয়া হচ্ছে, পরের প্রজন্মগুলোর পরিচয় সঙ্কটকে আড়াল করতে এবং আরো প্রকট করে তুলতে। কবিতাঙ্গনে ফৃ জেনারেশানের ঠিকুজি, কুলুজি ধরিয়ে ঘুরপথে আবার জীবনানন্দে, বিনয়ে ফেরত যাচ্ছি। কবিতাকে হাই আর্ট বলা হয় এ কারণে যে, এর কোনও শর্টকাট নেই!
১৯৯৫ সালে প্রকাশিত ফৃ স্ট্রীট স্কুল সাহিত্য পত্রটির প্রথম সংখ্যার মুদ্রাকর পঙ্‌ক্তির দিকে তাকানো যাক। পাওয়া যাচ্ছে, সম্পাদক, কাজল শাহনেওয়াজ। প্রচ্ছদ, রোকন রহমান। কম্প্যুটার সহায়তা, লুৎফর রহমান। প্রকাশক, ঋনা শাহনেওয়াজ। সূচিপত্রে গদ্য রচনায় পাওয়া যাচ্ছে, কাজল শাহনেওয়াজ, খায়রুল হাবীব, রোকন রহমান, সরকার মাসুদ, রিফাত চৌধুরী। কবিতা অংশে পাওয়া যাচ্ছে, আহমদ মুজিব, মাহবুব কবির, শশী হক, অমিতাভ পাল, সরকার মাসুদ, খায়রুল হাবীব, কাজল শাহনেওয়াজ। কাজলের গদ্যটির শিরোনাম এক পশলা খোলা বাতাস । খায়রুলের গদ্যটির নাম অনামি সৃজনশীলতার মেনিফেস্টো ৯৫। রোকনের গদ্যটির নাম মেঘের জার্নাল। সরকারের গদ্যটির নাম কবি জীবন, অকবিজন্ম। রিফাতের গদ্যটির নাম আমার কথারা।
কাজল ওর গদ্যে ঘোষণা দিচ্ছে যে, আশি, নব্বই দশকের তরুণদের হাতে বাংলা কবিতার ভাষা ও বিষয়ের বড় ধরনের দিক বদল ঘটেছে, একই রচনাতে কাজল রিফাতের কবিতার ক্রমশ দুরুহতা থেকে যোগাযোগপ্রবণ হবার ধাপগুলোর সংক্ষিপ্ত ফিরিস্তি দিয়েছে। সর্বকনিষ্ঠ খায়রুলের মেনিফেস্টোতে সামগ্রিক সাহিত্য ও সামাজিক অবস্থার সাইকাডেলিক হালচাল, নির্দেশনার সাথে কাজল ও আহমদ মুজিবের কবিতার সংক্ষিপ্ত আলোচনা। রোকন তার রচনায় অনেক কিছুর সাথে ব্যস্ত থেকেছে ফরাসি কবি হ্র্যাবোর নাম খ্র্যাম্বো না হ্র্যাবো তা নিয়ে। সময় মিলিয়ে বোঝা যায়, রোকনের আলোচনাটি ঢাবির আধুনিক ভাষা ইন্সটিটিউটের ফরাসি শিক্ষক শিশির ভট্টদের উদ্দেশ্যে নিক্ষিপ্ত, তবে রোকন কোনও নাম নিতে পারে নাই। সরকারের রচনাটি মূলত তাকে ঐ নির্দিষ্ট সাহিত্যপত্রে  সুজোগ করে দেবার জন্য সম্পাদককে ধন্যবাদ জ্ঞাপন। রিফাতের লেখাটি সার্বিকভাবে ওর আত্মতাচিহ্নিত আত্মসাক্ষাতকার, বয়সে সবার বড় হওয়াতে নিশ্চিতভাবে অনেকদিন ধরে ওর অনেক কথা জমে গিয়েছিল। রিফাতের লেখা, কাজলের সম্পাদকীও এবং আমার ম্যানিফেস্টোতে পারস্পরিকভাবে উঠে এসেছিলো নাগরিক অভিজ্ঞতাজারিত মানষিক ও পাঠ প্রস্তুতির আনঅর্থোডক্স সারাৎসার। যে সারাৎসায়নে সাজানো, নিশ্চিত বাগান, বাসাবাড়ির পাশে আগোছালো রাস্তার অনিশ্চিত যাপন, বস্তির বিনোদন, মাস্তিকে আলাদা না রেখে একটা কস্মোপলিটান আদিবাসের অবকাঠামোগত হৃদস্পন্দন তৈরি করা হয়।
ফৃ সন্নিহিত খায়রুল হাবীব বর্তমানের চয়ন খায়রুল হাবিব, তার অবর্তমানে প্রমাদবশত হাবিবে ঈকার যুক্ত হয়। অবশ্য এরই মধ্যে চয়ন নিরুদ্দিষ্ট, মেনিফেস্টোটি সে কাজলের হাতে তুলে দিয়েছিল ৯০ বা ৯৩ সালে, তারপর ২০০৭ অব্দি সে নিরুদ্দিষ্ট। ফৃ সাহিত্যপত্রের ফৃ নামটি থেকে বানান, বিষয়, দার্শনিক ইক্ষণে, মুদ্রণের প্রক্ষেপনে নান্দনিক প্রবর্তনার বিচিত্রগামী, বহুসচল, সাহসী সংস্কারের আভাস মেলে। আবার ফৃ`র পর স্ট্রীটটা কেমন য্যানো খাপে খাপ হয় না। সংস্কার ও প্রবর্তনার দিক থেকে যে ফৃ মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল, তার বড় প্রমাণ মেলে ফৃ ব্র্যান্ডে সিলগালাসমেত গ্রন্থিকা বের করতে পরের দশকের কবিদের কাজলের কাছে ধর্না দেবার আয়োজনে! ফৃ মেনিফেস্টো সঙ্খ্যাতে কবিতার শিরোনাম যথাক্রমে, প্রেমের কবিতা, আহমদ মুজিব। হত্যামুখরিত দিন ও অন্যান্য, মাহবুব কবির। নিয়তি অধ্যায়ের কাছে দাঁড়িয়ে, শশী হক। প্রসাধন ও অন্যান্য, অমিতাভ পাল। ডাকবাক্সের কবিতা ও অন্যান্য, সরকার মাসুদ। উল্লাশ পীরের মজমা, খায়রুল হাবীব। কোয়াইচিং ও অন্যান্য, কাজল শাহনেওয়াজ। স্মর্তব্য যে, ফৃ জেনারেশানের প্রবর্তণামূলক কবিতাধারার এখনো সক্রিয় নবায়ণ ঘটছে। যে সামাজিক, সাংস্কৃতিক পরিবেশগত চাপের মুখোমুখি এ কবিতাধারাকে এগোতে হয়েছে তাও দ্রষ্টব্য। পুরো আশির দশকজুড়ে সামরিক স্বৈরতন্ত্র যখন বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অঙ্গনে রিতিমত কেনাবেচা শুরু করে দেয়, তার প্রতিক্রিয়াতে স্বৈরতন্ত্রের পক্ষে, বিপক্ষে যেসব কবিতা সংগঠন তৈরি হয় তাদের এক পক্ষ্য যেরকম জোর করে উদ্দেশ্য-নিরপেক্ষ থাকতে চেয়েছে স্বৈরতন্ত্রের প্রতি পক্ষপাত ধামাচাপা দিতে, সেরকম আরেক পক্ষ চলে গেছে একমাত্রিক চিতকৃত স্লোগানে, যেখানে কবিতা মাত্রেই হয় গালাগাল নয় ছড়ার ছন্দে আদিরসে পর্যবসিত, এই দুই পক্ষের মিশেল হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে মিডিয়া ও বিজ্ঞাপনী সংস্থার দিকে। কোনও পক্ষের হাতেই কবিতার নান্দনিক এবং যাপিত শর্তগুলো আদায় হতে পারে নাই। এই গাদাগাদির ট্রেনে যখন নব্বই ও শূন্য দশকে ভাষিক প্রতিক্রিয়াশীলতা যোগ হয়েছে মৌলবাদী ফোক সংস্কৃতিকে ভর করে, তখন তার শিকার হয়েছে দুর্বল মিডিয়া ও সাইবার জেনারেশান, একে একে এসেছে নাস্তিক, আস্তিক বিতর্ক, ব্লগার হত্যার মত নারকিয় ঘটনা। নান্দনিকতার শর্ত আদায়, ভাষাপ্রমিতের সময়পযোগি নবায়ণ কোনও ক্যাম্পেই আর অগ্রাধিকার পায়নি।
শহীদুল্লাহ কায়ষার, জহির রায়হান, শহিদ সাবের, শাহেদ আলি, জাহানারা ইমামদের হাতে বিবর্তিত বাংলাদেশের একান্ত ভাষাপ্রমিতগত ধারাবাহিকতায় যারা বিশ্বস্ত থেকেছে, তারা অবশ্যই ধন্যবাদার্হ। সে ধারাবাহিকতায় বিনয় ও জীবনানন্দকে আমাদের দৈনন্দিন নান্দনিকতায় হেতুবদ্ধ, সেতুবদ্ধ করাটা দরকারি বৈ কি। কিন্তু কিসের সাথে হেতু ও সেতুবদ্ধ করবো, তা জানতে প্রশ্ন তোলা যেতে পারে, ফৃ জেনারেশানের অর্জন কি? চড়াদাগে কবিতাঙ্গনে ফৃ জেনারেশানের অর্জন ও অনুসরণ বাংলা ভাষাকে হেচকা টানে প্রিটেনশানের বাইরে নিয়ে আসার কারণে। আর সূক্ষ্মদাগের অর্জন হচ্ছে চাপানো মেদগুলোর স্তরকে চিহ্নিত করে, কবিতার ভেতরগত আবেদনের নান্দনিক শর্ত আদায়ের পরেও বাইরের খোলতাইকে নির্মেদ করে ফেলা।