ভিঞ্চি: সন্তের প্রচ্ছদে আরেক মানুষ

রাশেদ আহমেদ

প্রকাশিত : মে ৩১, ২০১৮

‘স্রষ্টা ছাড়া ঈশ্বরের সৃষ্টির মাহাত্ম্য কেউ বেশি উপলব্ধি করে না।’

লাল খড়িতে আঁকা আত্মপ্রতিকৃতি (৩৩.৩ সেমি উচ্চতা, ২১.৪ সেমি প্রস্থ)। লাল চকেই লেখা শিল্পীর নাম, লিওনার্দাস ভিঞ্চিয়াস। এই লাল চকের আবিষ্কারকও তিনি। এক ধরণের লোহাসমৃদ্ধ লালচে রঙের নরম পলল পাথর। ন্যুড স্টাডি ও প্রতিকৃতিকে নিখুঁত করে তুলে আনতে সহায়তা করে এই লাল খড়ি। পরে কালো কালিতে লেখা, পরিণত বয়সে তার আত্মপ্রতিকৃতি। যা এখন তুরিনের বিবলিওতেক এক্স-রয়্যালে সংরক্ষিত। সময়ের করাল থাবায় পাঠোদ্ধার করা যেমন কঠিন, প্রতিকৃতিটিরও একই দুরাবস্থা। লাল লাল ছোপ পড়েছে। এরপরও দেখলে মনে হবে, অদ্ভুত অমানিশা থেকে জেগে ওঠা জ্যোতিষ্ক। অন্তর্ভেদী চোখ। সিংহের মতো দাড়ি। বুড়ো ঈশ্বরের মতো। মুখটি বলে দিচ্ছে কী পরিমাণ কর্মময় শ্রমশীল এই স্রষ্টার জীবন!

কিংবা বিপরীত। তার শিল্পের মজা বা আশ্চর্যের দিকই এটি। এই শান্ত দয়াশীল চোখ, কখন যেন হয়ে ওঠেছে ক্রুদ্ধ ও অসুখী এক বৃদ্ধের চোখ। যাকে মানুষ রহস্য আর জাদু বলে ব্যাখ্যা করে আসছে এত এত বছর। পুরো নাম লিওনার্দো দি সের পিয়েরো দা ভিঞ্চি। রেনেসাঁর সন্তান লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি নামের এই শিল্পীর জন্ম ইতালির ফ্লোরেন্সের অদূরবর্তী ভিঞ্চি নামক অঞ্চলে। ফ্লোরেন্স থেকে যার দূরত্ব প্রায় পঁয়তাল্লিশ কিলোমিটার। নামের শেষে জন্মস্থানের নাম যুক্ত করা একটি পুরনো রেওয়াজ। সেই সূত্র ধরে নামের শেষের এই ভিঞ্চি।

‘এই স্বর্গযুগ, এই শতাব্দী আলোয় এসেছে সেসব প্রায়-নিষিদ্ধ, মুক্ত শিল্পগুলিকে: ব্যাকরণ, কাব্য, অলংকার, চিত্রকলা ভাস্কর্য, স্থাপত্য, সঙ্গীত, আরফিক লায়ার সহযোগে— সবই প্রধানত ফ্লোরেন্সে।’ মধ্যযুগের লণ্ডন এই ফ্লুরেন্স তখন বাণিজ্যে পৃথিবীর সেরা শহরগুলোর সঙ্গে কাঁধ মিলিয়ে হাঁটছে। অর্থে-বৈভবে ভরপুর উচ্চাভিলাসী শহর ফ্লোরেন্স। আর তখন শিল্পের তীর্থভূমিতে মাইকেল এঞ্জেলো ও ভিঞ্চির মতো শিল্পীরা ঘটিয়ে চলছেন পৃথিবীর অবাকতম কাণ্ড। সৃষ্টি হচ্ছে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম শিল্পগুলো।

বাবা-মার স্নেহহীন দাদা-দাদির সংসারে বড় হওয়া এই শিল্পীর শৈশব খুব সুখের ছিল না। একদিকে সৎমা, অন্যদিকে সৎবাবা। মধ্যে লিওর মলিন শৈশব। ১৪৬৮ তে দাদা-দাদির মৃত্যুর পর লিও ফ্লোরেন্সে পাড়ি জমান। অবৈধ জন্মের গ্লানিময় জীবনের রথ ঠেলে তিনি পৌঁছে যান তৎকালীন উচ্চাভিলাসী নগরী ফ্লোরেন্সের প্রথম কাতারে। তার জন্য তাকে নাকউঁচু এই সমাজে কম বঞ্চনা সইতে হয়নি। কম কাঠখড় পুড়াতে হয়নি। সইতে হয়েছে অসুরিক কায়িক শ্রম সাধনা। সমকামী এই শিল্পী একসময় গর্ব করে বলতেন, আমি অশিক্ষিত মানুষ।

সমালোচকদের দিকে তাক করে তিনি বলতেন, ওরা ভাবে, আমার সাহিত্য পাঠের অনভিজ্ঞতার জন্য আমি যে বিষয়টিকে আঁকছি তার বর্ণনায় কোনও খামতি থেকে যায়। আসলে ওরা জানে না, সরাসরি অভিজ্ঞতাই শিল্পের প্রথম প্রয়োজন— অন্যের লেখা রচনা থেকে পাঠ নয়। তিনি বলতেন, ‘পঞ্চেন্দ্রিয়ই আমার শিক্ষক’। তিনি লিখিছিলেন, ‘আমাদের সব জ্ঞানই আসে অভিজ্ঞতা থেকে।’ এই শিল্পী আজীবন চেষ্টা করে গেছেন শিল্পের জন্য ভিন্ন কিছু, আলাদা কিছু করতে। তারই ফলশ্রুতিতে তিনি সেই সময় মৃতদেহ ব্যাবচ্ছেদ এবং তা স্কেচ করা আর রঙের নিখুঁতায়নে এমনই মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন যে, বিস্ময়ের ঘোর পৃথিবী আজ অবধি কাটিয়ে উঠতে পারেনি। তিনি বাঁ-হাতি ছিলেন, ছিলেন নিরামিষ ভোজি। পরতেন হাঁটু পর্যন্ত লম্বা এক ধরণের লাল কোর্তা। ছিল সর্বজন শ্রদ্ধা জাগানিয়া সন্তসুলভ ভাবমূর্তি। আর তার ডায়েরী বলে অন্য কথা। অসুখি, নিঃসঙ্গ ও তিক্ততায় জারিয়ে যাওয়া এক ক্লান্ত পান্থের কথা। এই দৈত সত্তাকে তিনি তার শিল্পে মূর্ত করে তুলতে পেরেছেন। যা একই সঙ্গে শ্রদ্ধার এবং বিস্ময়কর।

তিনি ছিলেন একাধারে দার্শনিক, ভাস্কর, স্থপতি, সঙ্গীতজ্ঞ, সমরবিদ ও বিজ্ঞানী। কেউ কেউ বলত, ভিঞ্চি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জ্ঞানী। মোনালিসা, দ্য লাস্ট সাপার, জিনেভ্রা, লেডি উইথ এন এর মাইরে মতো অনেক শতাব্দীচিহ্নক শিল্পের স্রষ্টা তিনি। এই শিল্পী জীবনভর হন্যে হয়ে ছুটে বেড়িয়েছেন যেমন জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায়, তেমন ঘুরে বেড়িয়েছেন মিলান, রোম, ফ্রান্স। ফ্রান্সেই তিনি শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ১৪৫২ সালের রাতের তৃতীয় প্রহরে, সাড়ে দশটায় এই শিল্পীর জন্ম।

কৃতজ্ঞতা: যশোধরা রায়চৌধুরীর তর্জমাকৃত ‘লিওনার্দো দা ভিঞ্চি’