ভুল বিশ্বাস প্রচারকারী মতবাদগুলো

মুযাফ্ফর বিন মুহসিন

প্রকাশিত : জানুয়ারি ১৭, ২০১৮

ইসলামের নামে যুগ যুগ ধরে নানা মতবাদ ও আচার আমাদের সমাজে স্থায়ী আসন তৈরি করে নিয়েছে। বস্তুত যা কোরআন ও হাদিস বিরোধী। বিশ্ব ইজতেমা নামে যে আয়োজন হয় টঙ্গীর তুরাগ নদীর তীরে, তা যে শিরকের পর্যায়ে পড়ে, একথা শুনে অনেকেই তেড়ে উঠবেন। এসব বিষয়ে কোরআন ও হাদিস থেকে যৌক্তিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন মুযাফ্ফর বিন মুহসিন। আজ প্রকাশিত হলো প্রথম পর্ব।  

সুফিবাদ
আরবি ছুফ শব্দ থেকে সুফি শব্দের জন্ম। ছুফ অর্থ পশম। সুফিরা তাদের সন্ন্যাসের ভান ধরে পশমের কাপড় পরতো বলেই তাদেরকে সুফি বলা হয়। সুফি রোগগ্রস্ত কতিপয় মূর্খব্যক্তি একে আহলে ছুফফার সাথে তুলনা করেন। এটি নিতান্তই অজ্ঞতা। ইবনে খালদুনের মতে, দ্বিতীয় শতাব্দী হিজরীতে এই মতবাদের জন্ম হয়। মরমীবাদ বলেও এর পরিচিতি রয়েছে। খ্রিস্টান, বৌদ্ধ, হিন্দু, পারসিক ও গ্রীক দর্শনের সাথে মিশ্রিত হয়ে মুসলিম সমাজে মারেফতের নামে এসব মতবাদের অনুপ্রবেশ ঘটে। ইরাকের বসরা নগরীতে যুহদ বা দুনিয়া ত্যাগের প্রেরণা থেকে এটা প্রথম শুরু হয়। এ দর্শনের সাথে ইসলামের কোনো সম্পর্ক নেই। রাসুল (সা.), সাহাবা ও তাবেঈদের তিনটি স্বর্ণযুগে এর অস্তিত্ব ছিল না। ইরানের আবু ইয়াজিদ বায়েজিদ বোস্তামি (মৃত ২৬১ হিজরী) এবং হুসাইন বিন মানসুর হাল্লাজ (মৃত ৩০৯) এ দর্শনের মূল প্রচারক ছিলেন। পরে সুফি সম্রাট সিরিয়ার মুহিউদ্দীন ইবনুল আরাবী (মৃত ৬৩৮) এ বিশ্বাসের বিস্তৃতি ঘটান।
এ দর্শনে বিশ্বাসী লোকেরা আল্লাহভীতি অর্জন ও সার্বক্ষণিক জিকির করা এবং দুনিয়া থেকে মুক্ত হওয়ার জন্যে জঙ্গলে আশ্রয় নেয়। এ প্রচেষ্টায় সফল হতে তারা অসংখ্য শিরক ও বিদ’আতের আবিষ্কার করে। যারা উক্ত মতবাদে বিশ্বাসী তাদের মধ্যে অসংখ্য শিরকি, কুফরি ও বিদ’আতি বিশ্বাস রয়েছে। যেমন, ওয়াহদাতুল ওজুদে বিশ্বাস, প্রকৃত সুফিই আল্লাহ, যিনি আল্লাহ তিনিই মুহম্মদ, নবি-রাসুলদের চেয়ে সুফিরাই শ্রেষ্ঠ ইত্যাদি।
সমগ্র পৃথিবীতে ইসলামের নামে যত ভ্রান্ত দল ও মাজহাব রয়েছে, সেগুলোর প্রায় সবই সুফি রোগে আক্রান্ত। যেমন, দেওবন্দি মতবাদের যত শাখা-প্রশাখা আছে, সবই সুফিবাদে বিশ্বাসী। তাদের সবচেয়ে বড় শাখা ইলিয়াসি তাবলিগ। একইভাবে চরমোনাই, হাটহাজারি, পটিয়া ইত্যাদি সবই সুফি তরিকায় বিশ্বাসী। অন্যদিকে তাদের চরম বিরোধী মতবাদ ব্রেলভি তরিকা। তারা বায়েজিদ বোস্তামি, মনসুর হাল্লাজ, ইবনুল আরাবির একনিষ্ঠ এজেন্ট ও মূল উত্তরসূরি। তারা কবর, মাজার, খানকা, গাছ, পাথর, মাছ, পুকুর, আগুন, মানুষ, মূর্তি, পির-ফকির ইত্যাদি পূজায় খুবই দক্ষ। জিকিরের নামে রাতের মসজিদগুলোতে তারা নারী-পুরুষ একাকার হয়ে নষ্ট জগতে বিলীন হয়ে যায়। আটরশি, ছারছীনা, মাইজভাণ্ডারি, দেওয়ানবাগী, রাজারবাগী, চন্দ্রপুরী, কুতুববাগী, ফুলতলী প্রভৃতি লাখ লাখ খানকা শিরকের বিশাল বিশাল উৎপাদন কেন্দ্র। সবার মাঝেই সুফি দর্শনের চর্চা রয়েছে। উক্ত মতবাদের মাধ্যমে যেমন পির-ফকিরি প্রতারণার জন্ম হয়েছে, তেমনই মুসলিম সমাজে কুফরি, শিরকি, বিদ’আতি, বিধর্মীয় ও জাহেলি বিশ্বাসের বিস্তার ঘটেছে।

তাবলিগ জামায়াত
১৯২১ সালে ভারতের হরিয়ানা রাজ্যের মেওয়াত এলাকায় ফিরোজপুর নিমক গ্রামে মাওয়ানা ইলিয়াস (১৮৮৫-১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দ) তাবলিগ জামায়াত প্রতিষ্ঠা করেন। এ মতবাদের মূল গ্রন্থ তাবলিগি নেসাব, যা ফাজায়েলে আমল নামেও পরিচিত। এর লেখক ইলিয়াসের জামাই, ভাতিজা ও ছাতও মাওলানা জাকারিয়া (১৮৯৮-১৯৮২ খ্রিস্টাব্দ)। এ বই প্রকাশিত হয় ১৯৭৫ সালে। ইলিয়াসের পুত্র মাওলানা মুহাম্মদ ইউসুফ কান্ধলভির (১৯১৭-১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দ) লেখা এবং মুহাম্মদ সা’দ কর্তৃক উর্দু অনুদিত মুন্তাখাব হাদিস বইটিও তাদের অনুসরণীয়। এটি প্রথম প্রকাশিত হয় ২০০০ সালে। দেওবন্দি আলেমদের মতবাদকে তারা সর্বাধিক মূল্যায়ন করে। ওই বই ছাড়াও মাওলানা আশরাফ আলীর বেহেস্তি জেওর, নিয়ামুল কোরআন ও মকছুদুল মুমেনিনকে তারা অনুসরণ করে।
মাওলানা ইলিয়াস ১৯৪৪ সালের ১২ জুলাই মারা যান। ফলে তার পুত্র মাওলানা ইউসুফ কান্ধলভিকে আমিরের দায়িত্ব দেয়া হয় এবং তার মাথায় পিতার পাগড়ি পরানো হয়। ১৯৬৫ সালে ফেব্রুয়ারি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে ঢাকার ইজতেমায় অংশগ্রহণ করেন। তিনি মাত্র ৪৮ বছর বয়সে ১৯৬৫ সালের ২ এপ্রিল মারা যান। তার জানাজা পড়ান মাওলানা জাকারিয়া। এরপর জাকারিয়ার জামাই মাওলানা ইনআমুল হাসান কান্ধলভিকে (১৯১৮-১৯৯৫ খ্রিস্টাব্দ) দায়িত্ব দেয়া হয়।
বাংলাদেশে এর কার্যক্রম শুরু হয় ১৯৪৪ সালে। আর বার্ষিক ইজতেমার সূচনা হয় ১৯৪৬ সালে। ঢাকা কাকরাইল মসজিদে এর উদ্বোধন হয়। ১৯৪৮ সালের বার্ষিক ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয় চট্টগ্রাম হাজী ক্যাম্পে। এরপর নারায়নগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে অনুষ্ঠিত হয় ১৯৫৮ সালে। লোকসংখ্যা বাড়তে থাকলে ১৯৬৬ সালে টঙ্গীর পাগাড় গ্রামের মাঠে বার্ষিক ইজতেমার আয়োজন করা হয়। এরপর ১৯৬৭ সাল থেকে তুরাগ নদীর তীরে প্রতি বছর কথিত বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। সাবেক ডিআইটি বর্তমানে ‘রাজউক’ এর ১২৫ একর জমি ইজতেমার মাঠ হিসেবে ব্যবহার করা হতো। অবশ্য ১৯৬৭ সালেই তৎকালীন পাকিস্তান সরকার তাবলিগ জামায়াতকে এ মাঠ ব্যবহারের মৌখিক অনুমতি দেয়। ১৯৯৫ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া আনুষ্ঠানিকভাবে ইজতেমা কর্তৃপক্ষকে তিন শতাধিক একর জমি স্থায়ী বন্দোবস্ত দেন।
ফাজায়েলে আমল বা তাবলিগি নেছাব নামের দুই খণ্ডে সমাপ্ত একটি বই রয়েছে। সেগুলো পার্ট পার্ট করা। যেমন মূল উর্দু বইয়ের ধারাবাহিকতা হলো, ১. হেকায়েতে ছাহাবা। ২. ফাজায়েলে নামাজ। ৩. ফাজায়েলে তাবলিগ। ৪. ফাজায়েলে জিকর। ৫. ফাজায়েলে কুরআন। ৬. ফাজায়েলে রামাজান। ৭. ফাজায়েলে দরুদ। ৮. ফাজায়েলে ছাদাক্বাত প্রথম অংশ। ৯. ফাজায়েলে ছাদাক্বাত দ্বিতীয় অংশ। ১০. ফাজায়েলে হজ্ব। ১ থেকে ৭ অংশ নিয়ে ফাজায়েলে আমল নামে প্রথম খণ্ড। আর বাকি অংশ নিয়ে তাবলিগি নেছাব দ্বিতীয় খণ্ড প্রকাশিত হয়েছে। উল্লেখ্য যে, বাংলা অনুবাদে শ্রেণিবিন্যাস একটু পরিবর্তন করা হয়েছে এবং বিভিন্ন অংশ নিয়ে পৃথক পৃথক বই ছাপানো হয়েছে। মূলত মাওলানা ইলিয়াসের স্বপ্নের ওপর ভিত্তি করেই উক্ত জামায়াতের সূচনা। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, আজকাল আমার ওপর স্বপ্নে ছহি ইলম অবতীর্ণ হচ্ছে। এজন্য চেষ্টা করব যেন বেশি বেশি আমার ঘুম আসে। আনন্দের কারণে যখন ঘুম কম হতে লাগল, তখন ডাক্তার ও কবিরাজের পরামর্শে আমি মাথায় তেল মালিশ করলাম। ফলে ঘুমে ডুবে গেলাম। তাবলিগের এ তরিকাও আমার ওপর স্বপ্নে প্রকাশ পেয়েছে।
পর্যালোচনা: ইসলামের মানদণ্ড বা সংবিধান হলো কোরআন ও হাদিস। মুহাম্মদ (সা.) শেষ নবি। কিয়ামতের আগপর্যন্ত আর কোনও নবি আসবে না, এবং নাজিল হবে না কোনও রীতিনীতি। হযরতের মৃত্যুর মাধ্যমে সবকিছু বন্ধ হয়ে গেছে। ইসলামি তাবলিগের পদ্ধতি আল্লাহর পক্ষ থেকে নাজিল হয়েছে মুহাম্মদের (সা.) ওপর। কিন্তু ইলিয়াস যা দাবি করছেন, তা স্বপ্নে পাওয়া উদ্ভট ধর্ম। ইসলাম স্বয়ং আল্লাহর দেয়া জীবনবিধান। ইলিয়াসি তাবলিগের মতো মানুষের মস্তিষ্কপ্রসূত কোনও বানানো ধর্ম ইসলাম নয়। তাই ইসলামি দাওয়াতের শুদ্ধ পদ্ধতিই কেবল অনুসরণযোগ্য। স্বপ্নে পাওয়া মিথ্যে ধারণার কোনও মূল্য এখানে নেই।
তাদের মূল সমস্যা বিশ্বাসে। সুফিবাদে বিশ্বাসী হওয়ায় তাদের মদ্যে সুফিদের দর্শন সবই রয়েছে। যেমন, বিশ্বাস করা যে, আল্লাহ নিরাকার ও সর্বত্র বিরাজমান। তারা মনে করে, পৃথিবীর অস্তিত্বশীল সবই আল্লাহর অংশ। অর্থাৎ তারা ওয়াহদাতুল ওজুদে বিশ্বাসী। নবি মুহাম্মদ (সা.) আমাদের মতো কবরে জীবিত আছেন, এবং মানুষের কথা শোনেন, উপকার করেন। আল্লাহর নবিসহ অলিরাও গায়েব জানেন। নবি মুহাম্মদের পেশাব-পায়খান পবিত্র। স্বপ্নে পাওয়া বিষয়গুলোও শরিয়াত। টঙ্গীর ইজতেমায় অংশগ্রহণ করলে হজ্জ বা ওমরার সওয়াব পাওয়া যাবে। এ ধরনের অসংখ্য শিরকি বিশ্বাস তাদের মধ্যে রয়েছে।

চলবে...

লেখকের ‘ভ্রান্ত আক্বীদা বনাম সঠিক আক্বীদা’ বই থেকে পুনর্মুদ্রণ করা হলো