বোধিসত্ত্ব

পর্ব ৪

ছায়াবীথি শ্যামলিমা

প্রকাশিত : জানুয়ারি ১৩, ২০১৯

বোধিসত্ত্ব জীবন, আদর্শ ও উদ্দেশ্য: বুদ্ধত্ব লাভের জন্য যত্নবান সত্ত্বকে বোধিসত্ত্ব বলা হয়। বোধিসত্ত্ব বুদ্ধজীবনের পূর্ববর্তী অবস্থার করণীয় পর্যায়। এ জীবন বুদ্ধিক জীবনের মহত্বপূর্ণ দিক; পূর্ণতার লণ। তাই ইহা মুক্তির অন্বেষণ এবং পারমী পরিক্রমার কালপর্ব। বোধি+সত্ত্ব = বোধিসত্ত্ব। বোধি অর্থ জ্ঞান, প্রজ্ঞা, মনন; আর সত্ত্ব অর্থ জীভ (সার বা মূল উপাদান)। অতএব, বোধিসত্ত্ব শব্দের অর্থ দাঁড়ায় যে সত্ত্ব বোধি জ্ঞান লাভের জন্য সচেষ্ট। ড. বিনয়তোষ ভট্টাচার্য বলেছেন, বোধিসত্ত্ব জগৎ কারণ শূন্যের অশেষ গণের এক একটি গণের প্রতিমূর্তি স্বরূপ। বৌদ্ধ সাহিত্যে বুদ্ধাঙ্কুর জন্মকে অর্থাৎ বুদ্ধত্ব লাভের জন্য যত্নবান ব্যক্তিকে বোধিসত্ত্ব বলা হয়। অনেক জন্মের সাধনার অন্তিম পরিণাম স্বরূপ বুদ্ধত্ব প্রাপ্তি সম্ভব হয়। শাক্যমুনি গৌতম বুদ্ধ এক জন্মের সাধনায় বুদ্ধত্ব পদ লাভ করেন নাই, প্রত্যুত অনেক জন্মের (৫৫০ জন্ম ধারণ করে) সাধনায় বুদ্ধত্ব পদ লাভ করেছিলেন। প্রত্যেক জন্মে তাকে বোধিসত্ত্ব নামে অভিহিত করা হয়। মহাযান বৌদ্ধ ধর্মদর্শনে বোধিসত্ত্ব জীবনের গুরুত্ব অত্যধিক। মহাযানে বুদ্ধত্ব লাভের এক বিশিষ্ট সাধনার নিদের্শ হল বোধিচর্যা, বোধিচর্যার আরম্ভ বোধিচিত্ত গ্রহণ দ্বারা হয়ে থাকে।

মহাযানপন্থী সর্বজীবের মুক্তি এবং হীনযানপন্থী নিজের দুঃখ মুক্তিতে ব্যাপৃত। এ মতে, বোধিসত্ত্বের আদর্শ মহামৈত্রী ও মহাকরুণা। তিনি নিজের দেহ, নিজের জীবন, নিজের সকল কুশলের মূল পর্যন্ত জীব-জগতকে দান করেন। অথচ তার কোন প্রতিদান আকাঙ্ক্ষা করেন না। বৌদ্ধ সাহিত্যে বলা হয়েছে, ‘বুদ্ধো বোধেয্যুং, মুত্তো মোচেয্যুং, তিন্নো তরেয্যুং’। অর্থাৎ আমি নিজে বুদ্ধ হয়ে অন্যকেও বোধি লাভে সাহায্য করবো, নিজে মুক্ত হয়ে অন্যকেও মুক্ত করবো, নিজে সংসার সাগর উত্তীর্ণ হয়ে অন্যকেও উত্তীর্ণ করবো।

মহাযান গ্রন্থে বুদ্ধত্ব পদ প্রাপ্তির জন্য এক বিশিষ্ট সাধনার নির্দেশ মিলে, যার নাম বোধিচর্যা। বোধিচর্যার আরম্ভ বোধিচিত্ত গ্রহণ দ্বারা হয়। পালি পিটক গ্রন্থে বোধিসত্ত্ব শব্দ অনেক বার এসেছে, বুদ্ধ হওয়ার পূর্বে আমি যখন বোধিসত্ত্ব ছিলাম। এইখানে বোধিসত্ত্বের অর্থ, বোধি বা জ্ঞান লাভের জন্য প্রযতœশীল প্রাণী। বুদ্ধ পূর্বজন্মে যখন বুদ্ধত্ব লাভের সাধনা করতে ছিলেন, তখন তিনি বোধিসত্ত্ব ছিলেন। বোধিসত্ত্বই পরে বুদ্ধ হন। মহাযানে এসে বোধিসত্ত্বের স্বরূপেও পরিবর্তন হয়। তাঁদের মতে যেই পর্যন্ত বিশ্বের একজন মাত্র প্রাণীও অমুক্ত থাকবে সেই পর্যন্ত তিনি স্বীয় প্রযতœলব্ধ নির্বাণকে স্বীকার করবেন না। নির্বাণ লাভ তাঁদের মতে স্বার্থপরতা, সংকীর্ণতা ও হীন আদর্শ, পরন্ত পরিমুক্তির জন্য আত্মবিমুক্তি ত্যাগ করাই পরার্থতা, মহান আদর্শ, এই মহাযান। কারণ তাঁদের মতে নির্বাণ-মুক্তি অন্তিম অবস্থা নয়, এর পরেও তথাগত জ্ঞান দ্বারা সম্যক সম্বোধির অন্বেষণ করতে হয়। এই রূপে মহাযানে অনুত্তর সম্যক সম্বোধিকে নির্বাণ হতে পৃথক করা হয়েছে এবং ইহাকে এক উচ্চতর স্থিতি বলা হয়েছে। পালি নিকায় গ্রন্থে এই রূপ কোন বিভাগ করা হয়নি। অধিকন্তু মহাযান বৈপুল্যসূত্রাদিতে বুদ্ধকে চিরশাশ্বত করে নেওয়ার চেষ্টা হয়েছে। তাঁদের মতে নির্বাণের অর্থ বুদ্ধ অবস্থার শাশ্বতত্ব। সমাধিরাজসূত্রে বুদ্ধকে আদি-অন্তহীন চিরশাশ্বত বলা হয়েছে, নাম সঙ্গীত তন্ত্রে অনাদি অনন্ত বলা হয়েছে।

মহাযানীদের মতে বোধিসত্ত্বগণ নির্বাণের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও ভূতদয়া দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে বিশ্বপ্রাণীর উপকারার্থে নিজের স্বাধীকারকেও পরিত্যাগ করেন। এই জন্যই মহাযান গ্রন্থে বোধিসত্ত্বের সপ্তবিধ অনুত্তর পূজার এক অঙ্গ ‘বুদ্ধ যাচনা’ বলা হয়েছে। এতে নির্বাণাভিলাষী ব্যক্তি কর্তৃক কৃতকৃতের নিকট প্রার্থনা হয় যে, তিনি যেন অনন্ত কল্প পর্যন্ত নিবাস করেন, যাতে লোক অন্ধকারে আচ্ছন্ন না থাকে। বোধি সাধকের আদর্শ মহাযান বৌদ্ধধর্মের অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। বৌদ্ধধর্মে সাধকের ত্রিবিধ যান বা সাধনমার্গের কথা রয়েছে। যথা- ক. শ্রাবক যান, খ. প্রত্যেক বুদ্ধযান ও গ. বোধিসত্ত্বযান

শ্রাবকযানের সাধক স্বীয় দুঃখ বিমুক্তির জন্য গুরুর নিকট সাধনা করে অর্হত্ব লাভে সচেষ্ট। যে সাধক গুরুর উপদেশ ছাড়া নিজস্ব জ্ঞান বলেই সাধনা করে বোধি লাভে সমর্থ হন তিনি প্রত্যেক বুদ্ধ নামে অভিহিত হন। এর নামই প্রত্যেক বুদ্ধযান। তাঁরা কিন্তু মানবকে বোধিমার্গে অধিগায়ন গমনে প্রবৃত্ত হন না। বোধিসত্ত্ব যানের সাধক শুধু নিজের বিমুক্তি নয়, সর্বজীবের দুঃখ মুক্তির জন্য বুদ্ধত্ব লাভে ইচ্ছুক। শ্রাবক যান ও প্রত্যেক বুদ্ধযান দুটো ‘হীনযান’ নামে এবং বোধিসত্ত্বযান ‘মহাযান’ নামে আখ্যায়িত করা হয়।

বৌদ্ধধর্মে মানুষ মাত্রকেই দুই শ্রেণীতে ভাগ করা হয়েছ পৃথকজন ও আর্য। যারা সংসার প্রপঞ্চেলীন হয়ে অজ্ঞভাবে জীবন অতিবহিত করে তাদেরকে পৃথকজন বলা হয়। আর যাঁরা সংসার প্রপঞ্চের দৃঢ় বন্ধনকেও ছিন্ন করে নির্বাণগামী মার্গে আরূঢ় হন, তাঁদেরকেই আর্য বলা হয়। তাঁদের চরম ল্য অর্হৎ পদের প্রাপ্তি। এই পদে পৌঁছতে হলে চারটি সোপান অতিক্রম করতে হয়- স্রোতাপত্তি, সকৃদাগামী, অনাগামী ও অর্হৎ।

চলবে