বেশ্যাকন্যা

পর্ব ২২

সরদার মেহেদী হাসান

প্রকাশিত : মার্চ ১৮, ২০১৮

নিশিকুটুমদের বন্ধু হওয়া অন্যায়। এদের দেহে মনে হয় সমাজের কুৎসিত রক্ত প্রবাহ বিদ্যমান। তা না-হলে আমরা কেন তাদেরকে বারবার সূর্যের আলোর দীপ্ত শিখায় দেখতে অনীহা প্রকাশ করে থাকি? আমরা তাদের নাম শুনে যে পরিমাণ তাদের প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করে থাকি কিন্তু রাতের আঁধারে আমরা সেই লোকদেখানো ঘৃণাটুকু নির্লজ্জভাবে দূরে ঠেলে রেখে ছুটে যাই তাদেরই কাছে। আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে বন্ধু থাকতে পারে কিন্তু তাদের জীবনে কোনও বন্ধু থাকতে পারে না। বন্ধু ভাবলেই আপনি তাদের ছি ছি করবেন, ধিক্কার দেবেন বেশ্যা বলে। এ কারণেই বুঝি তাদের জীবনে বন্ধুত্বের মূল্য বাবু কিংবা জীবনের চেয়েও বেশি। এরা যেমন মানুষকে অর্থের বিনিময়ে নির্দ্বিধায় দেহ দিতে পারে, তেমনি আমাদের অন্তরের গভীরে লুকায়িত তিল পরিমান ভালবাসা পেলে জীবনের অপার বন্ধু ভাবতেও পারে। বন্ধুই পারে কোনও প্রকার দৈহিক সুখের মোহে ভাবাচ্ছন্ন না হয়ে অন্তর দিয়ে বন্ধুত্বকে বরণ করে নিতে।

শিউলী এ পল্লী থেকে বের হয়ে, সুস্থ পরিবেশে নতুনভাবে জীবন গড়তে চেয়েছিল কয়েকবার। ব্যর্থ হয়েছে সেই লক্ষ্য থেকে। সে যে কয়েকবার এ পল্লী থেকে গ্রামের বাড়িতে ফিরে গিয়েছে, ততবারই গ্রামের কিছু লোলুপ দৃষ্টি বাধ্য করেছে এ নোংরা পরিবেশে পুনরায় ফিরে আসতে। এ সভ্য সমাজে তাদের ফিরে আসার আগ্রহ যতটা থাকবে তার চেয়েও বেশি থাকা উচিৎ আমাদের সভ্য জগতের। তাদের মেনে নেবার মন-মানসিকতা আমাদের থাকা দরকার। তাহলেই হয়তো একদিন এ নোংরা পেশার অবসান ঘটবে।

বৃষ্টির গতি অনেকটা কমে এসেছে। আমি ও রশিদ ভাই বিভিন্ন গলিপথ পেরিয়ে ঝুমুরের ঘরে ঢুকি। দরজার পাশে গলির মুখে দেখতে পেলাম খালি একটি দোকান। দোকানটি বেশ খানিকটা বড়। চতুর্দিকে বেঞ্চ বসানো। মাঝখানে খালি। দোকানটি একা নির্জনভাবে পড়ে রয়েছে। দোকানটির দিকে এই ভরদুপুরে তাকানোর কেউ নেই। বাইজি পাড়ার বাইজি কন্যার মতো। ভরযৌবনা কান্তিকালে নব-নব ফুলের মধু পানে ছুটেছে কত ভ্রমর। সময়ের শেষ বেলায় এসে ফুলের মধু সংগ্রহের কোনও ব্যাকুলতা লক্ষ্য করা যায় না ভ্রমরের। তারা বুঝে যায়, ফুলের মধু শেষ। পরিত্যক্ত ফুলের প্রতি সবারই আগ্রহটা একটু কম। যারা আসে তার একেবারেই ভালোবাসার তাগিদে। সেখানে থাকে না তত লেনদেনের হিসাব, শুধুই ভালো লাগার বন্ধুত্বের বন্ধন। ঝুমুরের রুমে গিয়ে বসলাম। ঝুমুর বাইরে গেছে। কেউ একজন আমাদের আসার খবর তার কানে দিতে গেল। আমি এবার অনেকটা নিশ্চিন্তে দু’পা খাটের উপর তুলে বালিশে মাথা দিয়ে শুয়ে পড়লাম। আমার সহযোগী হিসেবে কাজ করছে এমন দু’একজন আমার সঙ্গে এখানে এসেছে। খাটে বসেছে। কিন্তু শুয়ে পড়ার মতো সাহস কিংবা ইচ্ছা দেখায়নি। এটা অনেকের ক্ষেত্রেই হয়। হঠাৎ করে এই নোংরা পরিবেশে এসে নিজেকে ততটা মানিয়ে নিতে পারে না। ঘরের এমন নোংরা পরিবেশে বসতেও ঘৃণা করে। কিন্তু অনুসন্ধানী সংবাদ সংগ্রহের সঙ্গে যারা প্রতিনিয়ত কাজ করছে কিংবা কাজ করে চলেছে, তারা মনে হয় অনায়াসেই আমার মতো হুটহাট কাজ করে বসতে কোনও প্রকার ভাবনার অবকাশ নেয় না। যদি ভাবতেই হয় নিজের বাসাতেই ভেবে নেয়া যায়। সংবাদ মিডিয়ার মানুষজন বুঝি এমনই হয়, সমাজের সর্বোচ্চ স্তরের মানুষদের সাথে চলাফেরার পাশাপাশি সমাজের একেবারেই নিগৃহীত মানুষদের সাথেও কাঁধে-কাঁধ মিলিয়ে একসঙ্গে চলতে পারে। এটাই মনে হয় সাধারণ মানুষ ও মিডিয়ার মানুষদের মধ্যে বড় একটি পার্থক্য। ঝুমুর আসার শব্দ পেলাম, সে অনেকটা উঁচু স্বরে কথা বলে। ঘরে ঢুকেই আমাকে দেখে সে অবাক হলো। সাধারণত অন্য কেউ এসে এভাবে তার বিছানায় অবলীলায় শুয়ে পড়ে না। ঝুমুর বেশ লম্বা। বয়স ১৭-১৮ এর বেশি হবে না। বেশ পরিপাটি পোশাক-আশাকে। কানে-গলায় সোনার গয়না। দেখে মনে হচ্ছে, কিছুটা অসুস্থ। আমি শোয়া অবস্থা থেকে উঠে বসতে চাইলাম। ঝুমুর বলল, আরে, করো কি, শুয়ে থাকো।
না না, তুমি শুয়ে থাকো। তুমি সম্ভবত অসুস্থ।
হ্যাঁ, শরীরটা ভালো  যাচ্ছে না।
তোমার কি হয়েছে?
জানা কি খুব বেশি দরকার?
না, বেশি দরকার না। তবে একজন মানুষ অন্য একজন মানুষের ভালো-মন্দ খোঁজখবর নিতে পারে না?

চলবে...