ভূত বিলাসের ঘর

আত্মজীবনী ৭

শ্রেয়া চক্রবর্তী

প্রকাশিত : জুন ০৫, ২০১৮

শিশুদেরও আত্মস্বীকৃতির চাহিদা থাকে। সেও আপনজনের ভালোবাসায় নিজের মূল্য সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠে। সিকিওর ফিল করে। সেল্ফ কন্ফিডেন্স তৈরি হওয়ার ওটাই সবচেয়ে প্রথম সোপান। ওই ধাপটুকু মিস হলে শিশুর মনে ভয় তৈরি হয়। সিস্টেম এমন ভাবেই তৈরি হয়ে আছে। অথচ প্রকৃতি তাকে জন্মকালীন মাতৃদুগ্ধটুকু ছাড়া আর কিসেরই বা ভরসা দিয়েছে? সেই যে বাঘিনীর গল্পটা পড়েছিলাম, যে তার শাবককে শিকার আর সাঁতারের মোক্ষম স্কিলটুকু দিয়েই বনের ভিতর একা একা ছেড়ে দিতো। কী বলিষ্ঠ সেই মাতৃত্ব। সে তো জানে, সে বুঝেছে, এই অসম্ভব অরণ্যময় পৃথিবীতে নিজের খাবারটুকু সংগ্রহ করার যে লড়াই নিজেকে টিকিয়ে রাখার যে লড়াই— সেই আসল লড়াই। অথচ মানবশিশু! সে তো আজন্মলালিত, বড় অসহায়। চিরটাকাল তার কাউকে না কাউকে দরকার হয় ভালোবাসা দেয়ার জন্য, সান্ত্বনা দেয়ার জন্য, স্বীকৃতির জন্য, খুব ইনসিকিওর একটা স্পিসিজ!

আমিও তাই ইনসিকিওর ছিলাম খুব। বাড়ির দিদিমণি পড়া না পারলে ফ্যানে ঝুলিয়ে দেয়ার ভয় দেখিয়ে মহাভারত দেখতে উঠে যেত। ছোট টুলে সাদা খাতায় পেন্সিল দিয়ে খসখস করে লিখতে লিখতে শুনতাম পাশের ঘর থেকে ভেসে আসছে কবির বাণী,
যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত
অভ্যুত্থানমধর্মস্য তদাত্মানং সৃজাম্যহম্
পরিত্রাণায় সাধুনাং বিনাশায় চ দুষ্কৃতাম
ধর্মসংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি চ যুগে যুগে

শব্দের মধ্যে একটা শান্তি ছিলো। কী অদ্ভুত এক দ্যোতনা। যেন কত জন্মের স্নান সারা হতো শব্দের পাতকুয়োর ভেতর। আর ওই খসখস করে লিখে চলা। ইচ্ছে হতো ওর ভিতর আশ্রয় নেই। মুখ দিয়ে পড়ে থাকি, যেন মায়ের স্তন। আমার বাবা-মায়ের যাবতীয় সংঘাত পারস্পরিক অভিসম্পাতের রাতে আমি বইয়ের ভিতর আশ্রয় পেয়েছিলাম। শব্দ আমাকে ভালোবেসেছিলো। অক্ষর আমার মাথায় হাত রেখেছিলো। বর্ণ আমায় স্নেহ চুম্বন দিয়েছিলো। কোনো ছলনা ছিলো না এই আশ্রয়ে। তাই অচিরেই লেখাপড়ায় আমি অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছিলাম। স্কুলে ফার্স্ট হওয়ার জন্য আইনস্টাইন হতে হয় না। অসম্ভব মেধারও হয়তো প্রয়োজন হয় না। কিন্তু স্কুলজীবনে আজীবন ফার্স্টগার্লের শিরোপা বা অভিসম্পাত মাথা পেতে নেয়ার জন্য যে অপারগতা দরকার, তা আমার ছিলো। আমি নিরাশ্রয় ছিলাম। আমার আত্মপরিচয়ের দরকার ছিলো।

তখন ক্লাস ওয়ান। বাক্য রচনা করতে দেয়া হলো `কঠিন` শব্দ দিয়ে। আমি লিখলাম, ‘কোনো কাজকেই কঠিন মনে করা উচিত নয়।’ কিন্তু ওই বয়সে একথা আমি জানলাম কী করে, সে কথা ভেবে এখনো আশ্চর্য হই। সত্যিই তো, যার যতখানি অতিক্রম করার যোগ্যতা, ঈশ্বর তার সামনে তার মতো করেই একটি অঙ্ক দেন। ওটাকে সলভ্ করা গেলে আবার একটু কঠিন। হ্যাঁ এইভাবে। আসলে তো এই অঙ্ক বা রিডিল তুমি নিজেকেই নিজে থ্রো করো। আর তোমার ভেতরের ঈশ্বর তোমার কাণ্ড দেখে হাসে। কঠিন কেবল তোমার ভিতরের ওই অসহায় রকমের অন্ধকারকে অতিক্রম করা, যা তোমাকে ক্রমাগত নিচের দিকে টেনে নামাতে চায়। কঠিন ওই মাধ্যাকর্ষণের ওপরে ওঠা। কে যেন আমার মাকে ডেকে বলেছিলো ওই শিশুকালে, ‘কাকিমা কাকিমা শ্রেয়ার না খুব অহংকার।’ পাঁচ বছর বয়সে সে অহংকারের কী মানে বুঝতো ছাই। কিন্তু ওকথা নিশ্চয়ই ওকে কেউ বলেছিলো। ফার্স্ট গার্লের অনেক জ্বালা। সারাক্ষণ তার অন্যের নিক্তিতে ওজনদরে মাপামাপি চলতো। ওই যে বললাম সিস্টেম! বড়বেশি তাৎক্ষণিক এইসব বিচার চলতেই থাকে, সবাই সবার সম্পর্কেই কতই না কথা বলে, বলতে থাকে। তবে চুপচাপ ছিলাম বৈকি, আত্মমগ্ন মানুষ ছিলাম, এখনো আছি। কমফোর্ট জোন না পেলে নিজেকে খুলি না।

আমার প্রথম প্রিয় বন্ধুর নাম ছিলো বৃষ্টি। উফ, কী যে একখানা দাবি ছিলো, একখানা প্রিয় বন্ধু থাকতেই হবে, ভালোবাসাবাসি হবে। বৃষ্টি এলো আমাদের বাড়ি। পায়ে পায়ে দড়ি বেঁধে লেগ রেস খেলা হলো। সে কী সখ্য! আমিও যাই বৃষ্টিদের বাড়ি। বৃষ্টি তার শোকেস থেকে সব পুতুল নামিয়ে ফেলে নিমেষে। বৃষ্টির বাবা-মাও আমাকে খুব ভালোবাসে। সরল বন্ধুত্বের আবেশে আমরা বড় হতে থাকি। বড় হতে হতে আমরা ভুলে যাই বড় হওয়ার মানে আসলে আত্মবিস্মৃতি, নিজেকেই ভুলতে থাকা, নিজের যাবতীয় কোমলতা আর নরম আবেগ থেকে সরে এসে ধীরে ধীরে স্মার্ট হওয়া, সামাজিক হওয়া, সামাজিক পাখি পড়ানোয় অভ্যস্ত হওয়া, তারপর একদিন অচিরেই ভুলে যাওয়া বৃষ্টির জলে কাগজের নৌকো ভাসানোর সেই অহেতুক আদিখ্যেতাগুলো।

মা আমাকে মাঝে মধ্যেই ট্রেনে করে বাসে চাপিয়ে নিয়ে যেতো জেঠুদের বাড়ি। জেঠিমারা সকলেই খুব পতিব্রতা ছিলেন। কিন্তু আমার কাছে এই সকল যোগাযোগ বড় বেশি অন্তঃসারশূন্য মনে হতো। রক্তের সম্পর্ক রক্তের যোগাযোগ এইসব স্থূল মাত্রায় জীবনের কোন্ নির্ণয়ে পৌঁছনো যায়, শেষ অবধি তা নিয়ে আমার বেশ সন্দেহ ছিলো ওই বয়সেই। জেঠিমারা জ্যাঠতুতো দাদাদিদির দল অযথাই আমাদের দূরে থাকা জীবন নিয়ে কাটাছেঁড়া করতে বসতো। কী প্রয়োজন ছিলো তাদের এই অধিকার দেয়ার? কারো কোন অধিকার আছে অন্যের জীবন নিয়ে অযথা জাজমেন্টাল হওয়ার? মানুষ নিজেই নিজের ঘাড়ে সেই দায় নিয়েছে যেন সকল দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। তারপর যা বুঝেছি, আসলে এই মেয়েরা যারা অযথাই অমুকে অমুক কেন করলো তমুকের তমুক করা উচিত ছিলো বলে অন্তঃপুর গরম করে তোলে— তারা সকলেই আসলে ভোক্তা। তারা কোনও না কোনও শাসকের দ্বারা পরিচালিত। যার নাম স্বামী। যিনিই আসলে সম্পত্তির মালিক ধারক বাহক দাতা ত্রাতা এবং পরিত্রাতা। তাই একজন ভোক্তা আসলে কখনোই অন্য আরেক ভোক্তার সামান্য উত্থান কিংবা নড়াচড়া ভালোভাবে নিতে পারে না। আসলে যে অন্ধকারে থাকে সে চায় না তো কেউ আলোকিত হোক। এই অন্ধকার আমাদের সামাজিক উত্তরাধিকার। এই অশিক্ষা প্রতিটি কোলোনাইজড এবং সাবাল্টেরনের রক্তগত সম্পদ।

তাই কারো কাছে নিজেকে জাস্টিফাই করতে যাওয়া নেহাতই অপ্রয়োজনীয়। অন্তত আমি তো তা করি না। আর রক্ত মানুষকে কোনদিকে কিভাবে টানে তার প্রবাহকে আমি আজ অবধি সনাক্ত করতে পারিনি। যেখানে আত্মার কোনও টান নেই, যে সম্পর্ক আত্মগত নয়। সেখানে শুধু রক্তের সম্পর্ক আমার কাছে কোনও আবেদনই রাখে না। বরং আমি সে সকল সম্পর্কের কাছে মাথা নত করি, যে হঠাৎ অনন্তের রহস্য নিয়ে নিজেকে উন্মোচিত করে, যে কোথাও ছিলো না অথচ তোমার ভেতরের অনেকটা অংশ তার, যে তোমার সাথে তোমার ঈশ্বরের পরিচয় ঘটায়, একা হতে দেয় না, মাথা নত করতে দেয় না, জীবনভর যে তোমার মেরুদণ্ড হয়ে থাকে।

যখনই এই অন্তহীন কাঁটাছেড়ায় একা হয়ে পড়তাম, কোথা থেকে দেখতাম বাবুই এসে হাজির। সে তার রাজদূতে চাপিয়ে আমাকে বেড়াতে নিয়ে যেত দূর দূর। হাওয়ার সমুদ্রে চাঙড় চাঙড় ভাবনার হাওয়া বেয়ে আমরা এগিয়ে যেতাম। রাজদূত নয়, যেন রথ আর বাবুই হলো অশ্বারোহী। সেই দুরন্ত পথ পেরনোর ফাঁকে ফাঁকে আমি দেখতাম সবুজ মাঠ, ঘন সবুজ অরণ্য, আবহমান সন্ধ্যা আর প্রাণভরে ঈশ্বরের গন্ধ নিতাম।

চলবে

 

লেখক: কবি, পশ্চিমবঙ্গ