ভূত বিলাসের ঘর

আত্মজীবনী ৬

শ্রেয়া চক্রবর্তী

প্রকাশিত : মে ২৫, ২০১৮

ছায়াঘেরা ঝাউপথের মধ্যে দিয়ে যেতে হতো সেই বিদ্যালয়ে। পথের দুপাশে ঝাউ আর দেবদারু গাছ। এ গাছের শাখা যেন ও গাছের শাখাকে আলিঙ্গন করে আছে। আর গুটি কয়েক শিশু চলেছে সেই আলোছায়ার রৈখিক পথে বাবুভাইয়ের ভ্যানে। ফিরতি পথে রবার্ট ফ্রস্টের `স্টপিং বাই উডস অন আ স্নোয়ি ইভনিং` এর মতোই আমরা কখনো কখনো লাফ দিয়ে নেমে পড়তাম ভ্যান থেকে।

হুস উডস দিস আর আই থিঙ্ক আই নো
হিজ হাউস ইস ইন দ্য ভিলেজ দো
হি উইল নট সি মি স্টপিং হিয়ার
টু ওয়াচ হিজ উডস ফিল আপ উইথ স্নো

বরফ ঝরতো না হয়তো, কিন্তু রোদ বৃষ্টির লুকোচুরি খেলায় আপ্লুত বালিকারা সেদিন কি বুঝেছিলো বাড়ি থেকে স্কুল পৌঁছেনোর পথটি আসলে অনন্ত? সে পথে যাতায়াত আজীবন লেগে থাকে, আর প্রতিদিন নিজের কাছে শপথ নিতে হয় নিজেকে নতুন করে চেনার সেই ফেলে আসা শৈশবের পড়ন্ত আলোয়। সে পথে দুদিকে যতদূর চোখ যেত আদিগন্ত জলাভূমি, সেখানে আমস্তক ডুবে থাকে মোষের পাল, পানিফলের চাষ, তারপর মোটরগাড়ির কারখানা পার করে সোজা... সেই ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড়!

আট দশটি শিশু নিয়ে স্কুলগামী ভ্যানটি টানতো বছর কুড়ির বাবুভাই। আমরা কলকল করতে করতে যেতাম। স্কুলে পৌঁছে একে একে সবচেয়ে ক্ষুদে শিশুগুলোকে কোলে করে ভ্যান থেকে নামিয়ে দিতো বাবুভাই। কারো ব্যাগ ঝুলে গেছে কাঁধ থেকে, কারো বোতল রাস্তায় তো কারো টিফিন বাক্স গড়াগড়ি যাচ্ছে। ওই বয়সে মানুষ নিজেকেই সামলাতে পারে না, তারওপর অতকিছু সামলানো। ওই বোতল বাক্সসমেত অনেকটা মায়ের মতোই শিশুগুলোকে স্কুলের দরজা অবধি পৌঁছে দেয়ার কাজ ছিলো বাবুভাইয়ের।

নার্সারি, কেজি ওয়ান, কেজি টু এই নিয়ে ছিলো শিশুনিকেতন। ছোট ছোট টেবিল-চেয়ার বই রাখার ডেক্সসমেত, সামনের দেয়ালে বড় ব্ল্যাকবোর্ড। পাশাপাশি এক এক ক্লাসে গোটা ত্রিশ ক্ষুদে পড়ুয়া, সেই ওতপ্রোত বন্ধনের শুরু। একসাথে কলকল ওপর-নিচ ছুটে বেড়ানো, হাতধরাধরি করে দোলনা স্লিপ, একইসাথে সুর করে অ আ ক খ, টিফিনবেলা বাপুজি কেকের ভাগ। এরাই কেউ ভালোবাসা কেউ শক্তি কেউ দুর্বলতা কেউ বিদ্বেষ কেউ হিংসা পরশ্রীকাতরতা কেউ স্নেহ শুশ্রূষা বন্ধুতার নানান প্রতিফলন হয়ে মনের ফার্নেসে কত যে কবিতার খোলামকুচি ছুঁড়ে দেবে আজীবন। সেদিন সে সত্যের অজ্ঞাতসারে কেবল মাথা উঁচু করে ছিলো হাত ধরাধরি করে বড় হতে চাওয়ার দাবি, ঢঙ ঢঙ করে ছুটির ঘণ্টা বাজলেই যার আরো একদিন পূর্ণতার দাবিতে ঘরে ফেরার ডাক আসতো।

আমার তখন দুদিকে লম্বা বিনুনি। হাই মায়োপিক ভিশন ধরা পড়ায় একচোখে ঠুলি লাগিয়ে স্কুলে যেতে হতো। তারপর এলো হাই পাওয়ারের চশমা। স্কুল থেকে ফেরার সময়ও সেই বাবুভাই। কেউ হয়তো বমি করতে করতে ফিরলো সারা রাস্তা। ভ্যান টানতে টানতেই সবার ভালোমন্দের খোঁজ রাখতো বাবুভাই। এরসাথে ফাউ ছিলো দু’এক ক্লাসের বড় দিদিদের রাঙাচোখের শাসন। হাতে স্কেল নিয়ে রীতিমতো তাদের মাতৃসুলভ তর্জন গর্জন চলতো সারাটা রাস্তা, ‘এই টিফিন বক্স খোলতো। একি কলা পড়ে আছে কেন? খা বলছি! এক্ষুণি শেষ কর। জল খেয়েছিস? দেখি? খা বলছি! এই একদম বকবক করবি না। এই যে স্কেলটা দেখছিস?’

শাসিতের শাসন বড় ভয়ংকর। আমি আর রাজরূপা মুখ বুজে সব টিফিন সাফ করে দিতাম। ঢকঢক করে জল খেতে খেতে প্রায় বাড়ির গলি এসে গেছে। এবার বোচকাসমেত বাচ্চাটিকে বাড়ির দরজা অবধি পৌঁছে দেয়া ছিলো বাবুভাইয়ের কাজ। অনেকসময় বোচকা থাকতো বাবুভাইয়ের কাঁধে, শিশুটি আপন মনে চলতো আগে আগে। যেদিন বৃষ্টি হতো খুব গোটা ভ্যানটা মোড়া থাকতো প্লাস্টিকের পরদায়। সামনে দিয়ে জলের ছাঁট আসতো তবু। বাবুভাই নিজের মাথায় ছাতা না ধরে সেই ছাতা দিয়ে আড়াল করতো আমাদের। ভাইদের থেকেও যে ভয়ের কিছু আছে, তাদের থেকেও যে সতর্ক থাকতে হয়, এ খবর ছিলোই না আমাদের কাছে।

তখন বিকেলবেলা পাড়ার বন্ধুদের সাথে খেলার রেওয়াজ ছিলো। ছোঁয়াছুঁয়ি, কুমিরডাঙ্গা, স্ট্যাচু স্ট্যাচু, ডাঙ্গুলি, কাল্পনিক রাজদরবার আরো কত কী! পাশের বাড়ির পিকুদা যে নাকি কৃষ্ণাচতুর্থীর চাঁদ দেখে বলতো, ‘এ চাঁদ তো সে চাঁদ নয়’, রাজার ভূমিকা নিতো। হ্যান্ডেল ভাঙা চেয়ারে সে ঠ্যাংয়ের ওপর ঠ্যাং তুলে বসতো নবাবি রোয়াবে আর আমরা তাকে পান পাতার লুচি, ইটের খোয়া দিয়ে বানানো আলু চচ্চরি রান্না বাটির বাসনে করে এনে পরিবেশন করতাম। সেই রাজা রাজা খেলার বদলে রাণীমা রাণীমা খেলার চল তখনো হয়নি। মানে কোনও এক পিঙ্কিদি ওই আরামকেদারায় বসে হাই তুলছে আর পিকুদা তাকে পান সেজে এনে দিচ্ছে, এমন সংসার ও সময় খুব একটা দেখা যেত না। নাহলে আমারও যে পিকুদার হ্যান্ডেলভাঙা চেয়ারে বসে পান পাতার লুচি খাওয়ার লোভ হয়নি, এমনটা নয়!

খেলতে খেলতে অন্ধকার হয়ে আসতো আর আমি সোজা দিদিমার পাশে। ক্রাউন টিভিতে উত্তম-সুচিত্রার সিনেমা দেখতে দেখতে রাত হয়ে যেত। অগ্নিপরীক্ষা, হারানো সুর, শাপমোচন, চাওয়া পাওয়া, সাগারিকা- আরো কত কত ছবি! চার বছরের বালিকার মনে সেই তখন থেকেই প্রেমিক বলতে উত্তম কুমারের ছবিটাই গেঁথে গেছিলো। প্রেম বলতে ঠিক কি বোঝায় তা তখন জানি না, কিন্তু প্রেমের ছবিটি মনের ভেতর কোথাও ঠিক ওই পয়েন্টে এসে ফ্রিজ করে গেছিলো যেখানে উত্তম-সুচিত্রার কাছে কিছু একটা অনুনয় করছে আর সুচিত্রা ঘাড়টা ঠিক নাইন্টি ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে রেখে পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে উত্তমের দিকে চেয়ে আছে। আহা কী অভিমান! অথবা জানলার ধারে দাঁড়িয়ে উত্তম গাইছে আর সুচিত্রা হাসি হাসি মুখ করে তাকিয়ে আছে...
নীড় ছোট ক্ষতি নেই আকাশ তো বড়,
এ মন বলাকা মোর অজানার আহ্বানে
চঞ্চল পাখা মেলে ধরো।

সেই তবে থেকেই ভালোবাসায় একটা গোটা আকাশ খুঁজে ফিরেছি আমি। এমন সময় হঠাৎ শুনতে পেতাম মায়ের ফেরার শব্দ। একদিন খুব রেগেমেগে বললো, ‘এই তো দেখে এলাম উপমা মন দিয়ে পড়ছে। আর তুই? কেবল টিভি টিভি টিভি। লেখাপড়ায় মন নেই।’ হ্যাঁ, লেখাপড়ায় মন নেই এমন অভিযোগ এ জীবনে আমাকেও শুনতে হয়েছিলো । তবে ওই একবারই। তার দুদিন আগে স্কুল থেকেও রিপোর্ট এসেছে মায়ের কাছে। কাজেই এই অপমান আর সইলো না। তারপর পণ করে উত্তম সুচিত্রার সিনেমা দেখা ছেড়ে দিয়েছিলাম।

আসলে এই যে আমরা এত স্কুল স্কুল করি, আলমা ম্যাটার আরো কত অভিধায় ভূষিত করি তাকে, এই স্কুলের ছবিটি আমাদের মনে ঠিক কিভাবে ধরা দেয়? স্কুল বলতে কি স্কুলবাড়িটা বোঝায়? জানলা দরজা চেয়ার টেবিল ব্ল্যাকবোর্ড বোঝায়? স্কুলের সবুজ মাঠ রাধাচূড়া কৃষ্ণচূড়া কাগজফুল বোঝায়? টানা বারান্দাটা নাকি সরস্বতী পুজোর আলপনা? খেলাঘর না দেয়ালপত্রিকা? দিদিভাইরাই কি স্কুল নাকি আমরা ছাত্রীরা? আসলে এই সবগুলোই, যা কিনা প্রত্যেকেই একটি নিজস্ব রঙ আর অভিঘাত নিয়ে মনের গোপনে সবচেয়ে নরম কোনও জায়গায় নিজস্ব পৃথিবী সৃজন করে। মনের ভেতরের ওই সবচেয়ে নরম জায়গাটির নাম হলো, স্কুল। যেখানে শৈশবের নাম না জানা ভালোবাসা ও ভয়, আলো ও অন্ধকার পরস্পর ওভারল্যাপ করে জড়াজড়ি করে শুয়ে থাকে। তাই স্কুলের আরেক নাম বন্ধুতা, যার স্মৃতি তোমার মনকে তোমার অজান্তেই অন্ধকার থেকে আলোর দিকে নিয়ে আসে... তমসো মা জ্যোতির্গময়।

জীবনটা একটা ম্যারাথন রেস। সময় থেমে থাকে না। শিশুনিকেতনের কচি ছাত্রীটি একদিন শিক্ষানিকেতন বিদ্যানিকেতন ছাড়িয়ে অজানা ফুলের গন্ধে জীবনের পাতাঝরা অরণ্যে মিশে যায়। তবু বারবার স্মৃতির কাছে ফিরে আসতে হয় তাকে। বারবার হাঁটুগেড়ে বসতে হয় দেবদারু বনে। বারবার জীবনের খেলাঘরে রাখতে হয় তার কাল্পনিক স্বীকারোক্তি। তারপর ফিরে যাওয়ার আগে মঞ্চে উঠে দাঁড়িয়ে একমনে নিবিষ্ট হয়ে সে পাঠ করে রবার্ট ফ্রস্টের ভাষায় জীবনের আক্ষরিক সংলাপ:
দিস উডস আর লাভলি ডার্ক অ্যান্ড ডিপ
বাট আই হ্যাভ প্রমিসেস টু কিপ
অ্যান্ড মাইলস টু গো বিফোর আই স্লিপ
অ্যান্ড মাইলস টু গো বিফোর আই স্লিপ।

তারপর ঢঙ ঢঙ করে ঘণ্টা বাজে। ছুটির ঘণ্টা। ফিরে আসতে হয়। ফিরে আসা বাধ্যতামূলক, তবু মনেমনে আসা যাওয়া লেগে থাকে।

চলবে