ভাসাও ভেলা এই বেলা: প্রেম ও দ্রোহের বয়ান

এস এম মুকুল

প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ১৯, ২০১৮

মানুষ সে যতই বড় হোক, শৈশব-কৈশোরের স্মৃতিকাতরতা যেন আমরণ তার ভেতরে বাইরে চেতনার ঢেউ তোলে। আর অবাধ্য ঢেউয়ের উচ্ছ্বলতায় কবিমন বলে ওঠে, এখানে আকাশ নেই, পলাতক চাঁদ/ছায়া ফেলে উড়ে যায় প্রাচীন শকুন/ ভয়ার্ত আদিম চিৎকারে কাঁদে/জ্যোৎস্নার ফসিল...
 
 
‘জ্যোৎস্নার ফসিল’ এমন চমৎকার শব্দচয়নে কবি মোশতাক আহমেদ ‘কংশ এখন জ্বলন্ত চিতা’ শিরোনামের কবিতায় কংশনদীকে কাব্যিক উপমায় কালের সাক্ষি হিসেবে তুলে ধরেছেন। কবির জন্ম নেত্রকোনার বারহাট্টা উপজেলার সিংধা গ্রামের এক মধ্যবিত্ত পরিবারে। শৈশব কেটেছে কংশপারের মেঠোপথে জাম, বরুণ আর হিজলের ছায়ায় হেঁটে হেঁটে।
 
 
কবি মোশতাক আহমেদ সত্তুরের দশকের প্রগতিশীল রাজনীতির তেজস্বী কর্মী। সমাজের আলো-অন্ধকারের জরাজীর্ণতার জঞ্জাল ছিন্ন করে বিবেকের কাঠগড়ায় কবি নিজেকে দাঁড় করান প্রতিনিয়ত অন্য আলোর কাব্যিক ভাবনায়। তার কাব্যময়তা দ্রোহ-প্রেম-প্রীতির অমিয় লীলাখেলা। কবিতায় আছে ক্রোধ-ক্ষোভ-অসংকোচ ও প্রতিবাদের অকপট উচ্চারণ।
 
সমাজের ভাবগতি আর অসঙ্গতির প্রতি তীব্র তিরষ্কার ফুটে উঠেছে এমন কাব্যিক ব্যঞ্জনায়, বেহায়া মরদ, তোমার মুরোদ বুঝেছি/লজ্জা করে না গতরে বুলাও হাত?/জঠর জ্বলছে ক্ষুধার জ্বালায়/উনি এসে তাও পিরিতি ফলায়।’ সত্যিই সমাজের ভেতরের কুপ্রবৃত্তিকে তিনি চোখে আঙুল দিয়ে দেখানো চেষ্টা করেছেন। প্রেম যেন তার কবিতার গভীরে আশকারায় মাতাল মূহ্যতা ছড়ায়।
 
 
প্রেমকাতুর কবি বলেছেন, আমি বললাম, তোমার চুল তো দেখি/আগের চেয়ে আরো বেশি কালো হয়েছে এখন’। কিম্বা, ‘কচুপাতা রঙটা বুঝি এখনও তোমার প্রিয়ই আছে?/শাড়িটা কিন্তু তোমায় মানিয়েছে বেশ’। আবার তিনি প্রেমিকার প্রতি বাসনার খেদ প্রকাশ করেছেন এভাবে, ‘আসতে যদি সময় মতো দেখতে বিকেল কেমন করে/চপল চোখের দৃষ্টি ছুঁড়ে পালিয়ে বেড়ায় এদিক ওদিক/ আলোর সাথে খেলা করে দেখতে আরও সকালবেলায়/গোলাপ কলি কেমন করে পাপড়ি মেলে।’
 
 
কবি মোশতাক আহমেদের এই কাব্যগ্রন্থে যেসব শিরোনামের কবিতা ঠাঁই পেয়েছে সেগুলো হলো, কংশ এবং জ্বলন্ত চিতা, ভাসাও ভেলা এই বেলা, অক্টোপাস, ঘৃণা জানাবার ভাষা চাই, কমরেড জসীম মণ্ডল, কলিকালের ছড়া, লজ্জা, মুখগ্রন্থের চিল, খতনামা, ঐশীকে, বেহায়া মরদ, তুমি যদি বলো, কবিতা ও তুমি, অনুভব, দ্বিধা, সন্ধি, আসতে যদি সময়মতো, নীরবতা ১, নীরবতা ২, অনুকবিতা, আফগানিস্তান, আগুনিয়া গাং-এর কথা প্রভৃতি।
 
 
সাবলীলতা, সৃষ্টিশীল জীবনবোধ, সুস্থ রাজনীতির বিকাশ, ভালোবাসার মোহন মায়া আর মানবিক মূল্যবোধকে খুঁজে ফেরা একজন নিবিষ্ট ফেরারি কবি। তিনি জীবিকার প্রয়োজনে ঘুরে বেড়িয়েছেন পৃথিবীর একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে। সর্বশেষ জাতিসংঘের পলিটিক্যাল অ্যাফেয়ার্স অফিসার হিসেবে আফগানিন্তানে দীর্ঘদিন কর্মরত ছিলেন। নিয়মের ছকে বাঁধা চাকরি জীবন থেকে সম্প্রতি অবসর নিয়েছেন। জীবনের একপ্রান্তরে একষট্টি পেরিয়ে এসে অবসরের সঙ্গী হিসেবে কলম ধরেছেন। অসময়ের অন্ধকার অবগাহনকে কবি চিহ্নিত করেছেন ঠিক এইভাবে, লখিন্দরকে কেটে গেছে বিষাক্ত নাগ/সেই কবে/এখনও তবু প্রস্তুত নয় তোমার ভেলা! বেহুলা, আর কেন দেরি তবে/যেতে হবে দূর মনসার ঘাট/আর কেন দেরি তবে/এখনই সময়, বেহুলা/ভাসাও ভেলা এই বেলা। ‘ভাসাও ভেলা এইবেলা’ কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ।
 
 
কবি মোশতাক আহমেদের কবিতার বই ভাসাও ভেলা এই বেলা প্রকাশ করেছে পুঁথিনিলয়। পৃষ্ঠা সংখ্যা ৬৪, দাম একশো বিশ টাকা। প্রচ্ছদশিল্পী রাসেল রানা। বইটি পাওয়া যাবে একুশে গ্রন্থমেলায় পুঁথিনিলয় স্টলে। স্টল নম্বর ২০০-২০২।