ভূত বিলাসের ঘর

আত্মজীবনী ৯

শ্রেয়া চক্রবর্তী

প্রকাশিত : জুন ১৭, ২০১৮

আমি তখন ক্লাস থ্রি। স্কুলে যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছি। একটা মেঘলা সকাল। হঠাৎ খবর এলো, দাদাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। একটা নামকরা মিশনারি ও রেসিডেন্সিয়াল স্কুলের ক্লাস ফাইভের ছাত্র তখন ও। সেবছরই চান্স পেয়েছে। কিছুদিন আগেই সামার ভ্যাকেশনে বাড়িতে এসেছিল। দুচারদিন আমাদের বাড়িতেও ছিল। আমার সমস্ত কাজিন-ব্রাদার্সদের মধ্যে সবচেয়ে প্রিয় ছিল। দুপুরবেলা স্নান সেরে প্রার্থনায় বসতো। বলতো, ওখানে যা শিখিয়েছে তা বাড়িতেও মেইনটেইন করতে হবে। আমাকেও ওর পাশে বসাতো। তারপর হাতজোড় করে চোখ বন্ধ করে গাইতো, খণ্ডন ভগবন্ধন জগবন্দন বন্দি তোমায়/নিরঞ্জন নররূপধর নির্গুণ গুণময়। ছুটি ফুরোতে ফিরে গেল স্কুলে।

সেদিন এমন খবর পেয়ে বাড়ির সবার মাথায় যেন বাজ ভেঙে পড়লো। ওর বাবা-মা তখনই রওনা দিলেন স্কুলের উদ্দেশে। সাথে বাবুই, যে আমার পরিবারের সকল বিপদে-আপদে সকল ওঠাপড়ায় আমাদের সাথে ছিল, আর আমার মামা। যদিও তিনি প্রবাসী তবে সেসময় এখানে ছিলেন। সারাস্কুল তন্নতন্ন করে খুঁজেও কোথাও ওকে পাওয়া গেল না। সবাই যখন উৎকণ্ঠায় দুশ্চিন্তায় ভেঙে পড়েছে সেসময় হঠাৎ স্কুলের রেসিডেন্সিয়াল বিল্ডিংয়ের পিছনে একটি পরিত্যক্ত ডোবায় ভেসে উঠলো দশ বছর বয়সী সেই বালকের ফুলে ফেঁপে ওঠা মৃতদেহ।

ঠিক সেইদিন সেই মুহূর্তে সহসাই ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেছিলো একটি সংসার, এক মা-বাবা, যারা হয়তো আগের দিন রাতেও `বাবু এখন নিশ্চয়ই ঘুমিয়ে পড়েছে, সকাল সকাল উঠতে হবে তো` এই মনে করে ঘুমাতে গিয়েছিলেন।

পুলিশকেস হলো। কিন্তু একটি স্বনামধন্য প্রায় মিথে পরিণত হওয়া মিশনারি স্কুলের সাথে লড়াইয়ে যাওয়াটা বড় কঠিন ছিল সেই মা বাবার জন্য, যারা সদ্য নিজের সন্তানকে হারিয়েছেন। কোনো এভিডেন্স মিললো না। রাতারাতি ওর দুজন রুমমেটকে শুধু স্কুল থেকে নয় তল্লাট থেকে সরিয়ে দেয়া হলো। স্কুল অথরিটি একটি চিঠি প্রোডিউস করলো, যা নাকি সুইসাইড নোট, যাতে আমার দশ বছরের ভাইয়ের নাম করে লেখা ছিল, ‘আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়।’ একটা দশ বছরের ছেলে যে কয়েকদিন আগেই স্কুল খোলার আনন্দে ফিরে গেছিলো, সে হঠাৎ সুইসাইড করবে কেন? হ্যান্ডরাইটিং এক্সপার্টের মতে, ওই হ্যান্ডরাইটিং ওর ছিল না। তবু সাক্ষ্য-প্রমাণ তদবিরের অভাবে কেসটা ধামাচাপা পড়ে গেল।

কেসটা পিছিয়ে পড়ার আরো এক কারণ ছিল। আমার মামা। যার নিজের ছেলে কিনা সেসময় অন্য এক মিশনারি স্কুলের ছাত্র ছিল। তিনি অনুরোধ করেছিলেন যাতে এটা নিয়ে বেশি জলঘোলা না করা হয়, তাতে তার ছেলের ওপরেও নাকি নেমে আসতে পারে প্রাতিষ্ঠানিক অভিসম্পাত। আর তাছাড়া, যে চলে গেছে মামলা করে তো তাকে আর ফিরিয়ে আনা যাবে না।

আমরা যারা সত্যান্বেষী, সমুদ্রের ওপরে ভেসে থাকা আইসবার্গের ওপরের দিকটা দেখেই আমরা যারা সব বুঝে যাই, একটু নেড়েচেড়ে তারপর এই ভেবে ঘুম দেই যে, ‘ধুর আমার কি! আমার ঘরটা ঠিক থাকলেই হলো।’ তাদের ঔদাসীন্যে একটা দশ বছরে শেষ হয়ে যাওয়া জীবন আর তার বাবা মার রাইট টু জাসটিস চিরদিনের মতো হেরে গেছিলো একটা ঠুনকো প্রাতিষ্ঠানিক ঐতিহ্যের সামনে।

অ্যান্ড হি লেফ্ট আস ফর এভার অ্যান্ড এভার।

তখন অনেক ছোট ছিলাম। চোখের সামনে দেখলাম একটা হাসিখুশি মা কিভাবে বুক ফাটা কান্না কাঁদতে কাঁদতে অন্ধকারের নিচে তলিয়ে যেতে থাকলো। ছেলেটির বাবা কথা কমই বলতেন। তিনি পুরোপুরি মৌন হয়ে গেলেন। তাদের আরেক ছেলে, সে আরো ছোট তখন, তার শৈশবও এলোমেলো হয়ে যেতে থাকলো পরিবারের ওপর নেমে আসা এই অপ্রত্যাশিত ঝড়ে। সেদিন কে যেন তছনছ হয়ে যেতে থাকা সন্তানহারা সেই মাকে ডেকে বলেছিল, ‘কাঁদিস ক্যান? তুই তো ভাগ্যবান। তোর ছেলে ভগবানের স্থানে গিয়া মরছে।’

মানুষের জীবনে কষ্ট আসে, বেদনা তাকে ফালাফালা করে, কোথা থেকে কখন কিভাবে সে ঝড় আসবে কেউ তা জানে না। কিন্তু এ সত্য। কষ্ট আসে, তাকে টেনে নামায় অন্ধকারে অতলে। তোমরা যারা মানসিক ডিপ্রেশনে ভোগা মানুষদের ঠাট্টার যোগ্য মনে করো, তাদের বলি, মানসিক অসুখ শারীরিক অসুখের মতোই স্বাভাবিক ও সত্য। তোমার হাত ভাঙলে পেটের রোগ হলে শ্বাসকষ্ট হলে যেমন ডাক্তারের কাছে যাও, তেমনি মনের মধ্যে বেদনার ভারি পাথর বয়ে বেড়াতে বেড়াতে যখন ক্লান্ত হয়ে পড়ো নিজেকে সে অন্ধকার থেকে টেনে হিচড়ে বের করে আনতে না পেরে যখন কেবল অন্যকে আক্রমণ করো তখন সে আঘাত আসলে তোমার নিজের প্রতিই তো হয়। তখন কারো সাহায্য নেয়াটা খুব দরকার। এতে মুখ লোকানোর কিছু নেই। এ নিয়ে অন্যকে ঠাট্টা করার কিছু নেই গো। তুমি তো জানো না তার পথটা, হাঁটোনি সে পথে।

ছেলেটির মাকেও যেতে হয়েছিল। তিনি ডিপ ডিপ্রেশনে ছিলেন। দিনের পর দিন বিছানা থেকে উঠতেননা, স্নান করতেন না, খেতেন না। হ্যালিউশিনেশনে ভুগতেন। খালি তার মনে হতো, ওই বুঝি বাবু আসছে। মাঝে মাঝে হঠাৎ সকালবেলা আমাদের বাড়িতে এসে ধপ করে রান্নাঘরের সামনেটায় বসে পড়ে আমার দিদিমাকে বলতেন, ‘মা লুচি ভাজো। বাবু খাবে। বাবু আসছে।’ দীর্ঘ দীর্ঘতর দিন তার মনে এ বিশ্বাস ছিল যে, বাবু ঠিক ফিরে আসবে। ভুল জেনেও সেই বিশ্বাসকে আঁকড়ে থাকতে চাইতো সন্তানহারা মায়ের মন।

কী করে তাকে শান্ত করবো তার পরিভাষা আমাদের জানা ছিল না। ছেলেটির বাবা কোনোভাবে নিজেকে সামলেছিলেন। আমাদের সংসারে পুরুষমানুষদের নিজেদের শক্ত রাখাই দস্তুর, ভেঙে পড়া তো তাদের অভিধানে নেই। কিন্তু নীরবে যে সহ্য করে সে কষ্ট পায় অনেক বেশি। আর আমার ছোট ভাই, তার শৈশব বনে বাদাড়ে ঘুরে ঘুরে একজন সদ্য সন্তান হারা মা বাবার অসহ বেদনা আর আর্তনাদের ঝংকারে যে অনেকটাই ড্যামেজ হয়ে গেছিলো তা অনুভব করতে অন্তত আজ আমার কোনো অস্পষ্টতা নেই।

নাতিকে হারানোর বেদনা সহ্য করতে না পেরে বছর ঘুরতে না ঘুরতেই আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন আমার দাদু, মায়ের বাবা, যার ছায়ায় আমি বড় হচ্ছিলাম, যাকে আমি বুড়োবাবা বলে ডাকতাম। ছেলেটির মাকে সাইক্রিয়াট্রিস্ট দেখানো হয়। দীর্ঘ চিকিৎসার পর তিনি সুস্থ হয়ে ওঠেন। নিজের জীবনের টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়া অংশগুলো আস্তে আস্তে জুড়ে নিয়ে তিনি আবার উঠে দাঁড়ান। হয় তো আরেক সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়েই তিনি তা করতে পেরেছিলেন। এখন তারা ভালো আছে। বুকের ভেতর কোথাও ওই দশ বছরের খসে যাওয়া পাজরের বেদনা কি আর নেই? আছে বৈকি। সময় সময় বুক মুচড়ে তোলপাড় করে ফুঁপিয়ে ওঠা কান্নাও যে আছে। আবার তার ওপর উঠে দাঁড়ানোও আছে। আজ ভাইটি বড় হয়েছে। সে জীবনে সফল হয়েছে। সুখী হয়েছে। তাদের জন্য তাদের কথা ভেবে আমি খুশি।

এ জীবন, জেনো, একটা উদ্ধত ঘোড়ার মতো। সে ঘোড়ার লাগাম তোমারই হাতে। সময় সময় সে ঘোড়া তোমাকে ছোটাবে। সময় সময় তুমি তাকে। জীবনে অনেক অপ্রত্যাশিত চ্যালেঞ্জ এসে পড়বে। সেদিন তুমি জেনো, ওগুলো তোমার পথে এসে পড়া এক একটা বাম্পারের মতো। তুমি সেখানে থেমে যেতে পারো। আবার টপকেও যেতে পারো। যদি পারো তাহলে জানবে জীবন তোমাকে দুহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরবে।

সেদিনের সেই ভেঙে পড়া পরিবার যদি থেমে যেতো, যদি সেই অসহ বেদনার এক একটা অভিঘাত পার করে আসার মতো সামর্থ্য না রাখতো, তাহলে আজ সেই দ্বিতীয় সন্তানের হাসিবিজড়িত গৌরবোজ্জ্বল দিনগুলি হয়তো কোনোদিন সত্য হতো না।

ভোরবেলা হঠাৎ মায়ের কান্নার শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। তারপর শুনলাম, ফোন এসেছিল। মামাকে নাকি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তড়িঘড়ি মা মেসো ট্রেনের টিকিট কেটে ছুটলো। আগের দিন সন্ধ্যাবেলা নাকি তিনি `একটু আসছি` বলে বেরিয়ে গেছিলেন। তারপর আর ফেরেননি। ভোরবেলা হঠাৎ হাইওয়ের ধারে খালের মধ্যে উলটে পড়ে থাকা তার মৃতদেহ পাওয়া গেল। কিন্তু কি করে এই ঘটনা ঘটলো, কেনই বা ভরসন্ধ্যায় কুয়াশার ভেতর তিনি তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে গেলেন, কেন হলো এই রহস্য মৃত্যু, আসল ঘটনা কি ছিলো তার কোনো তদন্ত হলো না। কারণ তার নিকট আত্মীয়রা তা চায়নি। আর ওসব জেনেই বা কি হবে? সে চলে গেছে সেকি আর ফিরবে!

সেই মামা, যিনি আমার ভাইয়ের মৃত্যু রহস্য উদঘাটনে বাধ সেধেছিলেন নিজ পুত্রের কথা ভেবে, কি অদ্ভুত আয়রনি, তারও সেই জলে ডুবে মৃত্যু হলো আর সে মৃত্যু এক রহস্যের মোড়কে থেকে গেল। জীবনটা এমনই। যা তুমি আজ বুঝে বা না বুঝে অন্যের দিকে ছুঁড়ে দিচ্ছো তাই একদিন তোমার জীবনেও ফিরে আসবে একই অভিঘাতে। হয়তো কেউ তা জানবে না, কিন্তু তুমি টের পাবে হাড়ে হাড়ে। তাই আমরা যারা কিছু না জেনে বুঝে আজ অন্যের সমালোচনায় ব্যস্ত, সহানুভূতির নাম করে মজা নেয়াটাই উদ্দেশ্য, আমরা যারা কাউকে কোথাও পৌঁছে দেবো কথা দিয়ে মাঝরাস্তায় হাত ছেড়ে দিয়ে চলে এলাম, আমরা যারা `ভালোবাসি` বলে কারো বিশ্বাসের সুযোগ নিলাম, আমরা যারা একজন মানুষ আসলে কি বলতে চেয়েছিল না বুঝেই ছিদ্রাণ্বেষীর মতো তার একটা দুটো শব্দ বা বাক্যকে নিয়ে তাকে তীব্র আক্রমণ আর ভর্ৎসনায় ধ্বংস করার জন্য উদ্ধত হয়ে উঠলাম, কাউকে অশিক্ষিত অসফল প্রমাণ করার উন্মাদনায় আসলে নিজেরই পরতে পরতে জমে থাকা অন্ধকার আর অশিক্ষাকে প্রকাশ করলাম, আমরা যারা অসহিষ্ণু হয়ে কাউকে মিথ্যেবাদী প্রমাণ করার জন্য যেমন তেমন ভাষায় আক্রমণ করলাম, তাদের মনে রাখা উচিত, এই সমস্ত অভিসম্পাত ধিক্কার কুৎসা বর্বরতা আঘাত আক্রমণ আর বিশ্বাসঘাতকতা একদিন আমাদের জীবনেও রূঢ় বাস্তব হয়ে ফিরে আসতে পারে। মানুষকে ততটাই আঘাত দেয়ার ঔদ্ধত্য রেখো যতটা নেয়ার মতো শক্তি তোমার নিজের আছে।

মিথ তোমরাই তৈরি করো। আবার মিথ তোমরাই ভাঙো। যারা সেদিন একজনকে কতই না সম্মান দিয়ে মাথায় তুলেছিলে, আজ তারাই তাকে হিড়হিড় করে টেনে নামাতে চাও। কিন্তু সে ভগবান কিংবা শয়তান এর কোনোটাই নয়। সে সাধারণ মানুষ। রোজ একধাপ করে সিঁড়ি উঠতে চায়। এ সিঁড়ি ফার্স্ট গার্লের সিঁড়ি নয়। নম্বর পাওয়ার নয়। তোমরা যাকে তথাকথিত শিক্ষিত হয়ে ওঠা বলো তারও নয়। ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার কিংবা সরকারি চাকুরে হওয়ার সিঁড়ি নয়। একজন অনুভবি মানুষ হয়ে ওঠার সিঁড়ি। তাই তার প্রতিটি ধাপকে আগে জানো।

তোমরা যখন তোমাদের বাবার কোলে চড়ে মেলা দেখতে যেতে, ছোট্টটি ছিলে, সে বয়সে আমি গুম হয়ে থেকে কেবলই ভাবতাম, মানুষের করুণা লাগে যে জীবনে তার ওপরে কিভাবে ওঠা যায়। স্কুলের মায়েরা গাছতলায় বসে আলোচনা করতো আমার মায়ের কথা। বাড়ির ডাক্তার বাবু রোগ দেখতে এসে বলে যেত, ‘সত্যি, তোর মা যা করছে- মহিয়সী।’ আমার এসব শুনতে ভালো লাগতো না। আমার এটাই মনে হতো, আমার মা শুধু তার কর্তব্যটুকু পালন করছেন। যেটা তার স্বাভাবিকভাবে করার কথা। এরজন্য তাকে মহিয়সী কেন বলা হবে? এরজন্য করুণা করে কেউ আমার গাল টিপে দেবে? আতুপুতু করবে? কেন? তাকে আমি মহিয়সী ভাবিনি ভাগ্যিস। তাই দিনশেষে একজন রক্তমাংসের মানুষকে কেবল মানুষ ভেবেই কিংবা তার ভুলে ভরা জীবনকে গ্রহণ করতে আমার কোনো অসুবিধা হয় না।

স্বাভাবিক ছিলেন না আমার বাবা। তিনি আমাদের সাথে থেকেও আমার প্রতি কোনোদিন স্নেহশীল ছিলেন না। তার এই কঠোরতায় আঘাত পেলেও কোনোদিন সে কথা কাউকে বলিনি। কোনোদিন তার ওপর আমার যে ভীষণ রাগ হয়েছে, তাও নয়। কারণ কোনো প্রত্যাশা ছিল না। আমাদের সবার ভেতরেই একটা শিশু লুকিয়ে আছে। সেই শিশুটা যাকে হয়তো মা বকেছে খুব, বাবা বেলুন কিনে দেয়নি, স্কুলে দিদিমণি স্কেলের বাড়ি মেরে বইটা কেড়ে নিয়েছে, বন্ধুর সাথে আড়ি হয়ে গেছে তারপর সে কেঁদে কেঁদে গাল ফুলিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে কখন যেন। যে শিশুটা কেবল আদর চায়। তাকে ঘুম থেকে তুলো। ভালোবেসো তাকে। তাকে বোলো তার শিশুমনে জড়িয়ে থাকা সমস্ত কষ্টের স্বপ্নগুলো একদিন তুমি ঠিক মুছে দেবে।

যে ছেলেটা খেলার মাঠে আসতো রোজ তারপর একদিন আসা বন্ধ করে দিলো, যে ভীষণ ভালো গান গাইতো কিন্তু কেন গানের স্কুল ছেড়ে দিলো, কেউ জানে না। যে খুব ভালো মাউথ অর্গান বাজাতো কিন্তু বাবা যেদিন রাগ করে অর্গানটা ভেঙে দিলো তারপর আর কোনোদিন ছুঁয়ে দেখা হয়নি, পাড়ার যে মেয়েটা সবচেয়ে সুন্দরী ছিল কিন্তু সংসার হলো না, মাঝরাতে বাচ্চাকে শুইয়ে রেখে পরপুরুষের হাত ধরে চলে গেল যে মেয়েটা, যে একদিন ভীষণ ভালোবাসতো তারপর কেন জানি না মুখ ফিরিয়ে নিলো, যে একদিন ক্লাসে ফার্স্ট হতো তারপর তোমরা আর তাকে খুঁজে পেলে না তোমাদের দৃষ্টির সীমাবদ্ধ পরিধির মধ্যে, তাদের সবার একটা গল্প আছে। প্রত্যেক মানুষের মধ্যেই একটা ভেঙে যাওয়া অংশ আছে, যেটা সে যথাসম্ভব আড়াল করে এগিয়ে চলেছে যেন কিচ্ছুটি হয়নি। সেটা বোঝার মতো অনুভবি মনটুকু না থাকলে তোমার সব আস্ফালনই বড় মিথ্যে।

আমার জীবনের নকশা সে আমি নিজেই বানিয়েছি। একজন চিত্রকর যেভাবে ছবি আঁকেন ক্যানভাসে, হাজার বার মুছে রঙের ওপর রঙ ঢেলে অজস্র এলোমেলো স্ট্রোকে একটা ছবি তুলে ধরতে চেয়েছি মাত্র। সফল হই বিফল হই আমার রঙ আমার তুলি আমাকেই নির্বাচন করতে হয়েছে। ভুল করলেও সেকথা বলে দেয়ার কেউ ছিলো না যে। তাই আমি হেরে যেতে ভয় পাই না গো। হেরে যেতে ভয় পায় সে মানুষ যে নিজের ভেতর বহু আগে থেকেই হেরে বসে আছে। আমি শুধু জিতে যাওয়ার যে সংজ্ঞায় মানুষ পাখি পড়ার মতো অভ্যস্ত হয়ে আছে তার বাইরে একটি নিজস্ব অর্থবহ অভিধান তৈরি করেছি।

আর হ্যাঁ, শব্দকে আমি ভীষণ গুরুত্ব দেই। এ পৃথিবীতে যখন তুমি আসো, তখন সে শব্দের মধ্যে দিয়েই এই ব্রহ্মাণ্ডের সাথে তোমার সেতুবন্ধন হয়। তারপর একটু একটু করে কথা বলতে শেখো। তাই যাই বলো না কেন তার সত্যতা জানো তুমি আর তোমার ব্রহ্মাণ্ড। শব্দ ব্রহ্ম। তাকে জেনে বুঝে খরচ কোরো।

চলবে