সংগৃহীত

সংগৃহীত

ভালোবাসার বানে ভেসে গেছে স্বৈরাচার প্রতিরোধ

রিফাত বিন সালাম

প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ১৪, ২০১৮

‘গুলিবিদ্ধ জয়নালকে সহজে ছাড় দেয়নি পুলিশ। গুলিবিদ্ধ অবস্থায় তার শরীরকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে ফালা ফালা করে দিয়েছিল তারা। নারী পুরুষ নির্বিশেষ সকলের উপর চালানো হয়েছিল অমানবিক নির্যাতন। সঙ্গে যোগ দিয়েছিল সেনাবাহিনী। লাশ গুম করার অভিযোগও উঠেছিল তাদের বিরুদ্ধে। সেদিন জয়নালসহ সারাদেশে প্রাণ দিয়েছিল সব মিলে ১০ জন। সরকারি হিসাবে এক দিনে গ্রেপ্তার হয় ১৩১০ জন।’ 

না, এটা স্বাধীনতার যুদ্ধ চলাকালীন কোন ঘটনা না। বরং স্বাধীন বাংলাদেশের ১৯৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারির ঘটনা। দিনটি একসময় ‘স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস’ হিসেবে পালন করা হত।

কিন্তু আজকের ভালোবাসা দিবসে হারিয়ে গেছে স্বৈরাচার এরশাদের সেই ১৪ ফেব্রুয়ারির রক্তপাতের ইতিহাস। সেটাই ছিল ১৪ ফেব্রুয়ারির আসল ইতিহাস। স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবসটি হারিয়ে যাওয়ার ঘটনার মধ্য দিয়ে ফুটে উঠে আওয়ামী লীগ বা বিএনপির মত দলগুলোর আসল চেহারা। একই সাথে এক শ্রেণীর সুবিধাবাদি বুদ্ধিজীবী, কবি, কলামিস্ট, লেখক, বিজ্ঞানীদের আসল ছবি। যারা মানুষের মাথা থেকে প্রতিবাদের ইতিহাসকে প্রায় মুছে দিয়েছে নামে মাত্র স্বাধীনতার বাণী শুনিয়ে।

 

 

১৯৮৩ সালের পর থেকেই দিবসটি ‘স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস’ হিসেবেই পালন করা হত। দেশের অধিকাংশ শিক্ষার্থীদের কাছে পরিচিত ছিল দিবসটি। কিন্তু ১৯৯৩ সালের দিকে সাংবাদিক শফিক রেহমান এবং ‘যায়যায়দিন’ পত্রিকার কল্যাণে সেই ২৬৯ সালে ইতালির মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত খ্রিস্টান পাদ্রী ও চিকিৎসক ‘সেন্ট ভ্যালেইটাইনস’ সাহেবের আবির্ভাব ঘটে বাংলাদেশে। ফলাফল সেন্ট ভ্যালেইটাইনসের নামের মধ্যে বিলীন হয় মুক্তিকামী মৃতদের নাম।

জাফর, জয়নাল, কাঞ্চন, দিপালী সাহাদের লাশের গন্ধ চাপা পরে যায় ভালোবাসা দিবসের গোলাপের সুগন্ধে। ১৯৯৩’র পর থেকে বই পত্রে আসে ভালোবাসা দিবসের গল্প কবিতা, টিভিতে নাটক। এরশাদের ১৪ ফেব্রুয়ারির হত্যাযজ্ঞের কোন সুস্থ বিচার হয়নি। কারণ সেই বিচার করতে হলে ৭২ থকে ৭৪ সালের মুজিব আমলের খুন হওয়া মৃত ছাত্রদের ভূতও উঠে আসবে। জিয়া আমলের হত্যাগুলোর কথা প্রকাশিত হয়ে যাবে। তাই সবার সুবিধার্থে এই দুই দলের যৌথ উদ্যোগে সব ছাত্র হত্যার গল্প মুছে দেয়া হয়েছে।

 

 

১৪ ফেব্রুয়ারির হত্যাকাণ্ডটি ছিল বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গী স্বৈরাচার এরশাদের শাসন আমলের শুরুর দিকের ঘটনা। তখান এরশাদের শিক্ষামন্ত্রী ছিলেন ড. আব্দুল মজিদ খান। ১৯৮২ সালের ৭ নভেম্বর মজিদ খান তার কুখ্যাত শিক্ষানীতি ঘোষণা করেন। তারই প্রতিবাদে রাস্তায় নামে সাধারণ ছাত্ররা। শুরু হয় ধরপাকড় ও পুলিশি নির্যাতন। তৎকালীন ছাত্র নেতাদের বক্তব্যে উঠে আসে সেনাবাহিনীর নির্যাতনের কথাও। অর্থাৎ পুরো রাষ্ট্রীয় যন্ত্র ছাত্রদের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়। কিন্তু ছাত্ররাও থেমে থাকেনি। তারই ধারাবাহিকতায় ওই শিক্ষানীতি প্রত্যাহার এবং বন্দি হওয়া আন্দোলনকারীদের মুক্তির দাবিতে ছাত্র জমায়েতের ডাক দেয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ।

সেদিন মিছিলে অংশ নেওয়া ছাত্রনেতা মোস্তাক হোসেনের তার বর্ণনাতে বলেছিলেন, “১৪ ফেব্রুয়ারি আরো সুশৃঙ্খল, আরো দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে ছাত্ররা কর্মসূচিতে যোগ দেন। মিছিলের প্রথমে শতাধিক ছাত্রীর অংশগ্রহণ ছিল উল্লেখ করার মতো। খুবই শান্তিপূর্ণ মিছিল ছিল, উৎসবের মতো অনেকটা। ব্যারিকেডের সামনে যখন মিছিল যায় হাইকোর্টের গেট ও কার্জন হল-সংলগ্ন এলাকায়, তখন মেয়েরা ব্যারিকেডের সামনে বসে পড়েন। নেতারা তারকাঁটার ওপর উঠে বক্তৃতা দিতে শুরু করেন। মিছিলটি ছিল হাইকোর্টের গেট থেকে বাংলা একাডেমি পর্যন্ত। কিন্তু কোনো উসকানি ছাড়াই তারকাঁটার একদিক কিছুটা সরিয়ে রায়ট কার ঢুকিয়ে গরম পানি ছিটাতে শুরু করে পুলিশ। এরপর ভেতরে ঢুকে বেধড়ক লাঠিচার্জ শুরু করে। সাধারণ ছাত্ররা তখন এদিক-সেদিক ছোটাছুটি করে পুলিশের দিকে ইট-পাটকেল ছুড়তে শুরু করেন। পুলিশ তখন ছাত্রদের ওপর গুলিবর্ষণ করে। এ সময় গুলিবিদ্ধ হন জয়নাল। সেদিন জয়নালকে গুলিবিদ্ধ করেই ক্ষান্ত হয়নি, তার শরীর বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে পুলিশ। বেয়নেট ফলা আর জয়নালের শরীর থেকে চুইয়েপড়া রক্ত বাংলার পথ-প্রান্তর ভাসিয়ে দেয়।”

 

 

শুধু জয়নাল নয়, ছাত্রদের ওপর পুলিশি তাণ্ডবের সময় শিশু একাডেমিতে একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে আসা দিপালী নামের এক শিশু গুলিবিদ্ধ হয়। তবে দিপালীর লাশ পুলিশ গুম করে ফেলে। জয়নাল পড়েছিলেন কার্জন হলের মধ্যে। তাকে ধরে ঢাকা মেডিকেলে নেয়া হলে চিকিৎসকরা মৃত ঘোষণা করেন। এ ঘটনা ছড়িয়ে পড়লে যেসব ছাত্র সকালে মিছিলে আসেননি, তারা বিকেলে জয়নালের জানাজায় বটতলায় উপস্থিত হন। হাজার হাজার সাধারণ মানুষও উপস্থিত হয়।

সকালের এই ঘটনার পর বিকেলের মধ্যেই ঢাবি ক্যাম্পাস একরকম দখলে নেয় সেনাবাহিনী-বিডিআর-পুলিশ। খুঁজে খুঁজে গ্রেপ্তার করা হয় অসংখ্য ছাত্রনেতা ও সাধারণ ছাত্রদের। হত্যা ও নির্যাতনের প্রতিবাদে তৎকালীন উপাচার্য পদত্যাগ করেন। যদিও স্বৈরাচার সরকারের পতন ঘটে আরও অনেক পরে। কিন্তু ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক’ এই শ্লোগানের সারমর্ম বুঝে যায় ছাত্র-জনতা। স্বৈরাচার এরশাদের পতনের পিছে এই আন্দোলন একটি চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করে।

একটা দিবসকে ‘ভালবাস দিবস’ বা ‘স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস’ হিসেবে পালন করা বা না করা সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত বিষয়। কিন্তু একটা দেশের ইতিহাসকে ধূলিসাৎ করার পেছনে থাকে একটা রাষ্ট্রীয় উদ্দেশ, থাকে লুটপাটের ধান্দা আর প্রতিবাদহীন মানব সম্পদ গড়ে তোলার একটা উদ্দেশ থাকে। তাই নব্বই-পরবর্তী সময়ে ধীরে ধীরে হারিয়ে যায় দিবসটি। স্কুল কলেজের পাঠ্য বইয়ে সে ইতিহাসকে মহান করে তুলে ধরা হয়নি। এর পেছনে কাজ করেছে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি এই দুই দলের ভাড়াটে বুদ্ধিজীবীরা। 


তাই তো ১৪ ফেব্রুয়ারির পত্রিকায় দামি লেখকদের ভালোবাসার গল্প ফুটে উঠে, নিহত শিশু দীপালিকে নিয়ে কোন প্রতিবাদি লেখা বা শোকগাঁথা খুঁজে পাওয়া যায় না।