বেশ্যাকন্যা

পর্ব ২১

সরদার মেহেদী হাসান

প্রকাশিত : মার্চ ১৭, ২০১৮

অনেকদিন হতে চলল, যতই নিষিদ্ধ পল্লীতে যাচ্ছি ততই অন্ধকারের মধ্যে নিমজ্জিত হচ্ছি। নতুন নতুন শব্দের ব্যবহারে পল্লীর মানুষদের কথা বলার রীতি, কালা-কানুন ইত্যাদি ওয়াকিবহাল হচ্ছি।

তখন বর্ষা মৌসুম। আকাশ কিছুটা কালো মেঘে ঢাকা। পল্লীতে যাব কীনা ভাবছি, রশিদ ভাই ফোন দিলেন। মেহেদী ভাই, আপনার আজকে আসার কথা ছিল, আসবেন?
ভাবছি, যাব কীনা।
আরে, চলে আসেন।
আচ্ছা, ঠিকাছে, আসছি।
গাবতলী থেকে বাসে উঠতেই আকাশ অনেকটা কালো মেঘে ঢেকে গেল। কিন্তু বৃষ্টি হলো না। পাটুরিয়াতে এসে লঞ্চে উঠলাম। অশান্ত নদী, ফুসছে ঢেউ, লঞ্চের ধীরগতিতে সামনে চলা, জীবনের চলার পথে এমন দৃশ্য কখনও দেখিনি... ভয়ও লাগছে, আবার ভালোও লাগছে। আমি আছি ভালো-মন্দের দোলাচলে।

অনেক ভাবনার পরেই দৌলতদিয়া ঘাটে নামলাম। তখন কিছু টিপ টিপ বৃষ্টি হতে শুরু করেছে। সঙ্গে ছাতি নেই তাই কিছুটা শরীরের কাপড়ে বৃষ্টির নখের আঁচড় পড়ল। রিক্সায় চড়ে কেকেএস এর অফিসের দিকে রওনা দিলাম, পথের মধ্যেই রশিদ ভাই এর সাথে দেখা, আমরা রিক্সায় চড়ে দুজনই পল্লীর দিকে রওনা হলাম। আমরা যেই-না পল্লীর প্রধান গলি দিয়ে ভিতরে ঢুকেছি, হঠাৎ... ঝুম ঝুম বৃষ্টি...

কিছু বুঝে ওঠার আগেই শুরু হলো কালো মেঘের বর্ষণমুখর সুরারিত বৃষ্টি। এই পল্লীটি একেবারেই নদীর কোল ঘেঁষে গড়ে ওঠায় এখানে প্রতি বছরই বন্যার পানি নির্দয়ভাবে প্রবাহিত হয়। এ জন্য এখানকার সকল ঘর টিনের বেড়া, টিনের ছাউনি দিয়ে বানানো।  আকাশের অগণিত পানির ফোঁটা যখন এই পল্লীর সকল টিনের ছাউনির উপর একাধারে টিপ টিপ করে পড়ছিল, তখন আশপাশের পরিবেশ বৃষ্টির ফোঁটার অবিরত শব্দের এক মিষ্টি সুরের মূর্ছনায় ভরে উঠেছিল। আমরা একটু পানিতে ভিজলাম। বেশি ভিজার আগেই আমরা লাফ দিয়ে দাঁড়িয়ে গেলাম একটি দোকানের সামনে। দোকানের সামনে দাঁড়ানোর মতো তিল পরিমান জায়গা নেই। তবু দাড়াঁলাম। এর মধ্যে কোথায় থেকে যেন দৌড়ে এসে প্রায় আমার বুকের সামনা-সামনি দাঁড়িয়ে পড়ল একটি নারী।

দেখতে সুন্দরী। মাথার চুল বব করে কাটা। ঠোঁটে গাঢ় লাল লিপিস্টিক। মুখমণ্ডলে গাঢ় পাউডারের মেকাপ। পরনে সালোয়ার কামিজ। বৃষ্টিতে প্রায় পুরোটাই সে ভিজে গেছে। আমাকে পর্যবেক্ষণ করে মেয়েটি বলল, কি দেখ?
জবাব দিলাম, তোমাকে।
ভেজা শরীরে কেমন দেখায়?
এই পরিবেশে খারাপ লাগছে না।
ঘরে যাবা?
ঘরে যেতে ইচ্ছে করছে, কিন্তু এই বৃষ্টিতে...
আরে মিয়া ভাবেন কি? পাশেই আমার ঘর, চলো...
তোমার বাড়িওয়ালির নাম কি?
বাড়িওয়ালির নাম দিয়া করবা কি?
আজকে না হয় থাক।
ক্যান, আজকে যাবা না?
না, আজকে না। আজকে মর্জিনা আপার সাথে দেখা করতে এসেছি।
ও, এইবার চিনতে পারছি। আপনে আমাগো নিয়া কাজ করতাছেন।
হ্যাঁ, চিনলা ক্যামনে?
আপনারে চিনছি। আপনে প্রায়ই এখানে আসেন, তা কইবেন না? হুদায় মজা লইলেন আমার সাথে।
মজা নিলাম কোথায়? শুধু তো কথা বললাম।
আরে মিয়া, আমরা ফাও কারও সাথে কথা বলি না।
কথা বলতেও কি টাকা দিতে হয়?
তা দিতে হয় না, কিন্তু আপনে তো আমার সময় নষ্ট করলেন।
আমি তো তোমার সময় নষ্ট করিনি। বৃষ্টিতে তুমিই দৌড়ে এসে এখানে দাঁড়িয়েছ। তাই তোমার সঙ্গে একটু কথা হলো। চা খাবা?
চা খাওয়াবেন?
কেন খাওয়াব না?
আচ্ছা, চা এর সাথে পানও খাওয়াতে হবে।
ঠিক আছে। তোমার যা ইচ্ছা, তুমি তাই-ই খেতে পারো।

আমরা চা খেতে-খেতে কথা বলছি। এখানকার যৌনকর্মীদের কাছে খদ্দের মানেই খদ্দের। তার সাথে অর্থ ছাড়া কোনও কথা নেই, কোনও আলাপচারিতা নেই। কোনও বিশ্বাস নেই। কোনও আস্থা নেই, কোনও ভালোলাগা নেই, কোনও বাকি নেই। আসবে, দরদাম হবে, বসবে, চলে যাবে।

বাবু মানেই খদ্দের। তবে এরা সাধারণ খদ্দের নয়, এরা স্থায়ী খদ্দের। এদের প্রতি বিশ্বাস আছে, দীর্ঘ-মেয়াদী অর্থের লেনদেন আছে, গর্ভধারণেরও ইচ্ছা আছে। স্থায়ীভাবে বসবাসেরও ইচ্ছা আছে। এই পল্লীতে কাজ করতে গেলাম দু’চার দিনের জন্য। কাজ করলাম। তাদের সাথে অবাধে দৈহিক মেলামেশা করলাম। তারপর কোনোদিন সেখানে গেলাম না কিংবা তাদেরকে নিয়ে কোনও কাজ করলাম না, তখন তাদের কাছে আমাদের মূল্য ওই খদ্দেরের চেয়ে কোনও অংশে কম নয়।

আপনে-আমি শুধুই কোনও নিউজ কিংবা শুটিং করবার জন্য সারাদিন তাদের কাছে থাকলাম, ভিডিও করলাম, দিন শেষে চলে আসলাম... তখন আমরা তাদের কাছে ভয়ের একটা জিনিস। এই বুঝি সবাই দেখে ফেলল, ওরে বাবা... ক্যামেরা, মিডিয়ার মানুষ, তাদের সাথে কথা বলাই মুশকিল। সম্পর্ক তো দূরের কথা, তারা মিডিয়াকে ভয় পায়।

আর আপনি তাদেরকে নিয়ে বছরের পর বছর কাজ করছেন, তাদের কাছে যাচ্ছেন, মনের কথা বলছেন, তাদের কথা শুনছেন, তাদের জীবনের সাথে মিশে গিয়ে গল্প করছেন... তখন আপনি/আমি তাদের একজন বন্ধু। এবং শুধুই বন্ধু, এর মধ্যে কোনও দৈহিক সম্পর্ক থাকবে না। থাকবে শুধুই বন্ধুত্বের বন্ধন।

আমার বিশ্বাস, এরা এদের জীবন থেকে বাবু পরিবর্তন করে ফেলতে পারে। কিন্তু বন্ধুত্বকে দূরে ফেলে দিতে পারে না।

চলবে...