বোধিসত্ত্ব

পর্ব ২

ছায়াবীথি শ্যামলিমা

প্রকাশিত : জানুয়ারি ১১, ২০১৯

মহাযান ধর্মদর্শনে বোধি মার্গ বা যান: মহাযান বৌদ্ধধর্মে বোধিসত্ত্ব মার্গ বা যান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বৌদ্ধধর্ম মতে, মার্গ বা যান শব্দের অর্থ পন্থা, পথ, মত, কৌশল কিংবা উপায় প্রভৃতি। বৌদ্ধ সাহিত্যে শ্রাবক বোধি, প্রত্যেক বোধি তথা অনুত্তর সম্যক সম্বোধি, অর্থাৎ শ্রাবক বুদ্ধ, প্রত্যেক বুদ্ধ এবং সম্যক সম্বুদ্ধ; পরস্তু উত্তরকালীন মহাযান বৌদ্ধ সংস্কৃত সাহিত্যে তৎস্থলে শ্রাবক যান, প্রত্যেক যান, বোধিসত্ত্বযান এবং মহাযান শব্দের উল্লেখ আছে। তেমন হীনযান, মন্ত্রযান, তন্ত্রযান, বজ্রযান, কালচক্রযান, সহজযান প্রভৃতির উদ্ভব হয়। এই যান শব্দ অনেক অর্থবোধক; কিন্তু এখানে যান শব্দের অর্থ মার্গ। গৌতম বুদ্ধ মানুষের মুক্তির যে উপায় বলেছিলেন, তা চারি আর্য সত্য তথা আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ। আদর্শ পথ বা সম্যক মত অনুসরণ। বলা হয়ে থাকে, আর্যদের অনুসৃত পন্থা কিংবা উপায়। উক্ত হয়েছে ‘একায়ানো’য় ভিক্খবে মগ্গো, সত্তানং বিসুদ্ধিয়া (সতিপট্ঠান সুত্ত)। হে ভিগুগণ, এটাই সত্ত্বগণের বিশুদ্ধির একটি মাত্র মার্গ। মগ্গানট্ঠাঙ্গিকো সেট্ঠো (ধর্মপদ)। সেই মার্গসমূহের মধ্যে অষ্টাঙ্গিক মার্গই শ্রেষ্ঠ। ‘উজুকো নাম সোমগ্গো।’ (সংযুক্ত নিকায়ে অচ্ছরাসুত্ত) সেই অষ্টাঙ্গিক মার্গই ঋজুমার্গ। এখানে ‘যান’ শব্দ মার্গ অর্থেই প্রযুক্ত হয়েছে। অতএব ‘যান’ শব্দের অর্থ নির্বাণ প্রাপ্তির মার্গ; সুতরাং বৌদ্ধ সাহিত্যের সর্বত্র মার্গ শব্দেরই প্রচলন দেখা যায়।

সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ধর্মনীতিতেও পরিবর্তন শুরু হয়। বৌদ্ধধর্মের বিকাশক্রমে ‘যান’ শব্দের প্রয়োগ কখন থেকে শুরু হয় তা বিবেচনা করা যায়। বৌদ্ধ ইতিহাসে মহাসাংঘিক নিকায় হতেই মহাযানের উদ্ভব হয়। মহাযানের প্রাচীনতম গ্রন্থ প্রজ্ঞাপারমিতা সূত্র; যার রচনাকাল খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতাব্দী ধরা হয়, তাতেও মার্গ শব্দেরই প্রচলন দেখা যায়। ‘যান’ শব্দের প্রথম ও ব্যাপক উল্লেখ পাওয়া যায় সদ্ধর্মপুণ্ডরীক সূত্রে, যার রচনাকাল ধরা হয় খ্রিস্টিয় প্রথম শতাব্দীর পূর্বাব্দ। গৌতম বুদ্ধ অনেক প্রকারে শ্রাবকদেরকে ধর্মের উপদেশ দিয়েছিলেন। তাঁর উপদেশের ক্রম ছিল, প্রথম দানকথা, শীলকথা, স্বর্গকথা, কামের আদীনব্ সংকেশ এবং নৈষ্ক্রম্যের আশংসা; এভাবে যখন জানতে পারতেন, শ্রোতাদের চিত্ত মৃধু, নীবরণ মুক্ত উদগ্র ও প্রসঙ্গ হয়েছে, তখন তিনি বৌদ্ধগণের সমুৎকৃষ্ট ধর্মদেশনা অভিব্যক্ত করতেন, যথা: দুঃখ, দুঃখ সমুদয়, দুঃখ নিরোধ ও দুঃখ নিরোধের উপায় ভূত আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ (বৌদ্ধ মতবাদের ভিত্তি)। সম্ভবত এই বিকাশ ক্রমের উপর ভিত্তি করেই মহাসাংঘিক নিকায়বাদীরা বলেছেন, গৌতম বুদ্ধের সাক্ষাৎ শিষ্যদিগকে অর্থাৎ সাধারণ যোগ্যতা সম্পন্ন শিষ্যদিগকে তিনি চার আর্যসত্য তথ্য নীতিবাদের উপদেশ দিতেন; স্বীয় গৃঢ়তম রহস্যময় তত্ত্বের উপদেশ দিতেন অতি অল্প সংখ্যক যোগ্যতম শিষ্যদেরকে যাঁদের বোধিসত্ত্ব বলা হয় এবং যাঁদের পরস্পরা প্রবর্তনের দাবি মহাযান করতেন।
পালি বৌদ্ধ শাস্ত্রে শ্রাবকযান ও প্রত্যেক বুদ্ধযানের উল্লেখ আছে।

শ্রাবক যানের সাধক বা শ্রাবকের অন্বিষ্ট অর্হত্ব। এরা নির্বাণ আকাক্সা করেন না। অন্যদিকে প্রত্যেক বুদ্ধযানের সাধক বা প্রত্যেক বুদ্ধের ব্যক্তিগত নির্বাণ। এরাঁ প্রত্যেকে নিজে বোধি লাভ করেন কিন্তু শাস্ত্র বা লোকসাধারণের মুক্তির পথপ্রদর্শক হন না। মহাবস্তু অবদান- এ মালিনী উপখ্যানে বলা হয়েছে- প্রত্যেক বুদ্ধেরা মৌন অবলম্বনেই মোভন হন, তাঁরা মহান প্রবাববিশিষ্ট, তাঁরা গণ্ডারের মতো একাকী বিচরণ করেন, তাঁরা কেবল নিজেকেই দমিত করেন এবং পরিনির্বাণ লাভ করেন। মহাযান মতে, বুদ্ধকে প্রত্যেক বুদ্ধদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ মনে করা হয়। কারণ তিনি বুদ্ধত্ব অর্জনের পরে লোকসাধারণের শাস্তা হয়েছিলেন।
বৌদ্ধধর্মের অনুসারী যাঁরা গুরুর উপদেশ অর্থাৎ সম্যক সম্বুদ্ধের মুখনিঃসৃত দুঃখ নিরোধের বাণী শ্রবণ করে তাঁরা নির্দেশিত মার্গানুসরণ করে রাগ-দ্বেষ-মোহ আদি সর্বকেশ সমতিক্রম করে ‘বোধি’ বা ‘জ্ঞান’ লাভ করে অর্হত্ত্ব ফল লাভ করেন, তাঁদেরকে ‘শ্রাবকবুদ্ধ’ বা ‘শ্রুতবুদ্ধ’ বলা হয়। যাঁরা গুরুর উপদেশ ব্যতীত পূর্বজন্মের সংস্কার বশত আত্ম চেষ্টায় তৃষ্ণায় করে সয়ং ‘বোধি’ বা ‘জ্ঞান’ লাভের অধিকারী হন; তাঁদেরকে ‘প্রত্যেক বুদ্ধ’ বলা হয়। শ্রাবকবুদ্ধ যান পৃথকজন ধর্ম, অর্থ, কাম এই ত্রিবর্গের সিদ্ধিতে ব্যাপৃত থাকে। কিন্তু শ্রাবক ইহার অতীত। তাদের প্রতীত্যসমুৎপাদ ও ধর্মনৈরাত্ম্য জ্ঞান থাকে। এজন্য এদের শ্রেষ্ঠ নির্বাণ লাভ হয় না। তাঁদেরকে তত্ত্বজ্ঞান লাভের জন্য কোনো প্রকার গুরুর পরতন্ত্রতা স্বীকার করতে হয় না। তাঁরা সদ্ধর্মের লোপ হলে স্বীয় উদ্দ্যেগ দ্বারা বোধি বা জ্ঞান লাভ করেন এবং উপদেশ ব্যতীত প্রাতিহার্য দ্বারা অন্য মতাবলম্বিগণকে সদ্ধর্মে অনুপ্রাণিত করেন। আর যাঁরা সম্যক প্রকারে গুরুর উপদেশ ব্যতীত সকল বিষয় স্বরস-লণ-প্রতিবেধ বশে স্বরম্ভূজ্ঞানে বুঝে ছিলেন বলে, চতুবার্য সত্য সম্যকরূপে স্বয়ং অবগত হয়েছিলেন বলে, অবিদ্যাদি প্রতীত্যসমুৎপাদ ধর্ম স্বয়ং বুঝে ছিলেন বলে এবং অনিত্য, দুঃখ ও অনাত্ম এই ত্রিলণ সম্প্রযুক্ত ধর্ম স্বয়ং সম্যকরূপে বুঝেছিলেন বলে, তথাগত সম্যক সম্বুদ্ধ নামে পরিকীতিত। অর্থাৎ বুদ্ধ তথাগত ধর্মসমূহ স্বয়ং সম্পূর্ণরূপে বুঝেছিলেন বলে সম্যক সম্বুদ্ধ।

শীলাচার শাস্ত্রী পালি পিটক গ্রন্থের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, বুদ্ধ তথাগত সম্যক সম্বোধি লাভ করে সর্ব প্রথম পঞ্চবর্গীয় শিষ্যদিগকে ধর্মচক্রের উপদেশ করেছিলেন ইসিপতন মৃগদাবে। কিন্তু মহাযানীদের মতে বুদ্ধ প্রথম ধর্মচক্রের প্রবর্তন ইসিপতন মৃগদাবে করেননি; এতে তিনি শ্রাবকযান তথা প্রত্যেক বুদ্ধযানের উপদেশ করেছিলেন। দ্বিতীয় ধর্মচক্র প্রবর্তন করেছিলেন রাজগৃহের গৃধকূট পর্বতে, এতে তিনি বোধিসত্ত্বযানের উপদেশ করেছিলেন। এদের মধ্যে প্রথম প্রবতিত ধর্মের নাম ‘হীনযান’ এবং দ্বিতীয় প্রবতিত ধর্মের নাম ‘বোধিসত্ত্বযান’ বা ‘মহাযান’। তৃতীয় ধর্মচক্র প্রবর্তন করেছিলেন ধান্যকটরে; এতে তিনি তন্ত্রের উপদেশ দিয়েছিলেন; এই তন্ত্রই পরে মন্ত্রযান, তন্ত্রযান, বজ্রযান, কালচক্রযান, সহজযান প্রভৃতি ভিন্ন ভিন্ন রূপ পরিগ্রহ করে। হীনযান বা থেরবাদে শীল, সমাধি, প্রজ্ঞা এবং ধ্যানের অনুশীলনের মাধ্যমে নির্বাণ লাভ করা। আর মহাযানীদের মুখ্য উদ্দেশ্য হল জীবন মুক্তির আদর্শ বোধিসত্ত্ব চর্যাব্রত গ্রহণ করত; সর্বপ্রাণীর হিতে, সুখে এবং বুদ্ধত্ব প্রাপ্তির উপায় অন্বেষণ করা। মহাযানের অষ্টাঙ্গিক মার্গের স্থলে উত্তরকালে বোধিসত্ত্ব চর্যার বিকাশ হয় এবং তাঁদের আদর্শ অর্হত্ব না হয়ে বোধিসত্ত্ব বা বুদ্ধাঙ্কুর নামে পরিচিত ছিলেন। অর্হতের আদর্শ বুদ্ধত্বের আদর্শ হতে হীন; তাই তাঁরা অর্হত্বের কামনা না করে বোধিসত্ত্বের আদর্শই স্বীকার করেন। বোধিসত্ত্ব একে বলা হয়, যিনি সম্যক সম্বোধি প্রাপ্তির আকাঙ্ক্ষা করেন, যাতে বোধি বীজ নিহিত এবং যাঁর চিত্তে প্রাণিজগতের প্রতি অসীম করুণা বিদ্যমান। এই নবীন ধর্মের নাম হয় মহাযান। এই মহাযানীরই প্রাচীন পন্থীদেরকে ‘হীনযান’ বলে আখ্যা দেন। তাঁদের অপর নাম শ্রাবকযান; এর প্রতিপ মহাযান বা বোধিসত্ত্বযান, একে অগ্রযানও বলা হয়।
সদ্ধর্মপূণ্ডরীক সূত্র মতে, বস্তুত যান একই তা ছিল বুদ্ধযান; সদ্ধর্মপূণ্ডরীর আদি মহাযান সূত্রগ্রন্থ।

গূঢ় ধর্মোপদেশ বুদ্ধ কতিপয় অত্যন্ত প্রতিভাশালী নির্বাচিত শিষ্যদের প্রতি দিয়েছিলেন যাঁদেরকে বোধিসত্ত্ব বলা হয়। এই বোধিসত্ত্বদের মার্গকেই মহাযান বা বোধিসত্ত্বযান বলা হয়। এই বোধিসত্ত্বযান বা মহাযান উভয়ই একার্থ বাচক। একে বুদ্ধযান অথবা তথাগতযানও বলা হয়। মহাযানের এই কল্পনাই পরবর্তী কালে বহুযানবাদী মার্গ প্রশস্ত করে, যেমন, পারমিতাযান, বোধিসত্ত্বযান, বুদ্ধযান, প্রজ্ঞাযান যা ভক্তিমার্গ প্রধান। পরবর্তী কালে তন্ত্রের প্রভাবে তন্ত্রযান, মন্ত্রযান, বজ্রযান, কালচক্রযান, সহজযান প্রভৃতি বিকাশ হয়, যা সাধনমার্গ প্রধান। প্রারম্ভিক বৌদ্ধধর্মে গূঢ় রহস্য বলে কোন কিছু ছিল না। বুদ্ধ স্বয়ং আনন্দকে বলেছিলেন, হে ‘আনন্দ, ভিতর বাহির কোন প্রকার ভেদ না করেই আমি ধর্মের উপদেশ করছি। ধর্ম বিষয়ে তথাগতের কোন প্রকার আচার্যমুষ্ট (রহস্য) নাই। ভগবান বুদ্ধের ধর্ম চন্দ্র-সূর্যের ন্যায় প্রকাশমান এবং সকলের সম অধিকার। তা সত্ত্বেও পরবর্তী মহাযানী আচার্যেরা বলেন, তাঁদের মহাযান বৈপুল্যসূত্র সমূহ ভগবান বুদ্ধের উৎকৃষ্টতম সংগ্রহ, যা কেবল মহাপ্রাণী বোধিসত্ত্বকেই উপদেশ দিয়েছিলেন। মহাযানীদের এই দাবীর পেছনে কোন ঐতিহাসিক ভিত্তি নাই; কেবল কল্পনা মাত্রই।

 

চলবে