বেশ্যাকন্যা

পর্ব ২৩

সরদার মেহেদী হাসান

প্রকাশিত : মার্চ ১৯, ২০১৮

ঝুমু বলল, পারে, তা কবে থেকে আমরা আবার মানুষ হলাম?
কেন? আমরা কি তোমাদের মানুষ হিসেবে দেখছি না?
দেখলে কি আমাকে এই অসুস্থ শরীরে খদ্দের ধরতে হয়?
খদ্দের নিচ্ছো কেন?
খদ্দের না নিলে খামু কি?
ডাক্তার দেখিয়েছো?
ডাক্তার? ডাক্তার কি গাছে ধরে? ওষুধ খাওয়ার পয়সা নাই, ডাক্তার!
তোমার কাছে কোনও টাকা সেভিংস নাই?
থাকব না ক্যান? কিছু টাকা জমানো ছিল।
ওই টাকা কি করলে?
কি আর করুম, এক খানকির পোলায় টাকা নিয়ে ভাগছে...
বলো কী! কীভাবে?
এক পোলায় ঢাকা থ্যাইকা আইছিল। দেখতে বেশ সুন্দর। প্রথম দিন আইছিল, বইছে, টাকা দিছে, চলে গেছে। এভাবে ঘনঘন বেশ কয়েকবার আমার কাছে আসার পর তাকে আমার খুব ভালো লাগছিল। এভাবে প্রায় ছয়-সাত মাস সে আসা-যাওয়া করেছে। একদিন হঠাৎ সে আমারে আইসা কইল, তার মা অসুস্থ, ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালে ভর্তি। টাকা নাই। আমি আমার কাছে জমানো এবং আমাগো অফিসে জমানো টাকা থাইকা ত্রিশ হাজার টাকা যোগার করে দিলাম। কিন্তু খানকির পোলা টাকা নিয়া সেই যে গেল, আর ফিরে আইল না। ফোন-টোন সব বন্ধ। আমাগো বেশ্যার টাকা মাইরা খাইতেও তোমাদের বিবেকে বাঁধে না। শরীর বিক্রির কষ্টের টাকা। তোমরা শালা মানুষের জাত না। আমাগো শরীর সাত-দিন রক্তে নাপাক থাকলেও তোমরা আমাগো ছাড় না। তোমরা আসলে কিসের জাত?

আমি কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছি। ঝুমু বলল, বাবা-মা ডাকার অধিকার আমি হারিয়েছি। হারিয়েছি স্বাভাবিক জীবন ধারণের সকল প্রকার স্বাধীনতা। প্রতারিত হয়ে নিঃগৃহীত হয়েছি সমাজ থেকে। মানুষকে বন্ধু ভাবার অধিকারটুকুও অর্জন করতে পারলাম না। এখন আমার কি করা উচিত, তুমিই বলো?

আমার ভাবনার কোনও কুল-কিনারা নেই। নিজেকে মানুষ ভাবতেই কিছুটা অবাক লাগছে। ওদের প্রশ্নের উত্তর কিভাবে দিব? পৃথিবীর সভ্যসমাজের শব্দ ভাণ্ডারে বন্ধু বলে কোনও শব্দ আর থাকবে না? না কি থাকবে? আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললাম, তোমার কাছে ছেলেটির কোনও মোবাইল নম্বর আছে?
মোবাইল নম্বর দিয়ে কি করবা? খানকির পোলার মোবাইল বন্ধ।
ও আচ্ছা। তুমি কেন বোকার মতো এতগুলো টাকা ছেলেটির হাতে তুলে দিলে?
মায়ের জন্যে সবসময় বুকটা কাঁদে। ছেলেটি যখন তার মায়ের অসুস্থতার কথা বলল তখন আমি ছেলেটির মাকেই আমার মা বলে ভেবেছিলাম। কিন্তু কপাল, মায়ের স্বপ্ন গেল, টাকা গেল, বন্ধুত্ব গেল। আমি এখন কি করব?

সভ্য সমাজের কিছু মানুষ আছে যারা সত্য ও বাস্তবতাকে সহজে মেনে নিতে চাই না। আমরা অতি আধুনিক সাজি শুধুই নিজের জন্য, যেখান পরিবার/সমাজ/দেশ/বিশ্বের কল্যাণে এর কোনও ছাপ পড়ে না। আমরা ছোটবেলার গণ্ডি পেরুলেই চটি রাজ্যের গভীরে প্রবেশ করি অতি গোপনে। প্রাপ্তবয়স্ক হবার সাথে সাথে মনের জৈবিক খিদের পরিমানও দিনকে দিন বাড়তে থাকে। মনের ভিতর তৈরি হয় গোপন লীলার কর্মক্ষেত্র। জীবনের প্রতি মুহূর্তে কোনো না কোনো অনৈতিক জৈবিক চাহিদা উঁকি মেরে চায় আমাদের দিকে। আমরা সব কিছু অনৈতিক কাজ করতে চাই অতি গোপনে। যৌন পেশাটাকেও বাঁচিয়ে রাখতে চাই আদি থেকে অনন্তকাল। তা না হলে এ পেশার যবনিকাপাত ঘটছে না কেন? আমরা পতিতাপল্লী ভেঙেচুরে মাটির নিচে পুতে ফেলতে চাই। কিন্তু এসব পল্লীর মানুষদের কি হবে? তারা কি সঠিকভাবে পুনর্বাসনের সুযোগ পাবে? যারা এ পল্লী থেকে বের হয়ে গিয়ে সভ্য সমাজে সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার চেষ্টা করছে, তারা কি আবারও নিগৃহীত হচ্ছে না আমাদের দ্বারা? বেশ্যা নাম শুনতে আমরা যত না লজ্জা পাই, তাদের কাছে রাতের অন্ধকারে ছুটে যেতে কি আমাদের ততটা লজ্জা হয়? দোকানে কনডম নিতে গিয়ে দোকানদারকে কি বলা উচিৎ? দিন-দুপুরে রাস্তায় বেরুনো নারীদেরকে অশ্লীল ভাষায় কথা বলতে পারি। জনসম্মুখে মানুষদের চাপাতি দিয়ে কোপাইতে পারি। বাবা-মার সামনে মেয়েকে ধর্ষণ করতে পারি। নিজের মা-বাবাকে অশ্লীল ভাষায় গালি দিতে পারি, কিন্তু কনডমকে কনডম বলতে আমাদের কতই না লজ্জা! আহারে! লজ্জা যেন সমগ্র জাতিকে পেয়ে বসেছে!

 

চলবে...