বুলবুল চৌধুরীর সাক্ষাৎকার

প্রকাশিত : আগস্ট ২১, ২০১৮

সত্তর দশকে বুলবুল চৌধুরী’র ‘টুকা কাহিনী’ নামক গল্পটি প্রকাশ পাওয়ার পর সবার দৃষ্টি পড়েছিল এই নতুন লেখকের দিকে। শুরুতেই প্রতিশ্র“ত নয়, পূর্ণ প্রতিষ্ঠিত গল্পকার হিসেবে আবির্ভূত হন। নগরের নানা রেখা-উপরেখা ছুঁয়ে গেলেও গ্রামীণ অভিজ্ঞতায় তার প্রধান অবলম্বন খোলা চোখে প্রবহমান জীবন দেখা। সেই জীবনের ভেতর দিয়ে বুলবুল চৌধরী ঢুকে পড়েছেন মানুষের অন্দর মহলে। প্রাণস্পর্শী দরদ দিয়ে তাদের তিনি বিন্যস্ত করেছেন সাহিত্যে। কথাসাহিত্যে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ‘কহকামিনী’ নামে উপন্যাসের জন্য পেয়েছেন হুমায়ুন কাদির স্মৃতি পুরস্কার। ২০১১ সালে কথাসাহিত্যের জন্য পেয়েছেন বাংলা একাডেমি পুরস্কার। ২০১৩ সালে ‘এই ঘরে লক্ষ্মী থাকে’ নামক উপন্যাসের জন্য পেয়েছেন ব্র্যাক ব্যাংক ও সমকাল সাহিত্য পুরস্কার। তাঁর প্রকাশিত ছোট গল্পগ্রন্থগুলো হলো ‘টুকা কাহিনী’, ‘পরমানুষ’, ‘মাছের রাত’ ও ‘চৈতার বউ গো’। উপন্যাস ‘অপরূপ বিল ঝিল নদী’, ‘কহকামিনী’, ‘তিয়াসের লেখন’, ‘অচিনে আঁচড়ি’, ‘মরম বাখানি’, ‘এই ঘরে লক্ষ্মী থাকে’, ‘ইতু বৌদির ঘর’ এবং ‘দখিনা বাও’। আত্মজৈবনিক দুটি হল ‘আঁকিবুঁকি’ ও ‘অতলের কথকথা’। তাছাড়া ‘গাঁওগেরামের গল্পগাথা’, ‘নেজাম ডাকাতের পালা’, ‘ভালো ভূত আর প্রাচীনগীতিকার গল্প’ নামক কিশোর গ্রন্থের রচয়িতাও তিনি। জনপ্রিয় এ কথাসাহিত্যিক ১৯৪৮ সালের ১৬ আগস্ট গাজীপুরের দক্ষিণবাগ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। এ সময়ের কথাসাহিত্য ও লেখালেখি নিয়ে তার সঙ্গে কথা বলেছেন মাহফুজ।

 

 

মাহফুজ: আপনার বিখ্যাত গল্প ‘টুকা কাহিনী’ আমি পড়েছি। আমি আমার মতো বুঝেছি…। গল্পটি নিয়ে লেখকের মূল্যায়ন জানতে চাই।

বুলবুল চৌধুরী: আমার যে কোনো লেখা কোনো না কোনো সত্য ঘটনা অবলম্বনে রচিত। বাস্তবে টুকাকে আমি যেমনটা দেখেছি, তেমনটা আঁকবার প্রয়াস পেয়েছি ‘টুকা কাহিনী’তে। তবে সাহিত্যে হুবহু বাস্তবের রূপায়ন নয়, তাতে কল্পনা ও রহস্যের মিশ্রণ ঘটানো চাই। আমার এ গল্প সেই দাবি কিয়দাংশে পূরণ করতে পেরেছে।

 

মাহফুজ: বর্তমানে লেখালেখির কোন বিষয় নিয়ে কাজ করছেন?

বুলবুল: আমার ছেলেবেলার অনেকরকম কথন নিয়ে লিখছি ‘মেঘমেদুর ছেলেবেলা’ একখানা কিশোর রচনা। পাশাপাশি হাত দিয়েছি ‘দক্ষিণাবহের রাত’ নামক একখানা উপন্যাসে। অতীতের এক যোদ্ধা পরিবারের তিন পুরুষের জটিল কিছু চালচিত্র অবলম্বিত হয়েছে। তবে আবার বলতেই হয় মানব-মানবীর প্রেমই জয় লাভ করেছে।

 

মাহফুজ: ইদানীং যারা গল্প লিখছেন তাদের গল্পের বিষয়, প্রকরণ ও ভাষা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার বিষয়টি আপনি কিভাবে দেখছেন?

বুলবুল: গল্পের বিষয়বস্তুর নানা জায়গায় পা পড়েছে। শিল্পরূপ ও পরিপূর্ণতা কমে যাওয়ায় ভূমি ও মানুষের মনোলোকে স্থান করতে সক্ষম হচ্ছে না। পঞ্চাশ, ষাট, সত্তরের গল্পের দাপটই মূলত এখনও অব্যাহত আছে। এ সময়ে রচিত কিছু গল্প আন্তর্জাতিক চিরায়ত সাহিত্যের কাতারে স্থান পেয়েছে।

 

মাহফুজ: সত্তর পরিবর্তী সময়ে আপনাকে সাহিত্যচর্চায় নিয়মিত হতে দেখা যায়নি- এর কারণ কী?

বুলবুল: পেশাগত কারণে আমি কোথাও স্থির হতে পারিনি। আমার জীবনে ৩০টিরও বেশি চাকরি বদল করেছি। জোনাকি, ঝিনুক, নিপুণ, রোমাঞ্চ, চিত্রকল্প এসব বিনোদন পত্রিকায় সাংবাদিকতা করেছি। সিনেমার পরিচালক হওয়ার স্বপ্নে ১৯৭৪ সালে সরকারি চাকরি ছেড়ে দিয়েছি।

 

মাহফুজ: সাহিত্যের বর্তমান অবস্থা এবং সাহিত্য নিয়ে আপনার ভাবনা সম্পর্কে যদি কিছু বলেন?

বুলবুল: আমরা একটা অস্থির সময় থেকে বেড় হয়ে আসতে পারছি না। তাছাড়া এই নগরজীবনও সাহিত্য রচনায় বিরূপ প্রভাব ফেলছে। তবে এখন একটা চর্চা অব্যাহত আছে, আর ভালো মানের লেখা দেরিতেই আসে। অবশ্য সব লেখকেরই একটা বন্ধ্যাকাল কাটে।

 

মাহফুজ: পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্যের সঙ্গে আমাদের মৌলিক পার্থক্য কী?

বুলবুল: ওখানেও বাংলা এখানেও বাংলা। কিন্তু সাহিত্য নির্মাণে দু’রকম গন্ধ আছে, দুটোর আঙ্গিক দু’রকম, দুটোই স্বতন্ত্র। মেলাতে পারবেন না। হুমায়ূন আহমেদ-ইমদাদুল হক মিলনের সাহিত্য যেমন মেলাতে পারবেন। পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে আমাদেরটা মিলবে না। তাদের সঙ্গে আমাদের সীমানাটা হয়ত এই দূরত্ব এনে দিয়েছে। আর সাহিত্য রচনার সময়টা তারা বেশি পেয়েছে আমাদের তুলনায়, বিধায় তাদের সম্পদের পরিমাণ বেশি হবে। তবে আমাদের সাহিত্যকর্ম শ্রেষ্ঠত্বের দিকে যাচ্ছে, আরও সমৃদ্ধ হবে।

 

মাহফুজ: অতীতে পুরান ঢাকায় বিউটি বোডিংয়ে দেশের অনেক লেখক কবি জড়ো হতেন। আপনিও যেতেন সেখানে। কেমন ছিল সেই পরিবেশ?

বুলবুল: আমার বন্ধু কায়েস আহম্মেদের আমন্ত্রণে ১৯৭৭ সালের কোনো মাসের আমি বিউটি বোডিংয়ে গিয়েছিলাম। তাকে দেখে দেখে এবং কখনও-সখনও তার অনুপ্রেরণা লেখক হওয়ার স্বাদ পেয়ে গেছে বটে। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে অমনটা ফলাতে পারিনি। এখানে ঢুকে একে একে পেয়েছিলাম অনেক নবীন-প্রবীণ লেখকদের সান্নিধ্য। চা-নাশতা চলার পাশাপাশি তাদের মুখে উঠতো হাজারো কথা, প্রতিদিন কেউ না কেউ নিজের লেখা পাঠ করে শোনাতেন। তবে বিউটি বোডিং আড্ডায় পাওয়া কবি আবুল হাসান হয়েছিলেন আমার অধিকাংশ সময়ের সঙ্গী। মূলত তার অনুরোধে প্রথম কাগজে-কলমে দাগ বসিয়েছিলাম, লিখে ফেলেছিলাম ‘জোনাকি ও সন্নিকট কেন্দ্র’ নামক একখানা ছোট গল্প।

 

মাহফুজ: সাহিত্যের জন্য আড্ডা কতটুকু জরুরি?

বুলবুল: একটা সময়ে শুধু বিউটি বোডিংয়ে নয়, সাহিত্যিকদের আড্ডা জমতো নবাবপুরে আমজাদিয়া হোটেল এবং নিউমার্কেটে একটা রেস্টুরেন্টে। আমার যাতায়াত ছিল সে সব জায়গায়। আমি এখনও ধ্রুব এষের বাসায় জমে ওঠা শিল্পী সাহিত্যিকদের আড্ডায় ছুটে যাই। নিজেকে দিয়ে বুুঝি এই মেলামেশার ভেতরে পড়ে আছে অনুপ্রেরণা।

 

মাহফুজ: তরুণদের মধ্যে যারা সাহিত্য রচনায় আসছেন তাদের কী বলবেন?

বুলবুল: যে কোনো শিল্পকর্ম একটা অংকের ধার ধারে। সেই অংক নিজেকে দিয়েই সাধন করতে হয়। এককালে আমিও নবীন লেখক ছিলাম। লেখা কাউকে শেখানো যায় না, নিজেই নিজেকে তৈরি করতে হয়, যে যত বেশি নিজেকে তৈরি করেত পারবে সে ততটাই নিজেকে বিস্তার করতে পারবে। পড়াটা লেখাকে পরিশুদ্ধ করে। তবে পড়াটা সর্বমূল নয়। জীবনের দেখার সঙ্গে কল্পনা-রহস্য এবং আবেগেরও একিভূত হওয়া চাই। সেই সঙ্গে চাই জীবনের বয়স। এরই ভেতর দিয়ে জীবন ও জীবন দর্শন, জীবনবোধ। আমাদের নবীন লেখকরা সেদিকেই এগোচ্ছেন।

 

মাহফুজ: আপনাকে ধন্যবাদ

 বুলবুল: আপনাকেও অশেষ ধন্যবাদ।