সংগৃহিত

সংগৃহিত

বুদ্ধিজীবী: দাস, ভিখিরি নাকি দায় এড়ানো

ফিরোজ আহমেদ

প্রকাশিত : এপ্রিল ১২, ২০১৮

এই বিষয়টা কি আমাদের বুদ্ধিজীবীদের ঔপনিবেশিক দাস মনের প্রতিফলন? কবি-সাহিত্যিক-অনুবাদক-সাংবাদিকদের বড় অংশ সংগ্রাম বলেন, বিপ্লব বলেন, সব কিছুতে্ তাদের আদর্শস্থানীয় দক্ষিাণ আমেরিকা মহাদেশ। কত বড় বড় নাম কত বড় ধাম! বড়জোর পশ্চিমবঙ্গের কী ত্রিপুরার সিপিএম নিয়েও তারা কেউ কেউ চিন্তিত। দেশে কিন্তু তারা খাঁটি আওয়ামী প্রাণী। চাকরির সমান অধিকার নিয়ে ছেলেমেয়েদের বাঁধভাঙা আন্দোলন তাই তাদের কাছে মধ্যবিত্ত পেটিবুর্জোয়া সুবিধাবাদ, কিংবা: হুম, জানি না আবার, কত ষড়যন্ত্র চক্রান্তের জাল চারিদিকে ছড়ানো... এদের মাঝে মধুর ক্যানটিনে আমার যে স্নেহের বড় ভাইয়ের লেখায় পয়লা `মায়োকার্ডিয়া` শব্দটা শিখছিলাম ৯৬ সালে, ভুলেও গেছি শব্দটার মানে, খালি মনে আছে কার্ডিয়াক অ্যারেস্টের সাথে এই প্রয়োগের কোনও সম্পর্ক নাই। এইবার দেখলাম, শিক্ষার্থীরা প্রচুর `চ বর্গীয় শব্দ` ব্যবহার করেছে বলে তিনি সরকারের অবস্থানের যৌক্তিকতা খুঁজে পেয়েছেন। রীতিমত ভূয়া একটা ছবি তিনি ব্যবহার করেছেন যেখানে দুই নারী শিক্ষার্থীর হাতের কাগজে `ভদ্রনারী ও পুরুষের কানে` অশ্লীল শোনা যাবে এমন দুটো চরম সত্যি কথা লেখা ছিল। অধ্যাপক গীতি আরা নাসরিন তো এই দেখে `কী করিয়া ভুয়া ছবি চিনিবেন` শীর্ষক একটা পাঠশালা খুলে বসলেন, তখন মনে হলো, জাতির শিক্ষার এই পথ। ভুল করে আর ভুল চিনিয়ে দিয়ে। শিক্ষকরা এই জন্যই মহান। পরে কিন্তু মনে হলো, গীতি আপার এই শিক্ষাদান প্রচেষ্টা সফল নাও হতে পারে। কেননা ছবিটা যদি সত্যিও হতো, এই `মায়োকার্ডিয়াক` নরম-কোমল ভাষার সাংবাদিক ভাইয়া যে উদ্দেশ্যে ছবিটা সামাজিক গণমাধ্যমে দিয়েছেন, তা তো আসলে প্রবল পুরুষতান্ত্রিক। একদিকে আন্দোলনকে জামায়াত-শিবির বলে আওয়ামী প্রচারণা চালিয়ে যাওয়া, আরেকদিকে দেখো দেখো, `মেয়েগুলা কত্ত খারাপ, আন্দোলনে এসে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে` বলে জনগণকে আন্দোলনের প্রতি বিরূপ করার মনোবৃত্তিই তো এতে প্রকাশিত। ফলে ছবিটা ভূয়া না সত্যি, কি আসে যায়!

খানিক পরই দেখা পেলাম, এই সামাজিক গণমাধ্যমেই, আমাদের ৯০ এর আরেক সুহৃদ, এর ডাক নাম বলা যায়, রিপনের। অতটা মায়োকার্ডিয়াক ছিল না রিপন, দিব্যি গালিগালাজ করতো, আরও নানা দুষ্টামির সাথে তার জড়িত থাকার কাহিনি আছে। নিজে এখন গণমাধ্যমে চাকরি করলেও কল্পনা করতে পারি, কল্পনার দায় একান্তই আমার, এবারের পরিস্থিতিতে বহু গণমাধ্যম কর্মীর সাথে মস্করা করার বিচিত্র বুদ্ধি সে বের করে ফেলতো তখনকার দিনে হলে, `সব স্বাভাবিক হয়ে আসছে` সম্প্রচার করা সাংবাদিকটির সাথে। দায়িত্বশীল রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে আমি নিজে তার মতো সৃজনশীলদের থামাবারও হয়তো চেষ্টা নিশ্চয়ই করতাম, হয়তো বকাই দিতাম। কিন্তু সত্যি বলতে কী, মৃদুভাষী মুচকি হাসা খাচড়া কথা বলা শয়তান রিপনই মায়োকার্ডিয়াক ভদ্রলোকের চেয়ে সর্বদাই বেশি আকর্ষণ করতো।

তো রিপন দেখি লিখছে, নিজের ভাষায় সংক্ষেপে বললে, আরে তোমরাই না এত ইলিয়াস ইলিয়াস করো, জনগণের ভাষা নিয়ে এত আদিখ্যেতা, নিজের কানে যখন তার প্রকাশটা দেখলা, তখন দাবির চেয়ে ভাষার শালীনতা বড় হইলো! ইলিয়াস তো প্রয়াত, জহীরও। সারা দুনিয়ার পাশাপাশি তাহলে কিন্তু দেশি প্রয়াত সাহিত্যিকটিও চলবে, কিন্তু পাশের ক্ষুধার্ত তারুণ্যের দাবিটিতে এরার ডর। আর যার কাছে পয়লা মেহিকো কী আর্হেহিন্তার উচ্চারণ শুনেছিলাম, তিনি দেখলাম লিখেছেন, এরপর ছাত্ররা বিনা পরীক্ষায় চাকরির দাবি করবে নিশ্চয়ই! আর্জেন্টিনা আর মেক্সিকোর উচ্চারণ যতই আমরা আমজনতা ভুল জানি, নেরুদা কি কার্পেন্টিয়ের যে এই আন্দোলনকে ভালোবাসতেন, সেটুকু জানি। আরে, (ভুল উচ্চারণে) মার্কেজের তো একটা উপন্যাসের শেষ শব্দ: `গু`! কত ভুলত্রুটি সীমাবদ্ধতার নিন্দাসহ `শত বছরের নিঃসঙ্গতা`য় সংগ্রামকে তিনি ভালোবেসেছেন বলেই তো তিনি মহান হলেন। বটেই, তলস্তয় যেমন লিখেছিলেন, বিমূর্ত মানবজাতিতে ভালোবাসা বরং অনেক সোজা। কঠিন হলো ভুলত্রুটিসহ পাশের জলজ্যান্ত মানুষগুলার দায়িত্ব নেয়ার চেষ্টা করা। ফলে আমি দ্বিধায় আছি, কেন তারা এই আন্দোলনটাকে ভালোবাসতে পারেন না?

তিনটি কারণ থাকতে পারে। উপনিবেশিক মনের দাসত্ব, যা নিজের দেশে মহান কিছুর অর্জনকে স্বীকার করতে চায় না। বুদ্ধিজীবীর সুবিধাবাদী বিমূর্ত ভালোবাসা, যা বাস্তবের ঝুঁকি নিতে চায় না, দায়িত্ব এড়াতে চায়? নাকি পুরস্কার-তিরস্কার, যদি মেলে গরম হাতের স্পর্শ, ক্ষমতার, তবে একটি পয়সা যদি পাওয়া যায় আরো— তা হলে ঢেঁকির চাল হবে কলে ছাটা।

লেখক: গবেষক, রাজনীতিবিদ