বেশ্যাকন্যা

পর্ব ১

সরদার মেহেদী হাসান

প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ২০, ২০১৮

নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি মানুষদের দুর্বলতা চিরাচরিত। অন্যদের কেমন তা আমি জানি না, তবে আমার বেশ্যাদের প্রতি দুর্বলতা কিংবা আগ্রহ অন্যদের তুলনায় বেশি। বেশ্যা কোনও ভিনজগতের প্রাণী নয়, এরা মানুষ। আমাদের মতো রক্তে গড়া মানুষদের মতোই একজন। এরপরও এরা বেশ্যা। বর্তমানে বেশ্যা বলাটা অন্যায়, তাদেরকে আপনি দেহব্যবসায়ী বলতে পারেন। এটি আমাদের মতো মুসলিম প্রধান দেশে নিষিদ্ধ হলেও, বিশ্বের অনেক উন্নত দেশে একজন প্রাপ্তবয়স্কা মহিলা এ পেশাটি সাদরে গ্রহণ করতে পারে। তার একটি আইডি কার্ড থাকবে। পুলিশ কিংবা অন্য কেউ তাকে ওই ব্যবসা করতে নিষেধ করতে পারবে না, এটা তাদের অধিকার।

এটি আদিকাল থেকে ধারাবাহিকভাবে চলমান একটি পেশা। আমরা দিনের আলোতে ওদের যত না ঘৃণা করি, রাতের অন্ধকারে ওদেরকে ততটাই পছন্দ করি। ঘরে বউ আছে, সমস্যা কি? মাস্তি কম হবে কেন? গণিকাবৃত্তি, দেহপশারিণী, প্রসটিটিউট, পতিতা, বেশ্যা, দেহকর্মী, দেহব্যবসায়ী, বাজারের মেয়ে, নিশিকুটুম- যে নামেই ডাকি না কেন, তাতেও যেন আমাদের তৃপ্তি মেটে না। আরও নতুন নতুন নামে আমরা তাদের ডাকতে চাই। কাছে পেতে চাই। আমরা মানবাধিকার বুঝি কিন্তু তাদের প্রাণের আকুতি বুঝি না। না বোঝার কারণ একটাই, তারা বেশ্যা।
 
আমরা প্রত্যেকেই একটা সময়ে রসময় গুপ্তের চটি পড়েছি। জেনেছি তাদের রসের গল্প। পত্রিকায় দেখেছি/দেখছি বাস্তব করুণ কাহিনি। আমার দুর্বলতা তখন থেকেই শুরু, যখন দেখেছিলাম শর্টফিল্ম ব্রথেল বেবি, ২০০৩ এ। দক্ষিণ এশিয়ার সর্ববৃহৎ পতিতালয় কলকাতার সোনাগাছি। সেখানকার শিশুদের ওপর নির্মিত সেই ছবিটি এখনও মনে দাগ কাটে। ২০০৩ সালে বাংলাদেশের পতিতালয় সম্পর্কে আমার কোনও প্রকার ধারণা ছিল না। ধারণাটা শুরু হলো আমার শ্রদ্ধেয় বড় ভাই, বাংলাদেশ টেলিভিশনের এক সময়ের জনপ্রিয় গুণী প্রযোজক/পরিচালক/নির্মাতা ফিরোজ মাহমুদের কাছ থেকে। তখন আমি ট্রিমেনডাস প্রযোজিত চ্যানেল আইএ প্রচারিত বিজনেস নিউজের চিফ ভিডিও এডিটর হিসেবে কর্মরত ছিলাম। আমার বন্ধুর পোস্ট প্রডাকশন হাউজ দর্পণ মাল্টিমিডিয়াতে পার্টটাইম কাজ করতে গিয়ে ফিরোজ ভাইয়ের সঙ্গে সম্পর্ক। সেই সুবাদে আমার সহকর্মী বড়ভাই, বিটিভির ভিডিও এডিটর সামসু ভাইয়ের হাউজে ফিরোজ ভাইয়ের পরিচালিত কিছু ডকুমেন্টারি এডিট করতে হয় আমাকে চ্যানেল আইএ’র জন্য। তখন টাঙ্গাইল পতিতালয় নিয়ে একটি ডকুমেন্টরি এডিট করতে গিয়ে তাদের জীবন-জীবিকা নিয়ে জানার আগ্রহ আমার বাড়তে থাকল।

এরপর আরটিভিতে চাকরিকালীন ২০০৬ সালে আমি প্রথম ভিজিট করি টাঙ্গাইলের কান্দাপট্টি পতিতাপল্লী। তখন আরটিভির জনপ্রিয় টিভি প্রযোজক প্রদীপ ভট্টাচার্যের তত্ত্বাবধানে আমার প্রযোজনায় একটি অনুষ্ঠান করার পরিকল্পনা মাফিক আমি গবেষণা কাজের জন্য প্রতি সপ্তাহেই একবার করে কান্দাহার পতিতাপল্লীতে যাবার চেষ্টা করি। কান্দাপট্টি পতিতাপল্লীতে প্রতিদিন যাওয়া যায়, কিন্তু ছবি তোলা যায় না। মোবাইল দিয়ে পল্লীর ভিতরে ছবি তোলায় সম্ভব নয়। সেখানে দশ জনের বড় একটা ক্যামেরা ইউনিট নিয়ে কিভাবে পল্লীর ভিতর দশ/বারো লাখ টাকার ক্যামেরা নিয়ে শুটিং করা সম্ভব? ক্যামেরা তো আমার বাবার টাকায় কেনা নয়, ভাড়া করা, তারা উত্তেজিত হয়ে ক্যামেরা ভেঙে ফেললে তখন কী হবে?

তাদের কাছে কাজ করার জন্য কোনও পুলিশ প্রটেকশন পাওয়াও সম্ভব নয়। তারা এ সমস্ত কেয়ারও করে না। আমাকে ও আমার ইউনিটকে তারা যদি আঘাত করে তাহলে আমরা কোথায় যাব? তাদেরকে নিয়ে ছোট দু’এক মিনিটের নিউজ কভারেজের ফুটেজ কালেক্ট করা সম্ভব, আমার তো প্রয়োজন টানা একসপ্তাহ পল্লীর ভিতরে আমার সমস্ত ইউনিট নিয়ে অবস্থান করে শুটিং করার। আমার বিশ মিনিটের ডকুমেন্টরির জন্য প্রয়োজন আনুমানিক ত্রিশ ঘণ্টার রাশ ফুটেজ। তার কি হবে? আমার সহকর্মী বন্ধু মিঠু বলতো, বাদ দে, এত রিস্ক নিয়ে শুটিং করতে যাস না। তোকে টিভি চ্যানেলের লোক জানলে ওরা তোকে ভিতরে ঢুকতেই দেবে না। তার ওপর ক্যামেরা ভাঙাসহ পিটুনি খাবার ব্যাপক সম্ভাবনা আছে। আমার সহকর্মী বড়ভাই প্রদীপদা বলেন, মেহেদী ভাই, আপনে যেভাবে ভাবছেন, সেভাবে কি শুটিং করা সম্ভব? অনেক ভেবেচিন্তে যোগাযোগ করলাম আমাদের আরটিভির টাঙ্গাইল জেলা প্রতিনিধি, টাঙ্গাইল প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক এসএসএস এনজিওর সহ-সভাপতি গোলাম মওলা ভাইয়ের সঙ্গে। ওনার সঙ্গে দেখা করার জন্য টাঙ্গাইলে গেলাম ওনার বাসায়। মওলা ভাই আমার কথা শুনে বললেন, মেহেদী ভাই, ঢাকা থেকে অনেক সাংবাদিকই আসে। আপনি ‘উব’ করার মতো কিংবা দু’এক মিনিটের মতো ‘ভক্সপপ’সহ প্যাকেজের ফুটেজ কামেরায় ধারণ করবার জন্য আমি আপনাকে হেল্প করতে পারি। কিন্তু আপনি যেভাবে চাচ্ছেন সেভাবে সম্ভব নয়। এর আগে অন্য কোনও সাংবাদিকও এ ধরনের কাজ করবার সাহস দেখায়নি এবং আমরাও সায় দেইনি। আপনি যদি দু’তিন দিন আপনার ক্যামেরা ইউনিট নিয়ে পল্লীর ভিতর অবস্থান করেন তাহলে কোনও খদ্দের ভিতরে ঢুকতে চাইবে না। তখন মেয়েরা রেগে গিয়ে আপনাদের ওপর আক্রমণ করে বসতে পারে, তখন পুলিশ দিয়েও সামলানো মুশকিল। এছাড়া এনজিও বিষয়টিকে কিভাবে দেখবে তা বলতে পারছি না। আমি এসএসএস এর নির্বাহী পরিচালকের সঙ্গে কথা বলে পরে আপনাকে জানাবো। দু’এক সপ্তাহ পর আমি গেলাম নির্বাহী পরিচালকের সঙ্গে দেখা করতে। মওলা ভাইসহ আমি ই.ডি মহোদয়কে বুঝাতে চেষ্টা করলাম আমাদের পরিকল্পনা। উনি আমাদের কথা শুনলেন এবং বুঝার চেষ্টা করলেন। বললেন, আপনি পল্লীর ভিতরে কাজ করবেন ভালো কথা, আমার প্রতিষ্ঠান থেকে আপনার সঙ্গে একজন গাইড থাকবে। তার সহযোগিতা নিয়ে আপনি ভেতরে গিয়ে কাজ করতে পারেন। তবে পরিবেশ অশান্ত হলে দায়দায়িত্ব আপনার। আমাদের শিশু হোম নিয়ে কাজ করতে চাইলে আপনি মেহেদীর (হোম ইনচার্জ) সঙ্গে কথা বলে নেবেন, ডিসি ও এসপি মহোদয় কোনও বিধিনিষেধ প্রয়োগ করলে আমাদের বলার কিছু থাকবে না। আমি ঢাকাতে ফিরে আসলাম এবং ভাবতে থাকলাম এখন কি করা যায়?

চলবে...