বিপ্লবী ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তীর আজ মৃত্যুবার্ষিকী

স্মরণ

ওমর সাঈদ

প্রকাশিত : আগস্ট ০৯, ২০১৮

বিপ্লবী ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তীর আজ মৃত্যুবার্ষিকী। দেশমাতৃকার মুক্তির জন্যে প্রায় সারা জীবনই তিনি সংগ্রাম করে গেছেন। জীবনের বেশিরভাগ সময় তার কেটেছে জেলখানায়। গণমানুষের মুক্তির দূত ত্রৈলোক্যনাথের মৃত্যুবার্ষিকীতে তাকে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা।

বৃহত্তর ময়মনসিংহের কিশোরগঞ্জ জেলার কুলিয়ারচর উপজেলার কাপাসাটিয়া গ্রামে ১৮৮৯ সালের মে মাসে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম দূর্গাচরণ চক্রবর্তী। ১৯০৫ সালে ত্রৈলোক্যনাথ বছরখানেক ধলা হাইস্কুলের ছাত্র ছিলেন। ১৯০৬ সালে স্বদেশি আন্দোলনের সময় তার অনুজ চন্দ্রমোহন চক্রবর্তী তাকে সাটিরপাড়া হাইস্কুলে ভর্তি করে দেন। সেসময় সাটিরপাড়া স্কুলে দুজন শিক্ষক ছিলেন মহিম চন্দ্র নন্দী ও শীতল চক্রবর্তী।

বর্ণবাদের বিরুদ্ধে লড়াই-সংগ্রাম ও আন্দোলন করার কারণে ২৭ বছর জেলখানায় বসবাস করে দক্ষিণ আফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গ নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা পৃথিবীর সব মানুষের হৃদয় কেড়ে নিয়েছিলেন। অথচ ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন করে ৩৪ বছর জেলখানায় জীবন অতিবাহিত করেন ময়মনসিংহের এই ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী (মহারাজ চক্রবর্তী)। অথচ তার নাম আজ অনেকের কাছেই বিস্মৃত।

১৯৬৭ সালে তার লিখিত গ্রন্থ `জেলে তিরিশ বছর ও পাক-ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম` প্রকাশিত হয়। এ বইয়ের ভূমিকায় তিনি লিখেছিলেন, `পৃথিবীতে সম্ভবত আমিই রাজনৈতিক আন্দোলন করার কারণে সর্বাধিক সময় জেলখানায় অতিবাহিত করেছি। মাঝখানে দু-এক মাস বিরতি ছাড়া আমি টানা ৩০ বছর জেলখানায় কাটিয়েছি।` তার জেল জীবনের কিছুটা বর্ণনা নিচে তুলে ধরা হলো:

প্রবেশিকা পরীক্ষার ঠিক আগে ১৯০৮ সালে বিপ্লবী কাজের জন্য গ্রেফতার হলে প্রথাগত শিক্ষার ইতি হয়। ১৯০৬ সালে অনুশীলন সমিতিতে যোগ দিই। জাতীয়ভাবে অনুপ্রাণিত হয়ে ব্যায়াম প্রতিষ্ঠান গঠন করে নিজ জেলায় বিপ্লবী ঘাঁটি তৈরি করতে থাকেন। ১৯০৯ সালে ঢাকায় আসেন এবং ঢাকা ষড়যন্ত্র মামলায় পুলিশ তার সন্ধান শুরু করলে আত্মগোপন করেন। এ সময়ে আগরতলায় উদয়পুর পাহাড় অঞ্চলে গিয়ে ঘাঁটি তৈরি করেন। ১৯১২ সালে গ্রেফতার হন। পুলিশ একটি হত্যা মামলায় তাকে জড়ালেও প্রমাণের অভাবে মুক্তি পান।

১৯১৩-১৪ সালে মালদহ, রাজশাহী ও কুমিল্লায় ঘুরে গুপ্ত ঘাঁটি গড়তে থাকেন। ১৯১৪ সালে পুলিশ তাকে কলকাতায় গ্রেফতার করে বরিশাল ষড়যন্ত্র মামলার আসামি হিসেবে আন্দামানে পাঠায়। ১৯২৪ সালে মুক্তি পেয়ে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের পরামর্শে দক্ষিণ কলকাতা জাতীয় বিদ্যালয়ের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯২৭ সালে পুনরায় গ্রেফতার হয়ে বার্মার মান্দালয় জেলে প্রেরিত হন। ১৯২৮ সালে তাকে ভারতে এনে নোয়াখালীর হাতিয়া দ্বীপে অন্তরীণ করে রাখা হয়। ওই বছরই মুক্তি পেয়ে উত্তর ভারতে যান এবং চন্দ্রশেখর আজাদ প্রমুখের সঙ্গে হিন্দুস্তান রিপাবলিকান আর্মিতে যোগ দেন। পরে বিপ্লবী দলের আদেশে বার্মার বিপ্লবীদের সঙ্গে যোগাযোগের উদ্দেশ্যে বার্মায় যান।

১৯২৯ সালে লাহোর কংগ্রেসে যোগ দেন। ১৯৩০ সালে আবারও গ্রেফতার হযন। মুক্তি পান ১৯৩৮ সালে। তিনি সেই বছরেই সুভাষচন্দ্র বসুর সঙ্গে যোগাযোগ করে রামগড় কংগ্রেসে যোগ দেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সিপাহি বিদ্রোহ ঘটাবার চেষ্টায় ভারতীয় সৈন্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করলেও সুবিধা করতে পারেননি। এ সময়ে চট্টগ্রামে গ্রেফতার হন। ১৯৪২ সালে ভারত ছাড়ো আন্দোলনে যোগ দিয়ে গ্রেফতার হন এবং ১৯৪৬ সালে মুক্তি পান।

তিনি তার `জেলে ত্রিশ বছর ও পাক ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম` পুস্তকটির ভূমিকায় আরও লিখেছেন: `আমি ১৯০৮ সন হইতে ১৯৪৬ সন পর্যন্ত ৩০ বৎসর কারাগারে কাটাইয়াছি। ৪-৫ বৎসর অজ্ঞাতবাসে কাটাইয়াছি। ...জেলখানার পেনাল কোডে যেসব শাস্তির কথা লেখা আছে এবং যেসব শাস্তির কথা লেখা নাই তাহার প্রায় সব সাজাই ভোগ করিয়াছি।’ তার এই লেখা থেকে পরিষ্কারভাবে বোঝা যায় যে, তিনি দেশের স্বাধীনতার জন্য কতটা বিপ্লবী এবং বিপ্লবী মনোভাবের ছিলেন।

১৯৪৭ সালে ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের পর তিনি পূর্ব পাকিস্তানের নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন। স্বাধীনতার পর তিনি ঢাকার রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী হিসেবে পূর্ব পাকিস্তান পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন জারি ও শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ার পর তিনি রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়ান। সামরিক শাসন জারির পর সামরিক জান্তা তার নির্বাচন বাতিল, রাজনৈতিক এমনকি সামাজিক কার্যকলাপেও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে।

এরপর ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী নিজ গ্রাম ময়মনসিংহের কাপাসাটিয়ায় চলে যান এবং সেখানে বসবাস করেন। ১৯৭০ সালে চিকিৎসার জন্য ভারতে যাওয়ার পর ওই বছর ৯ অগাস্ট বিপ্লবী মহারাজ ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী মৃত্যুবরণ করেন। দেশ ও মানুষের মুক্তির লক্ষ্যে কাজ করার জন্য তিনি চিরকুমার ছিলেন। ব্রিটিশ শাসনের কবল থেকে দেশকে মুক্ত করার জন্য তিনি সারা জীবন বিপ্লবী কর্মযজ্ঞে নিয়েজিত ছিলেন। অনুশীলন দলের সঙ্গে তিনি শৈশবে যুক্ত হয়ে পড়েন। ক্ষমতালাভ বা কোনো প্রকার ব্যক্তি স্বার্থের ধ্যান-ধারণা তার মধ্যে ছিল না। আদর্শের রাজনীতি বাস্তবায়নের জন্য কীভাবে লড়াই করতে হয় তার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তিনি।